জবানবন্দী পর্ব-দুই

0
240

#ধারাবাহিকগল্প
#জবানবন্দী
পর্ব-দুই
মাহাবুবা বিথী

ওর বাবা ওদের বাসায় যে কাজ করতো ঐ মহিলাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। অথচ ওর বাবা ওর মাকে বলেছিলো ব্যবসার কাজে দুদিন বাইরে থাকবে। এদিকে কাজের মহিলা জরিনা ওর মাকে বলেছিলো
—-খালাম্মা,খালু তো বাড়ি নাই। কাজের চাপ ও কম। আমারে দুই দিনের ছুটি দেন।
আজিরনের মা রাজি হয়। জরিনাকে দুদিনের ছুটিও দিয়ে দেয়। সকালে ওর মা ওকে বলেছিলো

—–আজিরন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড় মা।আমি সকাল সকাল সব কাজ করে ফেলবো। জরিনা দুদিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছে।

আর এখন ও দেখছে ওর বাবা জরিনাকে বিয়ে করে নিয়ে আসছে আর উঠোনে ওর মার লাশ পড়ে আছে। আজিরন সবার সামনে বলে,
—-বাবা আমার মাকে খুন করেছে। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় আমি মাকে এতো সুন্দর দেখেছি যে এই কয়েক ঘন্টায় আমার মা মারা যেতে পারে না। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
এই কথা শুনে ওর বাবা ওর বোনকে বলে
—-আয়েশা, তুই আজিরনরে ঘরের ভিতর নিয়া যা। আর তোর নতুন মারে ঘরে নিয়া বসা। আমি লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতেছি।
আজিরন চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর ওর বাপকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—-শোনে রাখো তুমি, দুনিয়ার আদালতে যদি আমার মায়ের খুনের বিচার না পাই তবে আল্লাহপাকের আদালতে আমি এই খুনের বিচার চাই।
ওর বোন ওর মুখ চাপা দিয়ে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে যায়। তারপর জরিনাকে নিয়ে আয়েশা ওর মায়ের ঘরে বসায়। কিছুক্ষণ পর আয়েশা আবার আজিরনের কাছে চলে আসে। আজিরন আয়েশাকে দেখে বলে,
—–বুবু তুমি কখন আসছো? তুমি যখন আসছিলা মা কি তখন বেঁচে ছিলো?
—-আমারে আব্বায় খবর দিয়া আনছে। আব্বা লোক দিয়া খবর পাঠাইছে মা না কি খুব অসুস্থ। এই কথা শুইনা বাড়ি আইসা দেখি মা বাঁইচা নাই।
—-সকালে আমি মারে এতো হাসি খুশী দেইখা গেলাম বুবু কি সে যে কি হইলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে আমার পাষণ্ড বাপ যদি আমার মারে মাইরা ফালায় তাহলে তার শাস্তি ওরে পাইতে হবে।
আয়েশা বলে,
—-মা তো বাঁইচা নাই তাই আমাগো মাথা ঠান্ডা করে চলতে হইবো। বোন তুই এখন আর এতো মাথা গরম করিস না।
আয়েশার বিয়ে পাশের গ্রামে হয়েছে। আর ও কখনও ওর বাবার কোনকাজে প্রতিবাদ করে নাই। আয়েশা ভীতু প্রকৃতির মানুষ। তাই ওদের বাবা সবার আগে ওকে খবর দিয়েছে। পরে ওর দুই ভাই ও স্কুল আর কলেজ থেকে চলে এসেছে। ওরা ওর মার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে।
শুধু আজিরন ওর মায়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। আস্তে আস্তে সময় গড়িয়ে যায়। আজিরন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় এসএসসি পাশ করে ও আর এ বাড়িতে থাকবে না। যদিও ওর বাবা ওকে বিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে কিন্তু ওর সাথে পেরে উঠেনি। ও ওর বাবাকে হুমকি দিয়েছিলো জোর করে বিয়ে দিলে ও আত্মহত্যা করবে। এই জন্য ওর বাবা ওর বিয়ের ঝামেলায় জড়ায়নি। এর মাঝে ওর বাবার জমি বিক্রি করে বড় ভাইটা বিদেশে চলে যায়। কিন্তু ওর বাবাকে কোনো টাকা পাঠায় না। ওর বাবার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আগের মতো ব্যবসা করতে পারে না। ওর বাপের এই ঘরে এক ছেলে এক মেয়ের জন্ম হয়।
আজিরনের এসএসসির রেজাল্ট খুব একটা ভাল হয় না। কারণ ও কোনো টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়েনি। পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টারে শুধু মডেল টেস্ট দিয়েছিলো। ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.২৫ পেয়ে মানবিক বিভাগ থেকে পাশ করলো।

এরপর অনেক চেষ্টা করে ঢাকায় একটা কলেজে ভর্তি হয়েছিলো। আর মেয়েদের হোস্টেলে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নিলো। বোনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মায়ের গয়না বিক্রি করে পড়ার খরচ চালাতে লাগলো। কারণ ওর বাবা বলে দিয়েছে ওর কোনো খরচ ওর বাবা আর চালাতে পারবে না। এবার ৩,৫০ পেয়ে এইচএসসি পাশ করলো। তারপর বাংলা কলেজে সমাজবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হয়। ও যে হোস্টেলে থাকতো সেখানে একটা মেয়ে তিস্তানামক এনজিওতে মাঠকর্মী হিসাবে চাকরি করে। ওর সহায়তায় অনেক চেষ্টা তদবির করে ওর জীবনের ঘটনাগুলো কিছুটা অফিসে জানানোর পর ওরা ওকে চাকরি দেয়। এরপর পড়াশোনার পাশাপাশি ও চাকরি করতে লাগলো। নীলক্ষেত থেকে প্রতিদিন বাসে করে মিরপুরে ওর অফিসে আসতে হয়। মাঝে মাঝে আবার কলেজে যেতে হয়। আর প্রতিনিয়ত বাসে কোনো না কোনো শয়তানের দ্বারা যৌনহেনস্তা হতে থাকে। ছোটোবেলা থেকে এভাবে হেনস্তা হতে থাকায় ওর মানসিকতার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
মাঝে ওর মনে হতো ওর শরীরটা মনে হয় অপবিত্র হয়ে গিয়েছে। দুতিন ঘন্টা ধরে ও গোসল করতো। তারপর নিজেকে পবিত্র মনে হতো।
এখন আর বোনের কাছে কোনো টাকা ও নেয় না। বরং ওর আর একটা ভাই এসে বিদেশ যাওয়া উপলক্ষে ওর কাছ থেকে ৫০,০০০ টাকা ধার হিসাবে নিয়ে যায়। কিন্তু ওর ভাই সেই টাকা ওকে আর ফেরত দেয়নি। এর মধ্যে ও ওর বোনের কাছে শুনতে পায় ওর বাবার দুই পা গ্যাংরিন হওয়ার কারনে কেটে ফেলতে হয়েছে। ওর বাবা ওকে দেখতে চেয়েছে। সে সময় উনি বারডেমে ভর্তি ছিলেন। প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্বেও আজিরন ওর বাবার সাথে দেখা করতে যায়। ওর বাবা ওর কাছে মাফ চেয়ে নেয়। মৃত্যু সজ্জ্বায় ওর বাবা ওকে বলে,
—-আজিরন মৃত্যুপথ যাত্রীরা কখনও মিথ্যা কথা বলে না। আমি তোর মায়ের উপর অনেক অত্যাচার করেছি। কিন্তু তোর মাকে আমি খুন করিনি। আর তার প্রতি করা অন্যায়ের শাস্তিও আমি পাইছি। আজ আমি রোগে কাতর সহায় সম্বলহীন একজন মানুষ। এটাই তো আমার বড় শাস্তি। বিশ্বাস করা না করা তোর ব্যাপার। তোর মা হার্টঅ্যাটাক করে মারা গিয়েছে।

এর কয়েকদিন পরেই হাসপাতালে আজিরনের বাবার মৃত্যু হয়। আজিরন হাসপাতালের সমস্তবিল পরিশোধ করে। ওর বাবার দাফন কাফনের সব ব্যবস্থা আজিরন সম্পন্ন করে। ওর বাবা এই ঘরে দুটো বাচ্চার লেখাপড়ার খরচ ও চালাতে থাকে। এদিকে ওর অনার্স কমপ্লিট হয়ে যায়। গ্রাজুয়েশনে মোটামুটি ভালই রেজাল্ট করে। অফিসে ওর একটা প্রমোশন হয়।

এরপর ওর বোন দুলাভাই ওর বিয়ের চেষ্টা করে। আজিরন বিয়েতে মত দেয়। অতঃপর ওর দুলাভাইয়ের ভাইয়ের সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়। উনি ইটালী প্রবাসী। ছেলের নাম স্বপন। আজিরনের সাথে স্বপনের মাঝে মাঝে কথা হয়। স্বপন আজিরনকে বলে,
—-বিয়ের পর আমি আর ইটালী যাবো না। বাংলাদেশেই ব্যবসা করবো।
কিন্তু আজিরন ওকে বলে,
—-বাংলাদেশে এসে আর কি করবেন? বরং আমাকে ইটালী নিয়ে গেলে ভাল হয়।
স্বপনও আজিরনের সাথে একমত হয়। অবশেষে ওদের দুজনের বিয়ে হয়। বাসর রাতে আজিরন এক বিভৎস পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। স্বপন মারাত্মক বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here