ইচ্ছের_উল্টোপিঠ #পর্ব_৬,০৭,০৮

0
547

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৬,০৭,০৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
০৬

জুভান অবাক চোখে পিছন ফিরলো। ঐশী ভয়ে প্রায় কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। জুভান ভাবছে , হঠাৎ করে কি হলো এই মেয়ের ? ঐশী জুভানকে এরূপ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মরিচ স্প্রে টা জুভানের সামনে বের করে আবারও জোরালো গলায় বললো,

” কি হলো ? গাড়ি থামাতে বললাম না। থামাচ্ছেন না কেনো ? ”

জুভান ঐশীর পাগলামি দেখে ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে আবারও ঐশীর দিকে তাকালো। ঐশী বারবার ঢোক গিলছে আর ভয়ার্ত চোখে জুভানের দিকে তাকিয়ে আছে। জুভান এতে কোনো ভাবান্তর না করে ভ্রু আঁকাবাঁকা করে ফট করে ঐশীর হাত থেকে মরিচ স্প্রে টা নিজের হাতে নিয়ে নিল। ঐশী হঠাৎ এমন ব্যাবহার দেখে থমকে গেলো ? এখন কি হবে ? ওর একমাত্র সম্বল তো ওই মির্জা হাতিয়ে নিল। ঐশী মুখের লালা দিয়ে গলা একটু ভিজিয়ে সিটের একটুখানি পিছিয়ে গেল। জুভান স্প্রের বোতল একটু নেড়েচেড়ে আবারও ঐশীর দিকে তাকালো। ভ্রুকুটি করে বললো,

” লাল মরিচ শুধু ? নাকি আর কোনো মরিচ আছে এতে ? ”

ঐশী নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,

” তাতে আপনার কি ? এক্ষুনি গাড়ি থামান। আমি নেমে যাবো। ”

জুভান প্রতিউত্তর না করে স্প্রে টা নিজের কাঁধ ব্যাগে রেখে দিল। এসব দেখে ঐশীর মন চাইলো এই মির্জা কে জাস্ট মেরে ফেলতে। কত সাহস ! ওর স্পেশাল থেরাপি টা নিয়ে নিল ? ঐশী মুখ ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। ঐশী রাগ দমন করতে না পেরে আবারও বললো,

” আপনার কি কান নেই ? কখন থেকে বলছি গাড়ি থামান। অথচ আপনি কানেই নিচ্ছেন না। আর আমার স্প্রে দিন। দিন বলছি। আমি নেমে যাবো। ”

জুভান ফোন স্ক্রল করছিল। ঐশীর কথা শুনে ফোনটা আবারও নিজের পকেটে রেখে দিল। ঐশীর দিকে ফিরে অতীব রাগী কণ্ঠে বললো,

” আর ইউ ম্যাড ? এই মধ্যরাতে, মাঝরাস্তায় তুমি গাড়ি থেকে নেমে যাবে ? চিনো কিছু ? জানো এই শহর সম্বন্ধে ? কোথ থেকে যে আসে এসব ডাফার । ডিসগাস্টিং । ”

বলেই জুভান বিরক্তি হেসে আবারও সামনে তাকালো। ঐশীর মনোভাব নিতান্তই তুচ্ছ করে আবারও ফোন স্ক্রল করতে মনোযোগ দিল। ঐশীর মাথা এবার আগুন হলো। জ্বলন্ত লাভা ফুটলো তার মগজে। সেই লাভার উত্তাপে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড করে বসলো ও । অত্যধিক ক্ষোভে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু জুভান সতর্ক হয়ে সাথেসাথে ঐশীর হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে আবারও সিটে বসিয়ে দিল। চটজলদি এক হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি করে দরজা আটকে দিল।

” ইউ মেড ” বলে ঐশীর এমন অবিশ্বাস্য ব্যবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে জুভান রেগে থাপ্পড় লাগাতে হাত অগ্রসর করতেই ঐশী চোখ খিচে বন্ধ করে দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাদতে কাদতে বললো,

” আমি যাবো না আপনার সাথে। যা করার করে নিন। ”

ঐশীর কান্নার শব্দ খুব অসহায় হয়ে ভেসে আসলো জুভানের কানে। জুভান থমকে গিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ঐশীর দিকে। রাগ এখনো কমে নি। কিন্তু এই মেয়ের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাওয়ায় সেও হিতাহিত বিবেক কে প্রশ্রয় না দিয়ে ড্রাইভারকে বলে মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দিল। গাড়ি থামানোর প্রায় সঙ্গেসঙ্গে ঐশী দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধরে। আর একবারও পিছন ফিরে তাকায় নি সে। ভয়ে এখনো বুকের ভিতর-টা তবলা বাজাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে। মুখ লালাভ রং ধারণ করেছে। কিন্তু মনটা এখন শান্তি। ওই মির্জা থেকে তো নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে। ভেবেই জয়ের হাসি হাসলো ঐশী। একটু পর পাশ দিয়ে জুভানের গাড়ি শো আওয়াজ করে সামনে এগিয়ে গেলো। ঐশী সেদিকে তাকিয়ে আবারও জিভ ঠোঁট ভেজালো। বাঁচা গেছে।

রাত কয়টা বেজে ঐশীর জানা নেই । একটা অতীব সত্যি বিষয় হলো , মানুষ মাত্রই অলস। সবসময় তার শুধু একটাই চাওয়া ” ইসস ! আরো সহজ উপায়ে যদি কাজটা করা যেত। ” কিন্তু সে এটা জানে না সেই তথাকথিত সহজ উপায় অবলম্বন করতে করতে সে নিজের ভাগ্যটাকেই সংকুচিত করে ফেলে । তেমনটাই করেছে ঐশী। সহজ উপায় স্বরূপ নিজের হাতঘড়ি- টায় একবার চোখ বুলালো। তিনটা দশ বাজে। ঐশী সময় দেখে এক ঢোক গিললো। কিন্ত তাতে কাজের কাজ কিছুই হলো না। গলা তবুও শুকনোই আছে। ঐশী চারপাশটায় একটু চোখ বুলালো। দুপাশে সারি সারি গাছ। অদূরে কয়েকটা মাটির ঘর দেখা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ঝি ঝি পোকার পরিচিত শব্দ কানে আসছে। নিঃসন্দেহে এটা এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ। আর ঐশী ভয়ও পাচ্ছে। ঐশী ভয়কে পাশ কাটিয়ে বিসমিল্লাহ বলে সাইড ব্যাগটা শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করলো। ঢাকা খুব দূরে নয়। সেই আন্দাজ করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো ঐশী।

তিনটা ছেলে হেলেদুলে হাঁটছিলো রাস্তা ধরে। আজ জুয়া খেলে নেশাটা ভালই হয়েছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে। কুচকুচে কালো রঙের ছেলে আকাশ দুলতে দুলতে বললো,

” মামা , আইজ খেললামও। আর গিললামও। এখন একটা মাইয়া পাইয়া গেলে তো রাতটাই ফুরফুরে হইয়া যাইবো। কি কস। ”

সজীব নামের ছেলেটা কোনো উত্তর না দিয়ে মাতাল গলায় গান ধরলো,

” মাই নাম ইজ শীলা , শীলা কি জাবানি।
বাহ। কিয়া জাবানি ! এমন জাবানি ওয়ালা মেয়ে মিলে গেলে তো মামা আমি বড়লোক হইয়া যাইতাম।ভাবতেই শরীর এখনই আনচান করতাছে। ”

দুজন যখন এক পৃথিবীতে মত্ত তখন হঠাৎ লিমন নামের ছেলেটা আঙ্গুল দিয়ে চাঁদের আবছা আলোয় ঐশীকে দেখিয়ে চমক গলায় বললো,

” মামা, ঐটা একটা মাইয়া না ? দেখতো।”

সজীব পিটপিট করে তাকালো। হেলে দুলে বললো,

” দূর বেটা। এহন এত রাইত্রে এহানে মাল আইবো কেমনে ? ”

মুখ দিয়ে বিষয়টাকে তাচ্ছিল্য করলেও আবারও সেদিকে তাকালো সজীব । কি হলো এটা ? সেকি ঠিক দেখলো ? একটা মেয়েই তো !

” হ মামা। মালই ত । ভালো করে চাইয়া দেখ। ”

আকাশের কথায় সজীব আর লিমন একটু নড়েচড়ে দাড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে তাকাল।না। একটা মেয়েই। তারা অবাক হলো। বিস্মিতও হলো। তারা একবারও কল্পনাও করেনি এত রাতে এই যুবতী চাঁদ পেয়ে যাবে।

তিনজন একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেলেদুলে জোরে হাঁটতে লাগলো ঐশীর দিকে।

” এই আফা। আফা গো। ও আফা। দাড়ান একটু। ”

পিছন থেকে বিশ্রী কণ্ঠ শুনে সেদিকে ফিরে তাকালো ঐশী। ছেলে তিনটাকে দেখে থমকে গেলো। এই মাতাল ছেলেপুলে দেখে যা বুঝার বুঝে গেলো ঐশী। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে আবারও সমানে তাকিয়ে জোরে হাঁটা ধরলো। আল্লাহ ! আজ যে আর কত কিছু মোকাবেলা করতে হবে। একদিনে ঐশীর অনেক অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।

” আফা। ও আফা। আইজ যাইবেন আমাগো লগে ? টাকা দিমু। অনেক টাকা। ”

বলে ছেলেগুলো দৌড়ে ঐশীর পিছন পিছন আসতে আসতে লাগলো। ঐশী এবার দৌড় লাগালো। রাগে , ভয়ে রীতিমত কান্না করছে সে। স্পেশাল থেরাপি-টাও নাই। ওই শয়তান মির্জা-টা নিয়ে গেছে। এখন কি হবে ? ঐশী প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। ঐশীর চাওয়া , একবার শেষ রক্ষা হোক। এইবার ঐশী নিজের সম্মান রাখতে সক্ষম হোক।

কিন্তু বিধাতা মনে হয় ঐশীর চাওয়া রক্ষা করতে ইচ্ছুক নন। তাইতো ওই মাতাল ছেলেগুলো ঐশীকে খুব জলদি ধরে ফেললো। সজীব এগিয়ে এসে চোখ বুজে ঐশীর শরীরের ঘ্রাণ নিল। সঙ্গেসঙ্গে ঘৃণায় ঐশীর শরীর রি রি করে উঠলো। ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগলো ও । ছেলেগুলো একে একে ঐশীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ঐশী ওদের এগুতে দেখে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম জপছে আর বারবার বাঁচার জন্যে ছটফট করছে।

” এই ধানিলঙ্কা মেয়েকে তোদের সাথে নিয়ে যা। যা টাকা লাগে আমি তোদের দিব। ”

হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠ শুনে ছেলেগুলো ঐশীর থেকে মনোযোগ ছিন্ন করে পিছন ফিরল। আর ঐশী ? সে তো সেই দুর্বিষহ বাক্য শুনে ভয়ে ক্ষয়। আজই কি তার জীবনের সময়সীমা শেষ ? মজবুত ঐশী আজকের পরই কি দুর্বল হয়ে যাবে ?

#চলবে

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

” যা না। নিয়ে যা ওকে। ”

জুভান ভাবলেশহীনভাবে কথাটা বলে ধীরে ধীরে ছেলেগুলোর দিকে এগুলো। ছেলেগুলো চোখ পিটপিট করে তাকালো জুভানের দিকে। সন্দেহ গলায় বললো,

” তুই এরে বাঁচাইতে আহস নাই ? ”

জুভান জিন্সের পকেটে দুহাত গুঁজে সোজা হয়ে দাড়াল। চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো,

” না। ”

ছেলে তিনটা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে ঐশীর দিকে এগোলো। ঐশী ততক্ষণে চোখ মেলে জুভানের দিকে তাকিয়েছে। এই মির্জা না চলে গিয়েছেন ? আবার আসলেন কখন ? আর এখন এসব কথা শুনে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না এই মির্জা এতটা খারাপ ! ওকে এই মাতাল ছেলেগুলোর হাতে এত সহজে তুলে দিচ্ছে ? ঐশী কঠিন চোখে জুভানের দিকে তাকালো। জুভান ঐশীর চাহনি পাত্তা না দিয়ে শিস বাজিয়ে আবারও সামনে পা বাড়ালো। অদূরে গাড়ি দেখা যাচ্ছে ওর। সেদিকেই যাচ্ছে। ছেলেগুলো ঐশীর বিশ্রী হেসে ঐশীর শরীর থেকে ওড়না নিয়ে নিল। ঐশী থমকে উঠে চোখ বন্ধ করে আবারও ছটফট করতে লাগলো। এতে মনে হয় ওই মাতাল ছেলেপুলে খুব মজা পেলো। বাঁকা হেসে এবার তারা ঐশীর জামায় হাত বাড়ালো। ঐশীর চোখের জল নাকের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আজ কি ওর বাঁচার কোনো উপায় নেই ? ঐশী দূরে তাকিয়ে দেখলো জুভান গাড়িতে উঠে যাচ্ছে।এবার ও জোরে চিৎকার দিয়ে বললো

” গায়ক সাহেব… ”

জুভান ফিরে তাকালো ঐশীর দিকে। ছেলেগুলো ঐশীর চিৎকারে হাত গুটিয়ে নিয়ে জুভানের দিকে তাকালো। জুভান ভ্রু বাকা করে বললো,

” সব জারিজুরি শেষ ? ”

ঐশী অসহায় নজরে তাকালো জুভানের দিকে। জুভান হাসলো। দুনো হাত উচু করে আড়মোড়া ভাঙলো। সঙ্গেসঙ্গে ওর শরীর থেকে ” মরমর” শব্দ ভেসে এলো। জুভান গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে ঐশীর কাছে এসে দাড়ালো। ঐশীকে একটু লক্ষ্য করে আবারও ছেলেগুলোর দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্য করে বললো,

” এতসময়ে জাস্ট ওড়না হাতিয়েছিস ? শেম অন ইউ গাইস ।”

ছেলেগুলো কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। যেনো নিজেদের অক্ষমতায় নিজেরাই লজ্জিত। আর ঐশী ? সে তো শুধু অবাক চোখে জুভানের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা ঘুরছে তার। এই গায়ক সাহেব কে এতটাও খারাপ ভাবে নি ও। জুভান সজীবের হাত থেকে ওড়না টা ফট করে নিয়ে নিল। ওরা এতে বোকার মত জুভানের দিকে তাকালো। জুভান বললো,

” মেয়েটার হাত ছাড়। আর আমার দিকে তাকা। দেখ আমি কিভাবে দু মিনিটে কাজ হাসিল করি। ওকে ? ”

ছেলেগুলো অবুঝ হয়ে মাথা নাড়ালো। জুভান এগিয়ে এসে ঐশীর গায়ে ওড়না জড়িয়ে দিয়ে সরে এলো।

” নাও আই উইল প্লে দা গেম। রেডি গাইস ? ”

ছেলেগুলো যেনো তুমুল উৎসাহ পেলো। সম্মতি জানাতে হুরহুর করে মাথা নাড়ল ওরা। ঐশী এসব দেখে ভরকে গেলো। জলদি মাথা নেড়ে কাদো কাদো গলায় বললো,

” প্লিজ… ”

জুভান শুনে বাঁকা হাসলো। এগিয়ে এসে ঐশীর গায়ের ওড়না নিতে এলে হুট করে হাত ঘুরিয়ে সজীবের নাক বরাবর ঘুষি দিল। আচমকা আক্রমণে সজীব নাকে হাত দিয়ে খানিক পিছিয়ে গেলো। এবার জুভান ধীরে ধীরে নিজের রাগী রূপে এলো। একে একে তিনটাকেই মারতে লাগলো এলোপাতাড়ি। ছেলেগুলো হঠাৎ জুভানের এমন রূপ বদলানো দেখে থতমত খেয়ে গেলো। আকাশ নাকের রক্ত দেখে জুভানের দিকে তেড়ে আসলে জুভান ওর পায়ে লাথি দিয়ে রাস্তায় শুইয়ে দেয়। রাগে কাপতে কাপতে বলে,

” জানোয়ারের বাচ্চা , কুত্তার বাচ্চা , মেয়ে দেখলেই শয়তানি করতে মন চায়। তাইনা ? আজ তোদের সবগুলোর ওই মিশনটাই নষ্ট করে দিবো। কুত্তার বাচ্চা।”

বলেই আবারও এলপাথারি লাথি দিতে থাকে ওই মাতালদের। ঐশী একপাশে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। বেশ ভয় পেয়েছে মেয়েটা।

ছেলেপুলে যখন মাটিতে কাতরাতে ব্যস্ত তখন জুভান ঐশীর দিকে তাকিয়ে কটমট গলায় বললো,

” ঢাকা একা যেতে পারবে তো। ওকে তাহলে। আমি চলে যাচ্ছি। একা একা হেঁটে ছয় কিলোমিটার পাড়ি দিও। যত্তসব পাগলের দল। ”

বলেই জুভান হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। ঐশী যা ভয় পেয়েছে তাতে একা একা যাওয়ার সব শখ মিটে গেছে ওর। তাই চুপচাপ নিজের সাইড ব্যাগ আকড়ে ধরে গাড়ির কাছে এসে দাড়ালো।

জুভান ঐশীকে দেখে কিছু বলল না। এক তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসলো। ঐশী চুপচাপ পিছন সিটে বসে দরজা আটকে দিল।

গাড়ি চলছে। জুভানের রাগ এখনো সপ্তমে চড়ে আছে। তাই তো এক হাত জানালায় রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি শূন্যে ভাসছে। চোখের নজর কঠিন। ঐশী নিজের ওড়নার শেষাংশ ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে। একটু পর ঐশী মনে হলো ওর স্প্রে ত ওই মির্জার কাছে। তাই ও মাথা তুলে জুভানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমার স্প্রে ? ”

জুভান হিংস্র চোখে পিছন ফিরলো। ঐশীর দিকে তাকিয়ে কঠিন সুরে বলল,

” আমার উপর এপ্লাই করার জন্যে ? ”

ঐশী এক ঢোক গিলল। আসলেই তো। যে ওকে এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করেছে তাকেই এখন ঠিকমত ভরসা করতে পারছে না। কেনো ? ঐশী কাচুমাচু গলায় বললো,

” আসলে আমি ইয়ে মানে.. ”

” আমি কোনো মেয়ের সম্মতি ছাড়া তাকে ছুঁয়ে অব্দি দেখিনা। আমি কখনো কাউকে নিজের কাজের কৈফিয়ত দেইনা। কিন্তু আমার সামনে বসে থাকা এক মাথা মোটার জন্যে বলতে বাধ্য হলাম। রিডিকিউলাস । ”

ঐশী সব শুনে উত্তর দিল না। আবারো জানালার দিকে তাকিয়ে তারা গুনতে মগ্ন হয়ে গেলো। জুভান এক উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে মরিচ স্প্রেটা নিয়ে সেটা ঐশীর দিকে বাড়িয়ে বলল,

” নাও। ”

ঐশী জানালার থেকে মুখ সরিয়ে ঝট করে জুভানের হাত থেকে স্প্রে টা নিয়ে নিজের ব্যাগে রেখে দিল।

জুভান অবিশ্বাস্য নয়নে ঐশীর দিকে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। এই মেয়েটা কিসের তৈরি ? খোদা ! এত অবিশ্বাস কোথা থেকে আমদানি হয় !

______________________

ফজরের আজান দিচ্ছে। গাড়ি জুভানের বাড়ির সামনে এসে থামল। জুভান গাড়ি থেকে নামতে নামতে ড্রাইভারকে বললো,

” চাচা , আপনি এই মেয়েকে সেফলি ওর বাসায় পৌছে দিয়েন। ”

বলেই ঐশীর দিকে ফিরল। ঐশী ততক্ষণে ঘুমে কাহিল। জুভানের রাগ লাগলো। সারারাত ওকে এত চিন্তায় ফেলে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমানো হচ্ছে ! জুভান গাড়ির সিট থেকে পানির বোতল নিয়ে এক আজলা পানি ছিটিয়ে দিল ঐশীর চোখে মুখে। ঐশী ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসলো। আদো আদো চোখে তাকালো জুভানের দিকে। জুভান হাত ঘড়ি দেখতে দেখতে বললো,

” অ্যাড্রেস বলো তোমার। ড্রাইভার চাচা পৌঁছে দিবেন। ”

ঐশী কি বলবে এখন ? কোনো উত্তর যে নাই ওর কাছে। ঐশী কাচুমাচু গলায় বলল,

” আ.আমার ঢাকায় কোনো ঠিকানা নেই। ”

” হোয়াট ? ”

জুভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো।

#চলবে…

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

অ্যাড্রেস বলো তোমার। ড্রাইভার চাচা পৌঁছে দিবেন। ”

ঐশী কি বলবে এখন ? কোনো উত্তর যে নাই ওর কাছে। ঐশী কাচুমাচু গলায় বলল,

” আ.আমার ঢাকায় কোনো ঠিকানা নেই। ”

” হোয়াট ? ”

জুভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো। ঐশী দুনো চোখ বেটে নিয়ে দুঃখ পেলো। বুক চিরে এক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাতাসও সেই নিঃশ্বাসে মিশে গিয়ে উষ্ণ হলো। ঐশী বলল,

” আমার কোনো ঠিকানা নেই। যেকোনো একটা বাসা খুঁজতে হবে এই শহরে। তারপর সেখানেই বাস। যতদিন না বাবা ফিরে আসতে বলে। ”

জুভান ভ্রুকুটি করে তাকালো ঐশীর দিকে। পাগল এই মেয়ে? কিসব বলছে ? জুভান বললো,

” এখন তো মাত্র ভোর সকাল। এখন একা রাস্তায় বের হওয়া মুশকিল। আপাতত আমার বাসায় চলো। পরে না হয় দুপুর হলে বাসা খুঁজতে বের হয়ে যাবে। ”

ঐশী ভাবলো। ওর ভয় এখনো কাটেনি। জুভানের চরিত্রের ব্যাপারে এখনো ওর ঢের সন্দেহ। ঐশী মিনমিনিয়ে বললো,

” আসলে আমি একা ..আপনি.. ”

জুভান ঐশীকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো,

” ওকে ফাইন। গাড়ি থেকে বের হও। বের হও বলছি। শালা তোমাদের মত মেয়েদের হেল্প করাটাই ভুল। একটা কথার একশোটা মিনিং বের করো। দরকার নেই হেল্পের। বের হও গাড়ি থেকে। ”

ঐশী চোখ সূক্ষ্ম করে তাকালো জুভানের দিকে। কি করবে ভেবে না পেয়ে সেই অবাঞ্ছিত কাজকেই সায় দিল। গাড়ি থেকে বের হয়ে চুপচাপ জুভানের বিশাল বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। জুভান হতবাক হলো। একদফা বিস্ময় নিয়ে তাকালো সেদিকে। সোজা কাজকে এভাবে বাঁকিয়ে করাটাই কি মেয়েদের কাজ ? কই ? আরো ত মেয়ে দেখেছে। ওরা তো এমন নয়। বরং জুভানের কাছে , আশেপাশে পড়ে থাকার জন্যে মরিয়া। জুভান মাথা নিচু করে গুটিকয়েক লম্বা নিঃশ্বাস নিল। মাথা শীতল করার চেষ্টা করলো। সফল হতেই ড্রাইভারকে লাগেজ আনার কথা বলে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো।

হল রুমে সাইড ব্যাগ আঁকড়ে ধরে দাড়িয়ে আছে ঐশী। মনটা আকুপাকু করছে। ঠিক করলো তো ? ছেলেটা সুবিধার না। আবার অবিশ্বাস করার মতোও না। উফফ। মাথা ধরে যাচ্ছে।

” ছয়টা রুম আছে। তাই তুমি উপরের ডান পাশের একদম কর্নারের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ”

জুভানের কথা শুনে ঐশী মাথা নাড়ল। হটাৎ কিছু মনে পড়ায় ঐশী বলে উঠলো,

” আপনার রুম কোনটা ? ”

জুভান ক্যাপ খুলতে খুলতে বললো,

” বাম পাশের একেবারে কর্নারে। তাই অযথা চিন্তা না করে রুমে যাও। খামোকা ঘরে দুর্গন্ধ ছড়িও না। ”

ঐশী শুনে ভ্রু কুচকে ফেললো। মাথা ঘুরিয়ে জুভানের দিকে তাকালো। থমথমে গলায় বললো,

” দুর্গন্ধ বলতে ? ”

জুভান এগিয়ে এসে সোফায় আরামসে গা এলিয়ে দিল। পা দুটো মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে বললো,

” সারারাত জার্নি করে তোমার শরীরের গন্ধ ধরেছে। আর সেই গন্ধে সম্পূর্ণ ঘর মৌ মৌ করছে। কেনো ? নাকে আসছে না তোমার ? ”

ঐশীর তেজ লাগলো। অপমান ! অপমান ! ঐশী দাঁত কামড়ে ধরলো। আকাশসম রাগ নিয়ে দাঁত চেপে বললো,

” আমার শরীরের দুর্গন্ধ ? আপনি কি তাহলে ? আপনার শরীরের সুগন্ধে তো আর বেঁচে থাকা যাচ্ছে না। ”

জুভান কৃত্রিম অবাক হয়ে বললো,

” আমার চুল থেকে মাথা অব্দি পারফিউম দেওয়া। তোমার মত গন্ধ নেই আমার শরীরে। এখন কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে যাও। ”

ঐশী আর কথা বাড়ালো না। এই লোকের সাথে কখনোই পেরে উঠবে না সে। তাই অযথা চেষ্টা না করে পা বাড়লো সিড়ির দিকে। হটাৎ জুভান ডেকে উঠলো,

” হেই … ”

ঐশী সিঁড়ির হাতল ধরে পিছন ফিরে তাকালো। জুভান এক আঙ্গুল উচিয়ে বললো,

” শুধু আজ সকালটা থাকতে দিয়েছি। দুপুর হলেই বিদায় হবে। মনে থাকে যেন। ”

ঐশী নিজের প্রবল আত্মসম্মানের জোরে বললো,

” দুপুর লাগবে না। আমি দুপুর হওয়ার আগেই চলে যাবো। ”

জুভান প্রত্যুত্তর না করে সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজে নিল। ঐশী গটগট পা ফেলে জুভানের দেখানো রুমে চলে গেল।

______________________

আকাশ রঙের জামা গায়ে ঐশী বসে আছে বিছানায়। ভিজে চুল , ঈষৎ লাল নাক এবং কাপা ঠোঁট ওর। ফোন হাতে নিয়ে অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে ওর বাবাকে। মায়ের ফোনেও দিয়েছে। কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। ঐশীর অভিমান হলো। এই প্রথম নিজের পরিবারের উপর জোরদার অভিমান হলো ঐশীর। অভিমানের দহনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে ফোনটা বিছানার দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। মৃদু কাঁপছে ওর শরীর। ও কোন কোন পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছে এই একটা দিন, কেউ খোঁজ নেয়নি। একবারও না। এই তাদের মায়া , আদর ? একটা জোয়ান মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তারপর একবারও ফোন দিয়ে খোঁজও নেয়নি। কেমন পরিবার ! ঐশীর কান্না পাচ্ছে। দুনিয়ার সবকিছু তুচ্ছ করে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। মন চাইছে ছুটে চলে যেতে নিজের পরিবারের কাছে। কিন্তু বাবার কসম ! সেটা কি করে ও অগ্রাহ্য করবে।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ এলো। ঐশী চোখ মুখ মুছে নিয়ে দরজা খুলে দিল। একজন সার্ভেন্ট দাড়িয়ে মাথা নিচু করে সাধারণ ভাবে বললো,

” ম্যাম , স্যার নাস্তা খাওয়ার জন্যে ডেকেছেন আপনাকে। কাইন্ডলি নিচে আসবেন ? ”

ঐশী মাথা নাড়ল। বিছানার উপর রাখা বন্ধ ফোনের দিকে বিদ্ধস্ত চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে জুভান বসে আছে । হাতে আই ফোনের লেটেস্ট ভার্সন। ফোনের স্ক্রিনে উপর আঙুল বিরামহীন চলছে। ঐশী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চুপচাপ একটা চেয়ারে এসে বসলো। সার্ভেন্ট ওদের দুজনকে নাস্তা এগিয়ে দিল। ঐশী আনমনে পরোটা ছিঁড়ছে আর এমনেই মুখে পুড়ে নিচ্ছে। ধ্যান – ধারণা সব ওর পরিবারের কাছে পড়ে আছে। জুভান খেতে খেতে ঐশীর দিকে একবার লক্ষ করল। ঐশী ঝাল ফ্রাই পরোটায় না লাগিয়েই এমনেই খাচ্ছে। জুভান একবার দেখে আবার নাস্তায় মনোযোগ দিল। কারণ তার এসবে কিছু যায় আসে না। হটাত সার্ভেন্ট ঐশীকে ডাক দিল,

” ম্যাম , ম্যাম … ”

ঐশী ধ্যান ভেঙে হুড়মুড়িয়ে তাকালো সার্ভেন্টের দিকে। সার্ভেন্ট নমনীয় গলায় বলল

” ম্যাম , নাস্তা ভালো লাগেনি ? ”

ঐশী মাথা নাড়ল। বললো,

” না। ভালো হয়েছে। ”

” তাহলে আপনি আপনার প্লেটের ঝাল ফ্রাই নিচ্ছেন না কেনো ? এমনি পরোটা খেলে ত গ্যাস্টিক হবে। ”

ঐশী মুখ ভার করে মাথা নেড়ে ঝাল ফ্রাই দিয়ে পরোটা খেতে লাগলো।

” আবারো দেশের একজন স্বনামধন্য পুলিশ অফিসার আশরাফুল হাবিব সপরিবারে নিহত হয়েছেন। ”

নাস্তা খাওয়ার মধ্যে হঠাৎ এমন অবিশ্বাস্য খবর শুনে ঐশী থমকে গেলো। খাবার খাওয়ার মাঝপথে হাত আটকে গেলো। শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলো। জলদি বাসি হাত নিয়ে টিভির সামনে এসে দাড়ালো। পাগলের মত রিমোট হাতে নিয়ে সাউন্ড একেবারে হাই করে দিলো। রিপোর্টার বলছে,

” আশরাফুল হাবিব একজন সৎ পুলিশ অফিসার ছিলেন। দেশে বিদেশে তার কাজ প্রশংসাযোগ্য। এই বিশিষ্ট পুলিশ কাল রাতে নিজ গৃহে আগুনে পুড়ে সপরিবারে নিহত হয়েছেন। জানা গেছে…”

ঐশী কি ভুল শুনছে ? আর শুনার ক্ষমতা হলো না ঐশীর। সেখানেই মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো। চোখ বুজতে বুজতে একটাই কামনা ছিল তার,

” এই নিষ্ঠুর খবরটা মিথ্যা হোক। তার রাজা বাবা আবারও তাকে প্রিন্সেস ডাকুক। শুধু একবার মা তাকে বকে দিক। ”

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here