জবানবন্দী পর্ব-চার মাহবুবা বিথী

0
251

#ধারাবাহিকগল্প
#জবানবন্দী
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

নিঃস্ব রিক্ত আজিরন এসে আবার সেই হোস্টেলেই উঠলো। প্রবাদ আছে,”কপালে নাই ঘি ঠক ঠকালে হবে কি”। আজিরনের অবস্থাটা অনেকটা সেরকম।
ওদিকে আজিরনের বোন আয়েশা আজিরনের দুলাভাইকে নিজের সংসার বাঁচাতে কিছুই বলতে পারলো না। আজিরনও চায়নি ওর বোন ওর হয়ে দুলাভাইকে কিছু বলুক। সেই ছোটোবেলা থেকে আজিরন ওর জীবনের লড়াইটা একাই লড়ে গেছে। ও এও জানে, ওর দুলাভাই রাশেদ যদি ওর বোনকে দুটো বাচ্চাসহ বের করে দেয় তাহলে ওর বোন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বাবা নেই মা নেই ভাইরা থেকেও নেই তাই আজিরন চায় না ওর বোন ওর জন্য কোনো ঝামেলায় পড়ুক। তারপরও আজিরনের বোন আয়েশা ওর দুলাভাই রাশেদকে বলেছিলো,
—–তুমি আমার বোনের সাথে যে কাজটা করলে তোমার নিজের বোন হলে সেটা করতে পারতে?
—-শোনো আমার বোন তোমার বোনের মতো নষ্টা চরিত্রের মেয়ে নয়। ওর এক পুরুষে চলে না হাজার পুরুষের দরকার হয়। তা না হলে পৃথিবীর আর কোনো মেয়ের সমস্যা হয় না শুধু তোমার বোনের সমস্যা হয়। খোঁজ রাখো তোমার বোন কি করে বেড়ায়? দেখো গিয়ে বসদের কতবার দেহটা বিলিয়ে দিয়েছে।
—–তুমিও শুনে রাখো অনেক মেয়েদের জীবনে এসব ঘটনা ঘটে। কেউ চেপে যায় আর কেউ প্রতিবাদ করে। আজিরন প্রতিবাদ করে বলেই সবাই জানতে পারে। আর এভাবে না জেনে কারো সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা ঠিক নয়। আল্লাহ তোমার ঘরেও মেয়ে দিয়েছে। এ কথাটা মনে রেখো।
—-শোন আয়েশা তোমাকে শেষ বারের মতো বলছি বোনের হয়ে আমার সাথে ওকালতি করতে এসোনা। তাহলে একুল ওকুল দুকুল হারাতে হবে কথাটা মনে রেখো।

ওদিকে আজিরনের ডিভোর্সের বিষয়টা অফিসে আর গোপন থাকেনি। এক কান দুকান হতে হতে অফিসের বস অবধি কথাটা চলে যায়। আজিরন খেয়াল করেছে ওর বস জোভান কারনে অকারনে ওর সঙ্গটা চায়। অথচ এতোদিন চাকরি করেছে কখনও খারাপ আচরণ করেনি শুধু মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃত হাতটা ছুঁয়ে দিতো মাত্র। ডিভোর্সের সুযোগটা সবাই নিতে চায়। তবে অফিসে বসকে নিয়ে অনেকরকম নারী বিষয়ক কানাঘুষা আছে।
যাই হোক ডিভোর্সের ছয় মাস পার হয়ে গেলো। মাঝখানে ওর হাত শুন্য থাকায় ভাইয়ের কাছে ওর পাওনা টাকাটুকু চেয়েছিলো। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আজিরন ওর পাওনা টাকাটুকু ফেরত পায়নি।
এর মাঝে ওদের অফিসের একটা ট্যুর কক্সবাজারে যাবে। সেখানে অন্য দুটো মেয়ের সাথে আজিরনের নামও থাকে। আজিরন সরল মনে বসদের সাথে ট্যুরে যায়। সারাদিন অফিসের কাজ করার পর রাতে ডিনার সেরে বসের রুমে সবাই মিলে আড্ডা দেয়। গল্পগুজবের পাশাপাশি মদ পানও চলে। ওর দুজন মহিলা কলিগ রুপা আর লিজাও সমানতালে ড্রিংক করতে থাকে। রুপা আর লিজা এরকম অফিসের ট্যুরে কয়েকবার এসেছে। আজিরনের জন্য এটাই প্রথম। ওরা আজিরনকে মদ অফার করে। আজিরন অমত পোষণ করে। তখন লিজা ওকে আপেলের জুস এগিয়ে দেয়। আজিরন জুসটা খেয়ে ফেলে। তারপর মূহুর্তে আজিরন ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।

পরদিন সকালে বস জোভানের বিছানায় নিজেকে আবিস্কার করার পর আজিরনের বুঝতে বাকি রইলো না ওর ভাগ্যে কি ঘটেছে। বিছানার সাইড টেবিলে এক বান্ডিল টাকা আর একটা চিরকুট রাখা আছে। আজিরন চিরকুট খুলে দেখে। ওখানে লেখা রয়েছে “যদি আমার কথামত চলো তাহলে তুমি কোথায় পৌঁছে যাবে নিজেও কল্পনা করতে পারবে না। আর টাকাটা নিয়ে নিও। জোভান চৌধুরী কোনো ঋণ বাকি রাখে না”।
আজিরন এবার আর কাঁদেনি। কোনো চিৎকার চেচাঁমেচি করেনি। টাকাটা হাতে নিয়ে ক্রুর হাসি হাসলো। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,ওর এবার রিভেঞ্জ নেওয়ার পালা শুরু হলো। আর কখনও পড়ে পড়ে মার খাবে না।
তারপর খুব স্বাভাবিক ভাবে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে আসলো। আজিরনের লিজা আর রুপাকে দেখে মনে হলো ওরাও বুঝি এভাবেই অভ্যস্ত।
বেশ কিছুদিন অফিস ভালই চললো। আজিরনও ওর ক্ষতগুলো আস্তে আস্তে সারিয়ে নিয়ে একটু স্বাভাবিক হলো। সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। জোভান চৌধুরী অফিস থেকে বের হওয়ার সময় আজিরনের হাতে কয়েকটা ফাইল ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—-বাইরে তোমার জন্য গাড়ি রাখা আছে। কাজ শেষ করে ফাইল নিয়ে আমার কাছে আসবে। কোথায় যেতে হবে সেটা ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে যাবে। তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
আজিরন রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
—-ওকে স্যার আমি সময় মতো পৌছে যাবো।

আজিরনকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে। ঢাকার অদূরে জনমানবহীন একা বিশাল বাংলো বাড়ির সামনে গাড়িটা থামলো। ও গাড়ি থেকে নামার পর গাড়িটা চলে গেলো। বাংলোটার সামনে একা দাঁড়িয়ে আজিরন বুঝতে পারছে না ভিতরে কিভাবে প্রবেশ করবে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত সাড়ে নটা বাজে। ফাইল গুলো ঠিকঠাক ও সাথে করে নিয়ে এসেছে। আর নিয়ে এসেছে ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বসের সাথে রাত কাটানো বলে কথা। অনেকক্ষণ দোনোমনো করতে করতে বিশাল লোহার গেটের কাছে পৌঁছে গেলো। গেটের বাইরে গার্ডের ঘর রয়েছে। একটু ডাকাডাকিতে গার্ড বের হয়ে এসে আজিরনকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। তারপর গেটটা খুলে হল ঘরটা দেখিয়ে দিলো। লোকালয় থেকে বেশ দূরে নির্জন জায়গায় বাংলোটা তৈরী হয়েছে। এখানে কেউ বিপদে পড়লে হাজার চিৎকার করলেও আশেপাশে ছুটে আসার মতো কোনো ঘরবাড়ি নেই। বাইরে থেকে বাংলোটা যতটা বিলাসবহুল ভিতরে তার থেকেও বেশী। ভোগ বিলাসের সমস্ত উপকরণ দিয়ে বাংলোটা সাজানো হয়েছে। মেঝেতে লাগানো হয়েছে ঝকঝকে সাদা মার্বেল পাথর। এই সাদা মার্বেলগুলো দেখে আজিরনের তাজমহলের কথা মনে পড়ে গেলো।যে ডিভানটায় আজিরন বসে আছে সেটাও খুব রাজকীয়। ডিভানটার গায়ে কাঠের উপরে সোনার পাত বসানো রয়েছে। অনেকটা সিংহাসনের মতো। সামনে বিশাল সেন্টার টেবিল। টেবিলটা দেখে মনে হচ্ছে শতবর্ষী কোন গাছের গুড়ি দিয়ে বানানো। তার উপর স্বচ্ছ কাঁচ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেয়াল জুড়ে গ্রীসের দেবদেবীদের নগ্ন তৈল চিত্র। নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আজিরন। এসব দেখে ওর অস্বস্তি হতে লাগলো।
এমন সময় বিদেশী কোনো দামী ব্রান্ডের পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে রুমে ঢুকলো জোভান। আজিরন জোভানের দিকে তাকিয়ে ভাবছো ব্যাটা একটা আস্ত শয়তান। কিন্তু আল্লাহপাক ওকে রুপ দিয়েছে। যে কোনো মেয়ে ওর প্রেমে পড়তে বাধ্য। কিন্তু ওর সুন্দর চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে নরকের কীট। জোভানকে দেখে আজিরন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—-স্যার আপনি যে ফাইলগুলো আনতে বলেছেন সেগুলো সাথে করে নিয়ে এসেছি।
—-ফাইলের গল্প রাখো। এই সুন্দর চাঁদনী রাত এতো সুন্দর বুনো পরিবেশ। তুমি আর আমি আদিম বন্যতায় এই চাঁদনী রাতে আজ স্নান করবো। জোভানের লুদ্ধ দৃষ্টি আজিরনের সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দিচ্ছে।
আজিরন জোভানের খুব কাছাকাছি এসে ঘনিষ্ট হয়ে বললো,
—আমিও তো স্যার আপনার ডাকের অপেক্ষায় আছি।
জােভানের চোখ কামনার তৃষ্ণায় যেন জ্বলে উঠলো। আজিরনকে নিয়ে ওর বিশাল রাজকীয় বেডরুমে প্রবেশ করলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here