হলিডে #পর্ব_৩২_ও_৩৩

0
346

#হলিডে
#পর্ব_৩২_ও_৩৩

#পর্ব_৩২

নীরার মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেল। হতে পারে ইন্ড্রাস্ট্রিতে সে নতুন, তাকে নাহয় দু-ঘন্টা যাবৎ অপেক্ষা করানো মানায় কিন্তু এই যে একজন নামীদামী ডিরেক্টরকে অপেক্ষা করানো হচ্ছে, সেটা কোনদিক থেকে ম্যানার? ভদ্রলোকের প্রতিটা মিনিটের অনেক দাম।
নীরা আরেকবার বললো,
—চলুন স্যার, চলে যাই। এত বড় নায়কের সাথে মিটিং এর কোনো দরকার নেই। উনাদের আসলেই সময় নেই! আপনি প্রডিউসারকে বলুন, আমরা চলে যাচ্ছি।
আরিফ সাহেব নীরার কথায় হাসলেন।
—ইন্ড্রাস্ট্রিতে তো এই আসল, এসব নায়কের সাথে একটা মিটিং এর জন্য কোনো কোনো ডিরেক্টর দুই -তিন মাসও ওয়েট করে। আর এখানে তোমাকে পছন্দ হওয়ায় প্রডিউসার ডাবল পেমেন্টে সবকিছু করছেন। দু-ঘন্টা তো কম। আমি তো আজ সারারাত ওয়েট করতেও রাজি।
—তবুও তিনি নিজেই এই টাইমটা ঠিক করে দিলেন।উনার পছন্দের সময়, উনার সুবিধের জায়গা, সবই উনার চয়েসে, তাও তো একটা মিনিমাম কার্টেসী রেখে কল দেরীর ব্যাপারে ইনফর্ম করলেন না।
—আরে দুর্নিবারের ব্যাপারটা তো তুমি বুঝবে না। ইন্ড্রাস্ট্রিতে ও সবার থেকে আলাদা। শুধু বেচারার সময়টাই বড্ড কম। যখন কথা বলবে, দেখবে কি সাধাসিধা অথচ সবথেকে বেশি রেমুনারেশন কিন্তু ও’ই নেয়।
নীরা আর কথা বাড়ালো না। মুখ কালো করে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিলো।। আরিফ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। লিফটের কাছে গিয়ে একবার ঢুঁ মেরে দেখা দরকার।

নীরা বিমর্ষ মুখে চায়ে চুমুক দিলো। তার ভালো লাগছে না। এত বড় নায়কের সাথে মিটিং কিন্তু সে একদম এক্সাইটিং ফিল করছে না। এই সন্ধ্যাবেলাটাও কেমন ভোঁতা ভোঁতা লাগছে।
মি. তামিমের আজ চলে যাবার কথা। রাত দুটোর দিকে ফ্লাইট। একবার কি এয়ারপোর্টে যাওয়া যায়? সে কি কোনো অনুভূতি থেকে যেতে চাচ্ছে নাকি কোনো দায়? দায় কিসের? নাকি ঋণ? মি. তামিমের কাছ থেকে সে অনেক টাকা নিয়েছে, আরো ফেবার নিয়েছে। সব মিলিয়ে যা নিয়েছে, সব হিসেব সে তো রেখেছে। তার দ্বিগুণ সে একদিন শোধ করে দেবে! কেন শোধ দেবে? শোধ না দিলে কি হবে? মি. তামিম কি তার শোধ না দেওয়ার মতো আপন কেউ? নাকি ভালোবাসা নামক বস্তুটা তার উপর ভর করতে চলেছে? এসব ভাবতে ভাবতে নীরা টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে সে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো, সে অচেনা ছায়াময় একটি নদীতে একা একা নৌকা চড়ছে। নদীর মাঝখানে এসে নীরা দেখলো, পানি এত গাঢ় সবুজ সুন্দর যে তার মুখটা তাতে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। নীরা পানির দিকে তাকিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। ও মাগো কি সুন্দর জল! আনন্দে সে হাত থেকে বৈঠাটা ফেলে দিলো।।
বৈঠা ফেলে দিয়ে সে মনের আনন্দে নদীর পানি নিয়ে খেলতে লাগলো। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, আরে বৈঠা কই? এখন কিভাবে বাড়ি ফিরবে সে? নীরা নৌকায় বসেই কাদঁতে লাগলো। আর তখনি কেউ একজন আরেকটা নৌকা নিয়ে এগিয়ে এলো। তাঁর নিজের বৈঠাটি নীরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—কাঁদছো কেন নীরা? বৈঠার জন্য তো? এই নাও বৈঠা।
নীরা বৈঠা নিতে হাত বাড়ালো। লোকটার বৈঠা নেওয়া কি ঠিক হবে? নীরা যদি বৈঠা নিয়ে নেয়, লোকটা নিজে কিভাবে ফিরবে? লোকটার কি ফেরার ইচ্ছে নেই? সে কেন নীরাকে সাহায্য করতে এসেছে? আচ্ছা, লোকটা কে? সে কি লোকটাকে চেনে? লোকটার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে গলার স্বরটা তার চেনা… ভীষণ চেনা।
আচ্ছা, সে কি লোকটাকে বলবে চলুন আমরা দুজনে একসাথে ফিরে যাই?

আরিফ সাহেবকে সারারাত ওয়েট করতে হলো না। নায়ক দুর্নিবার চলে এসেছে। পুরো রেস্টুরেন্টের সবজায়গার বাতি একসাথে জ্বলে উঠলো।
লিফটের দরজা খুলতেই দুর্নিবার হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। যেন সে আরিফ সাহেবের সাথে হাত মেলাতেই এসেছে। আরিফ সাহেবের মন গলে গেল। তিনি হাসমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ব্ল্যাক জ্যাকেটের সাথে ব্লাক টিশার্ট, সাথে ব্রিক রেড প্যান্ট। মাথার নীল ক্যাপটাও দুর্দান্ত। দুর্নিবারকে দেখাচ্ছে, হলিউডের ডিটেকটিভ মুভির নায়কের মতো। চমৎকার ঝরঝরে গলায় সে বললো,
—ভালো আছেন আরিফ ভাই? শরীর কেমন? ডায়াবেটিস?
দুর্নিবারের এই একগুণ! এতবড় হিরো অথচ ব্যবহারে কোনো অহংকার নেই। দুর্নিবারের সাথে তিনি যতটুকু কাজ করেছেন একটা জিনিস তিনি পেয়েছেন, তা হলো সদ্বব্যবহার। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ক্যারিয়ার তাঁর। এর মধ্যেই বাজিমাত করে দিয়েছে। বয়স মাত্র ২৭। এখনও চোখ বন্ধ করে আরো একযুগ ইন্ড্রাস্ট্রিতে লিড করবে সে। তবুও আচরণে এত বিনয় যে মনে হয় নিউ কামার। ছেলেটা অসম্ভব নরম অথচ আজকালকার চেংরা নায়কগুলো দু একটা মুভি করেই লাট বনে যায়। চেনেই না কাউকে। দুটো কথা বলার জন্য সময়ই নেই। কিন্তু দুর্নিবার অন্যরকম! সে অতীত ভুলে না, সবাইকে মনে রাখে।
—তোমার সাথে দেখা হয়ে শরীর ভালো গেছে সম্পূর্ণ। আর ডায়াবেটিস তো? তোমার সাথে আবার কাজ করতে পারলে সেটাও ভ্যানিশ হয়ে যাবে।
দুর্নিবার হাসিমুখে আবারও বললো,
—অপেক্ষা করেছেন অনেকক্ষণ, এইজন্য আমি দুঃখিত। সময় নিয়ে আমার সত্যিই খুব গিল্ট লাগে। ২৪ ঘন্টার দিন না হয়ে ৩০ ঘন্টার যদি হতো৷ এগেইন হার্টিলি সরি।
—কি যে বলো না দুর্নিবার! তোমার কত বিজি শিডিউল আমি তো বুঝি। ওহ বাবা, তুমি কি একা এলে? তোমার সাঙ্গ পাঙ্গ কই?
—না একা নয়। সিকিউরিটি গার্ডরা নিচে। একচুয়েলি মিডিয়া যাতে কভার করতে না পারে তাই একটু রেসট্রিকটেড করে আসলাম। বুঝেনই তো… হয়তো লিখে দেবে অন্য কথা। নতুন হিরোইন তো! তা আপনার হিরোইন কোথায়?
—আছে ভেতরেই। ওয়েটিং ফর ইউ। ইউ আর লুকিং টু গুড। ওয়েট লুজ করেছো অনেক। লুকিং হট টু!
—উইলিংলি লুজ করিনি। লাস্ট মান্থে হামের মতো কি বেরিয়ে জ্বর টর হলো, তারপর থেকে একদম খেতে পারছি না। একবেলা টক দিয়ে ভাত খাবার চেষ্টা করছি, তাও কাজ হচ্ছে না।
—হোয়াই ইউ আর ভেরি ট্রু দুর্নিবার? বলে গেইন নিতে পারতে তো?
দুর্নিবার হাসলো।
—প্লিজ আরিফ ভাই, কনফার্ম ইট ওয়ান্স এগেইন, এরা যাতে ভেরি ভেরি কেয়ারফুল থাকে। ফটো লিক করলে ঝামেলা। নিউ হিরোইন… সারপ্রাইজিং একটা ব্যাপার তো আছেই।
—ওকে….ওকে…. বলে আসছি আমি আবার। তুমি বসো গিয়ে, দ্য ফিফথ টেবিল ইন রাইট কর্নার। নীরা তোমাকে হঠাৎ দেখে একটা বোল্ড শক খেতেই পারে। বি কেয়ারফুল বয়!

দুর্নিবার ক্যাপটা খুলে এগিয়ে গেল। নীল শাড়ি পরা তার নতুন হিরোইন টেবিলে মাথা দিয়ে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে! মুখের আংশিক দেখা যাচ্ছে এলোমেলো চুলের কিছু অংশ মুখটা আরো ঢেকে দিয়েছে। তবে এই ঘুমেও সে চায়ের মগটা শক্ত করে ধরে আছে। আচ্ছা, মেয়েটির ঠোঁট কেন কাঁপছে? ঘুমের ঘোরে কি কিছু বলছে?
দুর্নিবার কাছে এসে ঠোঁটের কাছে কান বাড়ালো। নাহ্ কিছুই তো শোনা যাচ্ছে না। দুর্নিবার আরেকটু এগোলো।
আরিফ সাহেব ডাকলেন,
—হিরোইনের সাথে ক্লোজ আপ শট হয়ে যাচ্ছে নাকি এখনি?
—শশশশশশশ! প্লিজ ডোন্ট স্পিক। সি ইজ স্লিপিং আরিফ ভাই। আই থিংক, আই সুড লিভ।
—হোয়াট! ঘুমুচ্ছে মানে? হোয়াট এবাউট দ্য মিটিং? তোমার কথা বলার ছিল। আমি এক্ষুণি নীরাকে ডাকছি। এত ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিং এ সে কিভাবে ঘুমিয়ে পড়লো?
—নো প্লিজ! মিটিং হয়ে গেছে। আই থিংক আই এম রেডী টু ওয়ার্ক উইথ হার!
আরিফ সাহেব বিস্মিত চোখে দুর্নিবারের দিকে তাকিয়ে আছেন! তিনি দুর্নিবারের কথা বিশ্বাসও করতে পারছেন না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছেন না। নার্ভাসনেসে তিনি ডেকেই ফেললেন,
—নীরা.. নীরা ওয়েক আপ। নীরা…
নীরা চমকে উঠে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। উদ্বিগ্ন হয়ে দুর্নিবারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—ক’টা বাজে এখন? রাত দুটোর আগে আমায় একটু এয়ারপোর্টে যেতে হবে!
নীরা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো, ঘুম কাটেনি পুরো তার। চোখের কাজল ঘেঁটে গেছে একেবারে। গালের একপাশে টেবিলের দাগ হয়ে গেছে। এলোমেলো চুলটা এবারে কাঁধের পেছনে।
আরিফ সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, দুর্নিবার হাত ইশারায় থামিয়ে দিলো।
—এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে নীরা। আপনাকে এয়ারপোর্টে গেলে এখনি বের হতে হবে।
নীরার ঘুমের ঘোর এবারে ঠিকঠাক কেটেছে। একি, তার সামনে এটা কে দাঁড়িয়ে? ও মাই গড!
নীরা বিস্ময় কাটাতে মুখে হাত দিয়ে বসে পড়লো।
আরিফ সাহেব রেগে আগুন হয়ে তাকিয়ে তখন।
—এই তোমার এক্টিভিটি নীরা। ঘুমোচ্ছিলে তুমি বুঁদ হয়ে। হোয়াট কাইন্ড অফ সিনসিয়ারিটি ইজ দিস?উঠে আবার টাইম জিজ্ঞেস করছো?
নীরা গলার স্বর নরম করে বললো,
—স্যরি, স্যরি স্যরি। আমি আসলে… ভুল হয়ে গেছে আমার। স্যরি… ভেরি স্যরি।
—আপনি কি সব স্যরি আজই বলে ফেলবেন নাকি? কাম অন ইয়াং লেডী, আই হোপ উই’ল হ্যাভ দ্য টাইম। টেইক দিস ফর দ্য টাইম।
নীরা আবারও বললো,
—স্যরি স্যার! আমার দু-তিন রাত একদম ঘুম হয়নি। ঘুমোতে পারিনি। এখন একটু বসেছিলাম তো… স্যরি, স্যরি….
—-আপনি এয়ারপোর্টে যাবার কথা বলছিলেন। ইউ সুড গো নাউ। আদাওয়াইজ ইউ’ল বি লেইট। ইটস অলরেডী ইলেভেন এন্ড থার্টি ফাইভ।
নীরা কাঁচুমাচু হয়ে তাকিয়ে আছে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। ঘুমের ঘোরে এয়ারপোর্টের কথা বলেছিলো। ইশ্! দুর্নিবার সাহেব সেটা ধরেই বসে আছেন। তার এখন মুভি নিয়ে কথা বলা উচিৎ।
সিরিয়াসলি! কিন্তু ওদিকে মি. তামিম…
আরিফ সাহেব আবারও ধমকে উঠলেন নীরাকে,
—তোমার কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ তো ক্যারিয়ারে খুবই এফেক্ট করবে দেখছি। তোমার সিনিয়র একজন আর্টিস্ট! ফার্স্ট কাজ করতে যাচ্ছো… বি ফ্লেক্সিবল।
নীরা গুছিয়ে বসলো।
—আমার একদম এয়ারপোর্টে দরকার নেই স্যার। কোনো দরকার নেই। ঘুমের ঘোরে সব পাকিয়ে গিয়েছিলো।
দুর্নিবার ঘড়ি দেখলো আবার। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। ততক্ষণে দুর্নিবারের দু-জন পি এ আর বডিগার্ডরা সবাই চলে এসেছে। তারা নায়ককে ঘিরে দাঁড়ালো পুলিশের মতো।
নীরার এবার ভয় ভয় করতে লাগলো।
—ওকে…. তাহলে কাজের কথাই বলি, নীরা ম্যাডাম। আপনার বায়ো দেখেছি আমি। ওয়ান থিং, পড়াশোনা কি থামিয়ে দিয়েছেন?
নীরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
আরিফ সাহেবও একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন।
—সেটাই তো দুর্নিবার! স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা ছিল। নীরা অলরেডী পড়ে নিয়েছে। ভালো লেগেছে তাঁর। দেখো গল্পটা বেসিকেলী একটা চাকরি নিয়ে…..এ ম্যাজিকেল জব!
—আরিফ ভাই, আমি স্ক্রিপ্ট পড়ে নেবো। আলোচনার দরকার নেই। আমার মনে হচ্ছে নীরা ম্যাডামের তাড়া আছে। এই নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো!
নীরা খুবই জোর গলায় বললো,
—না না আমার একদমই তাড়া নেই। আপনি বলুন।
—দেখুন ম্যাডাম, আমি জানি আপনি ভেতরে একটা ছটফটানি নিয়ে বসে আছেন। এই ফিলিং নিয়ে আলোচনা মানে টোটাল ওয়েস্ট অফ টাইম। তার চেয়ে আপনি ওই কাজটাই সেরে আসুন আগে। ভেতরে এক কাজের অস্থিরতা নিয়ে অন্য কাজ ভালো হয় না। যখনি আমরা যা করবো, উই সুড বি ডেটিকেটেড টু আওয়ার ওয়ার্ক।

নীরা শুকনো একটা ঢোঁক গিললো। দুর্নিবার কি মনোবিজ্ঞানী? নীরার ভেতরের সব কিভাবে বুঝে ফেললো? অথচ নীরার সাথে এটা তাঁর প্রথম দেখা। তবে এর মাঝে একটা ব্যাপার বেশ ভালো; দুর্নিবার কথা বলছে অনেক দিনের পরিচিত’র মতো।
—দুর্নিবার, ইউ নো হোয়াট… তুমি শুধু শুধুই এভাবে বলছো। নীরা কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতেই এসেছে। ও’র অন্য কাজ নেই। আরে অন্য কাজ আবার কি? এটাই তো ও’র মেইন কাজ এখন। তোমার সাথে একটা মুভি করার তো সব হিরোইনের ড্রিম! ও তো… তোমার মিটিং এর…
দুর্নিবার হাসলো,
—আরিফ ভাই, আমার মিটিং হয়ে গেছে। আপনি বরং উনাকে এয়ারপোর্টে যাবার একটু ব্যবস্থা করে দিন। আর ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। কথাটা সিনেমা নিয়ে নয় এর বাইরে। আমি কি আপনাকে একটা ছোট্ট সাজেশন দিতে পারি?
নীরা কোনোরকমে বললো,
—জি অবশ্যই।
—আপনি ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে আসবেন৷ দ্যাট ইজ ভেরি গুড কিন্তু আমার মনে হয় পাশাপাশি পড়াশোনাটাও কন্টিনিউ করা উচিৎ। আপনার গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করা দরকার। পড়াশোনা ছাড়া এখানে কাজ করাটা একটু শক্ত। বিশেষ করে প্রমোশনের ইভেন্টগুলোতে আপনি যখন এটেন্ড করবেন, সেখানে কিন্তু শুধু আপনার শিক্ষাই কাজে লাগবে। আর কারও সাহায্য কাজে দেবে না। এই সেক্টরে সারাক্ষণ আমাদের প্রেসকে ফেইস করতে হয়, যা আপনি শুধু আপনার শিক্ষা আর রেডী উইট দিয়েই ট্যাকল করতে পারবেন। সো ইউ সুড কনসার্ন এবাউট দিস। দ্যাটস অল ফর নাউ।
আরিফ সাহেবের মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয়ে গেল। দুর্নিবার স্পষ্ট মিটিং কুইট করছে। অথচ হিরো হিরোইনের একটা ওপেন ডায়ালগ নেসেসারি ছিল। হিরো হিরোইনের মাঝে ভালো বুঝাপড়া থাকলে, কাজ আদায় সহজ হয়!

নীরা দাঁড়িয়ে পড়েছে যাবার জন্য। আরিফ সাহেব আরো ক্ষেপলেন মনে মনে। এই মেয়েটাও সত্যি সত্যি যাবার জন্য তৈরি। আশ্চর্য! তার কিসের এত তাড়া?

#পর্ব_৩৩

এয়ারপোর্টে এসে নীরার দেখা হলো, মিসেস সেলিনার সাথে। তাদের ফুল ফ্যামিলি এসেছে তামিমকে সি অফ করতে।
নীরাকে দেখেই বললেন,
—তুমি এখানে যে, কি দরকার?
নীরা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল,
—পাসপোর্ট করতে এসেছি।
—ধুর, এখানে পাসপোর্ট হয় নাকি? ও তো আলাদা অফিস আছে। এই নীরা, দারুণ খবর আছে। তামিম ক্লু দিয়ে গেছে, বউ কিভাবে খুঁজবো? জানো, সে নাকি মিডিয়ায় কাজ করে।
—ওহ। তাই নাকি? মি. তামিম আর কিছু বলেননি?
—বলার সময় পেলো কই? ছেলেটা দুনিয়ার ব্যস্ত। বন্দুক আর বুলেটে জীবন আটকে গেছে।
নীরার অবশ্য তামিমের সাথে দেখা হলো না। তামিম ওয়েটিং লাউঞ্জে তাদের টিম জয়েন করে নিয়েছে ততক্ষণে। টাইট সিকিউরিটি, ভিজিটর এলাউ করে না ওখানে।
হারুন সাহেবও ছিলেন সাথে। নীরাকে দেখে যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন,
—নীরা মা, আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে। খবর জানো?
নীরা বিষন্ন গলায় বললো,
—আপনার সবসময় কেন এত সর্বনাশ হয় বলুন তো? একবার অন্তত ভালো খবর বলুন।
—আমার কি আর দোষ বলুন নীরা মা? ভাগ্যই ফেবার করে না আমায়!
—সর্বনাশের খবরটা কি?
—নাফিসা ম্যাম, শফিক সাহেবকে ইউ এস তে বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইছেন। সেটা তো জানেন নিশ্চয়ই?
—হুঁ…
–মাগো, এই খবরে প্রাইম মিনিস্টার সাহেব আপনাদের ফুল ফ্যামিলির সাথে কথা বলতে চান। কি যে হয় কে জানে?
—এতে আপনার সর্বনাশের কি আছে? সর্বনাশ তো আমাদের হবে বলে মনে হচ্ছে।
—সর্বনাশটা হলো প্রাইম মিনিস্টার স্যার যখন ইনভেস্টিগেশনের ইনফরমেশন চাইলেন তখন তামিম স্যার বললেন, আমি নাকি নাফিসা ম্যামকে শফিক সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। মাগো, আমার বুঝি চাকরিটা আর রইলো না। আগামী মাসে বিয়ে, বাড়ির দলিল রেখে ব্যাংক লোন নিয়েছিলাম। এখন চাকরি চলে গেলে ব্যাংক তো আর আমায় এমনি এমনি ছাড়বে না।
—তাও ঠিক। দেখেন কি হয়? আপনার স্যার তো আসলেই বিরাট ফাঁপরবাজ। যেই স্যারের জন্য এত করলেন, সেই স্যারই কিনা আপনায় বাড়িছাড়া করছেন? একেই বলে, কাল সাপ।
নীরার কথায় হারুন অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো। তাঁর দৃষ্টি বলছে এই পৃথিবীত বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই।
—এত চিন্তা করবেন না। আমাকে মেয়ে বলেছেন, আমি তো কিছুতেই আপনাকে বিপদে পড়তে দেবো না। প্রাইম মিনিস্টার স্যারের কাছে আমি আপনার স্যারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবো।
হারুন এবার আশা ফিরে পেলো।
—মা গো আল্লাহ আপনার সংসার দুধে ভাতে ভরিয়ে দিক। আমার বিয়েতে আপনি আর স্যার দশদিন আগে যাবেন অতিথি হয়ে।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে নীরার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করলো না। রাস্তায় বসে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। এত কেন একা একা লাগছে? কই আগেও তো সে এমন করে একা একাই চলেছে, আজ বড় ভেতর ভেঙে যাচ্ছে! বুকের ভেতরটা বড্ড হু হু করছে তার।
নীরা ফিসফিস করে বললো, মি. তামিম আপনাকে আমি ভয়ঙ্করভাবে মিস করছি। ভয়ঙ্করভাবে।
কেন আপনি দেখা না করেই চলে গেলেন?

নাফিসা চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই সে বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে ফিরে এসেছে। বাবা বলেছেন তিনি ব্যস্ত আছেন। লক্ষণ ভালো নয়। তার স্পষ্ট মানে হলো বাবা রেগে আছেন। তবে রাগের পরিমাণটা ঠিক কোন পর্যায়ে, সেটা আন্দাজ করা কঠিন। তিনি কখনোই নাফিসাকে বকে ধমকে রাগ ঝারবেন না, রাগের খেলা তিনি খেলবেন বুদ্ধি দিয়ে।এই খেলাটা কি সেটা একবার ধরতে পারলে নাফিসা পুরো সিচুয়েশান ইজিলি সামলাতে পারবে!
নাফিসা আবারও চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে শুরু করলো। অনেক কিছুই তো সে আগে থেকে জানতে পারে, বুঝতে পারে! এটা কেন পারছে না? তবে কি অশুভ কোনো ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে? নো, এটা হতে পারে না! মি. শফিক সাহেবকে একটা মেসেজ করে দেওয়া যাক।

মি. শফিক,
আপনাদের পরিবার যখন বাবার সাথে মিট করতে আসবেন, বাবা কিন্তু আপনাদের সবার সাথে একসাথে কথা বলবেন না; আলাদা আলাদাভাবে কথা বলবেন, মানে একে একে! এবং সবার শেষে আপনাকে ডাকবেন। আমি জানি। সো আপনাকে যেটা করতে হবে টেকনিক করে বাবার সাথে প্রথমেই কথা বলে নিতে হবে। সেটা কিভাবে, সে বুদ্ধি আপনাকেই বের করতে হবে। আপনি একজন চমৎকার মানুষ, সেটা টের পাওয়া মাত্র বাবা তাঁর ভোল পাল্টে ফেলবেন। আমার বাবা মানুষ হিসেবে ভালোর থেকেও ভালো। সো এখন সব আপনার হাতে। যদি আপনার ভেতরের সত্যটা বাবা বুঝতে পারেন, তাহলে আমি নিশ্চিত যে আপনি আমার… ডট ডট ডট…

বাকিটা নাফিসা ইচ্ছে করেই লিখলো না। মি. শফিক যা খুশি ভেবে নিক।
তারপর অনেকটা স্পেস দিয়ে আবার লিখলো,

আচ্ছা, আপনি কি ভালো আছেন? আমি ভালো নেই কেন?

মেসেজটা পাঠিয়েই নাফিসা কফি বানাতে উঠে গেল। আর তক্ষুনি তার ইচ্ছে হলো, ইশ্ এই মুহূর্তে মি. শফিককেও যদি এক মগ কফি বানিয়ে দেয়া যেত! তিনি নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন।
মানুষের মন খুব খারাপ একটা যন্ত্র! কখন যে কি ইচ্ছে বানিয়ে বসে?

রিতু আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। তারপর অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বললো,
—ভাইয়া তোর কি সত্যিই কিছু বলার আছে নাকি এমন ফোন ধরে বসেই থাকবি? আমার পড়া আছে।
প্লিজ!
—ও কি সত্যিই এয়ারপোর্টে এসেছিলো?
—শোন ভাইয়া, এই কথাটা লাস্ট পুরো উইক ধরে হাজারবার অন্তত বলেছি। তোর যদি এতই অবিশ্বাস্য লাগে তোর প্রাণোবতীকে ফোন করে জেনে না।
—আমার সময় নেই ফোন করবার!
—ওকে তাহলে আমি নীরাপুকে বলে দিচ্ছি, সে তোকে ফোন করে নেবে। এখন বল, তোর ট্রেনিং কেমন হচ্ছে?
রিতু প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো।
—পেপারে, টিভিতে হাইলাইট করে নিউজ হচ্ছে, মুভি সাইন করেছে সে। টপ হিরোর সাথে। তাও দুর্নিবারের মতো হিরো। আমি তাঁর সব ইন্টারভিউস, পেপার কাটিং সবকিছু পড়ে দেখেছি। তাঁর জীবনে একটাও নেগেটিভ জিনিস নেই। শোবিজের সবচাইতে নিট এন্ড ক্লিন ম্যান! হি ইজ দ্য বেস্ট। তাকে ঘিরে সবাই মুগ্ধ… সে’ই কেন নীরার সাথে মুভি করবে? হোয়াই?
রিতু দীর্ঘশ্বাস ফেললো, ভাইয়ার ভালোবাসা প্রথমে অভিমান এবং এখন হারানোর ভয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাঁর মেন্টাল কন্ডিশন ফ্লাকচুয়েট করছে। এর মানে হলো, সে ঠিকঠাক ট্রেনিং এ মন দিতে পারছে না।
—নীরাপু তোকে ফোন করেনি একবারও?
তামিম জবাব দিলো না।
—তোর হারুন সাহেব কি বললো? উনি করছেটা কি?
—ও কাজে খুবই ব্যস্ত। বিলবোর্ডে ছবি যাওয়ার পর থেকে নাকি বোরকা পরে নাকি বেরুচ্ছে। এর মাঝে আরও কয়েকটা টিভিসি কন্ট্র্যাক্ট নিয়েছে। ও’র জীবন বদলে যাচ্ছে রিতু, সে জীবনে আমি যদি না থাকি?
—ভাইয়া, মুগ্ধতার ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও ঠুনকো নয়। তুই কোনো ব্যাপারে ইমপ্রেসড তার মানে হলো, সৃষ্টিকর্তা তোর মুগ্ধতার জন্য এটা ঠিক করে রেখেছিলেন। নাহলে পৃথিবীতে এত বেস্ট থাকতে তুই কেন নীরা আপুতেই মুগ্ধ হলি? ব্যাপারটা আমাদের হাতে নেই। তবুও আমি কথা বলবো। তুই একদম নিশ্চিন্ত হয়ে ট্রেনিং কর! দিস ইজ দ্য টার্নিং পয়েন্ট ফর ইওর ক্যারিয়ার।
—আমি তাকে কোনোভাবেই হারাতে পারবো না। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে রিতু! হোয়াই দিস রিলেশান ইজ সো সেনসিটিভ? নীরা খুব সাধারণ যখন ছিল, ভয়ে করেনি আমার। এখন কিছুই বুঝতে পারছি না।
—ভাইয়া, ব্যথা বয়ে বেড়ানোর শক্তি না থাকলে ভালোবাসাও উচিত নয় কিন্তু। ব্যথাই যদি না পেলি, মধুরতা বুঝবি কিভাবে? তুই অন্তত ফোন করে কথা বল একবার। প্লিজ… তিনি হয়তো ভয়ে তোকে ফোন করছেন না। তুই তো জানিসই সে খুব ইনট্রোভার্ট। তুই একটা ফোন কর।
—আমি তাকে ফোন করবো না, একদম না। সব কিছুতে আমিই কেন? সে কেন নয়? কি ভাবে সে? টাকা হলে আমি তাঁর নাম দেখে পিছু নেবো? নো। আমি যেটা করবো তা হলো, এক গভীরে রাতে বন্দুকের মাথায় সাইলেন্সার লাগিয়ে গিয়ে বুকের মাঝখানে গুলি করে আসবো। ঠিক সেরকম! এন্ড ইউ নো মাই ডিয়ার সিস্টার, আই নেভার মিস মাই টার্গেট!
—একটা মুভি সাইন করাতেই এত রাগ? ওটা তো তাঁর ক্যারিয়ার!
—মুভি সাইন করাতে রাগ না, দুর্নিবারের সাথে মুভি করা নিয়েও রাগ না। একমুঠো বেলীফুল হাতে যে বড় বড় চোখ করে বিলবোর্ডের ছবিতে তাকিয়ে আছে, সেজন্যও রাগ না। টিভিসিতে গোলাপী শাড়ি পরে যে শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যায়, সেজন্যও রাগ না। রাগ আমার অন্য জায়গায়, কষ্ট আমার অন্য কারণে। সেটা তুই খুঁজে বের করবি। তুই…
তামিমের গলা ভারী হয়ে এসেছে, সে ফোন রেখে দিলো।

তামিমের ফোনটা রেখেই রিতু নীরাকে ডায়াল করলো। ফোনটা অন্য কেউ ধরেছে, নীরা শুটিং এ ব্যস্ত!
রিতু এবার ফোন করলো বাবাকে।
—হ্যালো বাবা।
—বলো মামণি… বাহ্ তুমি আমায় ফোন করতে পারো জানাই ছিল না। তোমার তো সব দরকার থাকে শুধু তোমার ভাইয়ার সাথে। কি ভাইয়া চলে যাওয়াতে নাকি?
—একদম ঢং করবে না বাবা। তুমি জানো আমি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি এজন্য। তুমি কোথায় বাবা?
—অফিসেই! আসছো তুমি?
—না বাবা। বাবা, একটা ফেবার চাই আমার। বিশেষ ফেবার। ইটস এন ইমার্জেন্সি।
রিতুর বাবা মোস্তাফিজ সাহেব হাসলেন। এই প্রথম তাঁর অত্যন্ত ব্যাক্তিত্বধারী ছোট মেয়ে তাঁর কাছে কিছু চাইছে। তাও আবার এত রিকোয়েস্ট করে।
—বাবা, এটা একটা বড় আবদার। রাখতেই হবে তোমাকে! এনি হাউ রাখতে হবে ভাইয়ার জন্য।
রিতু প্রায় কেঁদে ফেললো।
—ফেবারটা কি সেটা তো বলে দেখো আগে। আমি অবশ্যই সেটা করার চেষ্টা করবো।
—একটা এপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দাও একজনের সাথে। আমি তাঁর নাম আর এড্রেস এসএমএস করে দিচ্ছি।
—বাবা, বিষয়টা খুব আর্জেন্ট! আমার মনে হচ্ছে, ভাইয়া দু-তিন দিন ধরে খেতে পারছে না, ঘুমুতে পারছে না। তাঁর সব ঘেটে গেছে। তবে তুমি এই নিয়ে ভাইয়াকে একদম কিছু বলবে না। প্লিজ…. প্লিজ।
মোস্তাফিজ সাহেব বেশ নার্ভাস বোধ করতে লাগলেন। তাঁর এত স্ট্রং মেয়ে কেমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। কারণ কি? তামিমের তাহলে সত্যিই কি কিছু হয়েছে?

নীরা শট শেষে আবার মুখ ধুয়ে নিলো। লাইটে চোখ জ্বালা করছে, নাকি কাজলটাই খারাপ ছিল কে জানে? প্রোডাকশন বয় এসে খবর দিলো,
দুর্নিবারের বাসা থেকে লাঞ্চ এসেছে; একসাথে খেতে হবে তাই।
নীরা শুনে একটু আশ্চর্যই হলো। সেদিন মিটিং এর পর নীরা শুটিং স্পটে দুর্নিবারের কমপ্লিট অন্য রূপ দেখেছে। শুটিং এ তিনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফেশনাল। একটা কথাও বাড়তি নেই। শটের আগে মিনিমাম দশবার আয়না দেখেন, কোনো পোশাক রিপিট হলেই মহাবিরক্ত। আর চুল তো সবসময়ই ঘাটছেন।
এমনকি মহরতের দিন নীরাকে হেয়ারস্টাইল নিয়ে একটা চোখ রাঙানী দিয়ে ফেলেছিলেন প্রায়!
আজ হঠাৎ লাঞ্চে?

নীরাকে দেখেই দুর্নিবার মিষ্টি করে হাসলো।
—আসুন, বসুন ম্যাডাম। আজ আমার সামান্য আয়োজন।
নীরা চেয়ার টেনে বসতে যাবার আগে দুর্নিবার নিজে উঠে এসে চেয়ার টেনে দিলো।
—ইউ আর মাই গেস্ট টুডে। সো ইটস মাই প্লেজার।
—আমার দুজনই, আর কেউ নেই? ডিরেক্টর স্যার?
—উনি খেয়ে নিয়েছেন। উনি যেদিনই টের পান আমি রান্না করে এনেছি, সেদিনই সবার আগে আগে ভ্যানিশ করে দেন।
—আপনি রান্না করেছেন মানে? এত বড় নায়ক রান্না করে?
—আমাকে এত বড় নায়ক বলে কি বুঝানো হচ্ছে? আমি অপদার্থ?
—না, না মোটেও না। আসলে পাঁচজন যেখানে সবসময় আপনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকছে, সেখানে আপনি রান্না করছেন ভাবাও যায় না!
দুর্নিবার নিজেই সব সার্ভ করলো। নীরার হাত-পা বরফ যেন। এত নামী মানুষ অথচ কত বিনয়!
—আপনার কাছে আজ দুটো আপিল করার আছে ম্যাডাম এবং দুটো ব্যাপারই রাখতে হবে আপনাকে। এজন্য এই যত্ন বুঝলেন।
—কি যে বলেন না স্যার… আপিল আবার কি? আপনি সোজা বলবেন শুধু। আমি জুনিয়র আপনার।
—আচ্ছা, আপনি পড়াশোনার ব্যাপারে কি ঠিক করলেন? গেট এ নিউ স্টার্ট প্লিজ। দেখুন, আপনি পড়াশোনা শুরু না করলে আমি আপনার সাথে কাজ করে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য পাবো না। আমি জানি, আমাদের জুটি হিট করে যাবে।
নীরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো,
—আপনি এত শিওর কি করে?
—আমি অনেক কিছু আগে থেকেই বুঝতে পারি। দেখুন নীরা ম্যাডাম, আমি এই প্রথম আপনার সাথে মুভি রিপিট করতে চাই। আর সেটা সম্ভব যদি আপনি পড়াশোনাটা শুরু করেন।
—-আমার পড়াশোনা ভালো লাগে না স্যার৷
—ভালো লাগুক আমি কিন্তু তা বলছি না। ভালো না লাগার মাঝেও আমি করে নিতে বলছি শুধু। প্রমোশনের ইভেন্টগুলোতে আমি আর আপনি যখন বসবো, তখন কিন্তু এক দল নিষ্ঠুর সাংবাদিক আপনাকে ফেইস করতে হবে। তারা এমন সব টেকনিকে এমন সব ওয়ার্ড ইউজ করে প্রশ্ন করবে যে আপনার পড়াশোনা জানা না থাকলে খুবই বিপদে পড়বেন। তখন কিন্তু কেউ আপনাকে চাইলেও হেল্প করতে পারবে না। কেউ না। আর প্রেস কিন্তু হিরোইনকে হ্যারাস করতেই বেশি ভালোবাসে!
—আমি ওভাবে ভেবে দেখিনি স্যার।
—ভাবতে হবে। এখানে যদি লং টাইম কাজ করতে চান, ইউ সুড বি কনসার্ন এবাউট ইওর এডুকেশন। মুভি হিট করে গেলে আপনাকে টিভি ইন্টারভিউতে বসতে হবে, প্রেসে কথা বলতে হবে। আপনার টিভিসিগুলোতো অলরেডী হিট করেই গেছে। তাই না?
নীরা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলো।
—কদিন পর গাড়ি ছাড়া বেরোতেই পারবেন না। ইউ আর গোয়িং টু বি এ সেলিব্রিটি । সো গেট দ্য প্রিপারেশন। পড়াশোনা করতেই হবে। এই মিডিয়া বলেন, সাধারন চাকরি জীবন বলেন, পড়াশোনা ছাড়া আজকাল টিকে থাকা অসম্ভব। আপনি যখন মুভির ডিলটা সাইন করেন, কন্ট্র্যাক্ট পেপারটা পড়ে দেখেছেন? পুরো পেপারটা ইংরেজিতে। পড়াশোনা কত কাজের বুঝতে পারছেন? ওখানে একটা ছোট্ট পয়েন্টে লিখা আছে, ছবি মুক্তি পর্যন্ত প্রমোশনের ক্ষেত্রে আপনি সাবলীলভাবে কাজ করবেন।
পড়েছেন? সেটা করতে হলে আপনাকে পাবলিক ডিলিং করতে হবে। আর সেজন্য মেনডেটরি হলো, আপনার এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন।
নীরা আসলেই তো এভাবে কখনোই চিন্তা করেনি।
—ইং শা আল্লাহ! আমি শুরু করবো।
—করতেই হবে, যদি আপনি আসলেই শোবিজটাকে ভালোবেসে থাকেন। আর এখানে ভালো সময় কাটাতে চাইলে।
—আপনার রান্না বেশ চমৎকার স্যার। আমি নিজেও এত ভালো মুরগী রান্না করতে পারি না। প্রিপারেশনটা বলে দিন তো নোট করে নিই।
—আপনি কাউকে এরকম খাওয়াতে চান ম্যাডাম?
দুর্নিবারের এমন প্রশ্নে নীরা ভীষন চমকে গেল।
—না মানে আসলে… আসলে, ভালো ছিল রান্নাটা।
দুর্নিবার পাতে অল্প একটু ডাল নিলো। ভাতে ঘাটতে ঘাটতে মৃদু হেসে বললো,
—আমার একটা সমস্যা কি জানেন? আমি অনেক জিনিস এমনিতেই বুঝে যাই। এই যেমন আপনার আমার মুভিটা যে হিট করবে, সেটাও জানি। তেমনি আরেকটা জিনিসও জানি, প্রতিটি ক্লোজআপ শটে আপনি যখন আমার সাথে কাজ করেন, আপনি তখন আমাকে নায়ক দুর্নিবার ভাবেন না, অন্য কোনে মানুষ ভাবেন। আমি জানি সেই মানুষটা আপনার খুব কাছের। আপনি তাকে ভেবেই শট দেন। এজন্যই প্রতিটি শট এত পারফেক্ট হয়।
—মানে… আসলে হয় কি….
—আই ডোন্ট নিড এনি এক্সপ্লেনেশন ম্যাডাম। কাজ ভালো হচ্ছে সেটাই বড় কথা। আই অলওয়েজ ওয়ান্ট দ্য বেস্ট আউটকাম।
দুর্নিবার হঠাৎ মন খারাপ করেই বাকি ভাতে পানি ঢেলে দিলো।
নীরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—একটা কথা জিজ্ঞেস করি স্যার?
দুর্নিবার তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে হেসে বললো,
—ইয়েস, অফকোর্স। ইউ ডোন্ট নিড এনি পারমিশন। ইউ আর মাই অনারেবল হিরোইন।
—আপনার হঠাৎ এমন মন খারাপ করার কারণ কি স্যার?
দুর্নিবার আবারো হাসলো,
—আমি জানতাম, এটা আপনি জানতে চাইবেন। এর কারণটা হলো, আমি অনেক কিছু আগে থেকে বুঝতে পারলেও আমার মা যখন অসুস্থ হলেন তখন আমি একবারও বুঝতে পারিনি। তিনি এত তাড়াতাড়ি আমায় ছেড়ে চলে যাবেন। অথচ বাকি সব আমি বুঝতে পেরেছি আগে আগে। এই যে, একসময় আমি ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে চুটিয়ে কাজ করবো এটাও জানতাম। শুধু মায়ের ব্যাপারটাই আমি কখনো বুঝতে পারিনি। মায়ের অনেক ব্যাপারই বুঝতে পারিনি।
নীরার খাওয়া শেষ। সে উঠে দাঁড়ালো। দুর্নিবার অন্যমনস্ক হয়ে তখন।
—স্যার, আপনি বলেছিলেন দুটো আপিল আছে। আর সেকেন্ড ব্যাপারটা?
—ওহ…. ইয়েস। সেটা হলো কাল আমার একটা হুট করে কাজ পড়ে গেছে, আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে কি হতে যাচ্ছে? তাই মর্নিং শিফটের শুটিংটা পোস্ট পন্ড করতে হচ্ছে। এই ছোট্ট সমস্যার জন্য আমি দুঃখিত।
—কি যে বলেন না স্যার! আমার অফুরন্ত সময়, যখন খুশি তখনই সম্ভব!
—এই অফুরন্ত সময়টা আর থাকবে না বুঝলেন নীরা ম্যাডাম? খুব শীঘ্রই প্রচন্ড বিজি শিডিউল হতে যাচ্ছে আপনার।
নীরা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। এই দুর্নিবার মানুষটা কি যে আশা জাগানিয়া কথা বলে! সত্যিই কি জীবন বদলে যাবে তার! একদিন সেও কি তার পরিবার নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকতে পারবে? যে বাড়িতে মি. তামিম এলে সে নিজে দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলবে,
—আসুন ভেতরে আসুন। বাবা সেই কখন থেকে আপনার সাথে ডিনার করবেন বলে বসে আছেন।

মি. তামিম কেন এতদিনেও একটা ফোন করেনি তাকে? তিনি কি বিদেশে গিয়ে নীরাবিহীন সময় অভ্যাস করে নিচ্ছেন? মি. তামিম কি জানেন না, নীরা যখন শুটিং এ কোনো রোমান্টিক ডায়ালগ বলে, তখন তার চোখের সামনে শুধু উনার মুখটাই ভাসে?

ভালোবাসা বড্ড খারাপ জিনিস, প্রতিটা মুহূর্তে শুধু মন পুড়িয়ে দেয়। উফফ….

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here