#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৯ (শেষ পর্ব)
শোয়েব রিসোর্ট ঘুরেই সিলেট ফিরে গেল সোজা। এক রাতের কথা বলে রিমিকে নিয়ে গিয়েছিলো, ফিরতে হলো তিনদিন পর! হানিমুনের কথা বলে নিয়ে গেলেও এই তিনদিনে দুজনে যে কাজটা খুব মন দিয়ে করেছে, তা হলো “ঘুম”। দিনে ১৮ঘন্টায়ই দুজনের কেটেছে ঘুমিয়ে। শোয়েব তিনবেলা খাওয়ার সময়টা শুধু জেগেছে আর রিমি সে সময়টা জেগে অর্ডারের ফোনকলসগুলো সেড়েছে।
শোয়েব তো ফিরে যাবার পথে গানও বানিয়ে নিয়েছে,
“তুমি আমি পাশাপাশি ঘুমিয়ে দুজন……
এভাবেই কাটাবো সারাটাজীবন…….
রিমি জবাবে হেসে বলেছিলো,
-“নিশ্চিন্ত” ভাবে কাটাবো সারাটাজীবন।
রিমির ওখান থেকে ফিরে মনে হলো এই রিফ্রেশমেন্টটা দরকার ছিল খুব তাঁর!
শোয়েব ভাইকে একটা ধন্যবাদ বলতে এত মন চাইছিলো। শুধু লজ্জায় বলা হয়নি! শোয়েবের সাথে এই ব্রেক কাটিয়ে ফিরে আসার পর রিমির কাজের প্রতি আগ্রহ আরো দশগুণ হয়ে গেল। মানুষটার মাঝে অদৃশ্য কিছু যেন আছে, রিমিকে এত সাহস দেয়! তবে এর মধ্যে অবশ্য একটা সমস্যা হলো, রেহেনা মানে শোয়েবের মা রিমির এই তিনদিন ধরে বিজনেসের কাজে বাইরে থাকাকে মানতে পারলেন না। তিনি প্রথমে রিমিকে বেঘোরে বকলেন, নিজে কিছুক্ষণ ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদলেন, রাগ করে ফিরে গেলেন ক্ষণিকের বিশ্রামাগারে। তাঁর মনে বদ্ধমূল ধারণা হলো লীনার মত তাঁর এই পুত্রবধুও তাঁর কথা শুনবে না, এই বৌও স্বাবলম্বী এবং একই সাথে স্বাধীন জীবনপথ বেছে নিবে। যে মেয়ে নিজের এত সিরিয়াস শারীরিক অবস্থায়ও কারও কথা শোনে না, তাকে নিয়ে তিনি আর স্বপ্ন দেখতে চান না… তিনি চলে যাওয়ায় রিমির অবশ্য সুবিধাই হলো বেশি! রাত জেগে অর্ডার ডেলিভারি করতে আর বাঁধা রইলোনা।
পরের সময়টা রিমির সব মিলিয়ে ভালোই কাটতে লাগলো; শুধু শারীরিক অসুস্থতা কষ্ট দিচ্ছিলো। এর মাঝে আরেকটা সুখবর হলো, তাঁর মায়ের ভিসা হয়েছে। তবে তিনি দিনরাত কেঁদে ভাসাচ্ছেন। তিনি কিছুতেই ইউ.এস.এ তে যাবেন না। রিমিকে একা রেখে সম্ভব না। কিন্তু রিমি জানে মা শেষ পর্যন্ত যাবেনই। কারণ কোনো মা তাঁর মেয়ের বিয়ের মতো সিরিয়াস একটা ঘটনায় পাশে থাকার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।
শোয়েবও এর মাঝে তাঁর বাবাকে ফোন করে পার্টি ক্যানসেল করালো। পার্টি হবে, তবে বাবু হবার পর।
আব্দুস সালাম সাহেবও এতে রাজি হলেন। একসাথে তিনি সবাইকে বরণ করবেন; এভাবেই সব প্ল্যান করতে লাগলেন। তিনি মহাউৎসাহে বাড়িতে একটা আলাদা রুম ডিজাইন করাচ্ছেন। তাঁর নতুন গ্র্যান্ডচাইল্ডের মুখ দেখার উপহার হিসেবে তিনি এটা দিবেন।
শোয়েবটা কখনও কিছু স্পেশাল পায়নি, জীবনের সবথেকে বড় উপহারটাই সে পেয়েছে অত্যন্ত সাদামাটা। বিয়ের মত গ্র্যান্ড একটা চ্যাপ্টার সে ফিল করেছে পানির মতো। অন্তত তাঁর সন্তানের জন্য স্পেশাল হোক!
নাসিমা চলে গেলেন পরের মাসের ১৩তারিখেই! রিমির ডেট ডিসেম্বরের ২৫। এয়ারপোর্টে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন,
-এর আগেই তিনি ফিরে আসবেন।
রিমি বিষন্ন আর ক্লান্ত গলায় বললো,
-এত তাড়াতাড়ি তুমি ফিরো না মা। কটা দিন আরাম করে আসো। আমিও তোমাকে টানতে টানতে ক্লান্ত!
নাসিমা মেয়ের এই কথায় তব্দা মেরে তাকিয়ে রইলেন। রিমি যদি প্রেগন্যান্ট না হতো, তিনি তখনই রিমিকে একটা চড় মেরে বলতেন,
-আমাকে টেনে খোটা দিচ্ছিস? নিজেও তো মা হচ্ছিস, মায়ের কত কষ্ট এখনো বুঝিস না?
মা চলে যাবার পর রিমির সবথেকে বেশি ভালো সময় কাটতে লাগলো। সব ধরনের টিউশন রিমি ক্লোজ করে দিয়েছিলো আগেই। এমনকি রিংকু ঝিংকুকে পড়ানো পর্যন্ত। ভারী শরীরে এত মুভ সে এখন করতে পারেনা। বাড়িতে দুজন সাহায্যকারীও আছে!
শোয়েব সকাল বিকাল ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে।আব্দুস সালাম সাহেবও মাঝে মাঝে এসে রিমিকে দেখে যাচ্ছেন। রিমি নতুন ম্যানেজার এপয়েন্ট করেছে বুটিকে। শোয়েবের পরিচিত এক বন্ধুর ছোট বোন! ব্যবসা চুটিয়ে চলছে।
এদিকে দেখতে দেখতে শোয়েবের “উন্নয়নের ফেরিওয়ালা” এওয়ার্ডের দিনও ঠিক হলো। ১ডিসেম্বর! প্রাইম মিনিস্টার নিজে থেকে পুরষ্কার দিবেন। রিমিও সাথে যাবে। শোয়েব এত বড় এচিভমেন্টে রিমিকে পাশেই চায়! শোয়েব দুদিন আগেই ঢাকায় চলে এলো রিমির কাছে। এসে থেকেই সে বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিয়ে রিমিকে বার বার টেস্ট করতে লাগলো, কোন পোশাকে রিমির পেট ছোট দেখাবে। কোনো পোশাকেই রিমির পেট ছোট দেখাচ্ছে না। শেষমেশ একটা সুতি জামদানিতে এসে ডিসিশান স্থির হলো। লেবু থেকে শুকনো বড়ই, অরেঞ্জ জেলী সবই প্যাকেট করে নেওয়া হলো,
রিমি যাতে প্রোগ্রামে কোনোভাবেই বমি না করে।
কিন্তু সমস্যা শুরু হলো আগের দিন রাতে। রিমির শরীর চরম খারাপ করতে লাগলো। রিমি দাঁতে দাঁত চেপে রাত কাটালো। শোয়েব রাতে বারবার জিজ্ঞেস করলো, তুমি এমন করছো কেন? খালি পায়চারি.. কোথাও স্থির হয়ে বসছো না কেন? কোনো সমস্যা? ডাক্তার ডাকবো?
-কোনো সমস্যা না, একটা বিজনেস আইডিয়া মাথায় এসেছে। বসে সেটা ভাবা যাচ্ছে না! তাই পায়চারি।
সকাল আটটা নাগাদ রিমি জানালো, সে শোয়েবের সাথে যাবেনা। একটা ভীষণ বড় অর্ডার পাচ্ছে সে।
শোয়েব চোখ কপালে তুলে বললো,
-একটা বড় অর্ডার পাবে বলে তুমি আমায় ডিনাই করছো?
-ডিনাই না শোয়েব ভাই। আমার শারীরিক অবস্থা যা, ওখানে গিয়ে চারপাঁচ ঘন্টার প্রোগ্রামে বসে থাকতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। ফেইন্ট টেইন্ট হয়ে গেলে… একটু সিনসিয়ার হওয়া তো দরকার! অন্তত আমাদের বাবুর জন্য!
শোয়েব রাগী চোখে তাকাতে গিয়েও নিজেকে সামলালো। জীবন কেন এমন পরিস্থিতি যে আসে? প্রিয় মানুষটাকে প্রিয় মুহূর্তে কেন সবসময় পাওয়া যায় না?
শোয়েব করুণ গলায় বললো,
-আমিও যাবো না রিমি। ইচ্ছে করছে না!
রিমি জবাবে কিছুই বললো না।
সকাল দশটার দিকে শোয়েবকে নিতে গাড়ি চলে এলো। শোয়েব খচখচ করা একটা মন নিয়ে চলে গেল এওয়ার্ড সিরিমনিতে!
শোয়েব চলে যাবার পর রিমি নিজে এসেই ক্লিনিকে ডক্টর দেখালো, একটা স্যালাইন নিলে বোধহয় ভালো লাগবে! ডাক্তার রিমিকে চেক-আপ করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-বাচ্চা লাস্ট কখন নড়েছিলো?
-মনে করতে পারছি না।
-বেবী তো বিলো লিমিটেড ওয়াটারে আছে! কন্ডিশন ভালো না। একটা আলট্রাসনোগ্রাফি এক্ষুণি করাতে হবে। আপনার কি পেইন আছে?
রিমি মাথা নাড়লো!
-কখন থেকে?
-গত পরশুদিন থেকে। মৃদু, মৃদু। গতরাতেই সেটা তীব্র হয়!
-কিন্তু আমার তো মনে হয় ব্যথাটা তীব্রই ছিল। আপনি আর কিছু, মানে ব্লিডিং?
-এরকম কিছুই না। শুধু মনে হয়েছে হালকা ব্যথা, সাথে দুর্বলতা।
-আপনি আগে কেন ফোন করেননি আমাকে? আপনি কেন এমনটা করেছেন রিমি? আপনাকে বার বার করে বলা সত্ত্বেওও.. আপনার শুরু থেকেই সমস্যা ছিল… এত এক্সট্রিম কন্ডিশনেও আপনি আমার দেওয়া একটা রুলস ফলো করেননি! কেউ এসেছে আপনার সাথে? গার্ডিয়ান ফোন করুন!
-আমি নিজেই নিজের গার্ডিয়ান।
রিমি বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। গলা শুকিয়ে আসছে তাঁর! এত তৃষ্ণা কেন পাচ্ছে?
-মানে? আপনার তো সিভিয়ার সিকনেস, এ অবস্থায়… প্লিজজজজ… ইউ আর ইন ইমার্জেন্সি নাউ! মিসেস রিমি!
-আমি কিন্তু এর আগেও একা একা ট্রিটমেন্ট নিয়েছি ডক্টর। আপনার ক্লিনিকেই নিয়েছি! তাহলে এখন কেন? তাছাড়া ফোন করে আনবার মত কোনো গার্ডিয়ান আপাতত নেই আমার। মা বাইরে, হাজবেন্ডও।
ডক্টর চিন্তিত মুখে রিমিকে আলট্রাসনোগ্রাফি রুমে পাঠালেন। রিমি নিজেকে শক্ত রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। শোয়েব ভাইকে কি ফোন করবে একটা? কটা বাজে? প্রোগ্রাম কি শুরু হয়ে গেছে?
রিমি ফোন ডায়াল করলো, বন্ধ!
ডক্টর আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে বললেন,
-সিজারিয়ান সেকশান করতে হবে।
রিমি চেয়ারেই হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো!ঠোট নাড়তেও যেন ক্লান্তি!
ডক্টর চিন্তিত মুখে রিমিকে কেবিনে নিয়ে যেতে বললেন।
-মিসেস রিমি, আপনি চোখ খুলুন। ঘুম পেয়েছে? কিছুতেই ঘুমোবেন না। একদম না। রিমি তাকান!
রিমি তাকালো। তাঁর ডক্টর, মিসেস সালমা চৌধুরীর মুখটা ঘাবড়াটে লাগছে খুব।
-মন দিয়ে শুনুন, আপনাকে শক্ত থাকতে হবে। মা হওয়া অনেক সহজ ও আনন্দের ব্যাপার এটা ভাবুন।আমি বাকি সব দেখছি… আমাদের কিছু ফর্মালিটিস আছে, উই নিড এ রিলায়েবল গার্ডিয়ান অফ ইউ! বুঝতে পারছেন? এসব করতে হয়!
রিমি কাকুতির মতো করে বললো,
-আমার ফোনে একটা কন্টাক্ট আছে, এনামুল হক। আমার আংকেল। আমার যদি কিছু হয়ে যায়,
উনাকে একটা ফোন করে দিবেন। উনি আগেও আপনার সাথে আমার ব্যাপারে কথা বলেছেন!
ডক্টর ঘড়ি দেখলেন।
-গার্ডিয়ান হয়ে সব ফর্মালিটিসগুলো আমি করে নিবো!
-আচ্ছা, এই অপারেশনটা কি বিকেলে করানো যায় না ডক্টর? আপনি যেরকম বলছেন আমি কিন্তু সেরকম অসুস্থ নই!
ডক্টর আশাহত দৃষ্টিতে তাকালেন। এত অল্পবয়সী অসুস্থ একটা মেয়েকে তিনি কিভাবে বলবেন যে, বাচ্চার হার্ট ঠিকঠাক বিট করছে না। ইভেন বাচ্চা বেঁচে আছে কিনা…
রিমির শরীরে ব্লাডের লিমিটেশন্স বলছে ঝুঁকি আছে! প্রেশার এত ফল করে গেছে যে, এক্সট্রা ব্লাড শরীর নিতে পারবে কিনা শিওর না। উইথড্রো সিনড্রোমসগুলো যে কি হয়!
ডক্টর ঠোঁট কামড়ালেন!
রিমি মুখ হাসি হাসি করবার চেষ্টা করলো।
-কন্ডিশন কেমন ভালো না, ডক্টর?
ডক্টর রিমির কথার জবাব দিলেন না। তিনি নার্সকে ওটি রেডী করতে বলে বেরিয়ে যেতে চাইলেন। ডক্টর দরজার কাছ অবধি যাওয়া পর্যন্ত রিমি সর্বশক্তি দিয়ে ডক্টরকে ডাকলো,
-আপনি আমার জন্য কেন এত করছেন? কেন এত ভাবছেন?
ডক্টর দাঁড়ালেন এবং ফিরে রিমির কাছে এলেন।
রিমির মাথায় হাত রেখে বললেন,
-ব্যক্তিগত জীবনে আপনি খুব সাহসী মানুষ বলে।আপনি আপনার সুখ বা দুঃখের জন্য কোনো কাকুতিমিনতি করেন না কারো কাছে, নির্ভরও করেন না। আপনি যতবার আমার কাছে এসেছেন আপনার এই জিনিসটা আমায় মুগ্ধ করেছে। আপনি আমার কাছে যতবার এসেছেন, একা এবং সাবলীল। হাসপাতালে শুয়েও কাজ করেছেন। এরকম পেশেন্ট আপনিই একজন। যে অসুস্থতার প্রতিটা মুহূর্ত সর্বোচ্চ সুস্থতা নিয়ে বাঁচে, তাই… এই পৃথিবীতে সাহসী মেয়ের বড় অভাব মিসেস রিমি!
ডক্টর উঠে চলে যেতেই রিমি হাত চেপে ধরলো ডক্টরের।
-আমার এই সব সাহস কে জানেন? আমার স্বামী।এজন্যই বাবু হবার খবরটা আমি তাকে প্রথম জানাতে চাই। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, বাচ্চাটাকে ভালো রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। আমি লাখখানেক টাকা ক্যাশ নিয়ে এসেছি!
ডক্টর রিমির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে গেলেন। একমুহূর্ত আর দেরি করা সম্ভব নয়! বাচ্চার কোনো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে না, এমনতো হবার কথা না।
রিমির ডক্টর সালমা চৌধুরী এনামুল হক সাহেবকে ফোন করলেন দুপুর একটা নাগাদ।
-হ্যালো..
-হ্যালো, আমি সেইফহোম ক্লিনিক থেকে ডক্টর সালমা বলছিলাম। আপনি কি এনামুক সাহেব?
-জি, জি। আপনি হঠাৎ.. বলুন।
ডক্টর সালমা কয়েক সেকেন্ড নিজেকে সামলালেন।
-আমার কথা একটু ঠান্ডা মাথায় শুনুন ,মিসেস রিমির কিছুক্ষণ আগে একটি ছেলে হয়েছে। ছেলেটি সুস্থ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। মিসেস রিমির শরীর ব্লাড এক্সেপ্ট করছে না। শি ইজ ইন…
-আমি এক্ষুণি আসছি ডক্টর!
-স্যার আপনার আসার চেয়েও জরুরী উনার হাজবেন্ডের আসার। উনার সাথে আমরা কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছিনা। উনি প্রাইম মিনিস্টারের একটা প্রোগ্রামে আছেন। আপনি কি কাইন্ডলি একটু দেখবেন… আমাদের হাতে সময় খুব অল্প।
এনামুল সাহেব ঘামতে লাগলেন। ঘাবড়াটে কাঁপা গলায় বললেন,
-ডক্টর সময় কি খুবই অল্প? কিছুই কি করার নেই?
-আমরা সব ধরনের চেষ্টা করছি। সিনিয়র ডক্টরদের একটা টিমওয়ার্কে অবজার্বেশন চলছে। প্রবলেমটা হলো, পেশেন্ট সেন্সে আছেন কিন্তু কোনো ফিলিংস রেসপন্স করছেন না। এটাই পাজল করছে আমাদের! উই আর টোটালি কনফিউজড।
এনামুল সাহেব ফোনের ওপাশে নিশ্চুপ! ডক্টর সালমা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
-স্যার উই আর ট্রায়িং আওয়ার বেস্ট! আপনি উনার হাজবেন্ডকে কানেক্ট করার চেষ্টা করুন প্লিজ! দেখুন, পেশেন্টের তিনদিন আগে থেকেই লেবার পেইন ছিল, তিনি আমাদের একদম ইনফর্ম করেননি। এমনকি যখন এলেন, তখন আমরা টেস্ট করিয়ে দেখলাম বেবি রেসপন্স করছেনা। আমরা প্রথমে বেবি নিয়ে টেনশানে ছিলাম। কিন্তু…
এনামুল সাহেব হতাশভাবে ফোন রাখলেন। রিমির শারীরিক অবস্থা শুরু থেকেই খারাপ ছিল। সে কখনোই এ নিয়ে কনসার্ন দেখায়নি। তাই বলে এত!
শোয়েবের আজকেই প্রোগ্রাম আর আজকেই কিনা রিমির… এনামুল সাহেব টিভি ছাড়লেন। প্রাইজগিভিং এর পোরশনটা শুরু হয়নি এখনো। এনামুল সাহেব ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে, আব্দুস সালাম সাহেবকে ফোন করলেন। আজ এতদিন পর তাঁর মনে হলো, তাঁর আজকের এই পজিশন আর পাওয়ার সত্যিই কাজে লাগতে যাচ্ছে। এনামুল সাহেব চোখ মুছলেন। ভালো ঘটনা, ভালো মানুষ এই দুই-ই কেন অল্প সময়ের জন্য দেখা যায়? হোয়াই?
শোয়েব রিমির বেডের পাশে দাঁড়িয়েই বললো,
-আপনারা প্লিজ যদি একটু যেতেন। আমি একটু একা কথা বলবো!
ডক্টর সালমা ইশারায় বাকিদের বেড়িয়ে যেতে বললেন, তিনি নিজে দাঁড়িয়েই রইলেন।
শোয়েব নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে রিমির হাত চেঁপে ধরলো।
রিমির মুখে অক্সিজেন মাস্ক!
-তুমি তো সকাল পর্যন্ত দিব্যি সুস্থ ছিলে। তাহলে? এখানে ডক্টররাই কিছু গোলমাল করেছে। তুমি কেন আমাকে বলোনি রিমি? আমি যখন যাচ্ছিলাম থামালে না কেন? হোয়াই ডিডন্ট ইউ স্টপ মি? ডক্টর ও বেঁচে আছে তো? ও’র ডেট তো আরো ২৫দিন পর ছিল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। গত পরশুদিন রাতেও ও আমায় আদর করেছে।মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে….
-পেশেন্টের শরীর শুরু থেকেই ক্রিটিকাল কন্ডিশনে ছিল মি. শোয়েব। উনার সহ্য ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে, উনি কিছুই শেয়ার করতেন না। ইভেন ফার্স্টটাইম চেক-আপের পর আমি উনার ফিজিক্যাল কন্ডিশন দেখে কমপ্লিট বেডরেস্ট সাজেস্ট করেছিলাম। উনার টলারেন্স পাওয়ার যাস্ট আনবিলিভেবল। সেভেন্টি পার্সেন্ট বডি এখন আউট অফ ব্যালেন্স। আমরা ব্লাড দিতেই…
-তাই বলে রিমি সকাল অবধি এত নরমাল। ডক্টর ও এমন কেন? হোয়াই? আমাকেও কখনো কিছু বলেনা।
ডক্টর সালমা কিছু বললেন না।
-রিমি, রিমি…
শোয়েব রিমির গাল আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। শরীর অবশ হয়ে আসছে তাঁর। তাঁর জীবন কি এখানেই থেমে গেল?
ও মাই গড…বলে.. শোয়েব নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ধরলো। চোখ ফেটে যেন রক্ত বেরুবে এখনি।
প্রায় চিৎকার করতে করতে বললো,
-এই বাবু পেটে আসবার পর থেকেই তোমার যত সমস্যা। যাস্ট এ প্যাকেট অফ প্রবলেম। আমি তাঁর মুখ দেখতে চাইনা। এই বাচ্চা আমার সমস্ত জীবন এলোমেলো করে দিচ্ছে কেন? হোয়াই?
শোয়েব বাচ্চা শিশুর মতো কাঁদছে।
ডক্টর সালমা শোয়েবের কাছে এসে দাঁড়ালেন।
-মি. শোয়েব প্লিজ বি কোয়ায়েট। প্লিজ কাম ডাউন।পেশেন্ট কিছু বলতে চাইছেন। শি ইজ ট্রায়িং টু সে সামথিং। লুক…
ডক্টর রিমির মুখ থেকে মাস্ক খুলে দিলেন।
শোয়েব অঝোরে কাঁদছে।
-ইউ আর এ শিট রিমি। আই হেইট ইউ। আমি তোমায় ছাড়বো না। কিচ্ছু বলতে হবে না তোমাকে।
রিমি অস্পষ্ট গলায় বললো,
-শোয়েব ভাই, আমি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।বাবুর মুখও আমি দেখিনি। আমি তখনই বুঝেছি আমার সময় শেষ। আপনি কি বাবুর মুখটা দেখে একটু বলবেন, ও দেখতে কার মতো হয়েছে?
শোয়েব রিমির বেডের পাশের টুল ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।
ডক্টর সালমা রিমির মুখে আবার মাস্ক দিয়ে দিলেন।রিমি মাথা সজোরে এদিকওদিক নাড়তে লাগলো।খিঁচুনি এসে গেছে আবার!
কড়া ঘুমের ইনজেকশন কাজ করছেনা তার শরীরে।
পেশেন্টকে এবার… নাকি তাতেও……
শোয়েব হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো!
ডক্টর সালমা এনামুল সাহেবকে ডাকলেন।
-মি. শোয়েব, আপনি প্লিজ বাইরে আসুন। প্লিজ, এরকমভাবে রিয়েক্ট করলেতো….
এনামুল সাহেব শোয়েবকে প্রায় টেনে হেঁচড়ে কেবিনের বাইরে নিয়ে গেলেন।
আব্দুস সালাম সাহেব, রেহেনা, লীনা সবাই এসেছেন।
রেহেনা ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন,
-তোর ছেলেকে দেখবি, কেবিনে আয়। কি সুন্দর দেখতে হয়েছে!
মায়ের হাত মাথা থেকে সরিয়ে নিয়ে শোয়েব শক্ত গলায় বললো,
-আমি কাউকে দেখবোনা মা। আমি রিমিকে চাই, বাচ্চা চাই না! ও’র সাথেই কেন এমন হবে? ও সকালেও সুস্থ ছিল। আমি প্রোগ্রামে বেরুলাম, ও কাপড়চোপড় ঠিক করে দিলো আমার। তাহলে?
রেহেনা জবাবহীন দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর সুন্দর চেহারার আদুরে ছেলের মাথার চুল এলোমেলো। টাই অর্ধেক খোলা, শার্টের ইন খুলে গেছে। উদ্ভ্রান্তের মতো ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। ছোটবেলায় শোয়েবের আড়াই বছরে সে যখন বুকের দুধ ছাড়লো, তখন মাঝরাতে জেগে জেগে বুকের দুধের জন্য এমন পাগলের মতো কাঁদতো। রেহেনা তখন নিজেকে সামলাতে পারতেন না, শোয়েবকে বুকে টেনে নিয়ে শান্ত করতেন। আজও তাঁর এমন ইচ্ছে করছে। আজ কি তাঁর ছেলে মায়ের বুকে গেলেই কান্না থামাবে? আচ্ছা, শোয়েবটার সবসময়ই কেন এমন হয়? সব সাধারণ জিনিসই তো সে চায়।তাহলে?
-তুই বাবুকে একটু কোলে নে বাবা। শান্তি পাবি। ডাক্তাররা তো বলছে, সব ধরনের চেষ্টা তাঁরা করছে।
রেহেনা আর আব্দুস সালাম শোয়েবকে বাবুর কাছে নিয়ে গেলেন। সুন্দর মিষ্টি চেহারার চোখ বন্ধ ফর্সা মুখ। সরু হাত পা গুলো কি অদ্ভূত কোমল!
শোয়েবের তাকিয়ে মনে হলো, বাবুটা একদম শোয়েবের মতো। একদম..! শোয়েব নিজের মুখ একবার হাত বুলিয়ে নিলো। এত মিল কিভাবে পসিবল? আশ্চর্য তো! সে চোখ মুছলো, গভীর আবেগে ছেলের হাত স্পর্শ করলো। আশ্চর্য! হাতের আঙুলগুলোও শোয়েবের মতো!
রিমিকে এক্ষুণি ডেকে বলা দরকার!
শোয়েব মায়ের দিকে তাকিয়ে বোকার মত জিজ্ঞেস করলো,
-মা, বাবুর নাম কি তোমরা রেখে ফেলেছো?
রেহেনা ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকালেন।
শোয়েব তৃষ্ণার্তের মতো সন্তানের মুখ দেখছে।
ডক্টর সালমা আব্দুস সালাম সাহেবকে ডেকে বললেন,
-মি. সালাম আপনি একটু আসুন।
লীনা নিজে থেকেই বললো,
-বাবা আমিও সাথে আসি?
ডক্টর সালমা ক্লান্তভঙ্গিতে চেয়ারে বসলেন।
-প্লিজ হ্যাভ এ সিট।
-কিছু কি হয়েছে? আপনাদের মেডিকেল বোর্ড বসাবার কথা ছিল? আমি রিমিকে দেশের বাইরে পাঠাতে চাই। দেখুন…..
-মিসেস রিমির মা কখন আসছেন?
-কালকের দুপুরের ফ্লাইটে।
-উই আর সরি, মি. সালাম। আপনারা বডি নেয়ার ব্যবস্থা করুন!
ডক্টর সালমা চোখ মুছে এপ্রন খুলে হাতে নিলেন।
-শোয়েব সাহেবকে এখনি কিছু বলার দরকার নেই।তাঁর বেবির কাছে থাকাটা এখন জরুরি।
লীনা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-রিমি কি এতই অসুস্থ ছিল? এরকম হবে এটা অবিশ্বাস্য!
-এটা আমার জীবনে ফার্স্ট কেইস, যেখানে বেবী নিয়ে রিস্ক দেখে অপারেশন করলাম… পরে দেখা গেল রিমির ইন্টারনাল ব্লাড স্টোরেজ কল্পনার বাইরে কম ছিল। ইটস এ মিরাকেল এমন ফিজিক্যাল কন্ডিশনে এরকম বেবী বেঁচে থাকা!
ডক্টর সালমা আবারও চোখ মুছলেন।
আব্দুস সালাম সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। শোয়েবকে সব কষ্টের মুহূর্তে দেখবার জন্যই কি তিনি বাবা হয়ে বেঁচে আছেন?
ডক্টর সালমা অশ্রুভেজা চোখে বললেন,
-সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, কোন বাদশা যেন ছেলের জন্য চেয়েছিলেন? আজ আমার সেই ঘটনা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে। মিসেস রিমি কি এমনই চেয়েছিলেন? আপনারা বেবীকেও নিয়ে যেতে পারেন।
আব্দুস সালাম সাহেব বাবুর কেবিনে উঁকি দিলেন। শোয়েব বাবুকে কোলে নিয়েছে, তাঁর চোখে আনন্দের অশ্রু! রেহেনা পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। আব্দুস সালাম সাহেবের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। রিমিকে তাঁর সরি বলা হয়নি! রিমিই সে সুযোগ দেয়নি। অথচ শোয়েবের ঋণ সে কত সুন্দরভাবে শোধ করে দিয়েছে। রিমি মেয়েটা পাক্কা হিসেবী আসলে, হিসেবে কোথাও একটু ভুল নেই। আশ্চর্য…..
শোয়েব ছেলেকে কোলে করে দরজায় এসে দাঁড়ালো।
-বাবা, তুমি ওকে দেখেছো? আমার মতো দেখতে একদম।
আব্দুস সালাম সাহেব অসহায়ভাবে ছেলের দিকে তাকালেন। শোয়েব সর্বশক্তি দিয়ে বাবুকে বুকে আঁকড়ে ধরে আছে! শোয়েবের সমস্ত শরীর থরথর কাঁপছে।
পরিশিষ্ট:
অনেক বছর পর, সিলেটের চা-বাগানের এক সুন্দর বাংলোয় এক বাবা তাঁর সদ্য ক্যাডেট কলেজে চান্স পাওয়া ব্রিলিয়ান্ট ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন।ছেলের সাথে শর্ত ছিল ক্যাডেটে কলেজে চান্স পেলেই বেড়াতে নিয়ে আসবেন। সেই ছেলের সবথেকে প্রিয় জিনিস রোদ্দুরের মাঝে হঠাৎ করে যে বৃষ্টি হয়, তা দেখা। বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে ডাকলো, বাবা বাইরে আসো। চট করে আসো। মা আমাদের সাথে এখানেও বেড়াতে এসেছে। এই দেখো রোদ্দুরের মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে! তুমিই তো বলেছো বাবা, মা হলো রোদ্দুরের বৃষ্টি।
শোয়েব ছেলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বড় বড় চোখের ছিপছিপে সুন্দর। অবিকল যেন শোয়েবের ফটোকপি। রিমিটা যে কি না, শোয়েবকে সারাজীবন চমকাবার মতো ভালো একটা মডেল দিয়ে গেছে।
বৃষ্টি থেমে গেল হঠাৎই!
মিশু মন খারাপ করা গলায় বললো,
-আচ্ছা বাবা, রোদ্দুরের বৃষ্টি এত অল্প সময়ের জন্য হয় কেন?
শোয়েব বিড়বিড় করে বললো,
-তোমার মায়ের মতো বলে। সেও খুব অল্প সময়ের জন্য আমার জীবনে এসেছিলো।
(সমাপ্ত)
#তৃধা_আনিকা