ইচ্ছের_উল্টোপিঠ #পর্ব_৩,০৪,০৫

0
630

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৩,০৪,০৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
০৩

” আন্টি , ঐশি কোথায় ? ”

জান্নাতের প্রশ্নে ঐশীর মা চায়ের পাতিল টা চুলা থেকে নামিয়ে লিকার কাপে ঢেলে নেন। কাপ হাতে নিয়ে জান্নাতের দিকে ফিরে বললেন,

” রুমেই আছে। তোমাদের মধ্যে কিছু কি হয়েছে ? ভালো মনেই তো গেলো গানের শো তে। এরকম কান্না করতে করতে ফিরে এলো কেন জানিনা। ”

” না আন্টি। আমার সাথে তো কোনো প্রবলেম হয়নি। ফোনও কেটে দিয়েছে আমার। ভাব বেড়ে গেছে উনার। ”

বলেই রেগে দাত কাটলো জান্নাত। ঐশীর মা হেসে চায়ের কাপটা নিয়ে স্বামীর রুমে যেতে যেতে আবারও ফিরে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন,

” তোমাদের ব্যাপার তোমারই জানো। রুমেই আছে। দেখো রুম থেকে বের করতে পারো কিনা।”

বলেই তিনি রুমে চলে গেলেন। জান্নাত ঐশীর মা’র যাওয়ার পথপানে তাকিয়ে আবারও উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো। এই ঐশী মেয়েটাকে এত বছরেও সে বুঝে উঠতে পারেনি। কখন একদম শান্ত ,মাটির মত। আবার কখন রণমূর্তি রোদ্রের ন্যায়। ভাবনার মধ্যে আবারও শুনা গেলো এক দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। সাথে শুনা গেল কতগুলো পদধ্বনির শব্দ। জান্নাত গটগট পায়ে এগিয়ে গেলো ঐশীর রূমের দিকে।

রুমে প্রবেশ করতেই বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ কানে আসলো জান্নাতের। এই মেয়েটা কি এই আসরের সময় গোসল করছে ? জান্নাত এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো। ঐশীর ফোনটা নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে বারবার বাথরুমের দিকে তাকাতে লাগলো। না। আজ একটা বোঝাপড়া করতে হবে। ঐশীর জন্যেই তো শো এর পরিচালক ক্ষেপে গেছে ওর উপর। যা নয় তাই বলে বকেছে ওকে।

একটু পর ঐশী টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হলো। বিছানার উপর জান্নাত কে বসে থাকতে দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়না ঐশী। পরোয়া না করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে মুখ ক্রিম দিলো। হাত পায়েও দিলো। অতঃপর শরীরে বডি মিস্ট দিয়ে ফিরলো জান্নাতের দিকে। চুলে বিদেশিদের মতো টাওয়েল পেচিয়ে জান্নাতের পাশে এসে বসলো। জান্নাত এখনও বেটে চোখে তাকিয়ে আছে ঐশীর দিকে। ঐশী জোড়ে এক হাফ ছেরে দিয়ে বললো,

” আমি শো তে কমফোর্ট ফিল করছিলাম না তাই চলে এসেছি। এছাড়া আর কিছু না। ”

জান্নাত কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ওর দিকে খানিক তাকিয়ে ধুম করে এক কিল বসিয়ে দিলো ঐশির পিঠে। ঐশী একটু পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। জান্নাত আরো গুটিকয়েক থাপ্পর বসিয়ে দিয়ে বললো,

” কুত্তা , হারামি , শয়তান ছেরি। তোর জন্যে ওই খাটাশ ব্যাটা আমারে যা নয় তাই বলেছে। আমি আনস্মার্ট , ক্ষেত। এসব মিডিয়া , শো আমার জন্যে নয়। আরো কত কি। সব তোর জন্যে। ”

” আরে। আজব। আমার জন্যে তোকে বকতে যাবে কেন ? ”

” আমি বলেছিলাম তুই আমার বেস্টি। তাই ফেঁসে গেছি ইয়ার । ”

ঐশী জবাব দিল না। মাথা নীচু করে বসে রইল নীরব। জান্নাতের ঐশীর এই শান্ত রুপ সহ্য হলো না। হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললো,

” কি হয়েছে তোর ? এত নীরব কেনো ? সত্যি করে বলতো শো’তে তোর সাথে আসলে কি হয়েছিল। ”

ঐশী মন ভার করে মাথা ডানে বামে নাড়ল। যার উত্তর ” কিছু হয়নি। ” জান্নাত ঐশীর গালে হাত রাখলো। আদুরে গলায় বলল,

” কি হয়েছে বান্ধুপি। বল তো। ”

ঐশী আর যায় হোক জান্নাতের কাছে কিছুই লুকায় না। এখন তো ওর মনে হয় ওর বাসর রাতের দিন যা যা হবে সবই এই অপদার্থ কে বলবে।আর রাখতে পারলো না। ঐশী পেটের মধ্যে গুজে রাখা কথাগুলো এক এক করে বললো জান্নাতকে।

সব শুনে জান্নাত খুব বেশি আফসোস করলো না। সে খুব স্বাভাবিক গলায় বললো,

” এটাই স্বাভাবিক। এসব নামিদামি লোকেরা বাইরে এক , আর ভিতরে এক। এরা কখনোই মিডিয়াতে নিজের আসল সত্য প্রকাশ করে না। আর তুই এটা নিয়ে এত মন খারাপ করিস না তো । আমি তোরে আমার বিটিএস এর মোস্ট হ্যান্ডসাম ” ভি ” কে তোরে দিয়া দিলাম। তুই এরে নিয়ে সুখে থাক। তাও ওই ক্যারেক্টারলেস মির্জা রে ভুইলা যা। ”

ঐশী চোখ টিপে তাকালো জান্নাতের দিকে। জান্নাত ঐশীর তাকানো দেখে আমতা আমতা করে বলল,

” আচ্ছা। বাদ দে। ” ভি ” এর হাফ আমার। হাফ তোর। পুরোটা দেওয়া যাবে না কিন্তু। ”

ঐশী জান্নাতের কথা শুনে এক হাফ ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কি করবে ও ? এই মীর্জা ছাড়া ওর আর কারো কাছে মন বসে না। ঐ সাদা চামড়ার ছেলেদের কাছেও না। মন টা বারবার সেই গায়ক মহাশয়ের কাছেই আহত হয়। কি করবে ও ?

___________________

” আরে কেমন আছেন মিস্টার ? দিনকাল কেমন যাচ্ছে আপনার ? সব ঠিক আছে তো ? ”

আজ হুট করে নিজের মুঠোফোনে মন্ত্রী সাহেদুল হকের কল দেখে চোখে মুখে খানিক বিস্ময় খেলে গেলো ঐশীর বাবা আশরাফুল হাবিবের। পেশায় তিনি একজন পুলিশ অফিসার। তবে আজ মন্ত্রীর কল করার ব্যাপারটা তার আন্দাজ করতে মোটেও কষ্ট হয়নি। তাই তিনিও ধারালো গলায় বললেন,

” হঠাৎ আমার ভালোমন্দ জানার আপনার এত ইচ্ছে হওয়ার কারণ জানতে পারি। ”

সাহেদুল হক মুখের পানের লাল রঙা থুতু গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেললেন। মেকি হাসি হেসে বললেন,

” কি আর করার। আজকাল আপনার একেক কাজ আমাকে আপনার কথা স্মরণ করতে বাধ্য করে। আমার আর কি দোষ বলেন। ”

আশরাফুল অতিমাত্রায় তেতে উঠলেন। তবে মুখে মধু রেখেই বললেন,

” এসব কথা বাদ দিয়ে মোদ্দাকথায় আসেন। ”

” ঠিক বলেছেন। এসব ঘোরাফেরা কথা না বলাই ভালো। আপনার কাছে একটা মেমোরি আছে না ? ওটা আমার চাই যে। আসলে কি বলেন তো। আমার বিরুদ্ধে কারো কাছে কোনো প্রমাণ আছে। তাহলে আমি সেটা অক্ষত থাকতে দেই কিভাবে বলুন ত। দায়িত্ব আছে না একটা। ”

আশরাফুল কঠিন গলায় বললেন,

” আপনি ভুল জায়গায় কল দিয়েছেন। আমি ঐ মেমোরি কার্ড কখনোই আপনাকে দিবো না। মরে গেলেও না। ”

” আরে আপনি তো আমাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন মশাই। তা মেমোরি দিবেন না যেহেতু তাহলে তো আপনার মরেই যাওয়াই ভালো। আর আপনার একটা যুবতী মেয়েও আছে শুনেছি। ওকেও একটু টেস্ট করা যাবে সেই সুবাদে। কি বলেন। ”

সাহেদুল হকের কণ্ঠ কেমন হিংস্র শুনালো। আশরাফুল এতে একটু বিচলিত হলেন। তবুও অভয় গলায় বললেন,

” এসব ভয় অন্য জায়গায় দেখান। আমাকে না। ”

” তাহলে। ওই কথাই রইলো। কাল তো হবে না। তাই পরশু আমরা আসছি আপনার বাসায়। দশ বারোজন হবে কিন্তু। খাতিরদারি যাতে ভালো হয়। নাহলে কিন্তু ঘেচাং। ঠিক আছে। ”

আশরাফুল কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেলো। এসব কথা শুনে তিনি যে ভয় পাননি তা কিন্তু না। বেশ গায়েই লেগেছে কথাগুলো। নিজের জন্যে ভয় পাননা তিনি। কিন্তু জোয়ান মেয়ে তার। এসব কুৎসিত মানুষদের কোনো ভরসা নেই। যদি তার পবিত্র মেয়ের গায়ে আঁচড় লেগে যায় ? আতকে উঠলেন আশরাফুল। এসব ভাবতে ভাবতেই চায়ের কাপটা হাতে তুলে নেন তিনি। কিন্তু লক্ষ করেন চায়ের কাপটা মৃদু কাপছে। কিন্তু তার পরপরই উপলব্ধি করলেন চায়ের কাপ নয় বরং তার দুহাত মৃদুমন্দ কাপছে। তিনি আবারও কাপটা টেবিলে রেখে দিলেন। কপাল দুহাত দিয়ে ধরে চিন্তায় মগ্ন হলেন। মেয়েকে তার শহর থেকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। খুব দূরে। এসব অমানুষদের হাতের নাগালের বাইরে। আর সেটা খুব শীঘ্রই।

#চলবে…

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

বেলকনিতে দাড়িয়ে জিম করছে জুভান। হাতের বাহুগুলো ফুলে উঠছে জিম করার তালে তালে। বেশকিছু সময় পর জুভান হাপিয়ে উঠে। পুষ আপ করা বাদ দিয়ে বোতলে থেকে পানি খেতে খেতে ডিভানে এসে বসে। ফর্সা মুখ ঘামে লালরঙা হয়ে গিয়েছে। জুভান রেস্ট নিতে নিতে চোখ বুজে গা এলিয়ে দিল ডিভানে। কিন্তূ বন্ধ চোখে ভেসে উঠলো সেই মেয়ের ছবি। মেয়েটা তাকে কারো সাথে কিস করতে দেখে নিয়েছে। মেয়েটাকে দেখতে সহজ সরলই লেগেছে। মনে হয়না সেই কিসের ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছে। জুভান আরো কিছুসময় রেস্ট নিয়ে লাগেজ গুছাতে শুরু করলো। আজ আবার ঢাকার বাড়িতে যেতে হবে।

__________________

” বাবা, তুমি এসব কি বলছো ? আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো ? ঢাকার কিছুই আমি চিনি না। কোনো আত্মীয় নেই। কোথাও থাকবো আমি ? ”

আশরাফুল হাবিব মেয়ের কথা শুনে কিছুটা কষ্ট পেলেন। আসলেই মেয়েকে এভাবে খোলা ময়দানে ছেড়ে দিতে তার একদমই মণ চাইছে না। কিন্তু মেয়ের নিরাপত্তার জন্যে এইটুকু আত্মত্যাগ তো করতেই হবে। আশরাফুল হাবিব তুলনামূলক জোরালো গলায় বললেন,

” দেখো ঐশী, আমি যা বলছি ভেবে চিন্তে বলছি। তাই তুমি আমার কথায় দ্বিতীয় কোনো কথা বলবে না। ”

ঐশী র চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময়। কি বলছেন বাবা? এভাবে একা একা ঢাকায় যাওয়া ? ও তো নিতান্তই এক মেয়ে ? ঢাকার পরিবেশের সাথে কিভাবে মানিয়ে নিবে ? ঐশী মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার করুন গলায় বললো,

” মা , দেখো না। বাবা কি বলে। আমি ঢাকা যাবো কেনো হুট করে। কিছু বলো তুমি। ”

কাঞ্চনা আক্তার মুখ ঘুরিয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। আবারো মেয়ের দিকে ফিরে বললেন,

” দেখ ঐশী। বাবা যা বলেছেন ভেবেই বলছেন। বাবা নিশ্চই তোমার মন্দ চাইবেন না। তাই যা বলছেন অমত করবে না তাতে। ”

ঐশী আবারও কথা বলতে চাইলে আশরাফুল হাবিব কঠিন গলায় বললেন,

“মা ,আমার কসম দিয়ে বলছি। তুমি যাবে ঢাকাতে। ”

ঐশী অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। এ কোন বাবাকে দেখছে সে ? যে বাবা একটা মুহূর্তের জন্যে তাকে নিজের থেকে আলাদা করেনি। আজ সেই বাবাই তাকে একা একা শহর থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ঐশী চোখ মুছে বললো,

” ঠিক আছে যাবো আমি। তাও তোমরা খুশি থাকো। ”

বলেই ঐশী চেয়ার থেকে উঠে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে । অভিমানের পাহাড় জমেছে তার ছোট্ট মনে। নিজের বাবা মায়ের এই ব্যাপার তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু এরকম কেনো হচ্ছে ?

___________________

” লন্ডন এক্সপ্রেস ” বাস স্টেশনের সামনে দাড়িয়ে আছে ঐশী। আশরাফুল হাবিব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নানা রকম আশ্বাস দিচ্ছেন। পারলে মেয়েকে নিজের বুকের ভিতর নিয়ে যান। তাও যদি এসব অমানুষের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচাতে যেত ! ঐশী মন ভার করে সামনে তাকিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত একটাও কথা বলেনি সে। বলবেও না। কেনো বলবে ? কোনো বাবা কি এমন করে নিজের মেয়ের সাথে ? আশরাফুল হাবিব মেয়ের মন বুঝতে পারলেন। পকেট থেকে নিজের ওয়ালেট বের করে ডেবিট কার্ড মেয়ের দিকে এগিয়ে বললেন

” মামনি? ”

ঐশী মুখ ভার করে ফিরে তাকালো নিজের বাবার দিকে। আশরাফুল নিজের কার্ডটা ঐশীর দিকে এগিয়ে বললেন

” এই কার্ড আমার অনেক আগের। তোমার জন্যে একটু একটু করে টাকা জমিয়েছিলাম। এটা সেই টাকার কার্ড। কিন্তু মনে রেখো অকারণে এই টাকা খরচ করবে না। আজ থেকে তোমার অনেক কিছু সামলাতে হবে। তোমার জীবনের অনেক দেখা – অদেখা বিষয়ের মোকাবেলা করতে হবে। নিজে সৎ উপায়ে টাকা রোজগার করবে। কিন্তু যখন আর্থিকভাবে খুব বেশি ভেঙে পড়বে তখনই এই টাকা খরচ করো। ”

ঐশী কিছুটা অবাক হয়ে কার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। এসব কথার মানে কি ? ঐশী হাজারখানেক দ্বিধা নিয়ে কার্ডটা হাতে নিল। বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো। যা হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু এইটুকু আন্দাজ করতে পারছে , কিছু একটা মন্দ হচ্ছে। বাস এসে পড়েছে। ঐশী ভারী মন নিয়ে বাসের দিকে তাকালো। আশরাফুল হাবিব এবার মেয়ের গলায় একটা লকেট পরিয়ে দিলেন। ঐশী অবাক হয়ে গলায় হাত দিল। আশরাফুল লকেট পরিয়ে দিয়ে মেয়ের দিকে ফিরলেন। বললেন,

” এই লকেটে কিছু আছে। যেদিন তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলবে সেদিন তুমি এই লকেট খুলবে। সেদিনই তুমি তোমার সব উত্তর পেয়ে যাবে। কিন্তু খরবদার তার আগে কিন্তু এই লকেট খুলবে না। ”

ঐশীর মনে হয় আজ শুধু অবাক হওয়ার দিন। একটার পর একটা চমক পেয়েই যাচ্ছে ও। কিন্তু মুখ স্বাভাবিক রেখে বললো,

” ঠিক আছে। ”

বাস ছেড়ে দিবে আর কিছুসময়ের মধ্যে। আশরাফুল হাবিব মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন

” বাবার খুব মনে পড়বে তার রাজকন্যার কথা। ”

ঐশীও অভ্যাসবশত বাবার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

” আমারও খুব মনে পড়বে তোমাদের কথা। ”

আশরাফুল হাবিব লক্ষ করলেন তিনি অনেক ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছেন। তাই সব বেঠিক হওয়ার আগেই ঐশীকে বাসে তুলে দিলেন। যতসময় বাস দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে রইলে ন একে অপরের দিকে। ঐশীর মত তার বাবারও চোখ ছলছল করছে। মন ভারী থেকে ভারী হচ্ছে। মনে হচ্ছে দিল ছিঁড়ে কেউ নিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের অনিশ্চিত জীবনের কথা চিন্তা করে আশরাফুলের বুক ফেটে আসছে। এমনই ত হয় বাবারা। নিজের মৃত্যুর কথা পরোয়া না করে সারাটাজীবন সন্তানের কথা ভেবেই পার হয়ে যায়। কি অদ্ভুত না বাবারা ? তাইতো হুমায়ূন আহমেদ একটা কথা বলেছিলেন,

” পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে। কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। ”

_________________________

বাস চলমান। বিজ্ঞা নের আপেক্ষিক সূত্র অনুসারে গাড়ির পাশের গাছ, বাড়ি গুলো উল্টোদিকে গতিশীল। ঐশী নিজের ব্যাগ নিয়ে নিজের সিটের দিকে এগিয়ে গেলো। সিট পেয়েও গেলো ও। ওর সিট পড়েছে একটা ছেলের পাশে। ঐশী খুব একটা লক্ষ্য করলো না ছেলেটাকে। ব্যাগটা উপরের তাকে রেখে দিয়ে বসে পড়লো সিটে। বোতল থেকে পানি খেয়ে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। রাত হয়ে গেছে। ঐশীর আবার ট্রাভেল ঘুম পায় না। পাশের ছেলেটা কানে ইয়ারপড, মুখে মাস্ক ,আর মাথায় ক্যাপ দিয়ে সি টে গা এলিয়ে বসে আছে। ঐশী একটু অবাক হলো। এই ছেলের কি গরম লাগে না ? হুট করে ঐশীর নাকে কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ এলো। বাসেও ইতিমধ্যে হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিছু কি পুড়ে গেল ? ঐশী ঘাবড়ে গেল।

#চলবে

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ঐশী বাসের সামনে পিছনে , ডানে বামে তাকালো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। পাশের ছেলেটা খুব আরামসে সিটে গা এলিয়ে বসে আছে। যেন যা হচ্ছে তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ঐশী বিরক্ত হলো। কোনো উপায় নেই পেয়ে পাশের বসা ছেলেকে মৃদু সুরে বলল,

” এক্সকিউজ মি ? ”

ছেলেটা কি শুনলো ওর কথা? ঐশীর এভাবে যেচে পড়ে ডাকতে কেমন যেন বাঁধছে। কিন্তু উপায় নেই। বাসের দায়িত্বহীন ড্রাইভারদের অবহেলার কথা আজকাল প্রতিনিয়িত খবরে দেখাচ্ছে। ঐশী আবারও মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো। ফোন স্ক্রল করছে। ঐশী এবার নিজেই উঠে এলো। বাসের ড্রাইভার এর কাছে এসে দেখলো ড্রাইভার আর হেলপার কিছু একটা কথা বলছে আর ড্রাইভ করছে। ঐশী ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,

” এক্সকিউজ মি , আপনারা কি কোনো কিছু পোড়ার গন্ধ পাচ্ছেন। ”

হেল্পার ঐশীর কথা শুনে আঙ্গুল উচিয়ে নিজের জোরালো গলায় বললো,

” জ্বী আমি তো সেই কখন থেকে পাচ্ছি। এই কাকু আমার কথার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমার মনে হয় ইঞ্জিনে কিছু হইসে। ”

ঐশী সব শুনে কঠিন চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকালো। ড্রাইভারটা দাঁত কেলিয়ে বললো,

” আসলে, আমার নাক বন্ধ ছিল। তাই গন পাই নাই। দাড়ান। আমি দেখতাছি। ”

ঐশী ভ্রুকুটি করে নিজের সিটে এসে বসলো। ড্রাইভার রাস্তার এক সাইডে গাড়ি পার্ক করে বাস থেকে বেরিয়ে গেলো। একটু পর বাসের হেলপার বাসে উঠে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি । আমাদের বাসের ইঞ্জিন পুড়ে গেছে। তাই বাস এখন আর গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। আমরা খুবই দুঃখিত। আপনারা সবাই নিজ নিজ ভাবে ঢাকায় ফিরে যান। এখান থেকে ঢাকা মাত্র দুই ঘণ্টার রাস্তা। তবে একটা উপায় আছে। আমাদের ঢাকার বাসগুলো অন ডিউটি আছে।আপনারা চাইলে আমরা ময়মনসিং থেকে আরেকটা বাস আনাতে পারি। তবে অনেক সময় লাগবে। ততসময়ে অন্য গাড়ি দিয়ে ঢাকা পৌঁছানো সম্ভব। আমরা আসলেই আমাদের সার্ভিস নিয়ে অত্যন্ত দুঃখিত। ”

ঐশী ভ্রু উচু করে তাকালো। বাসের সবার চোখে মুখে বিরক্তি। কিন্তু ঐশীর চিন্তা ,ও একা একটা মেয়ে এতদূর যাবে কি করে ? ক্ষতি হলে ?

জুভান হেলপারের কথা শোনে ইয়ারপড খুলে মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকালো। ইঞ্জিন পুড়ে গেছে শুনে জুভানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। এসব কিসের সার্ভিস ? আগে থেকে দেখে রাখবে না ? আজ ওই শাহাদাতের সাথে কড়া গলায় দুটো কথা না বললেই হচ্ছে না। জুভান নিজের ব্যাগ কাঁধে উঠিয়ে বাস থেকে নেমে গেলো। এক এক করে বাসের বাকি সবাই নেমে গেলো। ঐশী আর কোনো উপায় না পেয়ে নিজেও ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাস থেকে।

জুভান একটু দূরে হেঁটে যাচ্ছে। ঐশী আর কোনো উপায় নেই পেয়ে সাইড ব্যাগ শক্ত করে ধরে জুভানের পিছনে পিছনে হেঁটে এলো। জুভান ঐশীকে আসতে দেখে হাঁটা বন্ধ করে পিছন ফিরলো। সেদিনের মেয়েটা ওর পিছু পিছু আসছে কেনো ? ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

” হোয়াই আর ইউ ফলোয়িং মি ? ”

ঐশী জুভানের কথা শুনে থমকে গেলো। কি উত্তর দিবে ? ঐশী চোখ সরু করে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললো,

” আপনি কি ঢাকা যাবেন ? ”

ঐশীর কথা শুনে জুভানের কুঞ্চিত ভ্রু আরো কুঞ্চিত হয়ে গেলো। কেমন প্রশ্ন ? একসাথে ঢাকার বাসে উঠেছে তার মানেই ঢাকাই যাচ্ছে। জুভান কোমরে হাত ধরে বললো,

” হ্যাভ ইউ লস্টেড ? ঢাকার বাসে ছিলাম আমরা। ”

ঐশী নিজের বোকামি বুঝতে পেরে জিভ কাটলো। জুবানকে এখনো দেখেনি ঐশী। মাস্ক পড়া , মাথায় আর্মিদের মত ক্যাপ। সর্বোপরি চেনা মুশকিল। ঐশীকে চুপ থাকতে দেখে জুভান কোনো রিয়েক্ট করলো না। পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেনো কল দিল। ফোন রিসিভ হলে জুভান বলল,

” গাড়ি পাঠাও। আমি অ্যাড্রেস সেন্ড করছি। কুইক।”

” …..”

” কুইক। ”

জুভান দ্বিতীয় কথা না বলে ফোন কেটে দিলো। ঐশী জুভানের দিকে অসহায় নজরে তাকালো। জুভান সেটা লক্ষ্য করে ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো,

” কিছু বলার থাকলে বলো নাহলে গেট লস্ট । ”

ঐশীর কিছুটা রাগ লাগলো। এমনভাবে কথা বলছে কেনো এই লোক ? এত ভাব কিসের ? পরক্ষণে ঐশী ভাবলো না তাকে মাথা গরম করলে চলবে না। এই লোকটাই এখন শেষ ভরসা। ঐশী জুভানের থেকে দূরত্ব রেখে আরো একটু সরে গেলো। ওর দিকে তাকিয়েই বললো,

” আমাকে লিফট দিবেন আপনার গাড়িতে ? ”

জুভান ফোনের দিকে তাকিয়েই ভ্রু কুচকে ফেললো। লিফট ! জুভান ফোন অন রেখেই ঐশীর দিকে ফিরলো। বললো,

” ভয় করে না ? একটা অচেনা ছেলের কাছে লিফট চাইছ ? ”

ঐশী কথাটা শুনে ভিতর ধক করে উঠল। আসলেই লিফট চাইছে তাও একটা অজানা ছেলের কাছে ! কেন ? সে জানে না। ঐশী নিজেকে সাহসী দেখাতে মাথা নেড়ে বলল,

” ভয় কেন পাবো ? আপনি বাঘ না ভাল্লুক। ”

জুভান কিছুসময় ঐশীর দিকে তাকিয়ে আবারও ফোনের দিকে তাকালো । বললো,

” সেটা তোমরা মেয়েরাই ভালো জানো। ”

ঐশী জুভানের কথা শুনে আক্রোশ নিয়ে বললো,

” কটা মেয়ের সাথে চলেছেন আপনি ? সব মেয়ে এক না। যেমন আমি। আমি আপনাদের মত ছেলেদের ভয় পাইনা। ”

জুভানের হাসি পেলো ঐশীর কথা শুনে। কিন্তু হাসি ব্যাপারটা ওর ডিকশনারিতে নেই। তাই হাসি আটকে বললো,

” জাস্ট ফরগেট ইট। ”

ঐশী পায়ের কাছে একটা কালো রঙের পাথর লাথি দিয়ে রাস্তার একটু দূরে সড়িয়ে বললো,

” আপনি ভালো আছেন। তাই সব ভেবেই লিফট চেয়েছি। নাহলে কি চাইতাম ? ”

জুভান অবাক হলো। ফোন থেকে চোখ তুলে ঐশীর দিকে তাকালো। চমক কণ্ঠে বললো,

” আমি ভালো ! কে বলেছে তোমাকে ? ”

” নাহলে মাঝরাত পর্যন্ত একটা মেয়ে আপনার পাশে বসেছিল। চাইলে তো অনেককিছু করতে পারতেন। যেমন হাতে টাচ করা , গায়ে এনিয়েবিনিয়ে হাত লাগানো। কিন্তু আপনি তো ফিরেও তাকান নি। তাই বুঝেছি।আর এই বাসে তো একটাই মেয়েও নাই। মাত্র একটা ছোট পিচ্ছি মেয়ে ছিল। যুবতী বলতে আমি একাই ছিলাম। তাই আর কাউকে বিশ্বাস না করে আপাতত আপনাকেই করলাম। ”

জুভান বুঝতে পারলো মেয়েটা একটু বেশিই কথা বলে। সে এই কথার প্রতিউত্তর না করে আবারও ফোনে মশগুল হয়ে গেলো।

ঐশী সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ওর বাবাকে কল দিল। কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে। ঐশী প্রায় অনেকবার কল দিল। কিন্তু বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। ঐশী রাগে ফোনটা ঝট করে আবার ব্যাগে রেখে দিল। বুকে হাত গুটিয়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বুলি আওয়ারালো ” বাবা খুব খারাপ। খারাপ। খারাপ। ”

গাড়ি এসে গেছে ওদের। জুভান পিছন সিটের দরজা খুলে বসে গেলো। ঐশী জুভানের দিকে তাকালো। জুভান ঐশীকে এখনো গাড়িতে উঠতে না দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,

” হোয়াট ? সং এর মত দাঁড়িয়ে আছো কেন ? না গেলে বলো। আমি চলে যাচ্ছি। ”

ঐশী চোখ নামিয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে আবারও জুভানের দিকে তাকালো। ভয় ভয় গলায় বললো,

” আপনি কি সামনে বসবেন। একসাথে এভাবে পিছন সিটে …”

জুভান এক নিঃশ্বাস ফেলে পিছন সিটের দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে গেল। ঐশী ব্যাগ শক্ত হাতে আকড়ে ধরে ধীরে ধীরে পিছনের সিটে এসে বসলো।

গাড়ি চলমান। গাড়ির ড্রাইভার একনজরে সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। জুভান ফোন স্ক্রল করছে। ঐশী ব্যাগে সেফটিজোন হিসেবে একটা লাল মরিচ গুঁড়ো এর স্প্রে এনেছিল। সেটা ব্যাগ থেকে বের করে নিজের হাতে লুকিয়ে আকড়ে ধরলো। যতই হোক একটা ছেলেকে বিশ্বাস করা উচিত না। তাই এই ব্যবস্থা।

গাড়ি ঢাকার অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। জুভানের মাস্ক পড়ায় গরম লাগছিলো। তাই সে মাস্ক খুলে এসির তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিল। ঐশী প্রথমে জুভানকে লক্ষ্য না করলেও এখন সামনে বসে থাকা এই চিরচেনা মির্জা কে দেখে চমকে যায়। কপাল ঘামতে থাকে।এই চরিত্রহীন মির্জার সাথে সে এতক্ষণ এতটা পথ পাড়ি দিয়েছে। আর ও চিনলই না ! কিভাবে ? ঐশী জুভানকে দেখে ভয় পেতে শুরু করে। কিছু ক্ষতি করবে না তো ? ঐশী মরিচ স্প্রে টা আরো জোরে আকড়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বলে,

” স্টপ দা কার। আই সে স্টপ দা কার রাইট নাও। ”

জুভান অবাক চোখে পিছন ফিরলো। ঐশী ভয়ে প্রায় কেঁদে দেওয়ার মত অবস্থা। জুভান ভাবছে , হটাৎ করে কি হলো এই মেয়ের ?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here