আমার_হৃদয়ে_সে #রোকসানা_আক্তার পর্ব-১২

0
782

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১২

১৪.
চারিদক শুনশান নিরবতা।বাইরে থেকে ফাঁকে ফাঁকে বাতাস ধেঁয়ে আসে।বাতাসে পর্দাগুলো দুলে ওঠে।জানলা বন্ধ করা হয়নি।জেগে আছি।কাজ করছি ল্যাপটপে।অভির কোম্পানির বিজ্ঞাপনের প্রজেক্টটা নিয়ে বসলাম দুইঘন্টা হলো।এখন ১টা বাজতে চলছে।অভির প্রজেক্টে আসলে কাজ করতাম না।খালামণি যা বললো মনটা তাতেও ওতটা সায় দেয়নি।তবে আঙ্কেল অফিস থেকে ফিরে খালামণির থেকে অভির কোম্পানির প্রজেক্ট পেয়েছি শুনে তিনি খালামণি থেকেও আরো উৎসাহ দিয়েছেন। নাহ কাজটা ছাড়তাম না।কিছুতেই না।করতাম।যেভাবেই হোক করতাম।এখন বলা যায় উনাদের কথার চাপাতলে একপ্রকারে বাধ্য হয়ে করতে বসেছি।তবে কাজটা আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়েই করবো।কাজ শেষে অভির নিরস কথা শুনতে রাজি নই।এক তিল পরিমাণ ভুল হবে তাও নই।সে যেমন সলিত এবং নিঁখুত কর্মা চেয়েছে।ইনশাল্লাহ এরচেয়েও ভালো কিছু উপহার দেবার চেষ্টা করবো।করতে করতে অনেকটা সময় পার হয়।চোখমুখে ক্লান্তি এসে যায়।হাত ব্যথায় নিশপিশ করে।তারপরও রেস্ট নিচ্ছি না।সময় মাত্র চারদিন।এই চারদিনে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা।ক্লান্তিকে কোনো পরোয়া নয়।

চারদিন কেঁটে যায়।কাজটা সম্পূর্ণ হয়।এগোরটার দিকে অভির কোম্পানিতে যাওয়ার কথা।তাদের তাই বলেছি।এখন আঁটটা বাজে।তাই প্রোডাক্টসেরক্যালিগ্রাফি ডিজাইনগুলো আবার চেইক করতেছি কোনো ভুলত্রুটি থেকে গেলো কি না।স্ক্রিন ছোট্ট করি।আবার বড় কি।আঙ্কেল রুমে ঢুকেন।বলেন,

“কাজ কম্প্লিট?”

আঙ্কেলের দিকে তাকাই।হেস জবাব দিই,
“হ্যাঁ।তবে কোম্পানিটির রুচি মতন আমার কাজটা হলো কি না টেনফিল করছি।”
“আরেহ কিছু হবে না।দেখে অভি তোমার প্রোডাক্টস ডিজাইনগুলো দেখে আর খুশি হয়ে যাবে।”
“এত কনফিডেন্স?”
“তোর উপর আমার কনফিডেন্স আছে।তুই পারবি।তোকে দিয়েই পসিবল।”
“বেশি প্রশংসা করা হলো না,আঙ্কেল?”
“প্রশংসা নয়।যা সত্য তাই বলছি।”

আঙ্কেলের কথায় আর তর্কে যাই নি।ইনার সাথে এখন কথা বলেও আর লাভ হবে না।আমি যদি সারাদিন চিল্লাপাল্লা করেও বলি,নাহ আঙ্কেল, কাঁচা হয়েছে!’উনি বলবেন,সুন্দর হয়েছে।”জানি না উনার কোম্পানিতে সিলেক্ট হবার পর আমার প্রতি কেন উনার এমন বিশ্বাসটা জন্মালো।বুঝতে পারছি না।

১৫.

এগোরটার দিকে অভির কোম্পানিতে ঠিক ঠিক এসে পৌঁছায়।এম ডি আমাকে দেখে খুশি হয়ে যান।হাসিমুখে বলেন,

“ম্যাম,প্রজেক্ট কম্প্লিট?”
“জ্বী।”
“থ্যাংক ইউ, ম্যাম।স্যারের অফিসে যেয়ে বসুন।স্যার আপনাকে উনার অফিসে যেতে বলেছে।”

এম ডির কথায় খুব ধাতস্থতা হয়ে যাই।এখন অভির সামনে যেতে হবে।তার মুখোমুখি বসতে হবে।কথা বলতে হবে।ভাবতেই হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠে।গলার পানি শুকিয়ে আসে।চোখের পাতা আতংকে উঠানামা করতে থাকে।

“ম্যাম?যান।”

এম ডির কথায় আমি টনক নড়ে উঠে।নিজেকে বহুকষ্টে সংযত করে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ফুঁটিয়ে বলি,

“জ্বী,যাচ্ছি।”

কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে দরজার কাছে গেলাম।দটজা ঠেলে ভেতরে তাকালাম।অভি হুইল চেয়ারে বসে ল্যাপটপে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মনোযোগ নিয়ে টাইপিং করছে।আমি আমার উপস্থিতি জানান দিতে খ্যাঁক করে হালকা কেশে উঠি।তাতে অভির কানে পৌঁছায় নি।নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকি কয়েক মুহূর্ত।দাঁড়ানোর সময়টা একটু বেশিই গড়াতে ওপাশ থেকে,

“দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।এত ফর্মালিটি লাগবে না।অভি এসব পছন্দ করে না!”

এ’কথা গুলো সে কাকে বললো?এখানে আমি ছাড়া ত আর কেউ নেই।আমি ই ত শুধু দাঁড়িয়ে আছি।তাহলে সে কথাগুলো আমাকেই ইন্ডাইরেক্টলি বললো!এত ইগো!ভ্রু কুঁচকে আসে আমার।এদিকওদিক তাকিয়ে মনে জেগে ওঠা ক্রোধটাকে বহু কষ্টে সামলিয়ে তারপর ভেতরে ঢুকি।কোনোকিছু না বলে ধপাস করে তার সামনে চেয়ারটায় বসে পড়ি।এখানেও ফর্মালিটি দেখানো হয়নি।দেখাবোই বা কেন! সে ই ত মাত্র বললো এত ফর্মালিটি লাগে না তার কাছে।ল্যাপটপটা অন করি।বলি,

“কাজ কম্প্লিট।নাউ ইউ ক্যান সি।”

বলা মাত্রই অভি স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকায় এবার।তাকানোর চাহনি দীর্ঘ হয়।আমি তাকাই নি।একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব এনে টগবগ চোখে চারপাশে তাকাতে থাকি।অভি হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নেয়।বলে,

“থ্যাংকু।”

থ্যাংকুর আর জবাব দিই নি।দৃষ্টিটা সরাসরি আমার ল্যাপটপের দিকে নিবদ্ধ করে।বলি,

“কাজগুলো দেখে নিন।”
“সিউর।”

ল্যাপটপটা টেনে প্রোডাক্টস ডিজাইনগুলো একে একে দেখতে থাকে।এতক্ষণ পর এবার আমি অভির দিকে দৃষ্টি দিই।দেওয়ার কারণ ডিজাইনগুলো দেখে সে আসলে কতটা সন্তুষ্ট তার ভাব বুঝতে।দেখে যতটা মনে হলো সে খুশি হয়েছে।খুশি টা যদিও মুখে ফুঁটছে না তবে তার ঠোঁটের দিকে তাকালে স্পষ্ট ।কারণ ডিজাইনে চোখ বুলাবার মাঝে মাঝে বারবার ঠোঁট নড়ে উঠছে তার।এই নড়াটাই উৎফুল্লতার,প্রোজ্জ্বলতার এবং আকাঙ্খার।আমি যদিও সিউরিটি বলছি না তবে আমার মন তাই বলছে।হলোও তাই।দেখা শেষ করে সে আমার দিকে তাকায়।পুরো মুখ ছড়িয়ে হেসে দেয়।বলে,

“যতটা ভেবেছি।তারথেকেও সুন্দর হয়েছে।অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।”
“মোস্ট ওয়েলকাম।”

অভি আর কিছু বলে নি।সে এবার তার প্রোডাক্ট ডিজাইগুলোর ফাইলটা তার ল্যাপটপে ট্রান্সফার করে নেয়।ট্রান্সফার করা শেষ হলে,
“আজ রাতের মধ্যেই আপনার বাজেটটা ডাচ বাংলাতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”
“আসি …!”

বলে আমি ল্যাপটপটা টেনে হাতে নিই।উঠে দাঁড়াই।অভি আরো কিছু বলতে মুখ নড়ে উঠে।কিন্তু তাতে আমি আর পাত্তা দিলাম না।চলে এলাম সোঁজা।ওয়েটিং রুমের কাছে আসতে কোথা থেকে এমডি ছুটে আসেন আমার দিকে।বলেন,

“ম্যাম,এখনই চলে যাবেন?”
“জ্বী।”
“থাকুন প্লিজ আরেকটু।”
“কেন?”
তীর্যক চোখে তাকিয়ে বললাম।এমডি হেসে উঠেন।হাসি বজায় রেখেই জবাব দেন,

“ম্যাম,আপনি প্রথমবার এখানে এসেছে কিছু খানননি।আজ খেয়ে যেতে হবে।”
“সরি।”
“আজ আর সরি টরি শুনবো না।অভি স্যার ওদিন আমার উপর বড্ড খেপেছে।আজ যদি কিছু না খেয়ে যান তাহলে আরো খেপবে।তাই প্লিজ ম্যাম স্যারের প্যারা থেকে আমাকে বাঁচাতে আবদার টুকু প্লিজ রাখুন।আমি অভি স্যারকে খুব ভয় পাই।”

বলতে বলতে এম ডি মুখটা খুব নিরস করে ফেলে
আমি তাকিয়ে থাকি।তবে আমার কিছুই করার নেই।যেহেতু অভি আমাকে খাওয়ানোর জন্যে এম ডি কে থ্রেট দিয়েছে।তাহলে খাবারের অফারটা অভির থেকে এসেছে।আর তার সরাসরি মুখে না বলা অফার অন্যের মুখে থেকে গ্রহণ করে খাবো তা আমি নই!শক্ত হয়ে এম ডি কে জবাব দিলাম,

“সরি।”
দাঁড়ালাম না।চলে এলাম।আর বেচারী এম ডি মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে আছেন।

১৬.
দুইদিন না যেতেই ফেসবুক,টুইটার,গুগল,টেলিভিশন জুড়ে শুধু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির, আই মিন অভির কোম্পানির বিজ্ঞাপন!বিজ্ঞাপনের প্রতিটি প্রোডাক্টে শুধু আমারই হাতের অঙ্কন।মানুষ বিজ্ঞাপনের কর্মা দেখে বিমোহিত।রুচি,আগ্রহ বেড়ে যায় সাথে।ভিড়তে থাকে অনলাইনে,দোকানে-শপিং মলে যেখানে শুধু মাল্টিন্যাশনালের প্রোডাক্টস বেচেতা দেখে আঙ্কেল টেলিভিশন থেকে চোখ সরিয়ে ফেলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

“শেষে তুই যেয়ে ওদের আরো সুনাম বাড়িয়ে দিলি?”

আমি আঙ্কেলের এ’কথার বিনিময়ে একটা বাঁকা হাসি দিই।আঙ্কেল চোখের চশমা টা খুলেন।জোরে বার কয়েক নিশ্বাস ছাড়েন।তারপর আবার বলেন,

“আমি দোয়া করি তুই জীবনে অনেক বড় হ!”

কথাটা বলেই আঙ্কেলের গলার স্বর করুণ হয়ে এলো।বুঝলাম আঙ্কেল আমাকে মন থেকে দোয়া করছেন।আমি মাঝেমাঝে খুব অবাক হই।এই মানুষগুলোকে দেখে।।মা-বাবা আমাকে যতটা না বুঝেন তারথেকেও বেশি বুঝে এই মানুষ গুলো।বেশি সাপোর্ট করেন এই মানুষ গুলো।এই মানুষ এত ভালো কেন,হ্যাঁ?একটু কম ভালো হতে পারলো না?আবেগে বুকটা কেঁপে উঠে আমার।চোখে পানি চলে আসে।আঁচল টেনে মুখের উপর আলতো হাত উপর রাখি।পানি মুছে যায়।পাশে আন্টিও বসা ছিল।আন্টি বুঝতে পারেন আমি কাঁদছি। বলেন,

“তুই কাঁদছিস যে?”
মুখ থেকে আঁচলটা সরিয়ে।বলি,
“সুখে কাঁদি।অতি সুখে।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here