রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_৩৪

0
307

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৪

-কি হলো? বসো তুমি…
শোয়েব রিমির হাত ধরে একটা হেঁচকা টান দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। হাতটা ঘাড়ের কাছে নিয়ে বললো,
-এখানে। তোমার বোনতো আমার ঘাড়টা মটকেই দিয়েছিলো প্রায়! এখন ঠিক করো তুমি। হাত দুটো আগে গরম করে নাও ঘষে। তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন রিমি?
রিমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
-পারবোনা আমি। মা ওয়েট করছে। আমারও খুব টায়ার্ড লাগছে।
শোয়েব এইবার শোয়া থেকে উঠে বসলো।
-যত্তসব বাহানা। মা’কে বলো থেকে যেতে। আমার ঘাড়ের ব্যথা বাড়ছেই। ভালোমন্দ কিছু একটা ঘটে গেলে!
-ঘটলে ঘটবে। আমি কাউকে কিছুই বলতে পারবো না।
-কেন বলতে পারবে না? স্বামীর আদেশ মান্য করা শেখোনি?
-যেতে হবে শোয়েব ভাই। আপনি তো আর কালকেই চলে যাচ্ছেন না। কাল দেখা করি? প্লিজজ!
শোয়েব বসা থেকেই প্রায় জোর করেই রিমির কোমড় ধরে কাছে টানলো। রিমির পেটের কাছে মুখ লুকিয়ে বললো,
-তোমার মন এত পাথর কেন রিমি? আমি এই এতটা দিনে পাগলের মত হয়ে আছি… একেকটা সেকেন্ড একেক যুগ মনে হয়। আমাদের একসাথে থাকা খুব দরকার।
রিমি চুপ করে থাকলো। এই মানুষটা এত কেন রিমিকে চায়? এত কেন রিমি নির্ভরশীল হতে চায়?
রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাঁর মতো পথের একটা মেয়েকে রাজপুত্রের মত কেউ এমন ভালোবাসবে কে জানতো?
শোয়েব জামার উপরেই চুমু খেলো রিমির পেটেই।
রিমি মনে মনে চমকালো খুব। শোয়েব বুঝে যায়নি তো কিছু?
-কি স্বপ্ন যেন দেখেছিলে রিমি? আজ পূর্ণিমা। বলবে?
গভীর অনুভূতিতে শোয়েব বাচ্চাদের মত করতে লাগলো। রিমির শরীর থরথর করে কাঁপছে। শোয়েবের চুলের জেলের থেকে গন্ধ লাগছে, গা গুলাচ্ছে আবার!
-কি হলো? মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না রিমি। চুল সব আঠা আঠা হয়ে আছে, জট ছাড়িয়ে দাও।
রিমি কোনোরকমে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বললো,
-একটু ছাড়ুন আমাকে। আগে স্বপ্নটা বলি।
-এভাবে বলতে সমস্যা কি?
-আমি দাঁড়িয়ে, আপনি দিব্যি আরামে বসে আছেন।
শোয়েব রিমিকে ছেড়ে দিলো।
-এখানে বসো। কোলে মাথা রাখি।
-চুলের সুরসুরি লাগে শোয়েব ভাই। বালিশে শোন প্লিজ…
-ঘাড়ে ব্যথা তো! বালিশে মাথা রাখা যাবেনা। ব্যথা বাড়বে।
-একটু আগেই তো বালিশে শুয়ে ছিলেন… তো?
-তাতেই ব্যথাটা আরো বাড়লো…. উঁফুঁউঁ… কি ব্যথা!
রিমি মনে মনে বললো, এই জ্বালাতনের সব শোধ আমি নিবোরে পাগলা। দ্বিগুণ করে নিবো…
শোয়েব আরামসে রিমির কোলে মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুলো। টি-শার্টের বুকের বোতামটা খুলে ওখানে রিমির ডানহাতটা নিয়ে বললো,
-দেখো, এখানটায়.. গরম লাগছে না খুব? হৃদয় পুড়ছে আমার তোমার জন্য! এক টুকরো কাগজ রাখলে আগুন ধরে যাবে ঠিক। অগ্নিকান্ড ঘটবে ক্ষণিকের বিশ্রামাগারে।
শোয়েব সুর ধরে গাইতে লাগলো,
“জ্বালাইছো যে জ্বলছে আগুন……
নেভানো বিষম দায়…..
ও রিমি বেগম,
আগুন জ্বালাইছো কেন আমার গায়?
হোয়াই?”
রিমি সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। মানুষটা এত দুষ্টু কেন? নিজের স্ত্রীর সাথে এমন ফাজলামি কেউ করে? কোনো লজ্জা নেই… শোয়েব রিমির চোখ বন্ধ করা মুখটার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। নরম আদুরে ঠোটদুটো কাঁপছে তাঁর। চোখের পাতা কাঁপছে, মিষ্টিমুখে কপালের এ পাশটায় এলোমেলো চুলের গোছা। নাকের ছোট্ট সাদাপাথরের ফুলটা চিকচিক করছে। তারই চারপাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম, থুতনির মাঝখানটা আরো কোমল মায়াবী লাগছে।
শোয়েব রিমির কপালের চুলটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে বললো,
-কি হলো, বলো রিমি? স্বপ্নটা বলো….
রিমি চোখ বন্ধ রেখেই বলতে শুরু করলো….
-আমি দেখলাম কি, আপনি একদেশের বিরাট রাজা। মাথায় পাগড়ী, হাতে তরোয়াল, পরনে শাহী লেবাস সাথে অজস্র পাইক পেয়াদা নিয়ে রাজ্য ঘুরে দেখতে বেড়িয়েছেন……
-এরকম তিনবাঁকা মুখ করে বলছো কেন? আমায় রাজা দেখে ভালো লাগেনি বুঝি? হাসি হাসি মুখ করে বলো। হাসলে কি টাকা খরচ হয়ে যাবে তোমার?
শোয়েব রিমির ডানহাতের আঙুলগুলো নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে খেলতে লাগলো। বাঁ হাতে রিমি শোয়েবের চুলে বিলি কাটছে।
রিমি হাসার চেষ্টা করলো। তার এত কেন শরীর খারাপ লাগছে এখন? দুদিন আগেই তো স্যালাইন নিলো। পেটের বাবুটা কি রিমির সব শক্তি নিয়ে খেলাধুলা করছে নাকি যুদ্ধ করছে?
-আমি আপনার রাজ্যের দরিদ্র এক তাঁতী… আমি এতই দরিদ্র যে…
-চুলটা খোঁপা করো তো বেনী খুলে রিমি.. এত লম্বা বিণুনিটাকে আমার কাছে সাপ সাপ লাগছে। আচ্ছা, এই এত চুল দিয়ে তুমি করবেটা কি? এগুলো তো তোমার সব পুষ্টিরস খেয়ে ফেলছে।
রিমি বিণুনি ছাড়াতে লাগলো।
-এ কি হাত নিলে কেন? হাতটা দাও…..
-চুল খুলছি তো শোয়েব ভাই!
-একটা বিণুনি খুলতে দু-হাত লাগে নাকি?
শোয়েব রিমির ডানহাতটা আবার টেনে চুমু খেলো।
রিমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চুলটা ঠিক করতে লাগলো।
-বিণুনি খুলতে কি এক বছর লাগবে?
রিমি মুখ ভেংচালো…..
-আমি বুঝলাম না, তুমি কি ভেবে নাক ফুটো করালে? নাকে যে স্টোনটা পরে আছো, লাস্টটাইম ওটা লেগে আমার কতটুকু কেটেছে মনে নেই? এই ছাতাপাতা কেন পরো? রুচিবোধ কিচ্ছু নেই তোমার!
এটা খুলবে এক্ষুণি। আবার মুখ কুঁচকে আছো কেন?
-এখন খুলতে পারবো না।
-খুলতে পারবেনা মানে?
-লকটা টাইট অনেক।
-দেখি, আমি খুলে দিই…
-প্লিজজজজ না। আমাকে যেতে হবে…. আপা কল দিচ্ছে ফোনে বারবার…
কথাটা রিমি মৃদু মত বললো প্রায়।
-এত যাই যাই করছো কেন? যতক্ষণ আছো, একটু তো রিলাক্স থাকবে নাকি?
রিমি চুপ করেই রইলো। মানুষটার এত কেন তাড়াহুড়ো? কত সময় আছে কথা বলার, একসাথে কাটাবার।
-ভালো করে কথা কেন বলছো না? তুমি কি ব্রিটেনের রাণী? এত দাম তোমার কথার? সেই কখন থেকে বলছি, একটু মিষ্টি গলায়… যত্তসব।
ক্লান্তিতে রিমির শরীর ভেঙ্গে আসছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে ঘুম পাচ্ছে। রিমি হাই তুললো,
-তুমি হাই তুলছো কেন? হোয়াই? কি বুঝাতে চাইছো? ইগনোর করছো? এতদিন পর দেখা অথচ ভাব করছো যেন রোজ দেখে দেখে বিরক্ত তুমি।
শোয়েব রাগে গজগজ করতে লাগলো…
-আমি তো ভাবতেই পারিনা এত অল্প বয়সের একটা মেয়ের মধ্যে এত বুড়ি বুড়ি ভাব কেন? হাজবেন্ড বিদেশ ঘুড়ে এলো… তোমার তো উচিত আমায় জড়িয়ে ধরে একঘন্টা কাঁদা। স্বামী…. আ……মা…..র প্রাণের স্বামী গো…
শোয়েব বিলাপের অভিনয় শুরু করলো।

রিমি এবার আর পারলোই না সামলাতে নিজেকে।
শোয়েবকে এক ঝটকায় কোল থেকে সরিয়ে চট করে উঠে দাঁড়ালো।
-কি পেয়েছেন আপনি আমায়? কেনা ভৃত্য? সেবাদাসী? সবসময় এটা করো, ওটা করো…. সব আপনার কথামত? ক’টা বাজে দেখছেন? পারবোনা। কিচ্ছু করতে পারবো না। গেলাম…
রিমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে গটগট করে চলে যেতে লাগলো। শোয়েব চেঁচিয়ে পিছু ডাকলো,
-রিমি শোনো….
রিমি ফিরে তাকালো না, তবে থামলো।
-তুমি শুকিয়ে পুরো পুষ্টিহীন বাচ্চাদের মত হয়ে যাচ্ছো… গালমুখ শুকনো, শরীর ভাঙায় পেট মোটা লাগছে কিছুটা। দুখী বঞ্চিত শিশু। ইউনিসেফের ছবিগুলোতে যে অল্পবয়সী রোগা মেয়েদের দেখায় না, সেরকম… ঠিকঠাক খাও একটু। তোমার স্বামী তো মরে যায়নি আর!
রিমি দাঁতে ঠোট কামড়ালো। যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বললো,
-আমার শরীর, আমার ইচ্ছা, আমি শুকাবোই… দেখাক পুষ্টিহীন।
-আমার সাথে ছবি তুললে তো সবাই বলবে, আমি তোমাকে খেয়ে খেয়ে সরি তোমার খাবার খেয়ে তোমাকে চিকন করে রেখেছি। এই আঙুলের মত মেয়ে তুমি অথচ একদম কথা শুনোনা আমার! একহাতে তুলে আছাড় দিলে…
রিমির ইচ্ছে করলো, শোয়েবকে সে ঠাটিয়ে একটা চড় মারে। না আজ অন্ততপক্ষে কঠিন করে শোয়েব ভাইকে একটা ঝারি দিতেই হবে।
দরজার কাছ থেকে রিমি ফিরে এলো শোয়েবের কাছে।
শোয়েব হাসিমুখে বললো,
-থেকে যেতে ইচ্ছে করছে বুঝি? আমি জানতাম, তুমি নিজেকে সামলাতে পারবেনা। তোমার আবেগতো আমি জানি। একটু ভালো করে তাকালেই তুমি শেষ…
তারপর শোয়েব হাতটাকে নিজের গলার কাছে ছুড়ির মত ইশারা করে বললো,
-যাস্ট খাল্লাস…..
রিমি টেবিলে রাখা পানির জগের পুরো পানিটাই শোয়েবের বিছানায় ঢেলে দিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে এলো।
শোয়েব একটা ট্রিমেন্ডাস শকিং ফিলিংস নিয়ে রিমির চলে যাবার দিকে তাকিয়েই রইলো।
আশ্চর্য মেয়ে তো… বিছানায় কেন পানি ঢাললো? বিছানা কি দোষ করলো? শোয়েবের গায়ে ঢাললেও তো পারতো…
তার মানে রিমি কি বুঝাতে চেয়েছে? এর কি মানে?
শোয়েব একটা আনন্দের হাসি হাসলো। বাহ্… কি দারুণ ইশারা! বুদ্ধি আছে বটে রিমির… শোয়েবের ভেবেই খুব আনন্দ হলো, এমন ইশারাবতী বৌয়ের সাথে সে সারাজীবন থাকবে।

বাড়ি এসে রিমি বেশ শান্তি শান্তি অনুভব করতে লাগলো। বাহ্, এই প্রথম সে শোয়েবের সামনে একটা বীরের মত কাজ করে এসেছে… খুব আরাম চাই তো তোর! তাই নারে ব্যাটা, ঘুমা এখন আরাম করে ভেজা বিছানায় ঘুমা। যতক্ষণ সামনে, ততক্ষণ পুতুল নাচ করাবে। ছেঁচরা!

ভোররাতে রিমি গভীর ঘুম থেকেই অস্পষ্টভাবেই জবাব দিলো,
-জামাই এসেছে মানে?
নাসিমা গলার স্বর যথাসম্ভব নামিয়ে নিয়ে বললেন,
-শোয়েব এসেছে…
রিমি তড়াক করে ঘুম থেকে উঠে বসলো।
হঠাৎ ঘুম ভাঙায় শরীর টালমাটাল লাগছে তাঁর।
রিমি আড়মোড়া ভাঙলো।
-সেই কখন এসেছে। আমরা আসবার আধঘন্টা পরেই। তুই ঘুমে শুনে ডাকতে মানা করলো। ভোর হয়ে যাচ্ছে, এখনো বসে আছে।
রিমি দিশেহারা ভাবে মায়ের দিকে তাকালো। এত রাতে মানুষটা কেন এলো? কোনো সমস্যা?
-উফ্! আমায় ডাকোনি কেন মা?
রিমি হতভম্ব একটা ভাব নিয়ে শোয়েবের সামনে এলো,
-কোনো জরুরী দরকার ছিল? ফোন করতে পারতেন, রাতেই আসতে হলো?
-তোমার জন্যই তো এলাম..
-তাই বলে রাতে?
-তুমিই তো আসতে বললে… তুমি কি মনে করেছো, তোমার ইশারা আমি বুঝতে পারবোনা?
-মানে?
শোয়েব এগিয়ে এসে রিমিকে জড়িয়ে ধরলো,
-বিছানায় পানি ঢেলে দিলে, মানে কি? আপনার বিছানা ভেজা, আমার বিছানায় আসুন।তাই চলে এলাম।
শোয়েবের চোখেমুখে বিজয়ের হাসি।
রিমি হতাশ গলায় বললো,
-পানি ঢালার এই মানে করলেন?
-তুমি কি ভেবেছিলে আমি বুঝতে পারবোনা? শুনো, ফাইনাল সেমিস্টারে থাকাকালীন আমার একটা প্রজেক্ট ওয়ার্ক রেকর্ড করে ফেলেছিলো। আমার টিচার আমাকে বলেছিলেন, এরকম ব্রেইন তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে কোনো স্টুডেন্টের মাঝে দেখেননি….
-শুধু আমার ইশারায় আপনি এত রাতে এসে জেগে বসে থাকলেন!
শোয়েব নরমভাবে হাসলো,
-তোমার ইশারা হুকুম আমার জন্য… রাণী মানি তো তোমাকে… এই যে এখান থেকে।
রিমি অসহায়ের মত হাসলো। এত ব্রিলিয়ান্ট স্বামীর কি সত্যিই সে যোগ্য? মানুষটা কি রিমির রূঢ় আচরণ কোনদিনও বুঝবে? এত অন্ধ অনুরাগ!
-আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। চা খাবেন? ভোর হয়ে যাচ্ছে।
-হু খাবো…. চা খেতে খেতে স্বপ্ন শুনবো তোমার!
-বারান্দায় দাঁড়িয়ে?
-একটু বলে চলে এলে! মন খচখচ করছে শুনতে।
রিমি হাসলো। তাঁর জীবনে ভোর নিয়ে আসা মানুষটাকে সাথে করে আজ সে ভোর হওয়া দেখবে। আনন্দে রিমির বুকের কাঁপন শত লক্ষ গুণ হয়ে গেল।
শোয়েব পিছন ডাকলো আবার।
-রিমি….. মেক্সি পরেছো কেন?
রিমি নিজের মেক্সির দিকে ভালো করে তাকালো।রিমি মেক্সি পরেছে রাতে রিলাক্সে শুতে…. ডক্টরও বলেছেন, ফিটিং কামিজ রাতে শুতে না পরাই ভালো।
-কেন, ভালো লাগছে না শোয়েব ভাই?
শোয়েব ডানচোখটা টিপে দিয়ে বললো,
-শুধু ভালো লাগছে না, মাথা নষ্ট করা ভালো লাগছে। আমার সাথে যতক্ষণ থাকবে, ফ্রম নাউ মেক্সি ইজ এ মাস্ট।
রিমি চা বানাতে চলে গেল।

শোয়েব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো,
-তুমি চা খাবে না রিমি?
রিমি না সূচক মাথা নাড়লো।
-এই যে লেবুর শরবত খাবো। শুকিয়ে যাচ্ছি তো! হেলথ কনসাশ হয়ে যাবো এখন থেকে…..
শোয়েব রিমির গা ঘেঁষে পাশে দাঁড়ালো।
-গানটা যেন কি ছিলো রিমি? তুমি না থাকলে সকালটা এতো মিষ্টিই হতো না। ভোরের আলোটা দেখেছো? একটা স্পেসিফিক রঙকে কোট করছে। সব জিনিস এতে একটা বিশেষ রকমের লাগছে, তাই না? রোদের শুরুটা কত মিষ্টি হয়…. ভাবা যায়?
রিমি একমনে শরবত খাচ্ছে। রোদ রিমির কখনোই ভালো লাগেনা। রিমির ভালো লাগে বৃষ্টি। টানা বর্ষণ না, এক পশলা ঝুম বৃষ্টি!
-কি হলো? রিমি বলো… তুমি ছিলে গরীব তাঁতী, তারপর?
রিমি শরবতের গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো হাত থেকে।
বাঁ-হাতটা শোয়েবের কাঁধে ভাজ করে পেতে নিয়ে এই প্রথম স্বেচ্ছায় রিমি শোয়েবের কাঁধে মাথা রাখলো।
-আমি ভীষণ দরিদ্র তাঁতী। এতই করুণ অবস্থা যে, আমার শীতের কাপড়টা বুনতে বুনতে গরম এসে যায়, আবার গরমের কাপড়টা বুনতে বুনতে শীত এসে যায়। অর্থাৎ আমি সময়মত পাইনা কিছুই!
কিন্তু এত কিছুর পরও আমার কোনো অভিযোগ নেই, আমি খুব সৎ…. আপনি রাজ্য ঘুরতে এসে আমার দুঃখ কষ্ট দেখে আমায় সাহায্য করতে চাইলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি চাই? যা চাই, তাই পাবো।
আমি বললাম, মহারাজ, আপনি আমার হেরফের গুছিয়ে দিন। আমি যাতে শীতের বস্ত্র শীতে আর গরমের বস্ত্র গরমেই পাই। আপনি খুব অবাক হলেন। এত বড় রাজা আপনি, আমি কিনা এত তুচ্ছ সাহায্য চাইলাম! আপনি রেগে বললেন, যাও তোমার হেরফের ঘুচিয়ে দিলাম। শীতের বস্ত্র তোমায় শীতেই দেওয়া হবে। এখন দেখা গেল, শীত একেক বছর একেক সময়ে নামছে…. আমার হেরফের ঘুচিয়ে দিতে নাজেহাল অবস্থা! রাজ্যেরই খবর নেই…. আপনার!
শোয়েব হাসলো।
-ব্যস শেষ?
-হুঁ….
শোয়েব রিমির মুখোমুখি দাঁড়ালো।
রিমির দু-হাত শক্তভাবে মুঠো করে ধরলো।
-এই স্বপ্নটা তুমি ইচ্ছে করেই দেখেছো, তাই না?
-স্বপ্ন কি ইচ্ছে করে দেখা যায়?
-অবশ্যই… সারাক্ষণ ভাবছো, আমি তোমায় হেল্প করছি। নাহলে তুমি জলে ভেসে যেতে…..
রিমি গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো শোয়েবের দিকে।
-ভেসে যেতামই তো। আপনিই না শক্ত করে ধরলেন।
শোয়েব ওভাবেই কিছুক্ষণ রিমির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হাতটা ছেড়ে দিয়ে চায়ের কাপটা এদিকওদিক ঘুরাতে থাকলো।
-একটা কাজ করলে কেমন হয় রিমি?
-গ্রান্ড করে একটা রিসেপশান করি আমাদের। তারপর ওখানে পৃথিলাকে ডাকি, দেখুক। একটা লেসন তো ও’র দরকার আছে। কষ্ট পাক না একটু।
কি বলো? তোমায় আমি কুইনের মত গ্রহণ করবো দেখুক। ইনসাল্ট কাকে বলে? কি হলো কিছু বলছো না যে?
রিমি নিজের ওড়নার কার্ণিসটা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,
-শুধু ওকে কষ্ট দিতে রিসেপশান? আসলেই এভাবে ও’কে কষ্ট দিলে কি আমাদের সুখের পরিমাণ বাড়বে?
-মানে?
-মানে হলো, কাউকে কষ্ট দেবার জন্য কোনো চেষ্টার দরকার নেই। যে কষ্টটুকু তার পাবার কথা, তা সে এমনিতেই পাবে। সৃষ্টিকর্তা দেখছেন তো সব… সব উনার উপর সঁপে দিন। সর্বোত্তম ফলাফল নিশ্চিত।
-তুমি অনেক জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলছো.. হোয়াই?
শোয়েব মুখের ভাবটা বিরক্তিকর করে ফেললো।
-রিসেপশান করলেই এত এত টাকা খরচ… কোনো দরকার আছে? কাছের আত্মীয়রা তো সবাই জেনেছেই। দরকার নেই।
-উঁউঁউঁ.. দুদিন ব্যবসা করেই একদম টাকা চিনে গেছে…. দুদিনের বৈরাগী ভাতকে বলে অন্ন….
রিমি মনে মনে ফিসফিস করে বললো, হে পরম করুণাময়, মানুষটার সমস্ত জীবন তুমি সবথেকে আনন্দময় সময়ে ভরে দাও…..
-কি হলো? আবার মুক কুঁচকে তাকিয়ে আছো কেন? পেটে ব্যথা?
রিমি নিজের বুকের বামপাশটায় হাত ছুঁইয়ে বললো,
-না এই এখানে ব্যথা….
শোয়েব দুষ্টামির দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকালো। কাছে এসে রিমিকে কোলে তুলে নিলো। ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
-এখন আমরা ব্যথা শেয়ার করবো…..
-আমায় সাড়ে নটার আগে ছেড়ে দিতে হবে, শোয়েব ভাই! শিউলি আজ আসবে না। ও’র বিয়ের আলাপ চলছে…
-আর যদি না ছাড়ি?
-জরিমানা আসবে, প্রতি মিনিটে লক্ষ টাকা..
শোয়েব রিমির নাকটা আলতোভাবে কামড়ে দিলো।
-এই জীবন তোমার তরে জরিমানা…. রিমি!
রিমি লজ্জায় শোয়েবের গলার নিচে মুখ লুকালো….
ভোরের আলো ফুটে গেছে সম্পূর্ণভাবে। শোয়েব ঘরে ঢুকে পা দিয়ে ঠেলে দরজা বন্ধ করলো।
রিমি অস্ফুট স্বরে বললো,
-দরজায় পা দিতে নেই… ভালো না।
শোয়েব রিমির গালে গভীর করে চুমু খেলো।
-আজ তোমার সাথে সব “ভালো না” হবে।

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here