রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_৩২_ও_৩৩

0
287

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩২_ও_৩৩

#পর্ব_৩২

রেহেনা দরজা বন্ধ করে এসে আব্দুস সালাম সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালেন।
-দেখো… বাড়িভর্তি গেস্ট, এত নাটক করে ঘরে এনে বলবার দরকার নেই। আমার ডিসিশন বদলাবেনা।
-ছেলেদের ব্যাপারে আমি কোনোকালেই কিছু চাইনি, নিজের জন্য তো নয়ই… রিমির জন্য বলছি শুধু…. রেহেনার কথা শেষ হবার আগেই আব্দুস সালাম সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন এবং চেঁচিয়ে বললেন,
-এতো কেন বোকার মত করছো? আমি তো বলে দিয়েছিই, যার যাকে খুশি বিয়ে করুক সংসার করুক.. আমি তো আপত্তি করছিনা। বৌমা তো নিজে গিয়ে বলে এসেছেই ও’কে…. আমায় কেন যেতে হবে?
রেহেনা টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসলেন।
-ছেলেটা বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদছে! চোখের পাতা ফুলে ভারী হয়ে আছে। এতবড় একটা বিপদ কাটিয়ে ফিরলো! এখন কিনা…..
-বিপদ? কিসের বিপদ? কয়েকদিন কারো সাথে সময় কাটানো বিপদ? পৃথিলা শুধু চেয়েছিলো শোয়েব অন্তত একটা মাস রিমির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে ওর সাথে সময়টা কাটাক… সেটা সোজা করে হচ্ছিলো না বলেই তো… পৃথিলা সিনসিয়ার, ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে… তোমার ছেলেকে তো আর খেয়ে ফেলেনি? ব্রাইট একটা ছেলে, পছন্দ করলো কিনা ফুটপাতের একটা মেয়েকে… ছিঃ! মাদকাসক্তি নিরাময়ে আমরা তো ছেলেমেয়েদের রিহ্যাবেও পাঠাই.. তাহলে?
-রিমি কি মাদক?
-ওই একই তো! শোয়েবের নেশা… যা ক্ষতিকর, সম্মান হানিকর! জেঁকে বসে আছে, ছাড়ছেই না।
-একই বাবার মেয়ে দুজনে। একজনকে তোমার পছন্দ, অন্যজন চোখের বিষ! কেন?
-রিমির আপাতত কোনো ফ্যামিলি ব্যাকিং নেই, সোশ্যাল ওরিয়েন্টেশন নেই। পৃথিলার ক্ষেত্রে যেটা জাঁকজমকরূপে আছে। রিমির লাইফস্টাইল… আমি তো চিন্তাই করতে পারছিনা, যে ছেলে এসি ছাড়া শুতে পারে না, বড় বাথটাবের পানিতে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখে… তাঁর কিনা ওই রাস্তার মেয়েকে চাই!
রেহেনা গ্লাসের পানিটা একটানে শেষ করলেন।
স্বামীকে বলবার জন্য বেশ কিছু শক্ত কথা তিনি আজ গুছিয়ে রেখেছেন,
-তার মানে তুমি যাবেনা?
রাগে শরীর কাঁপছে তাঁর!
-আমি তো মানা করছিনা। আমায় লুকিয়ে বিয়ে করে যখন এতদূর, এখন নিজে গিয়ে নিয়ে আসুক! বাড়ি আনতে তো মানা নেই। থাকুক সুখে… একবার চিন্তা পর্যন্ত করলোনা… আমাদের কথা! আমি তো বাঁধা দিচ্ছি না কিছুতেই, বৌ নিয়ে এসে সংসার করুক!
তুমিই শুধু শুধু আদিখ্যেতা করছো। ছেলের অপরাধ স্বীকার করা তো দূরে…
রেহেনা উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজার মাঝ বরাবর সোজা হয়ে দাঁড়ালেন,
-তুমি খুব ভালো করেই জানো, শোয়েব রিমিকে আনতে যাবেনা। একটা কথা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও, শোয়েবকে না পেলেও রিমি বাঁচতে পারবে, বাঁচার দারুণ সাহস আছে মেয়েটার।ফুটপাথের মেয়ে কিনা! অনেক এবনরমাল সিচুয়েশানেও ও বেঁচে থাকতে পারবে। দুঃখ কষ্টের আবেগ, অনুভূতিকে জয় করেই এদের বাঁচা। কিন্তু তোমার ছেলে রিমিকে না পেলে মরে যাবে। একদম ভ্যানিশ হয়ে যাবে। সে এখন পর্যন্ত কিচ্ছু মুখে দেয়নি। তোমার ভাগ্য ভালো যে, সে সরাসরি তোমাকে কিছু বলবে না। মরে যাবে হয়তো রিমির জন্য, তবু আমাদের ছেড়ে যাবেনা। শোয়েব চাইলে কিন্তু আমাদের ছেড়েই রিমিকে নিয়ে শুরু করতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে সে ইনডিপেনডেন্ট।
মেয়েটার ক্ষমতা তো জানো? তোমার ভাষায়ই বলি, ফুটপাথের মেয়ে! শোয়েবের কিছু হলে ভরা বাজারে কাপড় টেনে খুলবে তোমার। রাস্তার মেয়ে বলছো তো, রাস্তায় না তোমায় টেনে নামায়। এই যে সম্মান সম্মান করছো বড়, তখন না জেলের ঘানি টানতে হয়!
আব্দুস সালাম সাহেব রাগে চোখ লাল করে তাকালেন।
-তুমি কি ছেলের হয়ে থ্রেট করছো আমাকে?
-না, একদমই না। সেই ভুল আমি করছিনা। এ সংসারে তোমার খেয়ে পরে আছি। কৃতজ্ঞতা স্বীকার আমি করতে জানি। বরং একজন আদর্শ স্ত্রী হয়ে স্বামীকে সতর্ক করছি। রাস্তার মেয়ের সাথে লাগতে যেওনা। শোয়েবের কষ্ট হলে রিমি আকাশ-পাতাল ফুঁড়ে ফেলবে। রিমির ভেতরে আগুন আছে, যেটা অদৃশ্য কিন্তু অনেক ক্ষমতার। বিজনেসে দেখেছো? এই কয়মাসে যাস্ট চমকে দিচ্ছে, তোমায় ক’দিন পরে… অস্তিত্বের লড়াইয়ে এই মেয়ে খুব পারদর্শী। এই জিনিসটা আমি বুঝে গেছি। তুমি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই ভালো।
আব্দুস সালাম সাহেব হতবিহ্বল দৃষ্টিতে রেহেনার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বড় একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে রেহেনা বেড়িয়ে এলেন। পার্টির মিউজিকের সাউন্ড অসহ্য লাগছে তাঁর। মাথা ধরে গেছে, শরীরও টলছে। এত লোড তিনি নিতে পারছেন না। তবে ভেতরটা হালকা লাগছে। স্বামীর ঘাবড়াটে চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো,
কথাগুলোতে কাজ হবে।

লীনা চিন্তিত আর অসহায় মুখ করে এসে বললো,
-মা, আমি কি আবার যাবো, ওদের ওখানে? গেস্টরা বারবার বলছে, যদি শেষ অবধি রিমিকে প্রেজেন্ট না করতেই পারি কতবড় ফেইসলস হবে বুঝতে পারছেন?
-শোয়েব কি নিচে এসেছে?
-না মা। ও’র আরেকটু দেরি হবে বললো।
-তুমি খাবার দিয়ে দিতে বলো গেস্টদের… যা হবার হবে।
লীনা অসহায় মুখ করে তাকালো।
-মা, রিংকু ঝিংকু পর্যন্ত আমায় খুব খারাপ ভাবছে।ঝিংকুটা কাঁদছে খুব। অনেকদিন পর আজ রিমি আসবে ভেবে ওয়েট করছে ওরা!
লীনার চোখ ছলছল করছে। নিজের ছেলেদের অভিমান বুকে বিঁধছে তাঁর!
-রিমি এখন ফোনটাও তুলছেনা। ঝিংকুটা এত এত খাবারের কিচ্ছু মুখে তুলছে না। রাগে দুটো থাপ্পড় দিয়ে দিলাম… এখন… এখন আমারই….
রেহেনা গভীর দৃষ্টিতে লীনার দিকে তাকালেন। আজ অনেকদিন পর তাঁর এই বৌমাটাকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে দেখতে। কি ফর্সা মিষ্টি মুখ, ছলছল চোখে ঠোট কামড়াচ্ছে। তাঁর অতি আধুনিকা বৌমাকে আজ সত্যিই মা মা মনে হচ্ছে। নারীত্ব বুঝি সবথেকে বেশি প্রবল হয় ‘মা’ রূপে।
-বুঝলে বৌমা, ছেলেমেয়ে ভুল বুঝলে, অভিমান করলে মায়ের কত কষ্ট হয়? কত ভেতর কাঁপে! বেঁচে থাকবার শক্তি কমে যায়, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে….
লীনা অসহায় ভাবে শাশুড়ির দিকে তাকালো। বড় অপরাধী সে চাহনি।
কান্নাজরিত আকুল কণ্ঠে বললো,
-সবকিছুর জন্য সরি মা। ভীষণ সরি… ভুল হয়ে গেছে বড়…. শুধরাতে হবে…

#পর্ব_৩৩

রেহেনা শোয়েবের ঘরে উঁকি দিলেন। শোয়েব ঘরে নেই। গেল কোথায়? ছাদে?
রেহেনা দরজায় দাঁড়িয়েই ডাকলেন,
-শোয়েব, শোয়ে…..ব
চেঞ্জিং রুম থেকে বেড়িয়ে এলো শোয়েব।
-তৈরি হচ্ছি মা। পার্টি জয়েন করবো। ক্ষণিকের বিশ্রামাগারের রেপুটেশন বলে কথা।
-রিমি যে এলোনা, তুই একা! সবাইকে কি বলবি?
শোয়েব জবাব দিলোনা। ঘাড় ব্যথা করছে তাঁর!
-দেখোতো ঠিক আছে নাকি মা? টাই কি পরবো??
একটা বোটল গ্রিন ফুলহাতা শার্টের সাথে শোয়েব ব্লাক একটা প্যান্ট পরেছে। রেহেনা ছেলের দিকে মুগ্ধ আর স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকালেন। তাঁর আদুরে ছেলেটার মুখটা শুকিয়ে আছে। চোখ ফোলা….
রেহেনা কাতর কণ্ঠে বললেন,
-একটু তো কিছু মুখে দে…..
-সত্যিই ক্ষিধে নেই মা।
-তুই আমাদের ক্ষমা করবি তো? ছেড়ে চলে যে একেবারেই যাবি বুঝতে পারছি, খুব। ঝড়ের আগেই সব শান্ত থাকে। তুই সেরকম করছিস, তাইনা?
শোয়েব কলারের নিচে পারফিউমটা স্প্রে করে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। দু-হাতে মায়ের মুখটা তুলে ধরে বললো,
-অন্তত রিমির জন্য তোমাদের আমায় কোনোদিন ছাড়তে হবেনা মা।
-এত নিশ্চিত তুই?
-হুঁ। সারাজীবনে যদি আমি আর একবারও ওকে ভালো না বাসি, ও’র কোনো অভিযোগ থাকবেও না।ও’ শুধু চায় আমি ভালো থাকি, নিজের পরিবারকে ভালোবেসে নিয়ে ভালো থাকি! ওই দিক থেকে আমি এত নিশ্চিন্ত যে, রিমির কাছে মাঝে মাঝে নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয়! বড় ছোট। সামান্য একটু দিতে ইচ্ছে করে ও’কে, তোমাদের ভালোবাসা দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাতো পারিনা আমরা, অনেক ছোট মন তো আমাদের…..
শোয়েব আবার চোখ মুছলো।
রেহেনার মাথা ঘুরছে। তিনি চোখে ঝাপসা দেখছেন।
-ও’র প্রচন্ড শরীর খারাপ ছিল, একা হাসপাতালে ছিল, এর মধ্যেও বিজনেসে ঠিকঠাক সময় দিয়েছে।
জানো মা, কাজল লেপ্টানো দুখী দুখী চেহারা ও’ কোনোদিন কাউকে দেখাতে পছন্দ করে না। মনে করে এটা বাহুল্য। আমি প্রমিস করেছি, আমি সবসময় তোমায় ভালবাসবো। আর রিমি জানে, আমি প্রমিস রাখতে ভালোবাসি!
রেহেনা দপ করে ফ্লোরে পড়ে গেলেন। শোয়েব চিৎকার করে ডাকলো,
-মা, মা… বাবা, ভাবী… মা অজ্ঞান হয়ে গেছে….
লীনা ছুটে এলো।
আব্দুস সালাম চেঁচিয়ে বললেন,
-ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো বৌমা। আমি রিমিকে আনতে যাবো।

আব্দুস সালাম সাহেব এসে রিমিকে বাড়িতে পেলেন না। রিমি ফিরলো প্রায় ঘন্টাখানেক পর। তাকে দেখে রিমি একটুও চমকালো না। খুব স্বাভাবিক গলায়ই বললো,
-আসবার আগে আমি জানলে বেরোতাম না। একটা মেহেদী ফাংশানের…
আব্দুস সালাম সাহেব অন্যদিকে তাকালেন। তিনি নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রান চেষ্টা করছেন। একটা বাচ্চা মেয়েকে তিনি এত কেন ভয় পাচ্ছেন? কেন এত কেয়ার করছেন?
-আপনি তো কিছুই খাননি দেখছি, স্যূপ টুপ কিছু করে দিতে বলি? মা, উনি চিলি চিকেন স্যূপ ভালোবাসেন। খালাকে বলো তো একটু করে দিতে।
-লাগবে না।
আব্দুস সালাম সাহেব বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। রিমি ব্যাগটা রেখে বসলো। চোখের ইশারায় মাকে চলে যেতে বললো রিমি।
-তোমায় যেতে হবে আমার সাথে। রেহেনার হুট করে শরীরটা খুব খারাপ করেছে। তোমার মাকেও সাথে নিয়ে নাও। সিমিদের সাথে লীনা কথা বলে নিয়েছে….
এটুকু বলেই সালাম সাহেব পানি চাইলেন। রিমি ঠান্ডা গলায় বললো,
-এক্ষুণি যাবো, চলুন।
পানির গ্লাসটা সালাম সাহেবের হাতে দিতে দিতে ডাকলো মাকে।
-মা, বেরুতে হবে চলো!
আব্দুস সালাম চমকে তাকালেন। রিমি এত সহজেই রাজী হয়ে গেল? কোনো অভিযোগ নেই তাঁর? তিনি শিওর হতে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-এখনি? মাত্র তো এলে…
-জি স্যার। আপনি এমনিতেই অনেকক্ষণ বসে আছেন। যাস্ট মাকে নিয়েই আসছি।
-না না ঠিকাছে। তুমি ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নাও আগে। আমি তোমাকে সাথে নিয়েই বেরুবো।
আব্দুস সালাম সাহেব হঠাৎ বোধ করতে লাগলেন, তাঁর খুব ভালো লাগছে, শান্তি শান্তি লাগছে। রিমির প্রতি করা সকল অন্যায় রিমি তাহলে মনেই নেয়নি অথচ তিনি ভেবেছিলেন, কত না সিনক্রিয়েট হবে! অথচ সব কত সহজ আর স্বাভাবিক। হবেই বা না কেন? কোটিপতির ছেলের বৌ হতে পারা কি কম আনন্দের?
রিমি সামনেই চুপচাপ বসে আছে।
আব্দুস সালাম সাহেব আড়ষ্টভাবে বললেন,
-তুমি মাস্ক ইউজ করছো যে হঠাৎ, এনি প্রবলেম?
-না না স্যার এমনিতেই, বাইরে বেরুলে ডাস্টে… খুলতে ভুলে গেছি। রিমি মাস্কটা খুলে রাখলো। সামনে রাখা ফলের ট্রে থেকে বিকট গন্ধ নাকে লাগছে তাঁর। গা গুলাচ্ছে। রিমি উঠে দাঁড়ালো।
সার্ভিং ট্রেটা নিয়ে যেতে যেতে বললো,
-মায়ের হলো কিনা দেখে আসি।
রিমির পেছনে ঘুরার সাথে সাথেই আব্দুস সালাম সাহেব বললেন,
-তোমার কি কোনো অভিযোগ নেই রিমি?
গলায় আটকে আসা কথাটা হুট করেই বলে ফেললেন তিনি।
রিমি ট্রেটা পাশের ঘরে দিয়ে এসে বসলো আবার।
-স্যার, মনে আছে আপনি যেদিন আমার প্রথম ইন্টারভিউ করেন আমার পরিবার সম্বন্ধে কিছুই জানতে চাননি অথচ টিউশনিটা তখন আমার এতই দরকার ছিল যে, আমি কাতর হয়ে আমার দরিদ্রতা ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম। পরে দেখা গেলো টিউশনটা আমিই পেলাম। তখন আমার এই দুঃখ কষ্টের জীবনী কত কাজে দিয়েছিলো, দেখেছিলেন?
-আমি কিন্তু তোমায় দেখেই বুঝেছিলাম, তোমার ধৈর্য্য ভালো হবে।
-জি, কিন্তু ওটা আমার কথাগুলো শুনবার পর আরো পোক্ত হলো। যে মেয়ে এত অভাবে বাঁচে, তাঁর… আজ আমার আপনার কাছে যেটা চাই, সেটার জন্য আমার সুখের গল্পের দরকার। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার দরকার… দুঃখ কষ্টের গল্প এখন কাজেই দিবে না।
-তুমি কি কমপ্লেইন করতে চাচ্ছো?
-একদমই না স্যার! কমপ্লেইন করবার ক্ষমতা আমার ভেতর তৈরিই হয়নি। আমার অল্প জ্ঞানবুদ্ধি। আমার শিক্ষা আমায় বলে যে, যার আমি যোগ্যই নই, তা না পেলে কমপ্লেইন করাটা ঠিক না। কমপ্লেইন করি না বলেই আমার সেই অল্পজ্ঞান, সেই শিক্ষাকে, সবাই আমার দুর্বলতা ভাবে। ঠুনকো ভাবে। তবে পছন্দের জিনিসটা পাবার জন্য নিজেকে যোগ্য করার চেষ্টাটা করতে ইচ্ছে করে… কাজের শক্তি আমার প্রচুর।
আর ওটাকেই সবাই ভাবে লোভ আমার।
রিমির কথাগুলো আব্দুস সালাম সাহেবের বুকে কাঁটার মত বিঁধলো। মন খচখচ করতে লাগলো তাঁর। তিনি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হালকা কেশে নিলেন।
-এই জীবন নিয়ে আমি খুব ভালো আছি স্যার। এই জীবনটাকেই ভালোবাসি আমি। শুধু চাই এতে কেউ যাতে অখুশি না হোক! কারো কাছ থেকে কোনো মমতাই জোর করে আমি চাই না। সবাই আমাকে ভেতর থেকে যেমন দেখে, তেমনই দেখুক। অন্তত মিথ্যে মমতা না দেখাক।
-আমি তো তোমার দূরের লোক, হয়তো নিষ্ঠুর হওয়াটা আমাকে মানিয়ে গেছে… কিন্তু যারা তোমার…
-স্যার যে সম্পর্কে মমতার জোর নেই, স্নেহের বন্ধন নেই তারা কি করে আপনজন হয়? এই যেমন ঘটনাটার পর পৃথি মা’কে ফোন করেছে অনেকবার। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফোন ধরে কথা বলছো না কেন মা? মা বললেন, ও’রকম কারো ফোন ধরতে আমার রুচিতে বড় বাঁধেরে রিমি। কান্ডজ্ঞানে বাঁধে।
মায়ের কাছে পৃথি এটাই অর্জন করেছে। অর্থাৎ যেটা আমার সত্যিই পাওনা সেটাই পৃথিবী আমায় দিবে।এর থেকে বেশিও না, কমও না।
আব্দুস সালাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আর্দ্র গলায় বললেন,
-কেউ তোমার চাওয়াতে অখুশি হবে না। তোমার জীবনের সুখটাও তোমার, দুঃখটাও তোমার! তুমি তোমার চেষ্টাটা স্বাচ্ছন্দ্যে চালিয়ে যাও…. যেটা তোমার প্রাপ্য, তাই পাবে…
রিমি হেসে বললো,
-এজন্য আপনাদের শুভকামনা দরকার আমার।আর হ্যাঁ, আমি আপনার গাড়িতেই যাবো স্যার।
আব্দুস সালাম সাহেব এবার আনন্দিত চোখে রিমির দিকে তাকালেন। রিমি মেয়েটা মানুষকে সম্মান দিতে জানে, আসলেই…

পার্টির পুরো সময়টাতে রিমির জাহান্নাম কেটেছে। খাবারের ফ্লেভার, পারফিউমের গন্ধে মরে যাবার অবস্থা! একবার শোয়েব আর সে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলো। শোয়েবের ইউজ করা স্প্রের গন্ধে আর একটু হলেই সে তক্ষুণি বমি করে দিচ্ছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছে। শোয়েব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে রিমির দিকে তাকিয়েছিলো তখন।
-এরকম পেটব্যাথার মত মুখ করে আছো কেন? পেটব্যাথা?
রিমিও হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়েছিলো।
-হবেই তো পেটব্যাথা। হাত ধোওয়ার কি ঠিক আছে? গোসল বছরে আর হাত ধোওয়া তো মাসে, তাই না?
রিমি ফেইক একটা খুশির হাসি হেসে বললো,
-জি একদম! বাঁ-হাত মাসে একবার, আর ডানহাত তিনমাসে একবার!
শোয়েব রেগে কটমট করে তাকিয়ে চলে গেল।
রিমি ঝটপট কিচেনের সিংকে এসে একগাদা বমি করে নিলো। রিমি মাঝে মাঝে নিজেই খুব আশ্চর্য হয়, একদম খেতে পারে না সে অথচ এত বমি কোথা থেকে করে? পেটের বাবুটা কি সারাক্ষণ বসে বসে বমি তৈরি করে নাকি? বাপের মতই বদের হাড্ডি!

পার্টির পর রিমিরা চলে আসবার আগে শোয়েবই ডাকলো ঘরে যেতে…..
রিমির ঘরে এসে আবার গা গুলাচ্ছে।
শোয়েব স্পষ্ট আর ঝাঁঝালো গলায় বললো,
–যাও খাবার নিয়ে আসো… খাওয়া হয়নি আমার।
রিমি শোয়েবের কথা না শোনার ভান করে বসলো বিছানার একপাশে….
শোয়েব চেঞ্জ করছিলো।
-শুনতে পাওনি? মাছের কোনো প্রিপারেশন আনবে না, শুধু চিকেন আনবে বুঝলে?
-আমি চলে যাবো শোয়েব ভাই। আপারা ওয়েট করছে আমার জন্য!
শোয়েব টিশার্ট গায়ে দিতে দিতে সামনে এলো।
-চলে যে যাবে জানিই তো… থাকতে তো বলছি না। খাবার খাইয়ে যাও আমায়, অসুস্থ আমি!
রিমি হতাশার শ্বাস ফেললো। খাবার সামনে এলে এবার নির্ঘাত সে বমি করবে। চিকেন তো ইম্পসিবল!
-টকি অসুস্থ আপনি যে খাবারটাও খেতে পারবেননা?
-ঘাড়ে ব্যথা। খাইয়ে দেবার পর একটু ম্যাসাজ করে দিয়ে যাবে। যাওওওওও…….
রিমি অনিচ্ছুকভাবে উঠে দাঁড়ালো। মানুষটা এত কেন কষ্ট দেয় তাকে? রিমি যে ক্লান্ত খুব, কেন বুঝে না? এত বাড়াবাড়ি কেন?
খাবারটা সামনে নিয়ে বসে রিমি ওড়নাটা শক্ত করে নাকে মুখে বেঁধে নিলো! তারপর ভাত মাখাতে লাগলো। শোয়েব মুখ কুঁচকে বললো,
-নতুন ঢং নাকি?
-হা করুন!
শোয়েব বালিশে হেলান দিয়ে আরো পেছনদিকে চলে গেল।
-এত দূরে আমি দিই কিভাবে শোয়েব ভাই?
-এখানে এসে দাঁড়িয়ে দাও! বললাম না ঘাড়ে ব্যাথা আমার!
রিমির ইচ্ছে করছে প্লেটটা শোয়েবের নাকে মুখে ছুঁড়ে মারে। কাঁচামরিচটা ভেংগে জায়গামত ডলে দেয়।
দাঁতে দাঁত চেপে রিমি রাগ সামলালো। উঠে
দাঁড়িয়ে খাওয়াতে লাগলো…
-ভাতের ভেতরে একটু করে লেবুর ছাল দিও, রস না। কামড়ে আগে লেবুর ছালটা টুকরো টুকরো করে নাওতো রিমি……
শোয়েব পা দুটো আয়েশীভাবে অন্য বালিশের উপর তুলে দিলো।
রিমি আস্ত মরিচ ঢুকিয়ে দিলো ভাতের ভেতর।
শোয়েব মুখে নিয়েই থু করে মরিচ ফেলে দিলো।
-একটু খেয়াল করে দিবে তো। জানো আমি ঝাল খেতে পারিনা। পানি দাও….
শোয়েবের চোখে মুখে বিরক্তি।
রিমি মনে মনে বললো, তোরে আমি ডট ডট ডট শালার ভাই।
খাওয়া শেষ করে শোয়েব বিছানায় বসেই মুখ ধুলো।রিমিকে দিয়েই করালো সব।তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে বললো,
-ঘাড় ম্যাসাজ বাকি।
রিমি ঘড়ি দেখলো। রাগে বিরক্তিতে কপাল ফাটছে তাঁর! এই জন্যই স্বামী নামক বস্তুটাকে সে ফিরিয়ে এনেছিলো। হুহ…
রিমি মনে মনে বললো, আমি একটু শক্ত হয়ে নিইরে ছেঁচড়া। তোকে আমি সকালবিকাল ছেঁচবো।তিনবেলা ছেঁচবো… এই ঘাড় আমি সত্যিই মটকে দিবো….
-কি হলো? তাড়াতাড়ি করো… দাঁড়িয়ে আছো কেন?

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here