জবানবন্দী শেষ পর্ব মাহবুবা বিথী

0
320

#ধারাবাহিকগল্প
#জবানবন্দী
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

বেডরুমে ঢুকে আজিরনের ভিমড়ি খাবার যোগাড়। ঘরটা দক্ষিনমুখী। চর্তুদিকে বাতাস খেলছে। ঘরের মাঝখানে কাঠের উপর খোদাই করা সোনালী পাত বসানো খাট। বিশাল আয়না ওয়ালা দেয়ালঘেঁষা আলমারি আর সিংহাসনের মতো সোফা দিয়ে ঘরটা সাজানো হয়েছে। বিশাল সেন্টার টেবিল। লাল রঙের মখমলের কার্পেট মেজেতে বিছানো রয়েছে। জানালায় মসলিনের মতো পাতলা ঝালরওয়ালা সাদা রঙের পর্দা। লোকটার সাদার প্রতি বেশ দুর্বলতা আছে। কিন্তু মনটা এতো নোংরা কেন আজিরন বুঝে উঠতে পারে না। দেয়াল জুড়ে নর নারীর নগ্ন তৈলচিত্র। আজিরন দাঁড়িয়েই থাকলো।

জোভান খুব সতর্ক। আজিরনের হ্যান্ডব্যাগটা আগেই নিজের দখলে নিয়ে নেয়। তারপর আজিরনকে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে বলে,
—- ওখানে সবকিছু রাখা আছে। তুমি গোসল করে আসো। খুব ফ্রেস লাগবে।
—–ওকে বস
আজিরন ওয়াশরুমে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর মনে মনে বললো বাছাধন তুমি চলো ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। তুমি যদি চলো পাতায় পাতায় আমি চলি শিরায় শিরায়।
আজিরন নিজের আন্ডার গার্মেন্টসের পকেট থেকে ক্লোরোফর্মের শিশিটা বের করে রাখলো। ওয়াশরুমের ভিতরের একটা পারফিউমের বোতল খালি করলো। ওটার মধ্যে ক্লোরোফর্মটা ঢেলে রাখলো। তার আগে আজিরন নিজের নাকমুখ ভাল করে ঢেকে নেয়। খুব সাবধানে ঢেলে রাখে। তারপর ওর পরনের কাপড়ের সাথে গুটিয়ে ময়লার বাস্কেটে শিশিটা ফেলে দেয়। এর পর চাকুটাকে পেন্টের পকেট থেকে বের করে বাথটবের পিছনে লুকিয়ে রাখে। এই চাকুটাকে দেখলে মনে হবে নেলকাটার। কিন্তু ভিতরে ধারালো চাকু। আজিরন খুব সাবধানে হাতের আংটিটা খুলে রাখলো। জোভান যখন কক্সবাজারে ওকে টাকাটা দিয়েছিলো ঐ টাকাটা দিয়ে একটা বিশেষ ধরনের সোনার আংটি বানিয়েছে। কারণ আজকের প্লান ও তখনই করে ফেলেছে। এই আংটির ডিজাইনটা একটু অন্যরকম।

যাইহোক বাথরুমে আজিরনের পিংক কালারের একটা খুব সুন্দর নাইটি রাখা আছে। গোসল করে নাইটি পড়ে যখন রুমে আসলো জোভান ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আর অন্তরে কামনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো।

আজিরনকে দেখে জোভান বললো,
—-আমি তোমার রুপের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি।
আজিরন জোভানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। আর মনে মনে বললো,আজকের পর তো আর ছাই হতে পারবে না।
জোভান আজিরনের উপর খুব খুশী। আজিরন এতোটা সাপোর্ট করবে জোভান ভাবতেই পারেনি। জোভান আজিরনকে বললো,
—-আলমারিতে তোমার জন্য একটা ড্রেস রাখা আছে। তারসাথে ম্যাচ করে ডায়মন্ডের কানের দুল আংটি আর লকেট কেনা রয়েছে। কাল সকালে ওটা পরে তুমি অফিসে যাবে। রাত অনেক হলো। চল ডিনারটা সেরে ফেলি।
আজিরন বললো,
—-ডিনারটা রুমে দিলে ভাল হতো না। আমার এখন এই পোশাকে ডাইনিং এ যেতে ইচ্ছে করছে না।
—-ঠিক আছে ডার্লিং তুমি যা চাইবে তাই হবে।
জোভান ফোন করে খাবার রুমে নিয়ে আসতে বললো।
আজিরন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করছিলো। জোভান পিছন দিক থেকে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। আজিরনও জোভানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—আই লাভ ইউ ডার্লিং।
আজিরন জোভানের কাঁধে আলতো করে মাথা রাখলো। জোভান ওকে আদর করতে লাগলো।আর আজিরনের চেহারাটাও বদলে গেলো। চোখে মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো। প্রতিশোধ নেওয়ার এক পৈশাচিক হাসি। জোভানকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে আজিরন ভাবলো,তুমি নিজেকে খুব চালাক মনে
করো। এইবার তুমি আমার ফাঁদে পা দিয়েছো। এখন সব কিছু আমার প্লান মাফিক হবে। কিন্তু তুমি বুঝতে পারলে না। কি ভেবেছিলে তোমার এই সুন্দর মুখের আড়ালে নোংরা কলুষিত চেহারাটা কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না। আমি এতো সহজে তোমার অন্যায়টাকে হজম করে নিবো?জানোতো আমি ধাক্কা খেতে খেতে এই জায়গাটায় এসেছি। তাই ভয়ানক ধাক্কা আসলেও উঠে দাঁড়াতে জানি। মুখ থুবড়ে পড়ি না। আমায় নিয়ে খেলতে চেয়েছিলে? তাহলে এবার আমাদের খেলাটা শুরু হলো। আর এই খেলাটার নাম হচ্ছে মৃত্যু মৃত্যু খেলা। আমাকে চরমভাবে অপমানিত করেছো।এর শোধ আমি তুলবো। তুমি আমাকে স্পর্শ করে যে পাপের অনলে আমি জ্বলছি আজ সেই পাপেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। আমি আল্লাহপাকের কাছেও মাফ চেয়ে নিয়েছি। আল্লাহপাক বলেছেন তার বান্দারা যদি শিরক না করে তাহলে বান্দার পাহাড় সমান গুনাহ্ আল্লাহপাক ক্ষমা করে দিবেন।আমার মালিক আল্লাহপাক আমার অন্তরটা জানেন।আজিরনের চোখটা দপ করে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠলো।
কলিং বেলটা বেজে উঠলো। জোভান আজিরনের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
—- কি হলো ডার্লিং ছাড়ো আমায়। ওরা খাবার নিয়ে চলে এসেছে।
—আজিরন জোভানকে ছেড়ে দিয়ে সোফার উপর বসে পড়লো।
তারপর দুজন মিলে রাতের ডিনার সেরে ফেললো। রান্নার ছেলেটা এসে এঁটো প্লেটগুলো নিয়ে গেলো। জোভান হাত ধুতে বাথরুমে গেলো। আজিরনও জোভানের সাথে হাত ধুয়ে রুমে চলে আসলো। তারপর আজিরন দুগ্লাস আপেল জুস গ্লাসে রেডী করলো। আংটিটা হাতে পড়ে আজিরন আংটিতে চুমু খেলো। এখন বাকি খেলাটা ঠিকমতো শেষ করতে পারলেই আজিরনের মুক্তি।

জোভান রুমে এসে দেখে আজিরন জুসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। জোভানও জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে পুরোটা শেষ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোভানের দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইলো। আজিরন ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,আমার আংটি বানানো সার্থক হয়েছে। আংটিটা গোলকরে বানানো হয়েছে। ভিতরে ফাঁকা ছিলো। উপরে আবার একটা ঢাকনির মতো দেওয়া ছিলো। সেই ফাঁকা জায়গাটায় ও ঘুমের ওষুধ ভরে নিয়ে এসেছে। যাক বাকি কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। রাতটা ফুরিয়ে যাচ্ছে। যদি ঘুমটা দ্রুত ভেঙ্গে না যায় সেজন্য ক্লোরোফর্মটা ওর নাকে মুখে ভালো করে মাখিয়ে দেওয়া হলো। তারপর ছুড়িটা ওর পেট বরাবর ঢুকিয়ে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। আর আজিরনের জ্বালাটা একটু একটু করে নিভে যেতে লাগলো। পুরো সাদা বিছানা রক্তে লাল হয়ে গেলো। আজিরনের গায়েও রক্তের দাগ লেগে আছে। ওয়াশরুমে গিয়ে নিজেকে ক্লিন করে নিলো। তারপর আলমারিতে রাখা পোশাকটা পড়লো। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। আজিরন হ্যান্ডব্যাগ ছাড়াই বের হলো যাতে ওকে কেউ সন্দেহ না করে। ও দরজা লক করে বের হয়ে আসলো। এতো সকালে গার্ড ওকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ম্যাডাম আপনি কোথাও যাবেন?
আজিরন বললো,
—না,সাহেব ঘুম থেকে উঠলে একসাথে বের হবো। আমি তোামাদের জায়গাটা ঘুরে দেখছি।
আজিরন ওদের হাতে ধরা দিতে চায়নি। কারণ বংশের সম্মান রক্ষা করার জন্য ওরা ওকে ওখানেই মেরে ফেলতো। আর আজিরনের চরিত্রকে মনের মাধুরী মিশিয়ে কাটাছেঁড়া করা হতো।
আজিরন পার্শ্ববর্তী থানায় গিয়ে ধরা দিলো। এবং নিজ মুখে শিকার করলো সে খুনী। পুলিশও বাংলোতে এসে খুনের সত্যতার প্রমান পেলো। তারপর আজিরন আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপু এই পৃথিবীতে আমার বাঁচার স্বাদ মিটে গেছে। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। তাই এখনও বেঁচে আছি। তবে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে একজন নরপিশাচকে আমি নিজ হাতে শেষ করতে পেরেছি এটাই আমার সবচেয়ে বড় শান্তি। আমি এখন হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে পারবো।

দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে জয়িতা জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসলো। ও একজন নারী বিধায় আজিরনের কষ্টের জায়গাটা অনুভব করতে পারলো। জয়িতা ভাবছে, আজিরন ওর উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পেরেছে। কিন্তু সবাই পারে না। সারাজীবন নারীরা বিভিন্নভাবে যৌনহয়রানির শিকার হয়। লোক লজ্জার ভয়ে সবটাই চেপে যায়। সেদিক থেকে আজিরন অন্যরকম। ওর জীবনে কোনো পিছুটান নেই। ও সবার থেকে আসলেই আলাদা। এ এক রক্তক্ষরণের জবানবন্দী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here