জবানবন্দী পর্ব-তিন

0
320

#ধারাবাহিকগল্প
#জবানবন্দী
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

আজিরনের বিয়ে ওর বোনের বাড়িতে হয়। ও ভেবেছিলো জীবনের সুখ বুঝি ওর হাতে এবার ধরা দিলো। স্বপন ছিলো ওর দুলাভাইয়ের ভাই। ওদের বাসর হওয়ার জন্য হোটেল সোনারঁগার একটা রুম ভাড়া করা হয়েছে। প্রথম যখন আজিরন এই কথা শুনেছিলো ও ভেবেছিলো স্বপন ওকে সত্যি অনেক ভালবাসে। অথচ ওর জীবনে এটা ছিলো স্বপনের চরম ভন্ডামী। নিজের সুবিধার জন্য ও এই ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

কত স্বপ্ন নিয়ে আজিরন বাসর ঘরে বসে আছে। দুচোখ ভরা কত স্বপ্ন। এবার মনে হয় ও সুখের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে বাসর খাট সাজানো হয়েছে। লজ্জারাঙ্গা মুখটা ঘোমটার আড়ালে ঢেকে রয়েছে। ভাল লাগার অনুভূতীতে ওর দেহমন আচ্ছন্ন। আজ ওর বাসর রাত ভাবতেই মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।ওর বাসর খাটে গোলাপ ফুলের পাপড়ি বিছানো রয়েছে। আজিরনের সেই মূহুর্তে জানা ছিলো না ফুলের মাঝে কাঁটা লুকিয়ে থাকে। সেই কাঁটায় একটু পরে আজিরন রক্তাক্ত হবে। আর স্বপ্নগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে।

আজিরনের একটু তন্দ্রা এসেছিলো। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দের ওর তন্দ্রা কেটে গেলো। ও খুব শিহরিত। স্বপন দরজা লক করে আজিরনকে বললো,
—-তুমি তোমার পোশাক খুলে ফেলো।
আজিরন চমকে উঠলো। স্বপন বুঝতে পেরে বললো
—–বিয়ের পোশাক পড়ে কি ঘুমাবে?
আজিরন বললো
—-আমার তো সুটকেস থেকে কাপড় বের করতে হবে।
—–আলমারিতে তোমার চেঞ্জের কাপড় রাখা আছে।
আজিরন স্বপনের এরকম কথা শুনে অবাক হলো। স্বপন ওর দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখলো না। বাসর রাত নিয়ে আজিরন ওর কল্পনায় যে চিত্রছিলো সেই চিত্রটা তো এমন ছিলো না। ও ভেবেছিলো ওর স্বামী এসে ঘোমটা খুলে ওকে দেখবে। অনেক মুগ্ধতা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপর ওকে আলিঙ্গন করবে। ও ভাবলো কি আর জীবনে ঘটলো কি?
স্বপন খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—-যাও দ্রুত কাপড় বদলে আস।
আজিরনের স্বপনের দিকে তাকিয়ে মনে হলো,স্বপন ড্রিংক করেছে। রুমের ভিতরে ফুলের গন্ধ ছাঁপিয়ে একটা উৎকট গন্ধ ওর নাকে এসে লাগছে। তারপরও আজিরন বললো,
—-আজকের রাতে দুজনকে একসাথে নামাজ পড়তে হয়।
—-দেখো আজিরন আমি অনেক টায়ার্ড। তুমি যা করবার করে তাড়াতাড়ি বিছানায় আসো।
কথাটা আজিরনের কানে খুব বাঁজলো।

তারপর আজিরনের জীবনে যা ঘটলো তা ও কোনদিন কল্পনা করেনি। এমন ভাবে স্বপন ওর ঠোঁটে চুম্বন করলো যে ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। আদিম পশুর মত ওর শরীরটাকে স্বপন খুবলে খেলো। ওর মনে হচ্ছিলো স্বপন যেন এক ক্ষুধার্ত শ্বাপদ। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক। এতো সুন্দর সম্পর্কটাকে মূহুর্তে ও বিভীষিকাময় করে তুললো। তার সাথে যুক্ত হলো মদের দুর্গন্ধ। বাসর রাতটা যেন নরকে রুপান্তরিত হলো। তারপর একসময় স্বপনের তৃপ্তি মিটে গেলে ও ঘুমিয়ে পড়লো। আজিরনের দেহটা রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত হলো। সারাটা রাত যন্ত্রণায় আজিরনের দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। ওর মনে হলো বাবাও কি ওর মায়ের সাথে একই কাজ করতো? এইজন্য হয়ত একনারীতে তৃপ্তি না হলে অন্য নারীর সঙ্গ নিতো। সারাজীবন স্বপনের মতো পশুর সাথে কিভাবে থাকবে?আর ওকে যদি ডিভোর্স দেয় দুলাভাই কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে?সব মিলিয়ে আজিরনের অস্থির লাগলো।

আজিরন চাকরি করে যেটুকু টাকা জমিয়েছিলো তার সাথে মায়ের গয়না বেচা টাকা দিয়ে ওর বোনের সাথে মোহাম্মদপুরে তিনকাঠা জমি কিনেছে। সেখানে লোন নিয়ে পাঁচতলা বিল্ডিংএর ফাউন্ডেশন দেওয়া হয়েছে। একতলা কমপ্লিট হয়েছে। আজিরন ওর বোনের সাথে থাকে। এখন যদি ও স্বপনকে ডিভোর্স দেয় আর ওর দুলাভাই ওকে যদি ঐ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ওর পাশে দাঁড়ানোর মতো এই পৃথিবীতে কেউ নাই। ওতো ওর সবটুকু সম্বল বোন দুলাভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। আজিরন দুচোখে অন্ধকার দেখছে।

খুব সকালে ওর বোন দুলাভাই চলে আসলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বপনের কোনো বিকার নেই। ও যে গত রাতে আজিরনকে বিভীষিকাময় বাসর রাত উপহার দিলো সেটা নিয়ে ওর কোনো অনুশোচনা নেই। আজিরনের বোন এসে বললো,
—-কিরে তোর শরীর খারাপ লাগছে?
আজিরন ওর বাসর রাতের কথা বোনকে বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সারাদিন সবার সাথে ভালই কাটলো। রাত আসলে আজিরন ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। ও খেয়াল করেছে স্বপন ওকে কষ্ট দিয়ে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পায়। আজিরন ভাবে একা একা বিদেশে থেকে রোজগার করেছে পয়সা কামিয়েছে। কিন্তু মনুষ্যত্বটা হারিয়ে ফেলেছে। অর্থ বিত্ত নাম যশ হওয়ার আগে ভাল মানুষ হতে হয়। সন্তানকে আমরা কতকিছু বানাতে চাই অথচ সবার আগে মানুষের মতো মানুষ হওয়া প্রয়োজন সেটাই আমরা ভুলে যাই। যে কয়দিন স্বপন দেশে ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো আজিরনের রাতগুলো ঘোর বিষাদে ঢেকে গেলো। জীবনের লালন করা স্বপ্নগুলো অমাবস্যার অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।
পরদিন স্বপন আর আজিরন মোহাম্মদপুরে চলে আসলো। ছুটি ফুরিয়ে যেতে স্বপন আবার ইটালীতে চলে গেলো। আজিরন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কয়েকদিন পার হওয়ার পর আজিরন ওর বোনকে বললো,
—-আপু তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
—– কি বলবি বল?
—–আপু আমি স্বপনকে ডিভোর্স দিবো?
—–তোর কি মাথা ঠিক আছে?
—-আপু আমার মাথা সম্পূর্ন ঠিক আছে। আমি তো একটা পশুর সাথে জীবন কাটাতে পারবো না। তুমি তো জানো না ও কতটা জঘন্য প্রকৃতির মানুষ। আমি শীঘ্রই ডিভোর্স ফাইল রেডী করবো।
—-শোন আজিরন মাথা গরম করিস না। ওতো দেশেই থাকে না। বছরে হয়ত একবার আসবে। একটু মানিয়ে নে। আর একেক পুরুষের চাহিদা একেক রকম হয়।
—-আপু আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না। ছোটোবেলা থেকে আমি এধরনের বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখেমুখি হয়েছি। আমিও আর মেনে নিতে পারছি না।
হয়ত সঠিক চিকিৎসা পেলে অনেকে হয়ত সেরে উঠে। আজিরনের সেই ধৈর্যটা আর নাই। জীবনের এতোটা বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার পর আজিরনও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। তাই ওর কাছে ডিভোর্সটাকেই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে। অবশেষে আজিরন স্বপনকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। ভাইকে ডিভোর্স দেওয়ার অপরাধে আজিরনকে বাসা থেকে ওর দুলাভাই বের করে দেয়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here