হলিডে #পর্ব_৩০_ও_৩১

0
371

#হলিডে
#পর্ব_৩০_ও_৩১

#পর্ব_৩০

মেজবাউর সাহেব পুরো ঘটনা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি তো সামনেই ছিলেন।
রিতু এবার আরো বেশি জোড়ে ধমকে উঠলো।
—বাবা, আমরা একটা বিয়ে বাড়িতে বেড়াতে এসেছি আর তুমি কিনা ধরে ধরে সবাইকে মদ খাইয়ে দিলে।
মা এখন কি করছে জানো? এখন রনি ভাইকে নিয়ে রাজ্যের উন্নয়ন ফর্দ করছেন। উফফ….. লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। বেচারার কাল বিয়ে অথচ আজ তিনি রাজবন্দী।
—আচ্ছা, নীরা মেয়েটার কি অবস্থা এখন?
রিতু মুখে আঙুল দিয়ে বললো,
—শশশশশশশ… আস্তে বাবা। উনার কথা এখনও কেউ জানে না। মায়ের কান্ডতেই সারা বাড়ি তুলকালাম অবস্থা।
—তাকে প্লেইন লেমন জুস দিতে বল একটু বেশি সল্ট এড করে। তাতে বমি হবে। বমি হয়ে গেলেই তারপর শরীর টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
—আর মা, মাকে কি করবো? তাকে কে সামলাবে?
মেজবাউর সাহেব বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে গায়ে চাদর টেনে নিলেন।
—রিতু, তোর মা একবারের জন্য নিজেকে মহারাণী ভেবে খুশি হচ্ছে। তাঁর এই সুন্দর অনুভুতিটাকে নষ্ট করে দেওয়া কি ঠিক হবে? তাছাড়া বেচারি তো কারও ক্ষতি করছে না। সবাই যখন মজা পাচ্ছে, এমন চলুক না….
—তার মানে তুমি যাবে না মায়ের কাছে?
মেজবাউর সাহেব জবাব দিলেন না।
রিতু উঠে দাঁড়ালো। ওদিকে ভাইয়া, নীরাপু কি করছে কে জানে? নীরাপুর বমি কি কমেছে? এমনিতেই বাড়ির সবাই জানে নীরাপু ঘুমিয়ে। তাই বলে কতক্ষণ! আরেকবার গিয়ে চেক করা দরকার। ভাইয়া একা কিভাবে সামলাচ্ছে কে জানে?
রিতু দরজা পর্যন্তও গেল না মেজবাউর সাহেব ডাকলেন,
—রিতু, তোর মায়ের পাশে পাশে একটু থাকিস। রাণী মানুষ, বুঝিসই তো? এটা ওটা দরকার লাগবে। এই তুই বরং একটা কাজ কর, একটা মুকুট কালেক্ট করে ফ্যাল, তোর মা’কে পরিয়ে দে… বেচারি যাও একটু রাণী হলো, তাও মুকুট নেই। আমার তো তোর মায়ের জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে।
—তো শুয়ে শুয়ে বুক ফাটাচ্ছো কেন? তুমিই এসে মাকে মুকুট পরিয়ে দাও। রাণীর রাজ্য অভিষেক রাজার হাতেই হোক!
রিতুকে অবাক করে দিয়ে মেজবাউর সাহেব উঠে পড়লেন।
—চল তাহলে আমিই মুকুটটা দিই। হীরের মুকুট হলে কেমন হয়? বেচারি কখনোই তো সাধ করে দামী কিছু চায়নি! এই প্রথম রাণী সাজছে… আচ্ছা, জুয়েলার্স কি খোলা পাওয়া যাবে? তুই বরং ড্রাইভার কে নিয়ে চলে যা রিতু।
রিতু বিড়বিড় করে বললো, সবারই তো নেশা হয়ে গেছে দেখছি। পারভীন আন্টি আর কেন বাদ থাকবে? উনাকেও একটু দেওয়া যাক। তিনি তো আস্ত মুরগী ফ্রাই করা নিয়ে ভয়ে আধমরা হয়ে আছেন। ড্রিঙ্ক নিলে হয়তো উনার ভয়টা কাটবে বরং।

রিতু দরজায় কয়েকটা টোকা দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তামিম কথা না বলে ফোনে টেক্সট করলো,
“ভেতরে আসবি?”
রিতু “ইয়েস” লিখে টেক্সট পাঠালো।
ঘরের বাতিটা নেভানো। আবছা আলো ঘরে। খুব সাবধানে ভেতরে এসে রিতু প্রায় থমকেই গেল।
—তুই গোসল করেছিস নাকি ভাইয়া?
—হু… তিনবার বমি করেছে। একবার মাথায়, দুইবার বুকে।
—নেশা কি কেটেছে কিছু?
—একটুও না। বরং বাড়ছে, ঘুমিয়ে গেলে বোধহয় ঠিক হয়ে যেত।
নীরা খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে গান গাইছে। তাঁর হাঁটু অবধি নগ্ন পা ভাঁজ করে সে দোলাচ্ছে! পিঠের ব্লাউজ অনেকটাই খোলা। শাড়ি নেমে গেছে বেশ….
—তিনি এখন ঠিক কি করছেন? চেইঞ্জ করে দে উনাকে।ভিজে কাপড়ে জ্বর বেঁধে যাবে।
তামিম জবাব দিলো না।
—তোর কি লজ্জা লাগছে?
তামিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—দেখ ভাইয়া মাতাল বউ বড় বিপজ্জনক বস্তু। একে হাতছাড়া করলেই মহাবিপদ। তার উপর তোর বউ আবার কাঁচকাটা সুন্দরী। তোকেই সামলাতে হবে।
তামিম রিতুর হাত চেপে ধরলো।
—আমি পারবো না রিতু। কি সব আচরণ করছে, এখন সেজেছে ঐশ্বরিয়া রাই। কখন কোন ভুল হয়ে যায় আমার! তুই থেকে যা না রিতু।
রিতু তামিমের হাত ছাড়িয়ে দিলো।
—আমি থাকবো মানে? তোর বউ মদ খেয়েছে, এটা তো তোর উপর বর্তায়! তুই সামলাবি, খবরদার এভাবে তাকাবি না। বউ যখন মদ খেলো, তখন কই ছিলি তুই?
তামিম অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে।
—দেখ, আমি বাবার সাথে মায়ের জন্য মুকুট কিনতে যাচ্ছি। আমি পারবো না।
—মায়ের জন্য মুকুট?
—হু। মা এই প্রথম রাণী হলো, বাবা হীরের মুকুট পরিয়ে রাজ্য অভিষেক করবে মায়ের।
তামিম মুখটা আরো কাঁদো কাঁদো করে ফেললো।
—তুই তোর বউয়ের সাথে আছিস ভাইয়া, এমন মুখ করছিস যেন বাঘের সাথে আছিস। তাও তোর ব্রান্ড নিউ বউ। যা একটু আদর টাদর করে ঘুম পাড়িয়ে দে!
—আমার নিজের ব্যালেন্স নেই রিতু। মাথার ঠিক নেই ওর। ভুল টুল কিছু হয়ে যায় যদি?
রিতু একদম আওয়াজ না করে দরজা খুললো।
—ভুল হলে হবে, এত ভয় পাবার কি আছে? তুই কি সাধুসন্ত নাকি যে ভুল করা যাবে না? বরং সুযোগ যখন পেয়েছিস ভুলটা করেই ফেল।
—-তুই যে কি বলিস না রিতু।
—আমি ঠিকই বলি ভাইয়া। জীবনে বেশি ভালো আর সহজসরল হওয়া একদম ঠিক না। দেখ, বাঁশঝারে বাঁশ কাটতে গেলে প্রথমে আমরা কোন বাঁশটা কাটি? সবথেকে সোজা আর সুন্দর বাঁশটা। জীবনেও এরকম; বেশি সোজা মানুষই এরকম সোজা বাঁশটা খায়! সো এত ভালো হবার কোনো দরকার নেই।
তামিম বিমর্ষ দৃষ্টিতে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
—বেস্ট অফ লাক ভাইয়া। কিছু লাগলে বলিস আমাকে।
রিতু বেরিয়ে গেল।

তামিম নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। নীরা এখন খুব মনোযোগ দিয়ে গান গাইছে, চেঞ্জ করা দরকার ওর।
তামিম কাছে গিয়ে আলতো করে হাত রাখলো নীরার মাথায়। নীরা উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার শাড়ি খুলে গেছে একেবারে।
—সে গুণগুণিয়ে উঠলো, হালকি হালকি মোলাকাতে থি, দূর দূর সে বাতে থি…. ধীরে ধীরে কেয়া হোগায়া হে মে কেয়া কাহু?
—চুপ… গান বন্ধ। তোমার কাপড় কোথায় রাখো বলো, আমি বদলে দিচ্ছি। হিন্দি কথা বন্ধ।
—তু মেরি কাপড়ে কো টাচ মাত কর, মে খুদ করোঙ্গি…. সর….
তামিম সরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলো না। এর আগেই নীরা শাড়িটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
পেটিকোটটা অনেক উপরে তুলে দিলো। তামিম চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।
—নীরা প্লিজ! তোমার এখন হুঁশ নেই। আমি করে দিচ্ছি বললাম তো…
নীরা কাপড়টা আরো টেনে নিলো উপরে!
—মেরি বদন, মেরি হোশ.. মুঝে যো আচ্ছা লাগে গা মে করোঙ্গি…. তু কৌন হ্যায়? ওওওও তু তো মেরেকো লুটলিয়া হ্যায়…. হায় মে তো গায়া…..
নীরা কাঁদতে লাগলো।
—কেঁদো না নীরা। কাঁদার কি হলো? উফ্! এই নিয়ে কয় রাউন্ড কাঁদলে বলোতো?
তামিম পাশে বসলো নীরার। নীরা প্রায় ঝাপটে ধরলো তামিমকে। তামিমের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো!
—তেরি মা কো মে সবকুচ বাতা দুঙ্গি। সব……. তু হি তো সব কা মূল…… তুনে মেরেকো…!
তামিম ফিসফিস করে বললো,
—এতো কাছে এসো না নীরা। এত কাছে এসো না…..
নীরা হেসে ফেললো।
—কিউ? কিউ নেহি আওঙ্গি? কুচকুচ হোতা হ্যায় কিয়া?
তামিম উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। নীরার চোখে অন্য ইশারা৷ নীরা ব্লাউজের অনেকটাই নামিয়ে ফেললো। সবুজ ব্রায়ের ফিতে বেড়িয়ে গেছে! সে খুব মোলায়েম ভাবে তামিমের কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো। তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে তাঁর।
—তুমি এক্ষুণি গিয়ে বিছানায় বসো। আমি তোমাকে…..
তামিমের কথা শেষ হলো না নীরা তাঁর ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো তামিমের ঠোঁটে! তামিম চোখ বন্ধ করে নিলো।
বাইরে জানালা দিয়ে হরেক রকম বাতির আলো ঘরে এসে যেন আবার ফিরে যাচ্ছে। ঘরের আবছা অন্ধকারে নীরা যেন আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। একটু পরপরের আলোর ঝলকানিতে লতানো শরীর চোখ পুড়িয়ে দিচ্ছে তামিমের।

তামিম ফিসফিস করে বললো, আমি কোনো সাধুসন্ত নই.. নীরা। আমি খুব সাধারণ মানুষ। দোষে গুণে মেশানো৷ আমার যে ভুল করতে ইচ্ছে করছে খুব!

#পর্ব_৩১

নীরার ঘুম ভাঙলো লাবণীর চিৎকারে।
—আমার আজ বিয়ে নীরা। অথচ দেখো, বিয়ের সব কাজ আমিই করছি।সারারাত জাগলাম, সকালের নাস্তাও আমি বানালাম। আর তুমি কিনা ঘুমোচ্ছো। এই বিয়ের তাহলে দরকারটা কি ছিল? আমার তো মনে হয় আমি যেদিন মারা যাবো, সেদিনও আমায় গোসল টোসল করে কাফন পরে রেডী হয়ে মরতে হবে। ওহো কবরে নেমেই মরতে হবে। তোমরা তো আমাকে কবরে নামাতেও সুযোগ পাবে না।

নীরা শোয়া থেকে উঠে বসলো। সারা শরীর ব্যথা হয়ে আছে তার। হাত পা কিছুই নাড়ানো যাচ্ছে না। কোমরের ধারটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন।
—কটা বাজে ভাবী?
—টাইম দিয়ে কি দরকার আর? আবার তো রাত হবেই, ঘুমিয়ে থাকো।
নীরা ভালো করে চাদর মুড়িয়ে নিয়ে বসলো,
—এক কাপ চা দেবে ভাবী? মাথাটা ভীষণ ভার ভার লাগছে।
—কেন, উঠবে না? বিছানায় বসেই চা খাবে? তোমার কি শরীর খারাপ নীরা?
নীরা মিষ্টি করে হাসলো। সে বিছানা ছাড়তে পারছে না তার কারণ অন্য। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই! একটা সুতোও নেই। এর কারণ কি? সে কি কাল রাতে নগ্ন হয়ে শুয়েছিলো?
লাবণী হাত বাড়িয়ে নীরার কপাল ছুঁয়ে দেখলো,
—জ্বর টর তো নেই! তাহলে বিছানা ছাড়ছো না কেন? আমার বিয়ের গোসলটা কে করাবে?
—আমি করাবো, তুমি যাও ভাবী। আমি দুমিনিটের মাঝেই আসছি।
লাবণী চলে যেতেই নীরা আবার শুয়ে পড়লো বিছানায়। শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে তার! অন্তত চা আসা পর্যন্ত শুয়ে থাকা যাক। নীরা জানে, লাবণী এত বকবক করলেও ঠিক চা পাঠিয়ে দেবে। তবে শরীরের ব্যথাটা বেশ অন্যরকম লাগছে। কাল রাতে কি হয়েছিলো? মাথা এত কেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে? কাল রাতে সে মেজবাউর সাহেবের সাথে মদ খেয়েছিলো, ইয়েস….. তারপর? তারপর?
নীরার ভাবনায় ছেদ পড়লো। ফোন বাজছে। এই সকালবেলায় কে হতে পারে? মি.তামিম? উঁহু… তিনি তো এবাড়িতেই আছেন। তিনি কেন ফোন করবেন? আচ্ছা উনার কথাই বা কেন মনে হলো এখন?
মোবাইলে তাকিয়েই নীরা চমকে উঠলো।
ওহ… ডিরেক্টর আরিফ সাহেব ফোন করেছেন।
—হ্যালো স্যার! গুডমর্নিং..
—হ্যালো। ভেরি গুডমর্নিং নীরা! একটা ভালো খবর দিতেই বিরক্ত করলাম। তুমি কি বাড়িতেই?
—জি.. বাড়িতেই। না মানে বিরক্ত কেন বলছেন?
—তোমার বাড়িতে বিয়ে, তাও সকাল সকাল এরকম ফোন। আসলে খবরটাই এমন দারুন, যে আমি ফোন না করে থাকতে পারলাম না। তোমার টিভি সি অন এয়ারে যাবার আগে প্রডিউসার বললেন, সবগুলো ডিভিশানে প্রায় দুশোর মতো বিলবোর্ড তুলে দিতে। মেক্সিমাম সাইজের ১০০ আর মিডিয়াম সাইজের ১০০! তোমার কিছু স্টিল ফটো এডিটের কাজ চলছে এজন্য। আসলে পাব্লিক রিয়েকশান জানা দরকার। উনি চাচ্ছেন রিয়েকশান দেখে নিয়ে তোমাকে একটা লং টাইম কন্ট্র্যাক্টে নিতে।
—ওহ স্যার!
খুশিতে নীরার যেন কথা আটকে গেছে! সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এসব কি? বিলবোর্ডে তার ছবি! আচ্ছা সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে না তো?
—তবে নীরা এটাই কিন্তু তোমার দারুণ খবর নয়, দারুণ খবরটা হলো চিত্রনায়ক দুর্নিবার চৌধুরীর সাথে তোমার একটা মিটিং ফিক্স হয়েছে। কারণটা পরে জানবে।
আরিফ সাহেব হাসলেন।
নীরা কি কথাটা ঠিক শুনলো? এসব কি হচ্ছে? একসাথে এত কেন ভালো খবর? না না এটা স্বপ্নইই। চিত্রনায়ক দুর্নিবার চৌধুরী মানে? গত ঈদে একসাথে যার তিনটে ছবি রিলিজ করে গিয়েও হিট। যে তাঁর করা ছবিতে হিরোইন রিপিট করে না, সেই দুর্নিবার চৌধুরী?
—হ্যালো, নীরা তুমি কি শুনছো আমার কথা?
নীরার কথা বেরুচ্ছে না। কোনোভাবেই না।
আশ্চর্য! আনন্দে সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেনি তো?
—হ্যালো নীরা, তুমি কি আমার কথা শুনছো? মিটিং এর জায়গা এবং টাইম আমি তোমায় টেক্সট করে দিচ্ছি। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো, হোয়াই আর ইউ সাইলেন্ট?
নীরা গোঙানোর মত করে বললো,
—আমি একা কিছুতেই দেখা করতে পারবো না, আপনি নিয়ে যাবেন আমায় স্যার! আপনি নিয়ে যাবেন।
আরিফ সাহেব আবারও হেসে বললেন,
—সিনেমায় হিরোইন হতে যাচ্ছো, বি এ ব্রেভ গার্ল। একা একা মিটিং করা শিখতে হবে তো…. কে জানে হয়তো, সব বদলে যাচ্ছে তোমার জীবনে!
নীরা শক্ত গলায় বললো,
—আপনি সাথে না গেলে আমি যাবো না। একদম না। সত্যি…….
নীরার খুব কান্না পাচ্ছে। কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলে হতো। এখন কেউ নেই কেন? ওহোহো…

লাবণী কবুল বলার সময় সোবহান সাহেবের গলা ধরে একঢালা কাঁদলো। নীরাও সামনে যায়নি, কেন জানি তারও তখন বুক ভাঙছিলো খুব। কান্না দেখে রনি ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলো, বিয়ে বাদ। বিয়ের কোনো দরকার নেই। আমি বিয়ে করবো না।
শেষমেশ নাফিসা সামলেছে তাকে। পুরো পরিস্থিতি নাফিসা শক্ত হাতে সামলেছে। এমনকি শফিক ভাইয়া পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,
—-ভাবীর বিয়ে বলে এত কেন কষ্ট হচ্ছে?
নাফিসা ঠান্ডা গলায় বলেছিল,
—আপনার ভাবী অনেক দিন ধরে ভালো নেই, এখন থেকে উনি ভালো থাকবেন। আপনি যদি এভাবে কাঁদতে থাকেন, তাহলে যে উনার ভালো থাকার আগ্রহ কমে যাবে।
শফিক তারপর যেন পাথর বনে গিয়েছিলো। একটাও কথা বলেনি। শান্তভাবে সব কাজে থেকেছে।

তবে বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানে মি. তামিমকে কোথাও দেখা গেল না। সেলিনা বেশ মন খারাপ করেই ছিলেন। নীরা একবার খেতে বসতে ডেকেছিলো; তিনি কান্নাজড়িত গলায় বললেন,
—বুঝলে মা, ছেলেটা করে জল্লাদের চাকরি।চাকরিতে কোনো আরাম নেই। যখন তখন এই মিনিস্ট্রি, সেই মিনিস্ট্রি থেকে ডেকে পাঠায়। কত্ত ঝামেলা। বিয়েতে বললো, বউটা আসবে; সেও তো এলোনা। একা কি করে খাই বলোতো?
নীরা আর বিরক্ত করেনি তাকে।
বিয়ের পর লাবণী বেশ মন খারাপ করেই সেলিনার সাথে গেল। রনি বারবার করে বললো,
—ওবাড়িতে কেন? এবাড়িতেই থাকি? ওখানে গেলে যদি আবার পেট খারাপ করে?
লাবণী তখন কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,
—দুদিনে আর কিইবা পেট খারাপ করবে? সেলিনা মেডাম নিজে দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বিয়েটা দিলেন, তাঁর অনারে হলেও আমাদের দুদিনের জন্য যাওয়া উচিত!
হারুন পাশে থেকে রনির পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
—যান রনি ভাই। আল্লাহ ভরসা। ভাবী যখন বলছে, দুদিন ই তো মাত্র!
তারপর গলার স্বরটা একটু নামিয়ে নিয়ে বললো,
—ভাই বিয়ে করেছেন মানে জীবন শেষ, সব বউয়ের হাতে। আমি যে কিভাবে বিয়েটা ক্যানসেল করি, সেটা নিয়েই ভাবছি।
লাবণীরা চলে গেলেও নাফিসা রয়ে গেল। সে একটারাত এবাড়িতে এমনি কোলাহল ছাড়া থাকতে চায়।
বিয়ের পরের সমস্ত কাজে সে নীরাকে হাতে হাতে সাহায্য করেছে।

সন্ধ্যার পর নীরা যখন বেরুবে বললো নাফিসাও খুব আগ্রহী হয়ে বললো,
—জুস কর্নারে যাবেন তো? আমিও যাবো।
শফিক কিছু না বলেই নীরা আর নাফিসার পেছনে পেছনে বেরুলো। নাফিসা ইয়ার্কির সুরে বললো,
—আপনি কই যান?
শফিক কিছু না বলে শুধু মাথা চুলকালো।
—আমাদের সাথে আসলে পাশে পাশে হাঁটুন আর অন্য কোথাও গেলে পিছু ছাড়ুন।
শফিক নিঃশব্দে পাশে পাশেই হাঁটতে থাকলো।
নীরা হঠাৎ করেই বলে ফেললো,
—ম্যাম, আমার একটা অন্য কাজ মনে পড়ে গেছে, আপনি ভাইয়াকে নিয়ে জুস কর্নারে যান। আমি কাজটা সেরেই আসছি।
নাফিসা মনে মনে হাসলো। সে জানে এখন নীরার কোনো কাজ মনে পড়েনি। নীরা এখন বাড়ি ফিরে যাবে। আর আজকের রাতে শফিক নাফিসার সাথেই থাকবে। আহা কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজ। নদীতে নৌকা চড়তে পারলে বেশ হতো। আকাশে একটা চাঁদ, আর পানিতে একটা।
শফিক কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বললো,
—কি কাজ? চল, আমরাও যাই তোর সাথে।
নীরা গম্ভীর গলায় বললো,
—সবসময় সাথ ধরবে না তো ভাইয়া। ওটা আমার পারসোনাল কাজ। তুমি বরং জুস কর্নারে নিয়ে যাও উনাকে।
নাফিসা হাসিমুখে বললো,
—একটা রিকশা নিন তো শফিক সাহেব, আমার পা ব্যথা করছে। আমি হাঁটতে পারবো না।
শফিক হাত উঁচিয়ে রিকশা ডাকলো….
নাফিসা আর শফিক পাশাপাশি রিক্সায় বসে। তবে শফিক ভাই বাইরের দিকে একটু কাত হয়ে কুঁজো হয়ো বসেছে। বেচারা, কি লজ্জাটাই না পাচ্ছে!

নীরা আনন্দিত চোখে আছে ওদের দিকে। এবার বুঝি শফিক ভাইয়ার দুঃখ ঘুচে যাবে!
নীরা আকাশের দিকে তাঁকালো। বাইরে চাঁদের আলোয় কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে বাড়ি ফিরবে সে। এমনিতেও বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই তার।
নীরার ফোন বাজছে, তামিম ফোন করেছে।
—হ্যালো নীরা….
—হ্যালো……
—কেমন আছো?
—এটা জানতেই ফোন করেছেন?
—না আসলে তোমার জন্য একটা মহাদুঃসংবাদ আছে, যেটা শোনামাত্রই তুমি যেখানে আছো সেখানে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলবে। কিভাবে যে বলি?
—মি. তামিম আমি এখন কোনো মহাদুঃসংবাদ শুনতে চাই না। আর কাঁদতেও চাইনা। ভালো খবর থাকলে বলুন।
তামিম কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না, তাঁর কাছে তো এখন কোনো ভালো খবর নেই।
—হ্যালো, হ্যালো…. চুপ করেন গেলেন যে, ভালো খবর নেই? তাহলে রাখি… আমি চাঁদের আলোয় ব্যস্ত।
—ও হ্যাঁ আজ তো পূর্ণিমা। আমার তো মনেই নেই।
—মনে নেই, তাও তো আপনি জানেন পূর্ণিমা। আমি তো জানিই না।
—না জানাই তো ভালো ছিল। এই যে এখন তুমি জেনে গেলে পূর্ণিমা এখন দেখবে চাঁদের আলো কম কম মনে হচ্ছে। ঠিক না।
আসলেই নীরার কাছো চাঁদের আলো কম মনে হচ্ছে। এমনকি চাঁদটাও ছোট লাগছে!
—হ্যালো নীরা, দুঃসংবাদ টা কি বলবো?
—না, একদম না।
—তাহলে ভালো খবরটাই বলি। তবে যেই ভালো খবরটা আমার কাছে আছে, তা কি তুমি ভালোভাবে নিতে পারবে?
—তারপরও বলুন। ভালো খবর যখন শুনে দেখি।
—নীরা, কাল রাতে নেশার ঘোরে তুমি আমার একেবারে কাছাকাছি এসেছিলে। তোমার সারা শরীরে মোট কয়টা তিল আছে আমি গুণেছি! এইমুহূর্তে তোমার শরীরে আমার ডিএনএ তুমি বয়ে বেড়াচ্ছো।
নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, রাস্তাই বসে পড়লো প্রায়! তাহলে এই কান্ড! মাথাপাগলটা মিথ্যে বলে ভয় দেখাচ্ছে না তো? এর কাজই হচ্ছে উল্টাপাল্টা কথা বলে নার্ভাস করে দেয়া। নীরা কনফার্ম হবার জন্য জিজ্ঞেস করলো,
—বলুন কয়টা তিল আছে?
—মোট ২৬টা। এর মধ্যে লাল রঙের ৫টা।
ঠিক হয়েছে না?
নীরা লম্বা শ্বাস নিলো। মি. তামিমের কথা ঠিক হয়নি। তার শরীরে মোট আটাশটা তিল আছে।
নীরা উঠে দাঁড়ালো। তাহলে ভয়ের কিছুই নেই, মাথাপাগলটা ঠিক বলেনি। তার মানে হলো, যে ভয়টা নীরা আজ সারাদিন ধরে পাচ্ছিলো, সেটা হয়নি।
নীরা জোর গলায় বললো,
—একদম ঠিক বলেছেন। কারেক্ট! মি. তামিম, আপনার মহাদুঃসংবাদটা কি বলুনতো? এখন কেন জানি দুঃসংবাদ শুনতে ইচ্ছে করছে খুব।
তামিম হাসলো,
—আমাকে একটা ট্রেনিং এ ছমাসের জন্য আমাদের ইউ এস এ’র একটা ইন্সটিটিউশানে ডেপুটেশনে দেওয়া হয়েছে। আগামী ছ-মাস তুমি তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে পাচ্ছো না। দেখাও হবে না।
নীরা কিছুই বললো না।
—হ্যালো, নীরা তুমি কি স্বামীর জন্য কাঁদছো? দেখো একদম কাঁদবে না। আমি জানি, তোমার বুক ফেটে যাচ্ছে। সোনা আমার, আমারও তো কষ্ট হচ্ছে। বরং বেশি কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি আর করা বলোতো, চাকরির প্রমোশনে এসব ট্রেনিং রেজাল্ট খুব দরকারি। দেখো, একটু কষ্ট তো করতেই হবে, অন্তত আমাদের বাবুটাবুর কথা ভেবে। ও’রা যখন হবে তখন যদি বলে বাবা তুমি শুধু এডি কেন? ডি ডি হতে পারোনি কেন? তখন?
নীরার হাসি পেয়ে গেল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
—আসলেই তো… আমি তো এভাবে ভাবিইনি। আপনি যান, পতিদেবতা। ট্রেনিং করে আসুন। ভালো করে ট্রেনিং শেষ করুন। রাখছি…..
—নীরা শোনো, ট্রেনিং এ থাকা কালে তোমার যখনি আমায় দেখতে মন চাইবে বলবে; আমি ভিডিও কল করবো। আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। আমি বিদেশে গেলেও কিন্তু একান্তই তোমার হয়ে থাকবো বাবু।
—আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? তাহলে রাখি?
—-না হয়নি। আমার কিছু জিনিসপত্র তোমাদের ওখানে আছে, থাকুক। ট্রেনিং থেকে তো আমি সোজা তোমার কাছেই আসবো। তোমাদের বাড়িতেই থাকবো। হাজার হোক বউ হও তুমি আমার। ছ-মাসের বিচ্ছেদ সইতে পারলেই হয়।
—আচ্ছা।
—আর শোনো, তুমি টাকা নিয়ে একদম ভাববে না। হারুন সাহেব সবসময় তোমাকে কানেক্ট করে থাকবে! আর প্রতি দু’সপ্তাহ পরপর একটা বিগ এমাউন্ট আমিই পাঠাবো তোমায়।
—আচ্ছা, রাখছি।
—এতো রাখি রাখি কেন করছো? কথা বাকি তো!
—আচ্ছা, বলুন।
—একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে; আসলে তোমার শরীরে তিল ২৬টা নয়। আরো একটা জায়গায় দুটো বিশেষ তিল আছে। মোট ২৮টা। আর সেই বিশেষ তিলদুটোতে আমি মিনিমাম হাজারখানেক চুমু খেয়েছি। এবার কি ঠিক হয়েছে?
নীরা স্তব্ধ হয়ে শুনছে। সমস্ত গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে তার।
—হ্যালো নীরা শোনো, এরপর থেকে আমায় একদম মিথ্যে বলবে না। স্বামীকে মিথ্যে বলা একদম ঠিক নয়। বুঝলে?

নীরার মেরুদণ্ড দিয়ে হালকা একটা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল। মাথাপাগলটা কি বলছে এসব? এ তো মারাত্মক জিনিস!
ও মাই গড!

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here