#ধারাবাহিকগল্প
#জবানবন্দী
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
জয়িতা জার্নালিজমে মাস্টার্স কমপ্লিট করে”দৈনিক আত্মরক্ষা” নামক একটি নারী বিষয়ক পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে জয়েন করেছে। এখানে ও নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌননির্যাতন প্রতিরোধ সহ নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুব দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে। এই পত্রিকার সম্পাদক জুবাইদা চৌধুরী। উনি আজকে জয়িতাকে ডেকে বললেন,
—-জয়িতা তোমাকে আগামীকাল জেলখানায় একজন ফাঁসির আসামির রিপোর্ট করতে যেতে হবে। ঘটনাটা একবছর আগে ঘটেছে। অফিসের এক মহিলা এমপ্লয়ির হাতে তিস্তা গ্রুপের উত্তরাধিকার খুন হয়েছিলো। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আসামি নিজেই খুন করে এসে ধারালো চাকু নিয়ে থানায় ধরা দেয়। নিজের জন্য কোন উকিলও নিয়োগ করেননি। ওনাকে সাহায্য করতে ওনার পরিবার থেকেও কেউ আসেনি। কি অবাক না! শুধু ফাঁসির রায় হওয়ার পরে এই প্রথম আসামি একজন মহিলা সাংবাদিকের কাছে নিজের শেষ জবানবন্দী তুলে ধরতে চায়। এটাই ওর শেষ ইচ্ছা। তাই আজ কারাগার থেকে ফোন করে একজন সাংবাদিক ওনারা কল করেন। যদিও তুমি নতুন তারপরও আমার তোমাকে খুব সাহসী মনে হয়। কাল সকাল দশটায় তোমার এপয়েটমেন্ট।
—-ওকে আপু। আমি দশটায় পৌঁছে যাবো।
ঘুম থেকে উঠতে জয়িতার একটু দেরী হয়ে গেলো। সকাল দশটার মধ্যে ওর জেলখানায় পৌছাতে হবে। মোহাম্মদপুর থেকে যেতে অনেক সময় লাগবে। তাই না খেয়েই জয়িতা আসামির কথা রেকর্ড করার জন্য একটা রেকর্ডার, লেখার কাগজ কলম সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে জেলখানার উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়লো।
আগে থেকেই জয়িতার নামে পাস যোগাড় করাছিলো। জয়িতার পরিচয় পাওয়ার পর একজন পুলিশ কন্সটেবল ওকে ভিতরে নিয়ে যায়। অনেক লম্বা পথ পেরিয়ে জয়িতাকে একটা রুমের সামনে দাঁড় করানো হয়। ওটা মনে হয় ফাঁসির আসামিদের ঘর। জয়িতা অনেক জায়গায় রিপোর্ট করলেও জেলখানায় এটা ওর প্রথম রিপোর্ট। কেমন যেন দমবন্ধ পরিবেশ। জয়িতার মনে হচ্ছে ওর আত্মাটা ছটফট করছে কখন এখান থেকে বের হবে। এই পরিবেশে ওর মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা শিরশিরে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। একজন মহিলা পুলিশ অফিসার এসে জয়িতাকে বললো,
—-আসুন আপা ভিতরে আসুন।
পুলিশ অফিসার জয়িতাকে আবারো বললো,
—জানেন মেয়েটা আজ অবধি মুখ খুলেনি। ওর একটাই কথা ও যেহেতু খুনী তাই ওর ফাঁসি হওয়া দরকার। ও কি কারনে খুন করেছে সেটাও আমরা জানতে পারিনি।
জয়িতা ভিতরে গিয়ে দেখলো ওর বয়সী এক সুন্দরী মায়াবতী নারী। জেলখানার পোশাকেও মানুষকে এতো সুন্দর এতো পবিত্র লাগে ওর জানা ছিলো না। মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে সালাম দিলো।
জয়িতা ওকে বললো,
—-আপনার নাম আজিরন বেগম?
—-জ্বি।
—-কি কারনে আপনি খুন করতে বাধ্য হলেন?
—-বলব বলেই তো আপু আপনাকে ডেকেছি। সে এক লম্বা কাহিনী। আপনাকে অনেক ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। আর একজন নারীর জীবনের লাঞ্চনার কথাগুলো দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
—-সমস্যা নেই। আমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে। আপনি বলা শুরু করুন।
আসামি বলা শুরু করলো———-
সে অনেক বছর আগের কথা। রংপুরের সীমান্তঘেঁষা এক প্রত্যন্ত গ্রামে আজিরনের বাস ছিলো। ওদের চার ভাইবোনের সংসার ছিলো। বাবা এলাকার নামকরা ব্যবসায়ী ছিলো। যদিও তার ব্যবসা প্রধানত চোরাচালানী কেন্দ্রিক ছিলো। যাই হোক আজিরনদের সংসারে কোনো শান্তি ছিলো না। প্রায় প্রতি রাতেই ওর বাবা ওর মাকে বেদম পেটাতো। আজিরন ছোটো থাকাতে বুঝতাে না। শুধু অবাক হয়ে ভাবতো বাবা মাকে কেন এভাবে পেটায়? ওর ভয় হতো বাবার মার খেয়ে ওর মা না জানি মরে যায়। একটু বড় হওয়ার পর বুঝেছে বাবা কেন মাকে পেটায়?বাবার ছিলো নারী মাংসের ক্ষুধা। তার নিত্য নতুন টেস্টের দরকার হয়। মা তার এই পাপ কাজে বাঁধা দেওয়াতে নজরানা হিসাবে বাবার আঘাতগুলো মায়ের কপালে জুটতো। ওর বোন ছিলো সবার বড়।তারপর দুই ভাই। আজিরন ছিলাে পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ট সদস্য। কিন্তু আজিরন শুধু ওর বাবার এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো।ওর বড় বোন খুব ভীতু ছিলো। আর ওর দুভাই হয়ত মনে করতো বৌ পিটানোটা মনে হয় কোনো দোষের না। কারণ গ্রামে কম বেশী সবাই বৌ পেটায়। তাই মায়ের এই ব্যথা ওদের স্পর্শ করতো না। ওদের বাসায় একজন লজিং মাস্টার ছিলো। আজিরনের বয়স তখন সাত কি আট বছর। ও ছোটো ছিলো বিধায় মা ওকে খুব চোখে চোখে রাখতো। সে একদিন আজিরনকে নিরিবিলি জায়গায় ডেকে নেয়। তারপর ওর সারাগায়ে বিশ্রীভাবে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে। তারপর যখন ওর প্যান্ট খোলার উদ্যোগ নেয় তখনি ওর মা দেখতে পায়। এবং ওকে ওই পশুর হাত থেকে বাঁচিয়ে ঘরে নিয়ে যায়। লজিং মাস্টার সাথে সাথে পালিয়ে যায়। আর মা তখন আজিরনকে বলে পাপ কোনদিন বাপকেও ছাড়ে না। বাপের পাপের কারনে না জানি ওদের জীবনটা ধ্বংস হয়ে যায়। ওর বোনের বয়স তখন ষোল বছর। মা বোনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়। আর এই ঘটনাটা আজিরনের মনেও দাগ ফেলে। পৃথিবীতে ভাল খারাপ দুই ধরনের মানুষ বাস করে। কিন্তু আজিরনের দুর্ভাগ্য এটাই যে খারাপ মানুষগুলো সাথেই আজিরনের সাক্ষাত হয়। তারপর থেকে আজিরন কোনো পুরুষ টিচারের কাছে আর পড়তে যায়নি। ওর আর এক দিনের কথা মনে আছে। ওদের বাসায় একজন হুজুর এসে ওদের আরবি পড়াতো। সেদিন বড়বোনের পিরিয়ড ছিলো দেখে আরবি পড়তে বসেনি। ভাই দুটোর পরীক্ষা ছিলো। অগত্যা ওকেই হুজুরের কাছে পড়তে বসতে হয়। তখন ও আজিরন খুব একটা বড় হয়নি। কিন্তু ওর বুকের দিকে হুজুর এমনভাবে তাকিয়েছিলো যে ওর মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। ও তখন হজুরের দাড়ি ধরে টেনে ছিঁড়তে লাগলো। হুজুরের চিৎকারে ওর মা দৌড়ে এসে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপর থেকে হুজুর আর ওদের পড়াতে আসেনি।
কিছুদিনের মধ্যে ওর মা ওর বোনকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন ওদের বাসায় এক যুবতী মেয়ে কাজ করতো। পাড়ায় যদিও ওর বাপের বদনাম ছিলো তারপরও ক্ষুধার জ্বালা বলে কথা। ওদেরও কাজের লোকের দরকার ছিলো। তাই কাজের মহিলার অভাব হতো না। সেই মেয়েটা আসার পর ওদের অশান্তি দ্বিগুন বেড়ে যায়। কারণ ওর মা ভয় পেতো বাপের এইসব নোংরা কর্মের জন্য যদি ওর বোনের সংসারটা ভেঙ্গে যায়? আজিরন তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। সেদিন সকালে ওর মা ওকে আদর করে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। মার পরনে ছিলো কমলা রঙের শাড়ি। ওর ফর্সা মাকে কমলা রঙের শাড়িতে শিউলি ফুলের মতো সুন্দর লাগছিলো। দুদিন ওর বাবা বাড়িতে ছিলো না। তাই ওদের বাড়ির পরিবেশটা খুব ভাল ছিলো। আজিরন যথারীতি সকালে রেডী হয়ে স্কুলে চলে যায়। টিফিন পিরিয়ডের সময় ওর ক্লাস টিচার ওকে ডেকে নিয়ে বলে,
—-তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। তোর মা না কি মারা গেছে?
এই কথা শুনে আজিরন স্কুল থেকে পুরোটা পথ দৌড়ে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু বাড়ি গিয়ে আজিরন ঐ দৃশ্য দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে।
চলবে