আমার বর★ লেখা : মিশু মনি শেষ পর্ব

0
791

★আমার বর★
লেখা : মিশু মনি
শেষ পর্ব

রাত একটা।
অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছিনা।বারবার শুধু আজ দিনের ঘটনাটা মনে পড়ে যাচ্ছে।আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছি আজ।
তন্ময়ের প্রতি ভীষন রাগ হয়েছিল।তাই ওকে ছেড়ে চলে এসেছি।এখন ও কোথায় আছে জানিনা।বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ওকে।এভাবে ছেড়ে চলে আসাটা উচিৎ হয়নি।বিয়ের পর প্রথম দিকে ও আমাকে সহ্য করতে পারত না।সে নিজেই কাল আমার দুয়ারে এসে দারিয়েছিল।আমার জন্য দামি ফোন কিনে এনেছে,বন্ধুর বাসায় বেরাতে নিয়ে গেছে,আর গত রাতের মত সুন্দর একটা রাত উপহার দিয়েছে।আমার প্রতি কিছুটা হলেও ওর ভালবাসা জন্মেছে।
ভাবতে ভাবতে মন ভালো হতে শুরু করেছে।তন্ময়ের দেয়া মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম। গ্যালারিতে ঢুকেই দেখি তন্ময়ের ৫০০ টা ছবি! অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করলো। ও সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকবে আর আমি এই ছবিগুলা দেখে ওর কথা ভাব্ব।আমার জন্য এতগুলা ছবি উপহার! ভালবাসা না থাকলে এটা করত না।
.
খুশি মনে ওর সব ছবি দেখতে লাগলাম। বিভিন্ন ভঙ্গিতে তোলা ছবি।এখন আর মন খারাপ ভাব টা নেই।বেশ ভাল লাগছে!
কিন্তু তন্ময় এখন কোথায়য়? বাসায় কেউ নেই।একা একা সেখানে কি করছে কে জানে! হয়ত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর নয়ত জেগে বসে আছে।
.
আর থাকতে পারলাম না।কল দিয়েই ফেললাম।কিন্তু ওর নাম্বার বন্ধ।পরপর অনেকবার কল দিলাম। বন্ধ দেখাচ্ছে।
ভীষন চিন্তা হচ্ছে।হয়ত আমার প্রতি রাগ করেছে।ওর ছবিগুলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
ঘুম থেকে উঠেই তন্ময় কে কল করলাম। নাম্বার এখনো বন্ধ।মনটা খারাপ হয়ে গেল।
সারাদিন কল দিতেই থাকলাম। প্রতিবার শুনতে পেলাম, সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
.
রাতে ঘুমাতে পারলাম না।
পরদিন সকাল হতে না হতেই শ্বশুরবাড়ি চলে আসলাম। এখন ওকে বাসায় পাওয়া যাবে।এত সকালে নিশ্চয়ই ডিউটিতে যায়নি।
কিন্তু বাসায় এসে দেখি মেইন দরজা তালাবন্ধ। তারমানে তন্ময় বাসায় ছিলনা।ও কোথায় থাকতে পারে সেই ধারনা আমার নেই।মন খারাপ করে বাসায় চলে আসলাম।
.
তিনদিন ধরে ওর কোনো খোজ পাচ্ছিনা।প্রতিমুহুর্তে খুব মনে পড়ছে বলে তিন দিন কেই অনেক দীর্ঘ সময় মনে হচ্ছে।
মা বাবা অনেক ভরসা করে আমার উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তারা যদি এই মুহুর্তে ফোন দিয়ে তন্ময়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে আমি কি জবাব দিবো? তন্ময় তো আমার কাছে এসেছিল।আমি নিজেই ওকে ছেড়ে চলে এসেছি।
বুক ফেটে কান্না আসছে।ভীসন রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি।
.
মোবাইল বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি তন্ময়ের নাম্বার থেকে কল।রিসিভ করেই কেদে ফেললাম।
তন্ময় শুধু বলল,মিফতা…
ওর কণ্ঠ শুনেই স্বস্তি পাচ্ছি।
বললাম,কি হইছিল আপনার? কোথায় হারিয়ে গেলেন?
– ভিডিও কল দিই প্লিজ?
– হুম দিন।
তন্ময় ভিডিও কল করল।ওকে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।এ কি ভয়ংকর চেহারা হয়েছে! বুঝতে পারলাম ও হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।বিপদের আশংকায় বুকটা কেপে উঠল আমার।
তন্ময় বলল,sorry মিফতা।
আমি কাদতে কাদতে বললাম আপনার কি হইছে?
-accident…
ওকে দেখে আমার ভীষন কস্ট হতে লাগল।তন্ময় বলল,এই কদিন আমি অচেতন অবস্থায় ছিলাম। তোমাকে কল দেয়ার মত কেউ ছিলনা।
– আমি অনেক ট্রাই করেছি..
– বললাম তো আমি অচেতন অবস্থায় ছিলাম।হুশ ছিলনা।
– কিভাবে এমন হল? আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? এখন কেমন আছেন?
– এত প্রশ্ন! তুমি আসো আমার কাছে। কষ্ট হচ্ছে আমার।
.
ফোন রেখে তন্ময়ের প্রিয় খাবার রান্না করলাম। নিজের প্রতি খুব রাগ হচ্ছে।মা বাবা অনেক দূরে আছেন। তন্ময়ের আপন বলতে এখন শুধুই আমি।সেই আমিই ওর বিপদে পাশে নেই..
.
তন্ময় আমাকে দেখে মানসিক শান্তি পেয়েছে বুঝতে পারছি।কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।খুব করুন অবস্থা ওর।পায়ের উপর দিয়ে গাড়ির চাকা চলে গেছে।ওর কষ্ট টা আমিও অনুভব করছি।বুক ফেটে কান্না আসছে।ও কথা বলতে পারছে,হাত নারাতে পারছে কিন্তু উঠে বসতে পারছে না।ওঠার শক্তি নেই।পা দুটোর কথা ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
আমার বর! আমার সবচেয়ে আপনজন। ওর এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছিনা।
.
অনেক কষ্টে হালকা কিছু খেতে পারল ও।
আমাকে কাছে ডাকতেই ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
ও বলল,মিফতা তোমার হাত ধরবো একটু?
আমি তন্ময়ের হাত ধরলাম।
তন্ময় মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে।
বলল,এত ভেঙে পড়োনা।আমি সুস্থ হয়ে যাব।
– আপনার পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ।
– আমি বুঝি সেটা মিফতা।কেদোনা পাগলী।এই accident টার খুব দরকার ছিল।
আমি বললাম,কি বলছেন এসব?
– হুম।এটার প্রয়োজন ছিল।আমি আমি বুঝতে পারছি আমার ভুল টা। তুমি একজন সুস্থ,পরিপুর্ন,সুন্দর একটা মানুষ। কিন্তু আমি তোমায় ছোট করেছি অনেকবার।আমি তোমার তুলনায় একটু লম্বা বলে খুব ভাব নিতাম। কিন্তু আজ যদি আমার পা দুটো কেটে ফেলত,কোথায় যেত আমার অহংকার? সারাজীবন হুইল চেয়ারে করে চলাফেরা করতে হত।অন্যের উপর নির্ভর করে বাচতে হত।
আমি ওকে নিষেধ করে বললাম, এসব কি বলছেন? এভাবে বলবেন না প্লিজ।আমার কষ্ট হয়।
তন্ময় বলল,আমাকে বলতে দাও মিফতা।স্বীকার করতে দাও।এই সময়ে আমি কাউকেই পাশে পেতাম না।আমার আব্বু আম্মু অনেক দূরে।আমার কোনো ভাইবোন নেই।মিমি কখনোই এখানে এসে আমার সেবা করত না।আজ বুঝি, আমার একমাত্র আপনজন এখন তুমি।এটা বুঝার জন্য এই accident টার খুব দরকার ছিল।আমার পা যতদিন ঠিক হয়নি,আমি তোমার উপর নির্ভর করে থাকবো।
আমি কাদতে কাদতে বললাম,সেদিন আমার ওরকম করা উচিৎ হয়নি।Sorry… আমাকে মাফ করে দিন।
– করবো। তবে শর্ত আছে।
– কি? বলুন?
– আমার একটা ইচ্ছে হচ্ছে।পুরন করবা?
– হুম।বলুন।
তন্ময় বলল,আমি ১০০ টা বিয়ে করতে চাই।
– কিহ! ১০০ টা বিয়ে!
– হুম।তবে সেটা শুধু একজন কেই।সে হচ্ছে আমার বিয়ে করা বউ।সে বিয়ের রাতে আমার কাছে ডিভোর্স চেয়েছিল। তাই আমি চাই,তাকে ১০০ বার করতে।শুধু আমার বউ মিফতাকে।১০০ বার বিয়ে করবো। আর হাজারো উপায়ে ভালোবাসব।
আমি হেসে বললাম,পাগল হলেন নাকি?
– হুম হলাম।করবা না আমায় বিয়ে?
– তাই বলে ১০০ বার?
– হুম।মুমূর্ষু রোগীর ইচ্ছা পুরন করবা না?
আমি হেসে বললাম,আপনাকে কি ১০০ বার বিয়ে করার অনুমতি দিবে?
– কেন দিবেনা? আমি তো ১০০ জনকে বিয়ে করবো না।আমি আমার বিয়ে করা একমাত্র বউকে বারবার বিয়ে করবো। আর যদি কেউ ঝামেলা করে তাহলে তুমি কবুল বলবা,আমি কবুল বলব ব্যস বিয়ে হয়ে গেল।
– তাই?
– হুম।আর যদি কেউ ঝামেলা না করে ১০০ বার ই বিয়ে করব কাজি ডেকে।
– কাজি যদি না পরায়?
– তাহলে সারাদেশ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করবো।
– পাগল হয়ে গেছেন আপনি?
– এত আপনি আপনি করবা না তো। আমার ঘুম পাচ্ছে।ঘুম পাড়িয়ে দাও।
.
তন্ময় কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বললাম।তিনি বললেন অনেক সময় লাগবে সুস্থ হতে।ওষুধ খাওয়ানো, পরিচর্যার নিয়ম,চলাফেরা,সেবা যত্ন সবকিছুই বিস্তারিত বুঝিয়ে নিলাম ডাক্তারের কাছ থেকে।আমার প্রচেষ্টা আর সেবা যত্ন দিয়ে ওকে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলতে হবে।বাবা মা হজ্ব থেকে ফিরে আসার আগেই ওকে হাটতে হবে।
.
হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এসে নিয়মিত ওর সেবা করতে লাগলাম। দুজনে মিলে অনেক ভালো সময় কাটাচ্ছি।
তন্ময় সেদিন বলল,অসুস্থ হয়ে বেশ ভালই হইছে।বাসায় বসে বসে বউয়ের ভালোবাসায় স্বর্গে এসে গেছি।
.
অনেক সময় লাগল তন্ময় সুস্থ হতে।আজ ও মাটিতে পা ফেলতে পেরেছে।খুব আনন্দ হচ্ছে।
.
মা বাবা হজ্ব থেকে ফিরে আসলেন। তন্ময় এখন পুরোপুরি সুস্থ।
খুব ধুমধাম করে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হলো।
.
আজ আবারো সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে।
আমি বউ সেজে বসে আছি।আজ খুব খুশি খুশি লাগছে।
.
তন্ময় এসে আমার পাশে বসল।ওর চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি।
আমি বললাম,বিয়ের প্রথম রাতে কি বলছিলা মনে আছে? আমি নাকি তোমার শর্ট বউ,তোমার মহা এলার্জি?
তন্ময় আমার নাক টেনে ধরে বলল,এই মহা এলার্জি টাই তো আমার জীবন।এই মিষ্টি বউ টার জন্যই সবকিছুকে এত সুন্দর উপভোগ করতে পারছি।
– যাও হইছে।আর বলতে হবেনা।
– কই যাবো? আজও আলাদা ঘুমাতে বলছ নাকি? আজ প্রাইম মিনিস্টার কল দিয়ে ডাকলেও আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছিনা।
আমি হেসে বললাম,এত প্রেম?
– হুম।আচ্ছা মিফতা আমরা যদি ১০০ বার বিয়ে করি,আমাদের ১০০ বার বাসর হবে।আর ১০০ টা বাচ্চাও হবে তাইনা?
আমি রেগে তাকালাম। তন্ময় শব্দ করে হাসতে লাগল।
মুগ্ধ হয়ে দেখছি ওর হাসিটা।এই ছেলে টাই আমার বর;আমার পৃথিবী!

..সমাপ্ত ..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here