তিনি_আমার_সৎমা পর্বঃ১

0
440

#তিনি_আমার_সৎমা
পর্বঃ১
মিথিলা নিভা

আমার বাবা যখন আমাদের দুই ভাইবোনের সামনেই নতুন এক মহিলাকে বিয়ে করে আনলেন সেদিন আমি একটা কথাও বলিনি। একটুও কাঁদিনি,চিৎকার করিনি কিচ্ছু না। ছোট ভাইটা অনেক ছোট। কিছু বোঝে না তেমন। বাড়িতে নতুন মানুষ দেখে গগণবিদারী কান্নাকাটি করে। ফলস্বরূপ নতুন একজন মহিলাকে দেখেও চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। বাবা সেদিকে একটু তাকালেন। কিছু বললেন না তেমন। শুধু দাদীকে ইশারা করলেন রনিকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যেতে। নতুন বউয়ের সামনে কোনো সিন ক্রিয়েট তিনি চাননা। অন্যদিন হলে রনির কান্নার জন্য বাবা আমাকেই চড় মেরে বসতেন, ও কেনো কাঁদছে।
দাদী খুব ভয় পান তার ছেলেকে। কোনো কথা না বলে রনিকে ভিতরে নিয়ে গেলেন তিনি। আমি দরজার কোণে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”এভাবে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? উনি তোমাদের মা। আজ থেকে উনাকে ছোট মা বলে ডাকবে। এখন যাও উনাকে সালাম করো।”
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। মাত্র চারমাসও হয়নি আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। দিনের পর দিন বাবার অবহেলার জন্য একটা মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। এই কয়দিনের মধ্যে আবার বিয়ে করে এসে তাকেই কিনা মা বলে ডাকতে বলছেন আমাকে?
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা এবার একটু রেগে যান। তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। আমি বুঝতে পারি বাবার রাগ উঠছে। রাগ বেশি উঠলে তার পরিণাম কি হতে পারে তাও আমার ভালোই জানা আছে। তিনি আমাকে বিভিন্ন শাস্তি দিতে পছন্দ করেন। সারারাত আমাকে অন্ধকারে বাথরুমে আটকে রাখার রেকর্ডও তার আছে। আগে মা বাঁচাতো। নিজে মার খেয়ে আমাকে বাঁচাতো। মা চলে যাওয়ার পর থেকে কেউ বাঁচাতে আসে না আমাকে। রনি ছোট, দাদী তো যমের মতো ভয় পান তার ছেলেকে। বাড়ির কাজের লোকগুলো তো বাবার ছায়াও মাড়ায় না। কেউ আর বাঁচানোর থাকে না আমাকে শাস্তির হাত থেকে। আমি জানি আজকের এই ঘটনার জন্য আবার বাবার রোষানলে পড়তে হবে আমাকে। কিন্তু যাই হয়ে যাক, আমাকে যাই শাস্তি দিক না কেনো আমি আমার মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নিতে পারবো না। ছোট মা ডাকা দূরে থাক, উনার সাথে কখনো কথা বলতেই যাওয়ার ইচ্ছা নেই আমার।
“কি হলো কি? কথা কানে যাচ্ছে না? তুমি জানো না এক কথা বারবার বলতে আমার ভালো লাগে না?”
বাবার চিৎকারে আমি একটু কেঁপে উঠলাম। একটু ভয় ভয়ও করছে। নতুন একজন মহিলার সামনে কি তিনি আমার গায়ে হাত তুলবেন? আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এক পা ও নড়লাম না।
“আচ্ছা থাক না, ছোট মানুষ। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি জোর করবেন না এভাবে প্লিজ।”
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ মিষ্টি একটা গলার স্বর শুনে চমকে উঠে তাকালাম উপরের দিকে। বাবার নতুন বউ আমার হয়ে কথা বলছে? কিন্তু উনি তো আমার সৎ মা। আমি জানি, সৎ মায়েরা কখনো ভালো হয়না। আমাদের স্কুলে একটা মেয়ে পড়ে। ওর আসল মা মারা যাওয়ার পর, ওর বাবাও একটা বিয়ে করে আনে। ওর সৎমা ওকে খুব মারে। ঠিকমতো খেতে দেয়না। যদিও ওর বাবা খুব ভালো। আমার তো তাও না। নিশ্চয়ই এই মহিলাও তেমন হবে। আজ প্রথমদিন দেখে একটু ভালো সাজছে হয়তো। আমি মুচকি হাসলাম উনার দিকে তাকিয়ে, করুণা করছে আমাকে।
“দেখো রুনা। আমার মেয়েকে আমি এভাবেই শাসন করি। তুমি নতুন মানুষ এই বাড়িতে। আমার উপরে কথা বলতে যাবে না। আমি যা বলবো তাই হবে।”
“আচ্ছা বেশ। কিন্তু এখন এসব প্লিজ বন্ধ করেন। আমার খুব টায়ার্ড লাগছে। আমি রেস্ট করবো। আমার ঘরটা দেখিয়ে দিন।”
আমি একটু কেঁপে উঠলাম উনার শেষ কথাটায়। উনার ঘর? উনার ঘর মানে তো আমার মায়ের ঘর। যেই ঘরে এখনো মায়ের গন্ধ লেগে আছে। মায়ের ছোঁয়া আছে সব জিনিসে। সেই ঘরে আজ থেকে উনি থাকবেন? মায়ের গন্ধ মুছে যাবে? তীব্র কান্না ঠেলে আসতে চায় ভিতর থেকে। গলার কাছে শক্ত হয়ে কষ্টটা আটকে থাকে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করি।
বাবা উনাকে ভিতরে নিয়ে যেতে যেতে আমার দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকালো। সেই চোখ দিয়ে আগুন ঝরছিলো। কিন্তু আজ কেনো জানি বাবার ওই চোখকে আমার একটুও ভয় করছে না। কারণ ভয়ের চেয়ে কষ্টটা বেশি চেপে ধরছে আমাকে। খুব মন পড়ছে আজকে মায়ের কথা। কেনো আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলো না মা? কেনো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাকে একা রেখে মা চলে গেলো? আমি আর থাকতে পারলাম না। বাবা উনাকে নিয়ে চলে যেতেই আমি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। দুই হাঁটুতে মুখ গুজে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম আমি। এই বাড়িতে যে শব্দ করে কাঁদাও নিষেধ। প্রতিটা নিঃশ্বাস এই বাড়িতে বাবার অনুমতি নিয়ে ফেলতে হয়। একটা ধরাবাঁধা ছকের মধ্যে আমাদের জীবন আটকানো।

সকালে আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। যদিও আজ স্কুলে যাওয়ার একদম ইচ্ছা নেই। বাসার এই পরিস্থিতি। রনিকে রেখে একটুও যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। এই সময় প্রতিদিন স্কুলে উপস্থিত থাকতেই হবে। এমনিতেও পড়াশোনার অবস্থা একটুও ভালো না মা চলে যাওয়ার পর থেকে। এখন আবার বাড়িতে অন্য ঝামেলা। ফেইল না করলেই হয়।
“তোমার ওড়নাটা তো ঠিকমতো বাঁধা হয়নি। আমি বেঁধে দিবো?”
আমি চমকে উঠে পিছে তাকালাম। ইনি আমার ঘরে?
“আপনি এখানে?”
“হ্যা, কেনো? রাগ হয়েছো আমি আসায়?”
“না।”
“তাহলে? এভাবে চোখমুখ কুঁচকে আছো। দেখে মনে হচ্ছে রাগ করেছো।”
“আমি দেখতেই এমন। স্বাভাবিকভাবে থাকলেও আমাকে এমনই দেখায়।”
বলা শেষ করতে না করতেই দেখি ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন। চোখে পানি চলে এসেছে তার হাসতে হাসতে। কি এমন বললাম এতো হাসির?
“তুমি বেশ মজার কথা বলো তো।”
আমি উত্তর দিলাম না। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে উনার এতো কথা শোনার সময় নেই আমার।
“তুমি বেশ সুন্দর দেখতে। একদম তোমার বাবার মতো।”
আমি একটু টিটকারি সূচক হাসলাম।
“মোটেই না। আমি আমার মায়ের মতো দেখতে। আমার মা খুব সুন্দরী ছিলেন।”
“তাই বুঝি? আমার চেয়েও সুন্দরী?”
এবার তো আর ভালো লাগছে না। উনি কি আমার মায়ের সাথে নিজেকে তুলনা করা শুরু করে দিয়েছেন? আসতে না আসতেই ঘরসংসার সব দখলের চিন্তা?
আমি আবার পেছন ঘুরে উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখে চোখ রেখে তাকালাম। গলার স্বর যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে বললাম,”জ্বি। আপনি সৌন্দর্যে আমার মায়ের ধারেকাছেও নন। আপনার মতলব কি আমি বুঝি না ভেবেছেন? কেনো একজন বিপত্নীক পুরুষ যার ছেলেমেয়ে আছে, তাকে বিয়ে করেছেন এতো কম বয়সে? বুঝিনা আমি?”
মহিলা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। যদিও তার চোখে বিস্ময়ের সাথে কৌতুকুও আছে। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। উনিও আমার মতোই ঠান্ডা স্বরে বললেন,”কেনো করেছি?”
আমি কিছু বলতে যাবো, তার আগেই দাদী এসে দরজার সামনে দাঁড়ান। তার চোখেমুখে ভীতি।
“নীরা, তুই এখনো যাস নি? আর বৌমা তুমি এখানে কি করছো?”
আমি ভদ্রমহিলার দিক থেকে চোখ নামিয়ে বললাম,”এখনই বের হবো দাদী। তুমি রনিকে দেখে রেখো।”
“না খেয়েই বের হবে? টিফিন নিয়েছো?”
আমি আবারও তাকালাম উনার দিকে। আচ্ছা বেহায়া মহিলা তো। এতোগুলা কথা শুনালাম। তারপরেও কীভাবে কথা বলছে।
“বৌমা, তুমি নতুন তো। তুমি মনে হয় জানো না। ও বাড়ির কোনো টিফিন পছন্দ করেনা। বড় বৌমাও কখনো টিফিন দিতে পারেনি ওকে। বাইরে থেকে কিনে খায় সবসময়।”
“সে এতোদিন যা করেছে, করেছে।আজ থেকে আর এসব করা যাবেনা। আমি সকালে রুটি তরকারি করেছি। ওটাই ও নিয়ে যাবে। বাইরের খাবার বেশি খাওয়া যাবে না। বাইরের খাবার আনহেলদি। নীরা, তুমি চটপট করে রেডি হয়ে চলে আসো। আমি তোমার টিফিন গুছিয়ে দিচ্ছি।”
এই বলে ভদ্রমহিলা দ্রুততার সাথে বেরিয়ে গেলো। আমি যেনো হতবাক হয়ে গিয়েছি, এতোটাই যে চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গিয়েছি। কে এই মহিলা? একদিন আসতে না আসতেই শুরু করে দিয়েছে। রাগে আমার শরীর কাঁপছে। আমি দাদীর দিকে তাকালাম। দেখলাম উনি হতবিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কারণ উনি খুব ভালো করে জানেন তার নাতনি তার ছেলের কাছ থেকে চণ্ডালের মতো রাগ পেয়েছে!

আমি কোনো কথা না বলে মেইন দরজার সামনে এসে জুতার ফিতা বাঁধতে শুরু করলাম। বাবা টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললো,”টিফিনের টাকা নিয়েছো তো?”
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ভদ্রমহিলা টিফিনবক্স গুছিয়ে আমার হাতে দিলো,”নাও ব্যাগে ঢুকিয়ে নাও।”
আমি একবার উনার দিকে তাকালাম আরেকবার বাবার দিকে তাকালাম। বাবাও বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন সেদিকে।
“কি হলো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো তোমার। ব্যাগে ঢুকিয়ে নাও এটা।”
দাদী রনিকে কোলে নিয়ে ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন। উনি শুধু ভয় পাচ্ছেন আমি যেনো সেই রাগ না দেখাই, যে রাগে তার ছেলে পর্যন্ত ঠান্ডা হয়ে যেতে বাধ্য। যদিও সবসময় সেই রাগ আমার ওঠে না, আমি চাইলেও না।
আমি শান্তস্বরে বললাম,”আপনাকে আগেও বলা হয়েছে বাড়ির টিফিন আমি নিই না। কেনো জোর করছেন এতোবার?”
“বাইরের খাবার খেতে খেতে শরীরের কি অবস্থা করেছো বলো তো। এতো মোটা হয়ে গেলে শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধবে। আজ থেকে আমি যেভাবে রুটিন করে দিবো, সেভাবে চলবে।”
বাবা ততক্ষণে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমতা আমতা করে বললেন,” থাক না, ওকে জোর করো না। এই নাও নীড়া টাকাটা রাখো। কিছু কিনে খেয়ে নিও কিন্তু মনে করে। ভাজাপোড়া কিছু খেয়ো না, ভালো কিছু খেয়ো।”
আমি কোনোদিকে না তাকিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার উদ্দেশ্যটা বোঝার চেষ্টা করছি। কি চাচ্ছেন উনি?
হঠাৎ করেই উনি ছোঁ মেরে বাবার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে নিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। আমি জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। বাবাও অবাকের শীর্ষে।
“কি করলে এটা? টাকাটা নিয়ে নিলে কেনো?”
“ও আজ থেকে বাসার খাবার খাবে। এটাই ফাইনাল।”
“তোমার সমস্যাটা কি? তুমি এতো কথা কেনো বলছো? তুমি কি ওর মা?”
“না আমি ওর সৎমা।”

(চলবে…..)

পাঠক কি মনে হচ্ছে? নীরার নতুন মা কি চাচ্ছে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here