ইচ্ছের_উল্টোপিঠ #পর্ব_৯,১০,১১

0
550

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৯,১০,১১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
০৯

” এই নিষ্ঠুর খবরটা মিথ্যা হোক। তার রাজা বাবা আবারও তাকে প্রিন্সেস ডাকুক। শুধু একবার মা তাকে বকে দিক। ”

জুভান নাস্তা করায় মগ্ন ছিল। ঐশীর আর্তচিৎকার কানে ভেসে আসতেই জুভান তাৎক্ষণিক ঐশীর দিকে তাকায়। ঐশীকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে সে কিছুটা ভরকে যায়। চটজলদি চেয়ার থেকে উঠে ঐশীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। ঐশীর দদুনো গাল হাতের মুঠোয় নিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে,

” এই ঐশী। ঐশী ? কি হলো। ঐশী ? ”

ঐশী নিরুত্তর। দুনো চোখ বুজে রাখা। চোখের নিচ বেয়ে একটা লম্বা দাগ এসে থুতনিতে ঠেকেছে। অতিরিক্ত অশ্রু ব্যয় করার ফলস্বরূপ। জুভান ঐশীর অবস্থা বেগতিক দেখে চটজলদি সার্ভেন্ট কে পানি আনতে বলে।

” আশরাফুল হাবিব এবং তার স্ত্রীর মুখ সম্পূর্ণ ঝলসে গেছে তাই তাদের চিন্তিত করতে পুলিশ তদন্ত স্বরূপ ডিএনএ টেস্ট করিয়েছে। সেই টেস্ট থেকে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারছি যে এই দুটি দেহ আশরাফুল হাবিব এবং তার স্ত্রীর। বিস্তারিত জানতে … ”

জুভান ভ্রু কুঞ্চিত করে বৃহদাকার টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। আবারো আগুনে পুড়ে যাওয়ার খবর ? একটা কিভাবে যে মানুষ এত অসচেতন হয় ? একটু খেয়াল রাখলে ত আর এভাবে পরিবারসহ পুড়তে হতো না। জুভান এক নিঃশ্বাস ফেললো। ভারী নিঃশ্বাস। সেই নিঃশ্বাসে মিশে আছে কতশত আফসোস , হাজারো অপ্রাপ্তি।

সার্ভেন্ট জগে করে পানি আনলে জুভান তরিগরি করে সেই পানি দুহাতের আজলায় নিয়ে ছিটিয়ে দেয় ঐশীর চোখে মুখে। তবে ঐশী অনুভূতিহীন। জুভান বিরক্ত হয়। জ্ঞান হারানোর আর সময় পেলো না ? জুভান আবারও পানি ছিটিয়ে দেয়। এবারও ঐশী জাগে না। জুভান শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে ঐশীকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নেয়। জুভানের এতে একটু অসস্তি হয়। তবে কোনো উপায় যে নেই। ঐশীর হাত মাটির দিকে অনুভূতিহীন ঝুলে আছে। জুভান একবার ঐশীর দিকে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। হন্তদন্ত হয়ে ঐশীকে গাড়িতে তুলে ড্রাইভারকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে যেতে বললো।

_____________________

ঐশীর হাতে স্যালাইন লাগানো। অনুভূতিহিন বেডের এক অংশ জুড়ে শুয়ে আছে। চোখ গুলো থেকে মাঝেমধ্যে টিপটিপ পানি গড়িয়ে পড়ছে। গালে , গাল থেকে বালিশ। অজ্ঞান অবস্থায় কি কাদছে মেয়েটা ? এত কষ্ট কিসের এই ছোট্ট মেয়ের ? কি নেই ওর কাছে ? একটা পরিবার আছে ? জীবনের সবটুকু সময় আগলে রাখার জন্যে একজন বাবা আছেন। তাহলে ? কিসের কষ্ট ? কিসের অপ্রাপ্তি ? জুভান সোফায় বসে ফোন হাতে নিয়ে ঐশীর দিকে তাকিয়ে আছে।

ঐশীর চোখের ভিজে পাপড়ি হালকা যেনো নড়ে উঠলো। তবে কি ঐশীর জ্ঞান ফিরছে ? ঐশী দীর্ঘসময় বুজে রাখা চোখ দুটো একটু একটু করে মেলছে। একটা সময় ঐশী সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকালো। ক্লান্ত দুচোখ যেন হাজারো কথা বলছে। চোখের নিচটায় লম্বাটে দাগ যেনো চিৎকার করে বলছে , ” শুনছো পৃথিবী , আমি একেবারে অসহায় হয়ে গেছি। এই নিষ্ঠুর মৃত্যু আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। সারাদিন বকে যাওয়া মা-টাকেও কেড়ে নিয়েছে। শুনছো মৃত্যু , তুমি সফল হয়েছে। একটা সন্তানের আর্তনাদ শোনার ইচ্ছে তোমার পূর্ণ হলো। এবার খুশী তো তুমি ? ”

ঐশী অনুভূতিহীন তাকিয়ে আছে মাথার উপর ঝুঁকে থাকা ফ্যানটার দিকে। হাতের রগে বহমান চঞ্চল লাল – নীল ব্যাথাটা যেনো তুচ্ছ ওর কাছে। ঐশীর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র অশ্রুর ফোঁটা।

জুভান ঐশীর জ্ঞান ফিরতে দেখে সোফা থেকে উঠে ঐশীর কাছে চেয়ার টেনে বসলো। ঐশীর দিকে তাকিয়ে দু চারটা কড়া কথা শুনাতে গেলে দু চোখে অশ্রুর ফোঁটা দেখে দমে গেল। এক ঢোক গিলে নিজের রাগকে সামলানোর চেষ্টা করে ঐশীর দিকে তাকালো। নরম কণ্ঠে নাম নিল,

” ঐশী … ”

ঐশী ঘাড় ঘুরিয়ে জুভানের দিকে তাকালো। শুষ্ক ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বললো,

” দু. দু.দুপুর হয়ে গে.গেছে। আ. আ.আমি চলে যাবো। আর ক. কষ্ট করতে হবে না আ.আ.আপনার। ”

জুভান ঠোঁট মেলে মলিন হাসলো। ফোনটা অন করে একবার চোখ বুলিয়ে আবারও ঐশীর দিকে তাকাল। বললো,

” ১১টা বাজে। দুটো বাজে নি। তাই এখনো দুপুর হয়নি। চিন্তা নেই। ”

ঐশী উত্তর দিলো না। কোনো অনুভূতিও প্রকাশ করলো না। বরং চুপচাপ ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও ঘূর্ণায়মান ফ্যান এর দিকে তাকাল। ওর জনম দুঃখিনী চোখ জোড়ায় এই সাদা রঙের ধুলোবালি জমা ফ্যানটাই যেনো পৃথিবীর নবম আশ্চর্য।

জুভান এক উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলল। পেটের মধ্যে এতক্ষণ ধরে জমে থাকা প্রশ্ন গুলো দলা বেধে বললো,

” কি হয়েছিল তোমার ? অজ্ঞান হলে কেনো ? ভয় পেয়েছো কিছু দেখে ? আমাকে বলো। কি হয়েছে ? ”

ঐশীর দুচোখ জোরালো ভাবে বন্ধ করলো। সঙ্গেসঙ্গে দু চোখের কর্নার থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা মুক্ত অশ্রু। ঐশী গুটিকয়েক ঢোক গিলে বললো,

” বা. বা.বা.বাবা , ম.ম.মা মা.মারা গেছেন। ”

জুভান থমকে গেলো। কপালের ভাঁজগুলো খুলে সোজা হয়ে গেলো। এক দফা বিস্ময় নিয়ে বলল,

” মানে ? কিভাবে ? কখন ? ”

ঐশী দু চোখ বুজে কয়েকটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় গলায় জ্বালা ধরলো। তপ্ত হলো দু চোখ। ঐশী শীতল গলায় বললো,

” আ. আ.আগুনে পুড়ে। ”

জুভান এবারও স্তব্দ হয়ে গেলো। সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক বললো , টিভিতে দেখানো সেই পরিবার কি … ”
জুভান ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলো,

” আজ একটু আগে টিভিতে …. ”

ঐশী কথার পিঠে হ্যা বোধক মাথা নাড়ল। জুভান সব শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কাউকে কোনোদিন সান্ত্বনা দেয়নি ও। কিন্তু আজ মনে হলো , এই মেয়েকে সামলানোর জন্যে সান্তনা দেওয়া টা খুব জরুরি। কিন্তু সে তো পারেনা। তবে কি তার সান্ত্বনা দেওয়াটা শিখে নেওয়া উচিত ছিল ? জুভান ব্যর্থতার নিঃশ্বাস নিল।

” মিস্টার মির্জা ? ”

ডাক্তারের কণ্ঠ শুনে জুভান ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। জুভান চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে ডাক্তারকে ভিতরে আসতে বললো। বয়স্ক ডাক্তার গম্ভীর মুখে ভিতরে প্রবেশ করলেন। ডাক্তার ঐশীলে পর্যবেক্ষণ করে জুভানের দিকে তাকালেন। বললেন,

” মিস্টার মির্জা । রোগীর জ্ঞান ফিরেছে মানে এখন উনি বিপদমুক্ত। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবেন খুব বেশি মানুষিক চাপের কারণেই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। তাই নেক্সট টাইম যাতে কোনোরূপ প্রেসার উনার উপরে না পড়ে। আর আমি এখন কতকটা ঔষুধ প্রেসক্রাইব করে দিচ্ছি। মেডিসিন গুলো ঠিকমতো যাতে নেওয়া হয়। ”

জুভান মাথা নাড়ল।

____________________

বিকেল হয়ে গেছে। জুভান হাসপাতালের ফার্মেসিতে এসেছিল ঔষুধ নিতে। হুট করে একজন নার্স হন্তদন্ত হয়ে জুভানের কাছ আসলো। জুভান নার্সের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই নার্স হাপাতে হাপাতে বললো,

” আপনার রোগী সুইসাইড করেছেন। ”

#চলবে

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

জুভান নার্সের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই নার্স হাপাতে হাপাতে বললো,

” আপনার রোগী সুইসাইড করেছেন। ”

বাক্যটা বাতাসে মিশে জুভানের কানে যেতেই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। ঔষধ ডেস্কের উপর রেখেই এক দৌড়ে ঐশীর কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। দুই তলায় আসতেই একজন মেয়ে ওকে দেখে চটজলদি এসে ঘিরে ধরলো। জুভান বিরক্ত হলো। রাগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেয়েটা চমক গলায় বললো,

“ও মাই গড। ও মাই গড। জুভান ? আপনি ? এই হসপিটালে ? আমি কি সত্য দেখছি । আর ইউ হেয়ার ? ”

জুভান ভ্রু কুচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আধুনিকা মেয়েটা জুভানের পথ আগলে দাড়ায়। জুভানের রাগ লাগে। আশপাশে তাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে ও। জুভান শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো,

” ক্যান আই গো ? আই অ্যাম বিজি নাও। ”

মেয়েটা কি শুনলো ওর কথা ? লাফাতে লাফাতে নিজের ব্যয়বহুল ব্যাগ থেকে একটা ছোট নোটবুক বের করে জুভানের দিকে এগিয়ে বললো,

” প্লিজ ওয়ান অটোগ্রাফ ? প্লিজ প্লিজ প্লিজ। জাস্ট ওয়ান অটোগ্রাফ।প্লিজ । ”

জুভান মেয়েটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবারও ফর্সা হাতে ধরে রাখা নোটবুক টার দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে নোটবুক টা হাতে নিয়ে বাম হাত দিয়ে কলম ধরলো। কলমের খসখস আওয়াজ তুলে লিখলো কিছু একটা। শেষ হতেই নোটবুক টা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে একপ্রকার জোর করেই পাশ কাটিয়ে ঐশীর কেবিনের দিকে পা বাড়ালো।

অনিন্দিতা নামক মেয়েটা জুভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ” হাইই ” বলে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। নোটবুক টা কিছুক্ষন বুকে চেপে ধরে আবার চোখের সামনে ধরলো। এক সমুদ্র আবেগ নিয়ে নোটবুক টা খুলে দেখল। গুটি গুটি অক্ষরে লেখা সেখানে,

” কমনসেন্স ব্যাক্তিভেদে পরিবর্তন হয়। কালো , সাধারণ মেয়ের মধ্যে সেই গুন অনেকসময় জ্বলজ্বল করতে থাকে। আবার অনেক সাদা চামড়ার , আধুনিক মনে এই গুন বড়ই দুর্লভ। আফসোস ! কেউ সেটা বুঝতে পারে না। ”

মেয়েটা লেখাটা পড়ে ভ্রু কুচকে ফেললো। বাক্যটা যে তাকেই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একটু আগে আবেগের জোয়ারে ভেসে যাওয়া মেয়েটার চোখ মুখ রাগে তেজস্বী হয়ে আছে। বুক ভরা নিঃসৃত হতে লাগলো এক সমুদ্র আক্ষেপ। আসলেই তো। আফসোস ! আফসোস !

_________________________

জুভান জলদি ঐশীর কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। ঐশী কে দুজন নার্স ধরে রেখেছে। আর ও বারবার মাথার চুল শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে। চুল ছিঁড়ে ফেলার অদম্য ইচ্ছে যেনো। বাম হাত থেকে রক্তের ফোঁটা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে হসপিটালের সাদা রঙের মাটিতে। ঐশীর জামায় ছোট ছোট রক্তের দাগ। ঐশী পাগলের মত বিলাপ করছে,

” আমি , আমি… এই তোমরা ধরে রেখেছ কেনো আমায় ? হ্যা ? ছাড়ো বলছি। বাবা কষ্ট পাচ্ছে ত। মা ? মাও ত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের মেয়ে তাদের কাছে নেই। না । আমাকে যেতে হবে। এক্ষুনি যেতে হবে। ছাড়ো বলছি। ছাড়ো আমায়। ছাড়ো। ”

জুভান ঐশীর কান্না শুনে এগিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে বসলো ঐশীর কাছে। ঐশী জুভানকে দেখে ওর শার্টের কলার আকড়ে ধরলো শক্ত করে। জুভান একবার ঐশীর কলার ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে আবারও ঐশীর দিকে তাকালো। ঐশী প্রবল জেদ দেখিয়ে বললো,

” ওরা কেনো ছেড়ে দিচ্ছে না আমায়। আমি বলেছি একবার আমি মারা যেতে চাই। আমার বাবা একা আছে না ? খুঁজবে তো আমায়। খুঁজবে না বলুন। ”

জুভান ঐশীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল,

” শান্ত হও ঐশী। শান্ত হও। ওকে। রিলাক্স। রিলাক্স। ”

শরীর দুর্বল থাকায় একসময় ঐশী জুভানের কাধে লুটিয়ে পড়লো। আবারো জ্ঞান হারিয়েছে ও। ঐশীর মুখ জুভানের কাঁধ স্পর্শ করার জুভান একটু অসস্তি বোধ করলো। জোরে এক হাফ ছেড়ে দিয়ে নার্স এর দিকে তাকালো। দুজন ঐশীকে ধরে এনে বেড়ে শুইয়ে দিল। জুভান এগিয়ে গিয়ে ঐশীর পাশে চেয়ার টেনে বসলো। চোখ গেলো বাম হাতের কাটা জায়গার দিকে। খুব ধারালো ছুরি দিয়ে কাঁটা হয়েছে রগ। জুভান লম্বা এক নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলালো। কি এক ঝামেলার পাল্লায় পড়েছে ও। কাল থেকে এই মেয়ে একটার পর একটা বিপদ খাড়া করেই যাচ্ছে। করেই যাচ্ছে। নার্স দুটো হাতের রক্ত পরিষ্কার করে ডাক্তার ডাকলো। একটুপর ডাক্তার এসে ঐশীকে পর্যবেক্ষণ করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। জুভানের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

” মিস্টার মির্জা, রোগী আপনার কে হয় ? ”

জুভান আঙ্গুল দিয়ে কপাল চুলকালো। কপাল ভাজ করে বললো,

” কেউ না। ”

ডাক্তার সামান্য হেসে বললেন,

” আপনি এত বড় একজন সেলিব্রেটি। তাই অপরিচিত কাউকে হেল্প করা কেমন যেনো অদ্ভুত শুনালো। ”

জুভান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

” রাস্তায় দেখা হয়েছিল। হেল্প দরকার ছিল। তাই হেল্প করেছি। এর বেশি কিছু না। ”

” ওকে। তাহলে এই হেল্প টা আরো কিছুদিন বজায় রাখেন। কারণ রোগী এখন মেন্টালি খুব ডিপ্রেশনে আছেন। আজ এত গার্ডের ভিতরে সুইসাইড করতে পেরেছেন।আজ একটুর জন্যে রগ কাটেনি উনার। তবে তার মানে হার লাইফ ইজ ইন ডেনজার। আবারো তিনি সুইসাইড এটেম্প করতে পারেন। তাই একটু চোখে চোখে রাখবেন। ”

জুভান মাথা নেড়ে হ্যা বোধক সম্মতি দিল।

ডাক্তার চলে গেলে জুভান আবারও ঐশীর পাশে চেয়ার টেনে বসল। আশপাশটায় তাকিয়ে আবারও ঐশীর দিকে চোখ ফিরালো। একদিনেই মেয়েটা কেমন মিহিয়ে গেছে। জুভান ভাবলো। ভাবলো অতীতের নানা জল্পনা কল্পনার কথা। কিন্তু এই ভাবার কি শেষ আছে ?

_____________________

ঐশীর রিলিজ ডেট আজ। প্রায় দেড় দিন পর। ঐশীর মাথা থেকে সুইসাইডের ভুত নামলেও কেমন যেনো গম্ভীর হয়ে গেছে মুখখানা। চঞ্চল ঠোঁটে হাসি নেই , প্রগাঢ় অনুভূতি নেই। বেচে থেকেও কেমন যেনো নির্জীব হয়ে গেছে মেয়েটা। জুভান ঐশীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

গাড়ি চলমান। দুপাশে শহরের কৃত্রিমতা নজর কাড়ছে। ঐশী জানালার দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। চোখ জোড়া ভেঙে কান্না আসছে। আজই ফিরে যাবে ও নিজের বাড়িতে। আসলে কি হয়েছিল জানার এখন প্রবল ইচ্ছে তার মনে। জুভান গাড়ি চালাতে চালাতে আরো একবার ঐশীর দিকে তাকালো। হটাৎ ঐশী মুখ ঘুরিয়ে জুভানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমি তো প্রায় দুই দিন আপনার কাছে ছিলাম। এত অনুগ্রহ করার জন্যে কৃতজ্ঞ আমি। এখন আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিন। বিকেল হয়ে গেছে। বাসা খুঁজে নিতে পারবো আমি। আপনার আর কষ্ট করতে হবে না। ”

জুভান ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে কপাল চুলকালো। অতঃপর বললো,

” উহু। দুইদিন হয়নি এখনো। দেড় দিন হয়েছে। আমার শর্ত মানো নি তুমি। ”

ঐশী মুখ ভার করলো। চোখ বেটে নিয়ে আবারও জানালার দিকে তাকাল। বললো,

” সরি। আমি নিজের মাঝে ছিলাম না। তাই শর্তের কথা মাথায় ছিল না। ”

জুভান বাকা হাসলো। ভ্রু আঁকাবাঁকা করে ঐশীর দিকে তাকালো।বললো,

” যেহেতু শর্ত মানো নি। সেজন্যে শাস্তি ত প্রাপ্য তোমার।কি বলো ? ”

ঐশী চমকে তাকালো জুভানের দিকে। জুভান বাকা হেসে ড্রাইভ করছে। ঐশী ভাবলো , কি শাস্তি দিবে এই মির্জা ?

#চলবে…

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

সময়ের কাটা ছয়টা ছুঁই ছুঁই। সন্ধ্যার প্রহর আঁকড়ে ধরেছে ওই বিশাল আকাশটাকে। আবছা নীল আকাশটা নিংড়ে বেরিয়ে আসছে ঝুড়ি ঝুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা। মাটিতে সেই ফোঁটা গুলো ঝরে পড়তেই অদ্ভুত সুরে বেজে উঠছে , ” টিপটপ” “টিপটপ “। ঐশীর সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক এই দৃশ্য দেখে ভাবছে ” প্রকৃতি এত সুন্দর কেনো ? এই যে এসব দেখে ঐশীর মনের কালো মেঘ গুলো সরে সেখানে জায়গা করে নিল রঙিন প্রজাপতি। একটা , দুটো অতঃপর অসংখ্য। আফসোস ! ঐশী কেনো ওই নীলাভ প্রকৃতি হলো না। তাহলে সেও হতো তার মতো আমরণ অমায়িক।

দীর্ঘক্ষণ জ্যামে আটকা আছে ওরা। ঐশীর ধ্যান ভাঙলো জানালার পাশ থেকে ভেসে আসা এক ভিক্ষুকের কণ্ঠ শুনে। একজন অর্ধ অন্ধ বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছেন জানালার পাশে। তার হাতে একটা দড়ি। সেই দড়ি বেঁধে রেখেছে একটা ভাঙ্গা চেয়ারের টুকরো। সেই ভাঙ্গা চেয়ারে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ পাগল মহিলা। ঐশী উনাদের দেখে ভারি অবাক হলো। ভিজে জানালা খুলে দিয়ে ওদের দিকে এক দফা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। বৃদ্ধ লোক বললেন,

” মা , একটা পয়সা দিবেন। হেতির ঔষধ কিনতে অইবো। দেন না , মা। আল্লাহ আপনারে রাজরানী করে রাখবো। দেন একটা পয়সা। ”

ঐশীর চোখ ভরে উঠলো বৃদ্ধ লোকের মুখে মা ডাক শুনে। মনে পড়লো বাবা – মায়ের সাথে কাটানো শত – সহস্র স্মৃতির কথা। ও বৃদ্ধ মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” ইনি আপনার কে হয় , দাদু ? ”

বৃদ্ধ লোক ফোকলা দাঁতে হাসলো। সেই হাসিতে ঝিলিক দিল একজন তরুণ প্রেমিক পুরুষ। ঐশী তাকালো। খুব অবাক চোখে চেয়ে রইলো সেই হাসির দিকে। লোকটা বললো,

” হেতি আমার বউ হয়রে মা। আমার ফাছ(পাঁচ) টা চাবাল(সন্তান) হইসিলো। হেতে সব মইরা গেছে। হের লাইগা হেতিরে ফাগলা(পাগল) রোগে ধরছে। ”

ঐশী মুগ্ধতা নিয়ে তাকালো মহিলার দিকে। জুভান এরমধ্যে এসে উকি দিল ঐশীর দিকের জানালায়। বললো,

” তাহলে আপনি উনাকে ছেড়ে দেন। উনাকে ক্যারি আই মিন বহন করে আপনার লাভ কি ? কষ্ট হয়না ? ”

ঐশী খানিক চকিতে তাকালো জুভানের দিকে। পাগল হয়েছে ? বলে কী এই ছেলে ? বৃদ্ধ লোকটা আবারও ফোকলা দাঁতে হাসেন। খানিক দুঃখ গলায় বললো,

” কি যে কন ? আমি ওরে কেন ছাইড়া দিমু। আইজ যদি আমি বেমার (অসুস্থ) হইতাম। তাহলে ঐ কি আমারে ছাইড়া দিবার পারতো ? বড্ড ভালাপাই(ভালোবাসি) ওরে আমি। ছারমু কেন ? ”

জুভান বিরক্ত হলো এই আবেগ পূর্ণ কথায়। কোনো প্রত্যুত্তর না করে আবারও সিটে গা এলিয়ে দিল। প্রহর গুনলো ঢাকার এই বিরক্তিকর জ্যাম ছাড়ার।

ঐশী মুগ্ধ হয়ে সাইড ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে বৃদ্ধ লোকটার হাতে দিল। লোকটা নোটটার দিকে চেয়ে রইল খানিক। দু চোখ ভরা কৃতজ্ঞতা তার। অতঃপর বিড়বিড় করে কি যেন পরে ঐশীর মুখে ফু দিয়ে বললো,

” আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক ,মা। স্বামী সোহাগী হও , মা। রাজরানী হইয়া থাহো সারা জীবন। ”

ঐশী মাথা নুইয়ে হাসলো। সেই হাসি প্রতিধ্বনিত হলো বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় ফোঁটায়। এক সমুদ্র খুশি ছড়ালো ওই কালো মেঘের আকাশে।

গাড়ি চলছে আপন পথে। ব্যস্ত শহর ছুটে যাচ্ছে নিজ নিজ গতিতে। ঐশী জানালার দিকে তাকিয়ে ছাড়ছে রাশি রাশি অপ্রাপ্তির নিঃশ্বাস। জুভান গাড়ি চালাতে চালাতে আরো একবার তাকালো ঐশীর দিকে। আচমকা জুভান বললো,

” দাদুটা কি বোকা, না ? এখনো এসব লাভ নিয়ে পড়ে আছে। কি ক্রিঞ্জ ব্যাপার স্যাপার। ! ”

ঐশী ফিরলো জুভানের দিকে। চোখে মুখে উদ্বেগ নিয়ে বললো,

” লাভ ক্রিঞ্জ ! ”

” হ্যাঁ। তাইতো। শুনো , এসব লাভ সাভ হলো জাস্ট লেম। এসব আবার ভাবার কিছু ? এসব জাস্ট রিডিকিউলাস। ”

ঐশী থমকালো। জুভানের আত্মবিশ্বাসী নয়ন দুটোয় তাকিয়ে অবাক হলো। আবার তাকালো রাস্তার দিকে। দূর দৃষ্টি দিল ঐ পিচ ঢালা রাস্তায়। আবেগ গলায় বললো,

” না। লাভ ক্রিঞ্জ না। লাভ যদি ক্রিঞ্জ হয় তাহলে সত্য নামক জিনিসটাও তাহলে সেই কাতারেই পড়ে। লাভ ইজ লাইক এ ম্যাজিক। যাকে একবার ছুঁয়ে দেয় তার সম্পূর্ণ জীবনটাই ম্যাজিক হয়ে যায়। স্তব্ধ জীবন হঠাৎ করেই প্রাণবন্ত হয়ে যায়। চারপাশটা রঙিন ফানুসের মত হয় তখন। সবকিছু , এভরি সিঙ্গেল থিং তখন জীবন্ত মনে হয়। লাভ ইজ লাইক এ ম্যাজিক। ”

জুভান হাসলো। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

” এত সুন্দর লাভের ডেফিনেশন দিলে যে ? কাউকে ভালোবাসো ? ”

ঐশীর মুখ ভার হলো। দুঃখ পেলো। সেদিনের কথা মনে পড়তেই কষ্টের ফোঁটা ছড়িয়ে পড়লো মনের আনাচে কানাচে। ঐশী নিঃশব্দে এক হাফ ছেড়ে দিয়ে বললো,

” হবে হয়তো। কিন্তু আমি একটাই দোয়া করব এরকম প্রেম যেনো কারো জীবনে না আসে। কারো জীবনে না। ”

জুভান ঐশীর দিকে তাকালো। মেয়েটার এত কিসের দুঃখ ? ছোট জীবনে যে এত দুঃখ পেতে নেই। জীবনটা প্রাণোচ্ছল ভাবে পার করা আবশ্যক। জুভান এসব ভেবে আবারও গাড়ি চালানোয় মন দিল।

” সো ।মোদ্দা কথায় আসা যাক। আমি যা শাস্তি দিবো মেনে নিবে তো ? ”

জুভানের রহস্যভরা কণ্ঠ শুনে ঐশী তাকালো। বিচলিত নয়নে চেয়ে রইল জুভানের চোখ জোড়ায়। কাঁপা কণ্ঠে বলল,

” শুনার পর ভেবে দেখবো। ”

জুভান একটা গাড়ি ওভারটেক করে বললো

” নিজের টাকায় আমাকে খাওয়াবে আজ। তোমার যা মন চায় তাই খাওয়াতে পারো। এভরিথিং, এনিথিং । দাম নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। তো বলো। রাজি ? ”

ঐশী মৃদু হাসলো। অতঃপর মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে সম্মতি দিল।

______________________

গাড়ি থামলো একটা টঙের দোকানের সামনে। জুভান ভ্রু কুঁচকে তাকালো ঐশীর দিকে। ঐশী সেই চাহনির বদলে একটা আলতো হাসি দিল। জুভান গাড়ির ইঞ্জিন থামিয়ে বললো,

“আর ইউ সিরিয়াস ? টঙের দোকান ! ”

ঐশী গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। বাইরে দাঁড়িয়ে গাড়ির জানালার হাত দিয়ে জুভানের দিকে তাকালো। বললো,

” এতজীবন তো নামিদামি রেস্টুরেন্টে খেয়ে এলেন। এবার এই ম্যাজিক দোকানের ম্যাজিক চা খেয়ে দেখেন। ট্রাস্ট মি , মুখে লেগে থাকবে। খাবেন ? ”

জুভান একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে মাস্ক পরে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। ঐশী দোকানের সামনে দাড়িয়ে দু কাপ চা দিতে বলে সামনে এসে দাড়ালো। দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে শীতল বাতাসের সাথে মিশে যেতে চাইলো। ভিজে মাটির গন্ধ ছড়িয়েছে বাতাসে। ঐশী মুখ ভরে শ্বাস নিল সেই মাটির। জুভান এক পাশে দাঁড়িয়ে আনচান করছে। এই পাবলিক প্লেসে একবার যদি ওর চেহারা লিক হয়ে যায় তাহলে ওর আর রক্ষে নেই। ঐশী জুভানের দিকে একনজর তাকিয়ে দৌঁড়ে এলো জুভানের কাছে। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

” আরে। আপনি এখানে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন কেনো ? সামনে আসুন। এই বাতাস দেখুন। জাস্ট ফিদা হয়ে যাবেন আপনি। আসুন না। ”

প্রকৃতির নেশায় মশগুল ঐশী আনমনে জুভানের হাত ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো। জুভান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ঐশীর হাতের মুঠোয় থাকা নিজের হাতের দিকে। “প্রথম স্পর্শ ! ” যেতে যেতে ঐশী থমকে গেলো। অবাক চোখে নিজের হাতের দিকে তাকালো। আসল ব্যাপারটা মাথায় প্রবেশ করতেই ঝটপট নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল জুভানের থেকে। ছি ! কি করেছে ও ? রাগ উঠলো। হঠাৎ করেই মনে হলো , সে চরম অসম্মানের কাজ করেছে। এভাবে একটা ছেলের হাত ধরা তার উচিৎ হয়নি। একদম না। ঐশী নিজের হাত কচলাতে লাগলো। হাসফাস করতে লাগলো এক অজানা শঙ্কায়। জুভান ঐশীকে কাচুমাচু করতে দেখে মৃদু হাসলো। নিজের প্রশস্ত বুকে দু হাত গুটিয়ে বললো,

” বি নরমাল। আমি কিছু মনে করি নি। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here