বাঁক (5 ১৪ পর্ব )
____________
( পড়লে পেইজ ভিজিট করে প্রথম থেকে পড়ুন, মাঝখান থেকে শুরু করবেন না)
৫
মৃদুল ঠিক করেছে আর কোনোদিন রাতে মানহার সঙ্গে থাকবে না। এর অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সেদিন ফজরের আগেই তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো,
– ‘মৃদুল এখন তুমি চলে যাও। ভোরে কেউ এক সঙ্গে দেখলে সন্দেহ করবে।’
সে বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘কিন্তু আমি এখন ইদ্রিস ম্যানসনে গেলে তো ওরা জিজ্ঞেস করবে রাতে কোথায় ছিলাম।’
মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘যুবতী একটা মেয়ের সঙ্গে রাত কাটানোর বুদ্ধি ঠিকই আছে, আর ওইখানে গিয়ে কী বলবে এই সামান্য বুদ্ধিটা নাই?’
– ‘মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে আজেবাজে কথা বলা শুরু করছো কেন? আমি তো থাকতে চাইছিলাম না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাও।’
– ‘কিন্তু আমি এখন গেলে ওদের কী বলবো?’
– ‘তুমি এখন ইদ্রিস ম্যানসনে না গিয়ে কোথাও গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাও। তারপর সেখানে ঠিক সতটায় যাবে। কেউ তখন কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে এক বন্ধুর বাসায় চলে গিয়েছিলে। ভোরে ফিরেছো চেম্বারে যাবার জন্য। ওরা এরচেয়ে বেশি কিছু আর জিজ্ঞেস করবে না।’
– ‘কিন্তু এতক্ষণ আমি কী করবো?’
– ‘তাহলে কী বর-কনের মতো ভোরে একসঙ্গে ঘুম থেকে উঠে গ্লাস খুলে লোক ডেকে দেখাবো?’
মৃদুল কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ উঠে গেঞ্জি পরে নিল।
– ‘আজ চেম্বারে দেরি করে আসতে পারো সমস্যা নেই।’
– ‘আচ্ছা।’
তারপর আলগোছে গ্লাস খুলে তাকে বাইরে বের করে দিয়েছিল মানহা। কয়েকটা ঘণ্টা তার হাওরে গিয়ে বসে থেকে কাটাতে হয়েছে। কী যে বিরক্তিকর মুহূর্ত ছিল। তখনই ঠিক করেছে মানহা যাইই বলুক আর কখনও রাতে থাকবে না সে।
এখন ভোর সাতটা। চেম্বারে যাবার সময় হয়ে গেছে। ওখানে গিয়েই গোসল আর নাশতা করবে। ব্রাশ, গামছা মানহার ওখানেই থাকে। কয়েকদিন থেকে এরকমই চলছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এখনও তার সবকিছু বলা হয়নি মানহাকে। ওর সঙ্গে মিশতে গেলে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যাচ্ছে। আবার এড়িয়ে চলতে গিয়ে কম কথা বলতে হচ্ছে৷ এরকম করে ক’দিন থেকে কিছুই বলা হয়ে উঠেনি। আজ ওই সহকারী ছেলেটি আসার আগে নাশতায় কথাগুলো তুলবে ভেবে রেখেছে। নিজ থেকে না বললে মানহা গুরুত্ব দেবে না৷ তার এখন সবকিছুতে প্রেম প্রেম ভাব। এসব জটিল কাজে মনযোগ নেই।
মানহা গোসল শেষে বের হয়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে নিজেকে তাচ্ছিল্য করে মুচকি হাসে। আজকাল এতটাই আনমনা হয়ে গেছে যে গানটা বন্ধ করে বাথরুমে যায়নি। মোবাইলে এখনও মৃদু সুরে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে,
“এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার”
মানহা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেলকনির দড়িতে মাথার ভেজা টাওয়াল রেখে আসে। ভাবছে আজ কামিজ পরবে না-কি শাড়ি? কামিজের ওপর দিয়ে এপ্রোন পরে কাজ করতে সুবিধা। তবুও শাড়ি পরতে ইচ্ছা করছে। মৃদুলকে যদি জিজ্ঞেস করে আমাকে শাড়িতে না-কি কামিজে তোমার ভালো লাগে? জবাবে কী বলবে? অবশ্য এসব ব্যাপারে সে উদাসীন। মৃদুল কী খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখছে না? এটা কেন করছে? একজন মেয়ে হয়ে সে এতো প্রশ্রয় দিচ্ছে। নিজেকে মেলে ধরছে তার কাছে, তবুও মৃদুল উদাসীন কেন? পুরুষ মানুষ তো এরকম না। অন্তত সমাজে চলতে গিয়ে পুরুষ সম্পর্কে তো তার অল্প-বিস্তর অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন পুরুষ তাকে এড়িয়ে চলার কোনো যুক্তি নেই। উলটো নিজের অবস্থান থেকে মৃদুলকে জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বপ্ন দেখা অযুক্তিক৷ তবুও মানহা চায়, কারণ জীবন নিয়ে অন্য সকলের মতো তার উচ্চাকাঙ্খা নেই, মনের শান্তি নষ্ট করে প্রতিযোগিতা নেই, লোক দেখানোর জন্য স্মার্ট প্রতিষ্ঠিত বরও কামনা করে না। তার লক্ষ্য হচ্ছে জীবনটা উপভোগ করা। মনের শান্তিকে প্রাধান্য দেয়া। মৃদুলকে বিয়ে করবে। ছোট্ট সংসার হবে, দরকার হয় বাচ্চাও নেবে না। দু’জন চেম্বার চালাবে। হুট করে কিছুদিন পর পর কোথাও বেড়াতে চলে যাবে। পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর জীবন।
ছোটবেলা থেকে ছন্নছাড়া ছেলেদের জীবন মানহার খুব পছন্দ। তারা কেরিয়ার -ফেরিয়ার নিয়ে ভাবে না। যেদিকে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায়। খা খা রোদে হাঁটবে, দিনে-দুপুরে মোড়ের চা’র দোকানে আড্ডা দেবে, বন্ধুর বাড়িতে যাবে, রাতে শুকনো মুখে দেরি করে ফিরবে। যেন দিনকাল মহা ব্যস্ততায় যাচ্ছে। এই জীবনটা মানহাকে বড়ো টানে। এর জন্য মৃদুলকে জীবনসঙ্গী দরকার।
অন্তত ছোটবেলায় মৃদুলের সঙ্গে খেলাধূলা করায় বড়ো হয়ে তাইই মনে হচ্ছে।
তবে আরেকটা জিনিস তার চাই। বরের প্রচণ্ড ভালোবাসা। সকল পাগলামি সহ্য করেও বর তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসবে৷ জীবনে এই বস্তুর বড়ো অভাব মানহার, তাই ভালোবাসার বড্ড কাঙাল সে। কিন্তু মৃদুলের কাছ থেকে তা পাচ্ছে না। সে এমন করছে কেন? সেদিন পুরো রাত কাটিয়ে গেল একবারও ভালো করে তাকায়নি, বুকে টেনে নেয়নি, যাবার সময় অন্তত জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে যেতে পারতো না? আচ্ছা সেদিনের পর থেকেও বা কেন কেবল বাহ্যিক সৌজন্যেতা পালন করে চলছে? চেম্বারের কাজ শেষেও সহকারী ছেলেটির সঙ্গে বিদায় নিয়ে চলে যায়। মানহাও অভিমান করে এখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সবকিছু কেবল সংগোপনে পরখ করে যাচ্ছে। কিছুদিন থেকে রাতে মানহা এখানেই থাকে। এর অবশ্য কারণ আছে। সমস্যা হচ্ছে মৃদুল এখানে জয়েন করার আগেরদিন ওর মামীর সঙ্গে ঝাগড়া হয়। রোজ চেম্বার থেকে ফিরে দেখে মামাতো ভাই-বোনরা ওর রুমে ঢুকে সবকিছু এলোমেলো করে চলে যায়। মানহার এমনিতেই শুচিবায়ু। সবকিছু নিয়েই অতিরিক্ত সতর্কতা। এলোমেলো দেখলে মেজাজ ঠিক থাকে না। তাই লতাকে হাতের কাছে পেয়ে গালে চড় বসিয়ে দেয়। এটা নিয়েই মামী শুরু করেছিলেন তুমুল ঝগড়া। তাদের বাড়িতে থাকা নিয়েও খোঁটা দিলেন। মানহা জানিয়েছিল ছোট খালাকে। উনি একটু বেশি রাগী। তবুও ঝামেলার ইতি টানতে চান। রাগে বললেন,
– ‘মানহা তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন? বিয়ে করে এখান থেকে সরলেই হয়। মানুষ নিজের মেয়েকেও বড়ো হলে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে আর তুইতো অন্যের মেয়ে বুঝিস না কেন?’
সে তখন উলটো রাগ করে বললো,
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি সরলেই তো সমাধান? আজ থেকে তোমার বাপের ঘর ছেড়ে চেম্বারেই থাকবো।’
খালা ওপাশে খিলখিল করে হেঁসে বললেন,
– ‘ব্যাটা মানুষের মতো দোকানে থাক।’
মানহা রেগে বললো,
– ‘ওইটা কী দোকান খালা? চেম্বারের সঙ্গে বাসা এটাচ।’
– ‘আচ্ছা ওইটা তোর বাসা, একা ভয় না পেলে থাক আমাদের কী? ওখানে থাকবি খাবি আমরাও তোর বাড়িতে বেড়াতে আসবো।’ বলে আবার হাসতে শুরু করলেন।
– ‘মজা করছো তাই না? আমি আসলেই ওখানে থাকবো।’
– ‘একা ভয় না পেলে থাকবি সমস্যার কী আছে? শুধু ব্যাটা মানুষ আনবি না আরকি।’
– ‘ধুরো তোমার মুখে কিছু আঁটকায় না।’
এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়েছিল সেদিন। আজ মনে হয় আবার কল দিতে হবে। বলবে মামীর সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে দিতে। তার নিজেরও দোষ আছে। বাচ্চারা বুঝে না বলেই সবকিছু এলোমেলো করে। এর জন্য চড় মারা মোটেও ঠিক হয়নি। তাছাড়া দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সে বাড়িতে থাকলে এখানে মৃদুল উঠতে পারবে। ইদ্রিস ম্যানসনে গুদামের মতো ঘরে থাকতে নিশ্চয় মানুষটার কষ্ট হয়। এখানে ভালো থাকবে। শেষপর্যন্ত শাড়ি বাদ দিয়ে ব্যাগ থেকে কামিজ বের করে পরলো মানহা। মৃদুল আসার সময় গেছে, নাশতা বানাতে হবে।
রান্নাঘরে গিয়ে দু’টা আলু প্রথমে সেদ্ধ করতে দেয়। এরিমধ্যে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা, টমেটো কুচি কুচি করে কেটে নিল। আলু সেদ্ধ শেষে গুঁড়ো করে দু’টা ডিম বের করে ফাটিয়ে আলুর সাথে কুচি করা পেঁয়াজ, কাঁচালংকা, নুন, হলুদ দিয়ে ভালো করে মাখায়। এবার চুলোয় ফ্রাইপ্যান বসিয়ে আগুন দিয়ে অল্প তেল দেয়। খানিক পর উপরে কিছু কুচানো পেঁয়াজ, টমেটো ও কাঁচালঙ্কা ছিটিয়ে নিয়ে আচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে মিনিট কয়েক রাখে।
– ‘কী বানাচ্ছ?’
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। মানহা বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বললো,
– ‘নাশতা বানাচ্ছি।’
– ‘আচ্ছা আমাকে একটু পথ দাও বেলকনি থেকে টাওয়েল নেব।’
মানহা সরে দাঁড়ায়। মৃদুল বেলকনি থেকে ফিরে এসে বাথরুমে গোসলে চলে গেল।
মানহার ভীষণ অভিমান হয়। লোকটা এমন করে কেন? একা বাসায় সে রোজ গোসল করে শাড়ি পরে উম্মুক্ত চুলে গ্লাস খোলা রেখে নাশতা বানায়। মৃদুল কী হুট করে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে পারে না? প্রেমিক একটু আক্রমণাত্মক না হলে হয়?
মানহা এগ পটেটো অমলেট কয়েক টুকরো করে কেটে টি-টেবিলে এনে রেখে মোবাইল টিপছে। মৃদুল গোসল করে প্যান্ট পরে খালি গায়ে বাথরুম থেকে বের হয়। মানহা মাথা তুলে তাকিয়ে চোখ সরাতে গিয়েও পারলো না। লোমশ বুকে আঁটকে গেল চোখ।
গৌর বর্ণের পেটানো শরীরে বিন্দু বিন্দু জল। বুক থেকে ছোট ছোট লোম নেমে এসেছে নাভি পর্যন্ত। পেটের বাঁ পাশে কীসের আঁচড়ে যেন খানিকটা লাল হয়ে আছে। নখ দিয়ে চুলকেছে? মৃদুল বেলকনিতে চলে গেল। মানহার বুকটা শিরশির করছে। কী হয় বিয়েটা করে নিলে? এইযে মানুষটা গোসল থেকে বের হয়েছে সে টাওয়েল নিয়ে চুল মুছে দেয়ার ছলে কাছাকাছি যেতে পারতো।
মৃদুল বেলকনির দড়িতে ভেজা গামছা মেলে দেয়। মানহাকে আজ কামিজ পরা হালকা সাজেও ভীষণ মায়াবী লাগছে। কী সুন্দর বসে মোবাইল টিপছিল। যেন কোনো শিল্পীর রঙ তুলিতে এঁকেছে মোবাইল টিপতে থাকা নারীকে। ওর সঙ্গে এখন কথা বলতেও তার ভয় লাগে। একা বাসায় এই রূপবতীর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকা মুশকিল। বারবার ছুটে গিয়ে আঁজলা করে মুখটা ধরে ললাটে চুমু খেতে ইচ্ছা করে। ওর চোখের ব্যাকুল চাহুনির আমন্ত্রণে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভীষণ আদর করে সাড়া দিতে মন চায়। কিন্তু সে কী করবে? তার যে হাত-পা বাঁধা। সে একজন বিবাহিত পুরুষ। আজ কোনোভাবে নাশতা করতে করতে ইশিদের খুঁজে বের করার প্ল্যান করে নিতে হবে। মানহাও কেন যেন এগুলো নিয়ে কথা বলছে না। সে আবার ফিরে এসে গেঞ্জি পরে নিল। বসলো গিয়ে চেয়ার টেনে মানহার সামনে। মানহা নিঃশব্দে তার দিকে বাড়িয়ে দিল প্লেট। মৃদুল ভেবে পায় না ও এতো নীরব হয়ে যাচ্ছে কেন? থাক নীরব, তার নিজের কাজ এগুতে হবে, এক পিস অমলেট হাতে নিয়ে কামড় দিয়ে কথাগুলো বলতে শুরু করবে তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো।
– ‘গ্লাস লাগিয়ে এসেছো না-কি?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আচ্ছা আমি গিয়ে খুলে দিচ্ছি তুমি খাও।’
___ চলবে ___