ঠিকানা লেখা : মিশু মনি পর্ব:০১

0
616

গল্প: ঠিকানা
লেখা : মিশু মনি

পর্ব:০১
.
ইফতি আর আমার বন্ধুত্ব আট বছরের।বন্ধুত্ব থেকে থেকে অন্য কোনো সম্পর্ক হয়েছিল কিনা জানিনা,তবে দুই পরিবারের সম্মতি তেই আমাদের বিয়েটা হলো।
এই দীর্ঘ সময়ে সবসময় ই ইফতির সাথে আমার ঝগড়া, খুনসুটি লেগেই ছিল।আজ বিয়ের রাতেও তার ব্যতিক্রম হলোনা।যদিও ঝগড়া হওয়ার কোনোই কারণ ছিল না।
ইফতি ঘরে ঢুকতে ই আমি বলেছি,আজ তোকে একদম তাহসানের মত লাগছে।
– তুই ও কি মিথিলার মত আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবি নাকি?
এই একটা বাক্যই আমাকে রাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।দাত কটমট করে তাকালাম।
ও বলল,তুই খুব ভাগ্য করে জন্মেছিস বলে আমার মত বর পেলি।তুই তো হাফ টিকেট, তোর মত খাটো মেয়েকে বাংটু, মটু আর কানা খোরা ছাড়া কেউ বিয়ে করত না বুঝলি?
– কি বললি? তাহলে তুই বিয়ে করলি ক্যান? কে বলছিল তোকে বিয়ে করতে?
– বাপ রে,তুই নিজেই তো বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলি।
– হু,আমি চাইনি।আর আমি চাইলেই বা তোর কি?
– আমি তোর বন্ধু না? তোর চাওয়া পাওয়ার গুরুত্ব দিতে হবেনা?
আমি রেগে তাকিয়ে আছি।নাচতে নাচতে বিয়ে করে এখন আবার কথা শুনানো হচ্ছে।
ইফতি বলল,তোকে শাড়ি একদম মানায় না।কাল থেকে থ্রি পিচ পড়ে থাকবি।
আমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।
ইফতি বলল,প্যাচার মত মুখ করে থাকিস না।আজ আমাদের বাসর রাত।
বলেই চোখ মাড়ল। আমি দাত করমর করে বললাম,রাখ তোর বাসর।মেজাজ টাই বিগড়ে দিয়েছিস।
– কই রাখবো? আমার পাঞ্জাবীর পকেট নাই।
বলেই আবারো চোখ মাড়ল। আমার ভয়ানক রাগ হচ্ছে।ওর এটা বদঅভ্যাস,কথায় কথায় চোখ মাড়ে। অন্য কারো ক্ষেত্রে এমন করেনা,শুধু আমার সাথেই এটা করে।অনেক টা ফেসবুকের চ্যাটিং এর মত।প্রতি মেসেজের পাশে একটা করে চোখ মাড়া ইমো।
ইফতি হাই তুলে বলল,ঘুম পাচ্ছে রে খুব।ঘুমাবো। তুই কস্ট করে দাত ব্রাশ করে আয়।
– কেন?
– তোর মুখের যা বিশ্রী গন্ধ,আমার ঘুম আসবে না তোর পাশে।প্লিজ ব্রাশ করে আয়।
আমি চেঁচিয়ে বললাম,বের হ ঘর থেকে।আমার পাশে তোকে ঘুমাতে হবেনা।
– যাক বাবা,আমার বাড়ি, আমার ঘর আর আমাকেই বলে বের হয়ে যেতে।
– হ্যা যা,তোর সাথে এক ঘরে থাকা সম্ভব না।
– সাধে কি আর বললাম,তুই মিথিলার মত আমাকে ছেড়ে চলে যাবি।আমার সাথে এক ঘরে ঘুমাতেই তোর আপত্তি,আর তুই করবি সংসার? ভুতের মুখে রাম নাম!
আমি রেগে গিয়ে ওর গলাটা টিপে ধরে বললাম,তোকে মেরেই ফেলবো একদম।
ইফতি কাশি শুরু করে দিয়েছে।আমি ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে আছি।
ও কাশি থামতেই বলল,তুই তো রে লেডি কুত্তা।রাক্ষসী রানী কটকটি।নিজের স্বামী কে মেরে ফেলতে চাইছিস? নাহ,তুই হচ্ছিস ফেরাউন।ওহ নো,ফেরাউন তো লম্বা।আচ্ছা গালি টা পরে দিচ্ছি। এই মুহুর্তে কোনো খাটো ডাইনীর নাম মনে পড়ছে না।
ইফতির উপর খুব রাগ হচ্ছে।আজকের রাতেও ওকে এভাবে ঝগড়া করতে হবে?
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেলকুনিতে চলে আসলাম।
.
ইফতির সাথে বন্ধুত্ব টা হয়েছিল ঝগড়া দিয়েই।
সেই আট বছর আগের কথা।একদিন ক্লাসে স্যার আমার বান্ধবী সামিনা কে একটা প্রশ্ন করলেন। সামিনা উত্তর দিতে পারছিল না।আমি পাশ থেকে আস্তে করে উত্তর টা ওকে বলে দিলাম।
সামিনার উত্তর পেয়ে স্যার ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বসতে বললেন। ঠিক তখন ই ইফতি বলে উঠল, স্যার ধন্যবাদ টা তো মিশুর প্রাপ্য।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন কেন?
– মিশু তো সামিনার হেল্পিং ভার্ব স্যার।হেল্পার বান্ধবী।
– মানে?
– উত্তর টা মিশুই বলে দিলো তো তাই বললাম।
আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছি।স্যার আমাকে দাড়াতে বললেন।
আমি দাঁড়িয়ে মুখ কাচুমাচু করে আছি।
স্যার বললেন, তুমি ওকে বলে দিয়েছ?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,হ্যা স্যার।
– খুব পন্ডিত হয়ে গেছ না? ক্লাসে বসে শুধু গল্প করো আর কেউ পড়া না পারলে তাকে বলে দেয়া হয়?
– সরি স্যার।
– চুপ করো। তোমার পন্ডিতি দেখবো এবার।
স্যার বকা দিয়েই চলেছেন। আমি রেগে বাকা চোখে ইফতির দিকে তাকালাম।ইফতি শয়তানি হাসি হেসে একবার চোখ মাড়ল। আমি তো একদম হতভম্ব! আমাকে বকা শুনিয়ে নিয়ে আবার চোখ মাড়া হচ্ছে?
স্যার আমাকে একনাগারে দশ টা প্রশ্ন করলেন। ভাগ্যিস উত্তর গুলা আমার জানা ছিল।নয়ত সেদিন আরো অনেক গালি খেতাম।
স্যার বেড়িয়ে যেতেই ইফতির সাথে তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে দিলাম।বেচারা প্রতিটা লজিকের পর একটা করে শয়তানি মার্কা হাসি দেয় আর চোখ টিপ মাড়ে। আমি হতভম্ব হয়ে যাই আর রাগের মাত্রা বাড়তে থাকে।
এভাবে ই বন্ধুত্ব হয়েছিল আমাদের।
একদিন ক্লাস পার্টির ব্যাপারে কথা বলার জন্য ইফতি আমার নাম্বার টা নিয়েছিল।সেই থেকে শুরু এসএমএস এ ঝগড়া।স্কুলে সারাদিন নানান ভাবে আমাকে জব্দ করত,আর বাড়ি ফেরার পর শুরু হত এসএমএস এ ঝগড়া।
এভাবে একসাথে কলেজ টাও শেষ করি।
ভার্সিটি তে দুজন আলাদা ডিপার্টমেন্ট হলেও প্রতিদিন ই দেখা হত।আর সাথে থাকত আনলিমিটেড ঝগড়া আর খুনসুটি।
দেখতে দেখতে অনার্স কমপ্লিট করলাম।বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেললো আমার।
ইফতিকে হেসে হেসে বিয়ের দাওয়াত দিলাম।বললাম,আমার বিয়েতে সব কাজ তোকে সামাল দিতে হবে।ডেকোরেশন থেকে শুরু করে,সব।
ইফতি হাসি মুখে বলল,যথা আজ্ঞা মহারানী। তোর বিয়ে মানে আমার বিয়ে।
বলেই চোখ মাড়ল।
আমিও খুব খুশি মনে বিয়ের পরিকল্পনা করতে লাগলাম।কিন্তু যতই বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল,ততই ইফতির সাথে কথা কমে যেতে লাগল।একটা সময় সারাদিনে একবার ও ইফতির সাথে কথা হলোনা।
তিন দিন ওর সাথে কথা হয়নি।খুব খারাপ সময় কাটালাম,খাওয়াদাওয়া করিনি,গোসল করিনি,সারাক্ষণ আনমনা আর এলোমেলো হয়ে ছিলাম।কোথায় যেন একটা শুন্যতা আর হাহাকার।ইফতির সাথে সারাক্ষণ ই আমার ঝগড়া হত,কিন্তু তবুও যেকোনো বিপদে একে অপরের পাশে ছিলাম।ওকে ছাড়া আমার একটা দিন কিভাবে কাটবে!?
সারাক্ষণ ইফতিকে মিস করতাম।
বাবা আমাকে ডেকে বলল,তোর কি বিয়েতে মত নেই মা?
– মত থাকবে না কেন? তোমরা যোগ্য ছেলেই বেছে নিয়েছ।
– ছেলে ভালো কিন্তু তোর কি অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে?
– না আব্বু,নেই।
– কিন্তু কোথাও একটা সমস্যা তো আছেই।যখন বিয়ের আলাপ হচ্ছিল,তখন ও তুই হাসিখুশি ছিলি।কিন্তু ডেট ঠিক হওয়ার পর থেকেই দেখছি কেমন বদলে গেছিস।কি সমস্যা আমাকে বল?
– আব্বু,আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।
– বাবাকে বল? আমি বুঝতে পারবো। তুই কি ইফতি কে…
আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। এই কয়েকদিনে একবার ও কাদিনি।সাধারণত সহজেই আমার কান্না আসেও না।কিন্তু সেদিন খুব কাঁদলাম আর বাবাকে বললাম,
– আমি জানিনা ওকে ভালোবাসি কিনা।কিন্তু ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।ওকে ছাড়া নিজেকে মানতে ও পারছি না।ও আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে।
বাবাকে আর কিছুই বলতে হয়নি।আমাকে না জানিয়েই আব্বু ইফতির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছে।যদিও ইফতি এখন কোনো কাজই করেনা,সার্টিফিকেট প্রাপ্ত বেকার।তবুও বাবার আপত্তি ছিলনা।ইফতির পরিবার ও আমাকে অনেক ভালোবাসত,তারাও খুশি হয়ে বিয়েতে সম্মতি হলেন।
অতঃপর বিয়েটা হয়েই গেলো।
.
বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম।নিজেকে খুব পূর্ন মনে হচ্ছে।
হঠাৎ পিছন ফিরতেই দেখি একটা সাদা পোশাক পড়া ভুত,দুই হাত নাড়িয়ে ডান্স করছে।মুখ টা কালো, পাতিলের তলার মত।জিভ বের করে ভেংচি কাটছে আর ডান্স করছে।
আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠল। ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
.
জ্ঞান ফিরতেই দেখি ইফতি আমার মুখের উপর উপুর হয়ে হাসছে।আমি উঠে বসলাম।
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে।ইফতি হেসে বলল,কি রে ভিতু ঘোড়ার ডিম!
আমি ভয়ে কথা বলতে পারছি না।
ইফতি হা হা করে হেসে বলল,ভুত দেখছিস? আমাদের বাসায় কিন্তু ভুত আছে।
– হু,ভুত দেখছি।ও বাবা গো!
বাবা গো, মা গো বলে চেঁচিয়ে ইফতিকে জড়িয়ে ধরলাম।
চোখ মেলেই দেখি ইফতির পিছনে একটা সাদা কাপড় আর একটা কালো মুখোশ!
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম।
ইফতি আমাকে ছেড়ে দিয়ে সেগুলো এক হাতে ধরে বলল,এইগুলা ভুতের ড্রেস।তাইনা?
আমি একবার ইফতির দিকে তাকাচ্ছি,আরেকবার পোশাক টার দিকে তাকাচ্ছি।
ইফতি বলল,ভুতের নাম কি জানো বউ? ভুত টার নাম হচ্ছে ইফতানা,ইফতির ফিমেল ভার্সন।
বলেই চোখ মাড়ল।
আমি রেগে দাত কটমট করে তাকালাম।
ইফতি বলল,এত রাগিস না।তুই রাগলে তোকে আরো কালো দেখায়।এমনি তেই তো ব্লাক বেংগল ছাগল,রাগলে একেবারে পাতিলের তলার মত লাগে।
আমি ভয়ানক রেগে ইফতির চুল টেনে ধরলাম।ইফতি চেঁচাতে লাগলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here