রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_৩৫

0
299

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৫

লীনা হাসিমুখে খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-বাবা দিয়েছেন। তুমি পড়বে, ভাববে, তারপর ডাকবে আমায়। আমি ততক্ষণ তোমার বুটিক ঘুরে দেখছি।
রিমি হাসিমুখে খামটা হাতে নিলো।
-এই রিমি, তোমার বুটিক তো বেশ জমজমাট। বাহ্ জমিয়ে দিয়েছো পুরোই।
রিমি সৌজন্যতামূলক হাসলো একটু।
-বলতে পারেন, ভাগ্য লেগে গেছে।
খামটায় চোখ বুলালো রিমি। কিচ্ছু লিখা নেই।
সাদা খাম। চিঠির নয়, অফিশিয়াল লেটারের! চিঠিটাকে রিমির কেমন জানি নিষ্ঠুর মনে হলো।
-আপনাদের এই চিঠি ব্যাপারটা মজার! অনেক কথা যেটা মুখে বলতে গেলে বেশ অস্বস্তি হয়, চিঠিতে সেটা কত স্বাভাবিক আর অবলীলায় লিখে দেওয়া যায়! শক্ত কথা, ভালো লাগার কথা… সবববব।
লীনা জবাবে হাসলো তবে তাকালো না। সে একমনে শাড়ির ডিসপ্লেটাতে চোখ বুলাচ্ছে।

চিঠিটা খুলে রিমি বুটিকের একটু কোণার দিকে চলে এলো। টাইপ করা সুন্দর চিঠি! সাদা কাগজটার চারিদিকে রুপোলী বর্ডার করা।
রিমি পড়তে শুরু করলো।

রিমি,
শোয়েব বাবা হতে চলেছে এত চমৎকার একটা খবর তুমি যদি শুরুতেই বলতে তাহলে শোয়েবের ফেরা নিয়ে কোনো কথাই হতো না। শ্বশুর হিসেবে তোমার কাছে আমি অপরাধী কিন্তু বাবা হিসেবে আমি মোটেও অপরাধী নই। তোমার নিজের যখন সন্তান হবে, তখন দেখবে তোমার সন্তানের জন্য তোমার যেটা ভালো মনে হবে সেটাই তুমি চাপিয়ে দিতে চাইবে! সে না চাইলেও দিতে চাইবে! সেটাই করেছি আমি। তোমার প্রতি করা অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত আমি।

তোমার মা যখন বললো, তুমি মা হচ্ছো, সেটা শোনবার পর থেকে আরও বেশি খারাপ লাগছে।
তোমার সব ধরনের অসুবিধা ও কাজে সহায়তা করতে চাই। আমাদের কাছে এসে থাকলে ভীষণ খুশি হবো। একটা অনুষ্ঠানের মত করে তোমায় বরণ করে নিয়ে আসবো আমরা! বাকি তোমার ইচ্ছে। তোমার কাজে সর্বোচ্চ সফলতা কামনায়!
তোমার অপরাধী (শ্বশুর) বাবা!

***আর একটা কথা, শোয়েবকে এই আনন্দসংবাদটা আমি প্রথমে জানাতে চাই। তুমি যদি অনুমতি দাও তবে!

রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সে মায়ের কাছে থেকেই বিজনেসটা চালাতে চায়! অনেক কাজ তাঁর। বিজনেসে ঝড়ের গতিতে রাইজ করছে। শোয়েবদের ওখানে যাওয়া মানে এই প্রেগন্যান্সি নিয়ে আলাদা আদিখ্যেতা। রাতবিরেতে বের হওয়া যাবেনা। অথচ রিমির রাতেই কাজ বেশি।

আচ্ছা, মা প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা বুঝলো কিভাবে? রিমি তো মাকে কিছু বলেনি! বমি করা দেখেছে নাকি বুঝা যায়? রিমি নিজের পেটের দিকে তাকালো।

লীনা হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-পড়া হলো?
রিমি মাথা নেড়ে বললো,
-আমি কি লিখে জবাব দিবো? নাকি…..?
-যেভাবে দিতে তোমার ভালো লাগবে।
লীনা রিমির আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালো। রিমির হাতটা ধরে বললো,
-সাথে চলে এসো আমার; জবাব দেয়া হয়ে যাবে। আমাদের সাথে এসে থাকো। অনেক যত্ন করবো তোমার… শোয়েব খুশি হবে।
রিমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাসলো শুধু।
-আমার এই ছোট্ট ব্যবসাটা খুব ভালো চলছে, মানে চিন্তার বাইরে ভালো। এখানে আমার খুব সময় দেয়া দরকার। ওই যে ক্রিকেটারদের থাকে না একটা পারফরমেন্স এইজ, আমারও বোধহয় বিজনেসে এখন সেটা।
-তার মানে দাঁড়ালো, এখনি যাচ্ছো না তুমি!
-জি, বাবু হয়ে গেলে এমনিতেই আমায় একটা মেটারনিটি ব্রেকে যেতে হবে। সুতরাং আমি মনপ্রাণ দিয়ে খাটতে চাই এখন।
লীনা একটা মন খারাপ করা হাসি হাসলো।
-আমি ব্যর্থ এবং দুঃখ পেলাম। তবে তোমায় কনগ্রাচুলেশন্স। এই এত বড় ব্যাপারটা একদম নিঃশব্দে চেপে গেলে কিভাবে? আন্টি যদি না বলতেন…
রিমি উঠে আবার প্যাকিং এ কাজ করতে লাগলো। দোকানে লেবার বাড়িয়েছে সে, তাও এত কাস্টমার ডিল করে সে কুলাতে পারছেনা। শরীরও দুর্বল খুব, খাওয়াটা যদি দুবেলাও ঠিকঠাক খেতে পারতো.. এত বমি কবে যে বন্ধ হবে?
লীনা বেরিয়ে য়ে যাবার আগে আবার রিমির সামনে এসে দাঁড়ালো।
-কিছু শাড়ি সিলেক্ট করেছি আমি, বিল যদি করে দিতে। তোমার এখানের সব প্রোডাক্টই খুব পছন্দের, কোনটা ছেড়ে যে কোনটা নিই?
-আপনি সিলেক্টেডগুলো আলাদা করে ক্যাশ কাউন্টারে রেখে যান। ডেলিভারি দিয়ে আসার সময় বিল নিই আমরা।
-বাব্বা, পাক্কা ব্যবসায়ী পুরো। আর চাপা একটা। বাবু পেটে দিব্যি চেপে গেছে, এত অসুস্থ শরীরে কত কাজের লোড নিচ্ছো। বরটা জানলে তো মরেই যাবে।
-বরের জন্যই তো করছি। আমায় সাকসেসফুল দেখলে স্বস্তি যাতে পায়!
লীনা একটা একপেশে হাসি হাসলো।
-বরই সব? এই যে আমি এখন এত পিছু ঘুরছি তা বুঝি কিছু না?
রিমি জবাব দিলো না। বিল প্যাডে একমনে বিল লিখতে ব্যস্ত সে।
লীনা মোবাইলে সময় দেখলো। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হবার জন্য উঠতেই রিমি বললো,
-স্যারকে বলবেন তিনিই যেন শোয়েব ভাইকে নিউজটা জানান। আমি এমনিতেও বলতে পারবো না।
তারপর রিমি লীনার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
-দেখুনতো, বুঝা যায় নাকি দেখে?
লীনা একটু মনোযোগী ভাবে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো রিমির দিকে।
-ক মাসে পড়লো? তেমন একটা না। যে জানবে না, সে বুঝবেই না! তবে শুকিয়ে গেছো একদম! নিজের একটু তো যত্ন নিবে, নাকি? অন্তত শোয়েবের বাবুর জন্য…
লীনার মুখের ভাবটা চিন্তিত মনে হলো।
রিমি বিল প্যাডটা রেখে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গার মত করলো।
-এই ঢাকা শহরে কত মহিলার বাচ্চা হয় জানেন? খেতে পারেনা, থাকার জায়গা নেই, সারদিন ইট ভাংছে, বোঝা টানছে, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে খাটে, তার তুলনায় বরং আমি তো অনেক ভালো আছি, গাড়ি করে চলছি। এটা সৃষ্টিকর্তার রহমতের ব্যাপার সম্পূর্ণ। চিন্তা করবেন না এত!
-তোমার অনেক ধৈর্য্য রিমি! আমি তো সারাবাড়ির সবাইকে টেনশান দিয়ে মারতাম। শোয়েব আসলেই অনেক লাকি! কোনো পেইন নেই, গিফট চাওয়া নেই…. একদম প্লেইন পিস।
-উনি লাকি না, বলতে পারেন আমি লাকি। কিসে আমার সফলতা তা অন্তত বুঝতে পেরেছি। নাহলে বেকার খেটে মরে যেতাম, জীবনে কি করার ছিল জানতামই না কোনোদিন।
-তোমার অনেক সাহস রিমি আর মনের জোড় তো লা জবাব। একটা ছোট্ট বিজনেস আইডিয়া কিন্তু এখানে এসে দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ দাঁড় করিয়ে দিয়েছো! সাহসী নারী বলতে হবে।
রিমি মনে মনে বললো, সাহস আমার একদমই নেই লীনা ম্যাম, শুধু শোয়েব ভাইকে পাশে পেয়ে বিশ্বজয় করে ফেলতে ইচ্ছে করে।
কি যেনো গান শুনেছিলো সে একটা….
“তুমি যদি হেসে বলো, দু-কদম পাশে চলো জিতবোই অবশেষে….”
-আমি কিন্তু তোমায় কথা দিয়েছিলাম, আমি হারলে তোমার ওয়েলকামে আমার সবথেকে বেশি ভূমিকা থাকবে।
-সেজন্যই বুঝি এত করছেন? বারবার করে নিতে আসছেন আমায়?
লীনা একটু চমকালো, সে কি নিজের কথা রাখতেই এতসব করছে? সব করছে সে তাঁর স্বামীর জন্য… নিজের একমাত্র ছোটভাইকে কষ্টে ফেলার অপরাধে, সৌরভ লীনার কাছ থেকে একটু একটু করে কি দূরে সরে যাচ্ছে না?
-ইচ্ছে না করলে জবাব দিতে হবে না। থাক…
লীনা দুমিনিট দুম মেরে থাকলো। তারপর একটু অসাড় গলায় বলতে লাগলো…
-ঠিক তা না রিমি.. জীবনে কিছু ব্যাপার থাকে “আমাদের”! কিছু ব্যাপার থাকে “আমার”। কিছু শুধু ‘আমার’, এই ব্যাপারগুলো কোনোদিনই “আমাদের” হয়না। সৌরভ আমার জীবনে তেমন শুধু ‘আমার’ ব্যাপার। বলতে পারো, শোয়েবকে সে খুব ভালোবাসে, আর আমি সৌরভকে। সৌরভ আমার অনেক সাধনার রিমি… আমি ও’কে কষ্টে পেতে দিতে পারিনা। আমার জীবনের এই এত এত স্বাধীনতা; সব কিন্তু ও’র জন্যই। স্ত্রী হিসেবে সে আমায় ভালোবাসেনি, বরং তাঁর সমান একজন ‘মানুষ’ হিসেবে সব সময় ভালোবেসে এসেছে। এই যেমন শোয়েব তোমার কাছে আসবার জন্য কেমন পাগল পাগল করে…. এই সব কিন্তু শুধু ভালোবাসা’ই, বুঝলে রিমি। ভালোবাসা বড় কঠিন যন্ত্রণা!
লীনার গলা ধরে এলো। রিমি প্রায় ফিসফিস করে বললো,
-ভালোবাসার এত শক্তি কেন বলতে পারবেন ম্যাম? এই যে আমার এত শরীর খারাপ, তাও দিনরাত খেটে মরে যেতে ইচ্ছে করে… সবসময় স্বপ্ন দেখি, একদিন আমায় নিয়ে শোয়েব ভাই কোনো টেনশানে থাকবে না, আমার জন্য যাতে কখনোই সে হয়রান হবেনা… খালি ভালো অনুভব.. খালি স্বস্তি দিতে মন চায় মানুষটাকে।
“ভালোবাসা” একটা শক্ত মৃত্যুর নাম। শোয়েব ভাই’র জন্য এই প্রাণের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি কাজ করতে রাজি।
লীনা চলে গেল…. রিমির আবার গা গুলাচ্ছে… জুস খাওয়া দরকার! শোয়েবের গায়ের গন্ধটা হঠাৎ নাকে লাগছে… ইয়াক…

শোয়েব ফোন করলো, রাত দুটোর দিকে। রিমি জেগেই ছিল। ফোন দেখেও রিসিভ করলো না, নিশ্চয় খবরটা শুনে ফায়ার হয়ে আছে। আজ সন্ধ্যায় রিমি এজন্যই ফোন করেনি। এতক্ষণ ওয়েট করে শেষমেশ নিজেই ফোন দিলো তা হলে? এত রাতে কারো বকা শুনতে তাঁর একদম ইচ্ছে করছে না। চমৎকার ঘুম পেয়েছে তাঁর! ঘুমোবে সে……
ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখতে রাখতে রিমি বললো, তুই তোর মত চাকরি কর না রে ভাই, আমায় বিজনেসটা ঠিকঠাক করতে দে।

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here