#প্রথম_প্রেমের_উষ্ণতা[০৭-শেষ পর্ব]
#ফারজানা_আক্তার
মধ্যরাতে আমার রুমে কি করছো তুমি? আমি জানি তুমি নির্লজ্জ কিন্তু এতোটা নির্লজ্জ সেটা ভাবতে পারিনি। তোমার সাহস হয় কি করে আমার অনুমতি ছাড়া আমার রুমে পা রাখার?”
কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে দিয়ে বলে কথাগুলো রিক্তা। রিক্তার চিৎকারে জায়েদা সুলতানা উঠে যায় ঘুম থেকে আর নিবিড়ও এক ছুটে চলে আসে, ভয়ে চুপসে যায় মায়া কেননা যদি সবাই বুঝে যায় মায়ার উদ্দেশ্য তবে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। সবার উপস্থিতি দেখে মায়া আমতা আমতা করে বলে “আসলে আমার এই বাবুটার প্রতি একটা অদ্ভুত টান অনুভব হচ্ছিলো তাই একটু কোলে নিতে আসছিলাম, আর সবার সামনে নিতে চাইলে তো রিক্তা আপু দিতো না তাই সবার ঘুমানোর পর আসছিলাম”।
মায়ার নরম কন্ঠ রিক্তার মনে সন্দেহের ঝড় তুলে দিলো। কিছুতেই স্থির হতে পারছেনা রিক্তা। গর্জে উঠে রিক্তা নিবিড় কে বলে মায়াকে নিয়ে এখনই এই রুম থেকে চলে যাওয়ার জন্য। এই ঘটনার পর থেকে বেশ সচেতন হয়ে যায় রিক্তা আর জায়েদা সুলতানা। এর মধ্যেই নিবিড় আর রিক্তার ডিভোর্স টা হয়ে যায় যদিও নিবিড় চাইনি ডিভোর্স দিতে। যেদিন রিক্তা আর নিবিড়ের ডিভোর্স হয় সেদিনই মায়া আর নিবিড়ের রিপোর্টগুলো আসে। নিবিড়ের রিপোর্ট নর্মাল আসলেও মায়ার রিপোর্ট দেখে থমকে যায় নিবিড়, অনিচ্ছাকৃত ভাবেই নিবিড়ের চোখ সমুদ্রে ঢেউগুলো খেলছে আপন মনে, এই বুঝি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে গড়িয়ে পরবে লোনা জল। নিবিড়ের নিরবতা দেখে মায়া ভয় পায় কিছুটা কারণ সত্যি টা মায়া আগে থেকেই জানতো যদিও নিবিড়কে তা কখনো বলেনি সে। মায়া কখনো মা হতে পারবেনা এটা যেনো মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েও বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে নিবিড়কে। কিসের আশায় কি হারালো বুঝতে আর বাকি রইলোনা নিবিড়ের। নিয়তি এভাবে ধ্বংস করবে তাকে তা কল্পনাও করেনি নিবিড় কখনো। নিবিড় এখন প্রায়ই পাগল পাগল হয়ে ঘুরে, কাজ কাম সব ছেড়েছে। মায়া জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
জায়েদা সুলতানা অনেক কষ্টে বুঝিয়েছে রিক্তাকে এই মেয়ের জন্য হলেও আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য নিজের নিয়তিকে। নিবিড়কে ভুলে শিশিরের সাথে পথ চলার জন্য, শিশিরকে আগামী বানানোর জন্য। নিবিড় অতীত আর অতীত কখনো সুখ বয়ে আনতে পারেনা জীবনে। রিক্তা ৩দিন সময় নিয়েছে ভাবার জন্য। অনেক ভেবে চিনতে মেয়ে রিহার জন্য রাজি হয়ে যায় অবশেষে রিক্তা। কয়েকদিনের মধ্যেই কয়েকজন মানুষ নিয়ে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী ঘরোয়াভাবে শিশির রিক্তার বিয়ে হয়ে যায়।
দুই মাসের মেয়েকে নিয়ে বাসর ঘরে বসে আছে রিক্তা। চটপট করছে পরাণ। অদ্ভুত সব অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে প্রাণে। মন যেনো বাঁধন হারা নৌকা ভেসে চলেছে ঢেউয়ের দোলায়।
খানিক বাদেই শান্তভাবে রুমে প্রবেশ করে শিশির। কিছুটা ক্ষেপে উঠে রিক্তা, রিক্তার অস্থির লাগছে, ঘেমে ঘেমে যাচ্ছে অথচ মাথার উপর পাখা চলছে পুরো দমে। রিক্তার অবস্থা বুঝতে পেরে শিশির বলে “রিলেক্স হয়ে বসতে পারেন আপনি, পরিবারের খুশির জন্যই বিয়েটা করতে হয়েছে আমাকে, আপনার মনের অবস্থাও বুঝতে পারছি আমি খুব করে কেননা আমার সাথে যা হয়েছে আপনার সাথে তার থেকেও কিছুটা বেশি হয়েছে।”
শিশিরের কথা শুনে রিক্তা অবাক হয়। রিহা ঘুমিয়ে গেলে ওকে সুন্দর করে শুয়ে দেয় ঠিক খাটের মাঝখানে তারপর শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলে “আমার আফসোস নেই যা হয়েছে তা নিয়ে কারণ হয়তো এটা আমাদের ধৈর্যের পরিক্ষা ছিলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আর সেই পরিক্ষায় আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি।”
“হুম ভুল কিছু বলেননি আপনি, ভাগ্যের পরিহাস হয়তো এর-ই নাম। যত ইচ্ছা সময় নিন, দিলাম আপনাকে আমি, আপনি যখন মন থেকে তৈরি হতে পারবেন তখন না হয় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এগুবো আমরা। ততদিন কি বন্ধু হয়ে থাকতে পারিনা??”
“অবশ্যই তবে বন্ধুত্ব করতে হলে আপনার আমাকে তুমি বলে সম্মোধন করতে হবে”
রিক্তার কথায় দুজনেই হেঁসে ফেলে কুটকুট করে।
________
রিহার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শিশিরের। রিক্তা ওয়াশরুমে। বিয়ের দেড়বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু এখনো মেয়ে সামলানো শিখতে পারেনি শিশির। কত কত খেলনা দিচ্ছে রিহার কান্না থামানোর জন্য কিন্তু কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেনা, শিশির বুঝতেই পারছেনা যে রিহার খিদে লেগেছে। রিহার কান্নার শব্দ পেয়ে তাড়াহুড়ো করে কোনোমতে শুধু শাড়ি গায়ে পেছিয়ে ওয়াশরুম থেকে ছুটে আসে রিক্তা। রিক্তা এসেই রিহার কান্না থামাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। মুগ্ধ হয়ে এক পানে পলকহীনভাবে চেয়ে আছে শিশিরের চোখজোড়া রিক্তার এলোমেলো চুলের দিকে কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই রিক্তার কারণ রিহার একটুখানি কান্নাও সহ্য করতে পারেনা রিক্তা। রিহার কান্না থেমে গেলে রিক্তার চোখ যায় শিশিরের দিকে। শিশির যেনো সপ্নে ভাসছে। মেয়ের কান্না থামানোর জন্য বিছানায় খেলনার দোকান বসিয়ে দিয়েছে শিশির সেখান থেকেই একটা ছোট্ট খেলনা গাড়ি ছুঁ’ড়ে মা’রে রিক্তা শিশিরের গায়ে, হাতের উপর গাড়ি গিয়ে পরতেই হুঁশে আসে শিশির। লজ্জায় কুটিকুটি হতে থাকে রিক্তা, মুচকি হাসে শিশির। রিক্তা শিশির ধীরে ধীরে স্বামী স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কে সামনে এগুচ্ছে খুব যতনে। যদিও দু’জনের-ই বক্ষ মাঝে অজানা চিনচিন ব্যাথা অনুভব হয়েছিলো শুরুতে।
এই দেড়বছরে চেঞ্জ হয়ে গেছে অনেক কিছু। নিবিড় প্রায়ই আসতো রিহাকে দেখার জন্য, রিক্তাও সবসময়ই রিহাকে পাঠাতো অন্য কাউকে দিয়ে নিবিড়ের কাছে কিন্তু নিজে কখনো ওর সামনে আসতোনা কারণ ওকে দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেনা হয়তো তাই।
কয়েকদিন আগে একদিন নিবিড় আসে রিহাকে দেখার জন্য। নিবিড় সবসময়ই একা আসতো কিন্তু সেদিন সাথে মায়াও আসে। দু’জনের-ই চোখের নিচে কালি পরে গেছে, শুকিয়ে হয়ে গেছে একেবারে কাঠ। শিশির রিহাকে এনে নিবিড়ের কোলে দিয়ে বলে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেনা সে কারণ নিবিড়ের সাথে আবর্জনা আছে আজ, কথাটি মায়াকে ইঙ্গিত করেই বলে শিশির, মায়ার বুকটা যেনো মুহুর্তেই ভাঙ্গচুর হয়ে যায়, ছলছল নয়নে চেয়ে থাকে শিশিরের দিকে। নিবিড় শিশিরের হাত ধরে একটা আবদার করে সে একটিবার রিক্তার সাথে দেখা করতে চাই, আবদার টা শুনেই শিশিরের মাথায় রগ চড়ে বসে। শিশির নিবিড়ের কোল থেকে ছুঁ মেরে রিহাকে নিয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শিশিরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে নিবিড় আর মায়া। নিবিড়ের চোখে সমুদ্রের ঢেউ খেলছে।
জায়েদা সুলতানা বেশ অসুস্থ হয়ে পরেছেন, বয়স হয়েছে কিনা। তবুও ছেলে আর ছেলের বউকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ান এখনো। মায়ার হাতে সংসার তুলে দিতে মোটেও রাজি হচ্ছেন না তিনি যদিও রিক্তা অনেক বুঝিয়েছিলো কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল। নিবিড় আর মায়া বাসায় আসতে আসতে দুপুর হয়ে আসে, ততক্ষণে জায়েদা সুলতানার সব রান্না শেষ তবুও মায়া শ্বাশুড়ির কাছে যেয়ে আবদার করে তার হাতে সমস্ত সংসার তুলে দেওয়ার জন্য। মায়া খুব নরম সুরে বলে “মা আপনার তো বয়স হয়েছে, এবার না হয় সংসারের সব কাজ সব দায়িত্ব আমার হাতে দিয়ে আপনি শেষ বয়সে একটু আরাম করুন”
মায়ার কথা টা শুনে কোনো প্রতিত্তোর না করে গট গট করে পা ফেলে ড্রয়িংরুমে এগিয়ে যান জায়েদা সুলতানা আর হাতে করে এক গ্লাস পানি নিয়ে যান ছেলের জন্য। মায়া যদিও এখন কোনো খারাপ কাজ করছেনা তবে লোভ এখনো আছে ওর। জায়েদা সুলতানার সমস্ত সম্পত্তি নিজের করে নিতে চাই মায়া কিন্তু জায়েদা সুলতানা সেই সুযোগ দিচ্ছেননা মায়াকে। কেননা কিছু করতে হলে আগে মায়াকে জায়েদা সুলতানার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে যেটাতে বারংবার ব্যার্থ হচ্ছে মায়া।
মায়ের হাতে একগ্লাস পানি পান করেই নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে যায় নিবিড়, কে জানতো এটাই হবে নিবিড়ের জীবনের শেষ নিদ্রা।
__________
শিশির আজ কাজে যায়নি বিকালে রিক্তা আর রিহাকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে যাবে বলে। দুপুরের খাবার খেয়েই সবাই নিজ নিজ রুমে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনই রিক্তার ফোনে কল আসে জায়েদা সুলতানার। কল রিসিভ করে নিবিড়ের মৃত্যুর খবর শুনে যেনো থমকে যায় রিক্তা। রিক্তার এমন অবস্থা দেখে থেমে যায় সবার পা, কেউ আর এগুচ্ছে না নিজের রুমের দিকে। শিশির জিজ্ঞেস করতেই বাচ্চাদের মতো কান্না জুড়ে দেয় রিক্তা। রিক্তার এমন বাচ্চাদের মতো কান্না দেখে শিশির বুকে জড়িয়ে নেয় রিক্তাকে তারপর শান্তভাবে জানতে চাই কি হয়েছে। জায়েদা সুলতানা কি বলেছে যে রিক্তা এমন রিয়েক্ট করছে তখন হ্যাঁচকি তুলে রিক্তা বলে আমার মায়ের আপন বলতে আর কেউ রইলো না, কিভাবে একা বাঁচবে আমার অসহায় মা টা? “এতটুকু বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে রিক্তা। তারপর লিজা স্পষ্ট ভাবে সব জানার জন্য জায়েদা সুলতানাকে কল দেয়, কয়েকবার রিং বাজতেই কল রিসিভ করেন তিনি কিন্তু কান্নার জন্য কিছুই স্পষ্টভাবে বলতে পারছেননা তিনি তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো জায়েদা সুলতানার বাসায় যাওয়ার। রিক্তাকেও নিয়ে গেলো কিন্তু রিক্তা একবারো নিবিড়ের মৃত লাশের দিকে একনজরও তাকালো না, রিক্তা শুধু জায়েদা সুলতানার পাশে চুপ হয়ে বসেছিলো। জায়েদা সুলতানাও রিক্ততাকে দেখার পর আর কান্না করলেননা কারণ রিক্তা উনার কান্নাজল সহ্য করতে পারেনা, জায়েদা সুলতানা একটু কান্না করলেও রিক্তা উনার থেকে বেশি কান্না করেন তাই।
রিক্তা অনেক করে বললেও রিক্তার সাথে ওর শ্বশুড়বাড়িতে যেতে জায়েদা সুলতানা রাজি হয়না কিছুতেই, উনি উনার স্বামীর ভিটায় থাকবেন এটাই উনার শেষ সিদ্ধান্ত বলে অটুট থাকেন।
__________
নিবিড়ের মৃত্যুর ১৫দিনের দিন রিক্তাকে আর শিশিরকে কল করে আসতে বলেন জায়েদা সুলতানা। ওরা আসলেই রিক্তার হাতে কিছু কাগজ দিয়ে বলেন “আমার যদি নিজের বলতে কেউ থাকে তবে সে তুই, তুই ছাড়া আমার আর নিজের বলতে কেউই নেই”
কাগজ গুলো খুলে রিক্তা হতবাক, রিক্তা কিছু বলতে চাইলে জায়েদা সুলতানা বলেন “যদি আমাকে নিজের মা মনে করিস তবে আর একটা কথাও বলিসনা এই সম্পর্কে। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় রিক্তা। জায়েদা সুলতানাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে দু’ফোটা চোখের জল ফেলে রিক্তা।। আর মনে মনে বলে “প্রথম প্রেমের উষ্ণতা কি ভুলা যায়? এই ঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায় আমার প্রথম প্রেমের উষ্ণতার ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে”
মায়াকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কারণ নিবিড় মারা যাওয়ার পর থেকে সে নিজের রুম থেকে এক পাও বের হয়নি। রিহাকে কোলে নিয়ে ভাবছে শিশির “মায়া তুমি নিজ হাতেই নিজের জীবনটা নষ্ট করেছো, এমনটা না করলেও পারতে। প্রথম প্রেমের উষ্ণতা হৃদয়ে গেঁথে থাকে কাঁটার মতো। আফসোস সঠিক সময়ে বুঝলেনা। তবুও আলহামদুলিল্লাহ ভীষণ ভালো আছি রিক্তাকে নিয়ে। রিক্তাই এখন আমার স্পন্দন। ”
“রিহার আব্বু” রিক্তার মধুর কন্ঠের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে শিশির। তারপর রিক্তার দিকে তাকিয়ে বলে “ভালোবাসি তোমায় অনেক বেশিই ভালোবাসি” হঠাৎ শিশিরের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে যতটা অবাক হয়েছে রিক্তা তারচেয়ে বেশি লজ্জায় কুটিকুটি হচ্ছে।।।
____________সমাপ্ত_____________