এক_শহর_প্রেম💓 লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_২০

0
992

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২০
স্নিগ্ধ প্রহরে ধরিত্রীর বুকে প্রভাকর তার মিষ্টি রোদের ছটা ছড়িয়ে নতুন দিনের সুস্বাগতম করছে। ভোর ছয়টা ছুঁই ছুঁই। আদিরা ভাবলো একটু হাঁটতে বের হবে। গ্রাম থেকে আসার পর বাবা-মায়ের সাথে আর কথা হয় নি তাই মনটা ভার হয়ে আছে। ভার্সিটিও বন্ধ। বিকেলের আগে অলস বসে থাকতে হবে। বৃষ্টির কারণে পিচ ঢালা রাস্তা সিক্ত হয়ে আছে। গাছের পাতায় ভেজা রাস্তাঘাট আচ্ছাদিত। একাকি হাঁটতে ভালোই লাগছে আদিরার। কিছুটা দূরে একটা কদম গাছ আছে। বর্ষা ঋতুর আভিধানিক বিদায় খুবই নিকটে হলেও আদৌতেও কী বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষার বিদায় শ্রাবণেই হয়? কদম গাছটার কাছে মাহিদের সাথে এক দুইবার যাওয়া হয়েছিল। মাহি ছবি এঁকেছিল সেখানে গিয়ে। আদিরা সেই পথ ধরতে গিয়ে দেখতে পেলো কিছুটা দূরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। আদিরা এগিয়ে যেতে চেয়েও গেলো না। যদি খারাপ কেউ হয়। আদিরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাপারটা না বুঝে চলে যাচ্ছিলো তখন দেখলো একটা ছেলে ট্রাউজার ও গেঞ্জি পড়া সে হাতে ছোটো ফ্লাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার কাছে দৌঁড়ে আসছে। দৌঁড়ে আসা ছেলেটাকে পাশ থেকে আদিরার কাছে পরিচিত মনে হলো। আদিরা অন্যপাশ দিয়ে একটু সামনে এগোলো। দুইটা ছেলের মধ্যে সদ্য আসা ছেলেটার মুখাবয়ব আদিরার কাছে দৃশ্যমান হলো। ছেলেটা আহনাফ। আহনাফ হাতে থাকা ফ্লাস্কটা থেকে চা ঢেলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কিছু করছিল ছেলেটাকে চা দিল। আদিরা অনুমান করে নিলো দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা মারসাদ হবে। আদিরা দ্বিমনায় ভুগলো, যাবে কি যাবে না? অতঃপর ভাবলো, যাবে না। আদিরা কদম গাছটার দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো।

আহনাফ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এদিকওদিক নজর সরিয়ে একটা মেয়েকে দেখে মনে হলো ওটা আদিরা হতে পারে। তাও সত্যতা যাচাই করতে মারসাদকে মেয়েটার দিকে ইশারা করে বলল,

–দেখ তো ওটা আদিরা না?

মারসাদ ক্যানভাসে রঙ-তুলির সংমিশ্রণ থামিয়ে ইশারাকৃত দিকে তাকিয়ে মৌন সম্মতি দেয়। আহনাফ সহাস্যে আদিরাকে জোরে ডাক দেয়। আদিরা ডাক শুনে থেমে পেছোনে তাকায়। আহনাফ দৌঁড়ে আদিরার কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

–এই সকালবেলা কই যাচ্ছ?

আদিরা মিষ্টি হেসে বলে,
–সামনে কদম গাছটা আছে না? সেখানে যাচ্ছিলাম ভাইয়া। আপনারা এখানে কী করেন ভাইয়া?

আহনাফ জবাব দেয়,
–মারসাদের ছবি আঁকার ঝোঁক উঠলো তাই ফজরের পর আমাকে টেনে নিয়ে আসলো। আসো দেখবে।

আদিরা আহনাফের সাথে যায়। মারসাদ আদিরাকে আসতে দেখেও কিছু বলে না। আজ তার মন খারাপ। আদিরা আহনাফের সাথে সেখানে গিয়ে দেখে মারসাদ চিত্র আঁকছে। যেখানে একটা মেয়ে বিশাল খোলা নীল অন্তরিক্ষের নিচে কোনো পাহাড় বা টিলার উপরে খোলা চুলে নীল শাড়িতে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচল ও চুলগুলো বাতাসে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। অদূরে বড়ো বড়ো সবুজ পাহাড়ের মতো আবছা দেখা যাচ্ছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি।

আদিরা মুগ্ধ হলো চিত্রটা দেখে। এতো সুন্দর জীবন্ত চিত্র যা ভাষায় ব্যাক্ত করা যায় না। মুগ্ধচিত্তে চিত্রটার দিকে একমনে নজরবন্ধী করেছে আদিরা। মারসাদ ঈষৎ ঘার ঘুরিয়ে আদিরার সম্মোহিত দৃষ্টি দেখে হালকা হাসলো তারপর আবার রঙ-তুলিতে চিত্রটার আরও রূপ দিতে লাগলো। আহনাফও চিত্রটার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে। আদিরা চোখে-মুখে মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলল,

–এতো সুন্দর জীবন্ত চিত্র। মনে হচ্ছে মেয়েটাকে আমি এই ভয়ংকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করছি।

মারসাদ তুলি হাতে নিয়ে চিত্রটার দিকে নজর রেখে আলতো হাসলো। আদিরা কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

–কাউকে উদ্দেশ্য করে আঁকা হয়েছে কী? নাকি এমনেই এঁকেছেন?

মারসাদের বিষন্নতা ভারাক্রান্ত মন হেয়ালি করতে চাইলো। হেয়ালি করে বলল,

–এমন কেউ! যাকে আমি অনেক ভালোবাসি। যাকে এই রূপে দেখে আমার মন তার খুশিতে উচ্ছাসিত হয়েছিল। যাকে ছাড়া হয়তো নিষ্ঠুর পৃথিবী আমায় গ্রাস করে নিতো। যার জন্য নিজের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেই পরম সুন্দরী রমণী আমার দেখা দ্বিতীয় সুন্দরী নারী। প্রথমজন আমার মা। যাকে আমি জ্ঞান হওয়ার পর দেখি নি।

আদিরা মারসাদের মুখ নিঃসৃত প্রতিটা শব্দ গভীরভাবে অনুধাবন করলো। হুট করে তার মনের কুঠুরিতে প্রশ্নের উদ্রেক হলো। মারসাদ কী কাউকে ভালোবাসে? আদিরা সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করলো,

–তাকে খুব ভালোবাসেন?

মারসাদ তাচ্ছিল্য হাসলো। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
–খুব! তার জন্য জান দিতেও পারি নিতেও পারি! তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না যে।

আদিরার মনে হলো তার মন কাঁচের মতো ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। তাহলে এতোদিন মারসাদের চোখের ভাষা সে কী ভুল পড়েছে? আদিরা আপন মনে প্রমোদ গুনলো, মারসাদ তো তাকে মুখে কিছু বলে নি। আর না কোনো ওয়াদা দিয়েছে। হয়তো তার ভাবনাটাই ভুল ছিল!

আহনাফ আদিরার দিকে তাকালো। আদিরার চেহারার ভাব-ভঙ্গী তার সুবিধার ঠেকলো না। মারসাদ কী হিসেবে কথা গুলো বলেছে তা সবার বোধগম্য হওয়ার কথা না। যারা এই বিষয়ে অবগত তারাই বুঝতে পারবে। আহনাফ আদিরার পাণ্ডুর মুখশ্রী দেখে নিয়ে মারসাদের দিকে তাকালো। মারসাদ একদৃষ্টিতে চিত্রটার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বুঝলো মারসাদ যা বলেছে সব তার অবচেতন মনের সরল ভাষা। আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে এক ঢোক গিলে আদিরাকে বলল,

–জানতে চাও না চিত্রটা কার?

আদিরা মলিন হাসলো। তার জানার ইচ্ছে নেই। সে যে শুরুতেই জেনে গেছে তাতে সে নিজেকে সামলে নিতে পারবে। আদিরা ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তে করে বলল,

–না ভাইয়া সমস্যা নেই। আমি একটু কদম গাছটার কাছে যাবো।

আহনাফের মনে হলো আদিরা জানতে চাক বা না চাক কিন্তু তাকে বলতেই হবে। আহনাফ হড়বড়িয়ে বলল,

–সে আপিলি! মানে মারসাদের বড়ো বোন। আজ আপিলির তৃতীয় মৃ*ত্যুবার্ষিকী। এই শ্রাবণ মাসেই আপিলির সাথে মারসাদ শেষবারের মতো বান্দরবান গিয়েছিল। তারপর তো আপিলির সাথে আর যাওয়া হয় নি। আপিলি পাহাড়ের চূড়ায় এমনভাবেই প্রকৃতি উপভোগ করেছিল। সেটাই মারসাদ চিত্রতে ফুটিয়ে তুলেছে।

আদিরা সব শুনে বোকা বনে গেলো। সে তো চিত্রর মেয়েটাকে মারসাদের প্রেমিকা ভেবে মস্ত বড়ো ভুল ভেবে বসেছিল। আদিরা ভুল ভেবে চোখ মুখ খিঁচে জিভে কাঁ*মড় দেয়। আর মারসাদ সামনে দিকে তাকিয়েই আলতো হাসে।

________

বিগত তিন দিনে রাদিবের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সে ঘুমে জাগরণে সর্বক্ষেত্রে মিলিকেই দেখে। রাদিবকে রাতের বেলা কেউ খাবারের সাথে “লাই*সার্জিক অ্যা*সিড ডা*ইই*থাইলা*মাইড” ড্রা*গ মিশিয়ে দেয়। যা একটি সিন*থেটিক ড্রা*গ। শস্যদানার ওপর জন্মানো বিশেষ ধরনের ছত্রাক থেকে উৎপাদিত লা*ইসা*র্জিক অ্যা*সিড থেকে রা*সায়নিক সংশ্লেষের মাধ্যমে ডি-লাই*সা*র্জিক অ্যা*সিড ডা*ইইথি*লামাইড বা এল*এস*ডি তৈরি করা হয়। সাধারণভাবে এল*এস*ডি হয় বর্ণ ও গন্ধহীন। এটা এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে। ফলে এটা সেবনের পর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন একজন মানুষ যা খুশি তাই করতে পারেন। এটা হ্যা*লুসি*নেশন করায়। যা নিয়ে খুব চিন্তা করবে তা তার অক্ষিপটে ভেসে উঠবে। যদি সুন্দর চিন্তা করে তো সুন্দর সব ভেসে উঠবে আর খারাপ চিন্তা করে এটা সেবন করলে খারাপটাই ভেসে উঠবে। এটা চিকিৎসকদের অনুমতি ছাড়া সেবন করা ক্ষ*তিকর ও প্রাণহা*রক।

রাদিবের নিজেকে শে*ষ করে দিতে ইচ্ছে করে। এই অভিপ্রায় সে গতকাল রাত ৩টার পর দুই পাতা স্লি*পিং পি*ল খে*য়ে ঘুমিয়েছে।

মারসাদ আজ বিকেলে মিলাদ পড়িয়ে ও এতিমখানার বাচ্চাদের মিলির জন্য খাবার খাইয়ে মিলির শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছে মিলাদের খাবার নিয়ে। মারসাদ সেখানে গিয়ে বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপে। দরজা খুলে সেই বাড়ির কাজের লোক। মারসাদ বাড়ির মানুষদের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ে,

–কোথায় শিকদার বাড়ির মানুষজন। বাহিরে আসুন। আপনাদের বাড়ির বউয়ের ও ছেলের ঘরের সন্তানের আজ তৃতীয় মৃ*ত্যুবার্ষিকী।

বাড়ির লোকজন চৌকাঠের কাছে এসে মারসাদকে দেখে অবাক হলো। ওদের প্রথম মৃ*ত্যুবার্ষিকীর পর মারসাদ দ্বিতীয় মৃ*ত্যুবার্ষিকীতে আসে নি। আজ এসেছে দেখে অবাক হলো। মারসাদ বাঁকা হাসে। তারপর বলে,

–আপনাদের ছেলে কোথায়? সে তার বউ-বাচ্চার মৃ*ত্যুবার্ষিকীর মিলাদের অংশ হবে না? ডাকুন তাকে।

রাদিবের বাবা-মা, ভাই-ভাবি অবাক হয়ে গেল। মারসাদ ওদের আর ঘাটাতে চাইলো না। মারসাদ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

–থাক। সে হয়তো আমার সামনে আসতে চায় না। মিলাদের খাবারগুলো রাখুন। আমি আজ আসলাম। আল্লাহ্ হাফেজ। ভালো থাকবেন।

মারসাদ রাদিবদের বাড়ির কাজের লোকের হাতে খাবারের প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো। মারসাদের ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির বাঁকা হাসি।

চলবে ইনশাআল্লাহ্
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here