আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে #২য়_পর্ব

0
414

#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#২য়_পর্ব

পরীক্ষার কোনো বিষয়েই অন্না ভালো করে নি। ভালো তো দূরে থাক, সে ফেল করেছে। অন্নার মুখখানা মিয়ে গেলো। নতমস্তক এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক তখন ই দ্বিতীয় বারের মতো তার মাথায় বজ্রপাত হলো যখন রিতাদেবী বলে উঠলেন,
“এখন থেকে বাহিরে যাওয়া বন্ধ৷ সন্ধ্যে থেকে পড়তে বসবি। আর আজ সন্ধ্যে থেকে তোর টিউটর আসবে। আমি অর্জুনকে বলেছি, ও আজ থেকে তোমাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পড়াবে”

কথাটি শেষ করার পূর্বেই অন্না বিস্ময়মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“অর্জুন দা রাজী হয়েছে আমাকে পড়াতে? এতো অষ্টম আশ্চর্যজনক ঘটনা। পৃথিবীর পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা উচিত”

অন্নার কথায় চোখ গরম করলেন রিতাদেবী। সেই ক্রোধাগ্নি চাহনী নাপার মতো কাজ দিলো, অন্না চুপ করে দিলো। তারপর হিনহিনে কন্ঠে তিনি বললেন,
“হতে চায় নি। শুধু আমার আর তোমার দাদার মুখ চেয়ে পড়াবে। ছেলেটা নেহাত আমাদের সম্মান করে, নয়তো তোর মতো একটা লেজ কাঁটা বাঁ’দরকে কেউ পড়াতো না। মেয়ে যে বড় হচ্ছে খবর নেই, ধিঙ্গিপনা তার করতে হবে। বলি কোথায় ছিলে এতো সময়?”
“শামীম ভাই এর দোকানের সামনে কুলফি ওয়ালা এসেছিলো। সেটা খেতে!”
“কুলফি খেতে দুপুর?”

অন্না আর কিছু বলার সাহস করলো না। সকালের ঘটনা মার কানে গেলে পি”ঠের চা’ম’ড়া আস্তো থাকবে না। মায়ের রাগ বেশ ভালো করেই জানা। ওড়না দিয়ে র’ক্তা’ক্ত হাটুটি ঢেকে নিলো। রিতাদেবী কিছু বলার পূর্বেই অবন্তীকা দেবী বলে উঠলেন,
“অন্নপূর্ণা তুমি স্নান সেরে আসো। ভাত হয়ে গেছে। দুপুর গড়িয়েছে অথচ এখনো কেউ ভাত খায় নি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে না। যাও এখন ই যাও।”

বড়মার আস্কারা পেতেই অন্নাকে আর পায় কে! ছুটে চলে গেলো নিজের ঘরে। এদিকে রিতাদেবীর রাগ এখনো শান্ত হচ্ছে না। ধিঙ্গি মেয়েটাকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। অবন্তীকা দেবী তাকে শান্তস্বরে বলেন,
“রিতা, মেয়ে বড় হয়েছে। এতোটা শাসন ভালো নয়। ধুমধাম গা’য়ে হা’ত দিবে না। দেখায় কেমন? অন্না একটু চঞ্চল, বয়সের সাথে ঠিক হয়ে যাবে।”
“আর কবে ঠিক হবে দিদি? এখন মেয়ে ইন্টারে পড়ে, বয়স তো আঠারো হতে বেশি বাকি নেই। ওর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। তোমার তো দেবব্রত কোলে ছিলো।”
“আমাদের দিন আলাদা ছিলো। তখন কি মোবাইল, কম্পিউটার ছিলো বলো? বয়স হতেই বিয়ে দিয়ে দিতো। এখন জমানা আলাদা। কোথায় উনিশত নব্বই আর কোথায় দুহাজার বাইশ?”
” আরোও মাথায় তোলো। কোথায় একটু শাসন করবে! নাহ! মাথায় তুলে নাচো। এই তোমাদের আদরে মেয়েটা বাঁ’দ’র হচ্ছে। আমি আর কিছু বলবো না। যা পারো করো তোমরা”

রিতাদেবী হনহন করে ভেতরে চলে গেলেন। অবন্তীকার বুক চিরে বের হলো দীর্ঘশ্বাস। এবাড়ির লোকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দেবব্রত জন্মাবার ছয় বছর পর অন্নপূর্ণার জন্ম হয়। এর পূর্বে তিন প্রজন্মে কোনো মেয়ের জন্ম হয় নি। ফলে তিনকুলের এই প্রথম মেয়ে হবার খুশিতে আত্মহারা হয় মুখার্জি পরিবার। মেয়ের নাম দেয় অন্নপূর্ণা। মেয়ে যেনো দেবী লক্ষীর রুপে এই পরিবারে আগমণ ঘটিয়েছে। অন্নার জন্মের পর ব্যাবসায় বেশ ভালোই লাভ হয় নারায়ন বাবু এবং প্রদীপ বাবুর। তাই তো মেয়ের দুষ্টুমি গুলোও যেনো চিনির সিরায় ডোবানো মিছরি লাগে। আর এদিকে আদর পেতে পেতে অন্নাও ডানামেলে বিহঙ্গিনীর রুপ নিলো। মাথা ভর্তি গিজগিজ করতে লাগলো দুষ্টবুদ্ধি। ফলে রিতাদেবীর চিন্তা আরোও বাড়লো। অবন্তীকা দেবী জানেন, অন্না চঞ্চল কিন্তু অভ’দ্র নয়। সে জানে তার দায়রা। তাই তিনি ঢাল রুপে দাঁড়ান। যতই হোক, মেয়েটি যে সকলের আদরের। প্রদীপ বাবুর দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বললেন,
“যাও, দেখো রিতার রাগ পড়লো কি না!ওর মান ভাঙ্গিয়ে খাবার টেবিলে আসো”

প্রদীপ বাবু মাথা নাড়লেন। এখন মুখ্যম কাজ স্ত্রীর রাগের দমন_____

******

সূর্যের অন্তিম কিরণ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে ধরণীর বুকে নামলো নিগূঢ় আঁধার। শঙ্খের ধ্বনি কানে আসছে। পর্দার ফাঁকে তমসায় ঘেরা পাঁড়াটিকে একনজর দেখলো অন্না। কালো আকাশের নিচে ছোট ছোট একতালা, দোতালা বাড়ি, টিনের ঘর। তাতে জ্বলছে সাদা আলো, কিছু আবার অন্ধকার। চোখের সম্মুখের হিসাববিজ্ঞানের বই গড়াগড়ি করছে অথচ তার সেদিকে নজর নেই। তার উন্মুক্তমনা হৃদয় তো প্রকৃতিকে দেখছে। এমন সময় দরজায় আঘাত পড়লো। তার সাথে সাথেই রিতাদেবীর রাশভারী কন্ঠ,
“অন্না, অর্জুন এসেছে”

কথাটি শুনতেই অন্না মুখ বাঁকালো। লোকটির এখন ই আসা লাগলো! মিনিট দুয়েকের মধ্যে হনহন করে ঘরে প্রবেশ করলেন মাস্টারমশাই। চেয়ার টেনে বসলো। অন্না আড়চোখে তাকালো তার দিকে। পরণে গেরুয়া রঙ্গের পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীটা কড়কড়া। এখন ই যেনো ইস্ত্রী করে আনা। হাতাগুলো কনুই অবধি তোলা। হাতের বড় বড় লোম দেখা যাচ্ছে। নাকের একটু উপরে তার কালো ফ্রেমের চশমা। কপালে আসা চুলগুলো বা হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো সে। যা দেখে শুকনো ঢোক গিললো অন্না। এই হাসির অর্থ “এক মাঘে শীত যায় না”— এবার আর বুঝতে বাকি রইলো না, পড়ুয়া অর্জুন দা কেনো সেধে সেধে তাকে পড়াতে এসেছে। হাজার ডলার একদম সুদে আসলে উঠিয়ে নিবে সে। অর্জুন হাতাটা ঠিক করতে করতে বললো,
“পরীক্ষার খাতা কোথায়? শুনলাম হিসাববিজ্ঞানে নাকি নয় পেয়েছেন। তা বলি! এই নয় দিয়ে ডলারের হিসাব দিস আমাকে? বল এক ডলার কত টাকা?”

অন্না জানে না এক ডলার কত টাকা! থাকে বাংলাদেশে, ডলার কত তা জেনে কি হবে। তাই চুপ করে রইলো সে। অর্জুনের হাসি প্রসারিত হলো। এবার বাগে পেয়েছে সে অন্নাকে। আর ছাড় হবে না। অন্নাকে চুপ থাকতে দেখে বললো,
“খাতা দিতে বললাম তো”

অন্না খাতা এগিয়ে দিলো। অর্জুন বিজ্ঞের মতো চোখ বুলালো খাতায়। মেয়েটি পারে না কথাটি ভুল। সে পারে কিন্তু সব খানে অহেতুক ভুলভ্রান্তি। প্রতিটা স্থানে যোগ বিয়োগে ভুল। যেখানে ৩০০ বিয়োগ করতে বলা হয়েছে সে ২০০ বিয়োগ করে রেখে এসেছে। ফলে সব মিলিয়ে তার মার্ক এসেছে নয়। অর্জুন গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, তারপর বললো,
“তুই কি পরীক্ষার সময় চোখ খুলে ঘুমাস? সব জায়গায় এতো এতো ভুল কেনো? সামান্য দেখে তুলবি তাও হলো না?”
“আসলে প্রশ্ন পাবার পর খুশি হয়ে গেছিলাম। ভেবেছি সব পারা অংক এসেছে। আমিও চোখ বুজে করতে বসেছি। কে জানতো স্যার যে ভেতরে ভেতরে সংখ্যা বদলে দিবে?”

অর্জুন কিছুসময় অন্নার দিকে তাকিয়ে রইলো। বেছে বেছে একটা ছাত্রী জুটেছে। নেহাত দেবব্রত তার বন্ধু নয়তো এই মেয়েকে পড়ানোর প্রশ্নই উঠে না। এর মাঝেই রিতাদেবী মিষ্টি নিয়ে এলেন। অর্জুনকে খেতে দিয়ে বললেন,
“একটু দেখিয়ে দাও বাবা, একটা বিষয়েও পাশ করে নি। এভাবে হলে আর ইন্টার পাশ দিতে হবে না। ভেবেছিলাম মেয়েটা আমার শান্তশিষ্ট হবে! আফসোস”

অর্জুন তখন বিড়বিড়িয়ে বললো,
“হ্যা, শান্তশিষ্ট, লেজবিশিষ্ট”

অন্না সাথে সাথেই বলে উঠলো,
“কিছু বললে অর্জুন দা?”

অন্নার কথায় রাম ধমক এলো,
“অর্জুন দা কি রে, স্যার বল”

অন্না মাথা কাত করে সম্মতি দিলো। অর্জুন তখন বললো,
“দেখুন কাকীমা, আমি খারাপ ছাত্রী পড়াই না। আর অন্না শুধু খারাপ ছাত্রী ই নয়, ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দেখছেন ই তো ইংলিশ আর বাংলা বাদে কিছুতেই সে পাশের মুখ দেখে নি। অবশ্য হবেই বা কিভাবে অন্যের বাড়ি চু’রি করতে গেলে তো দেবীর কৃপা হয় না। তাই বলি আমি ওকে আপনার মুখ দেখে পড়াবো কিন্তু আপনার ওকে চোখে চোখে রাখতে হবে”

চু’রির কথাটা শুনতেই অন্নার মুখ রক্তশূন্য হলো। আড়চোখে তাকালো রিতাদেবীর দিকে। বুঝলো আজ আর রাতে ভাত জুটবে না। এদিকে অন্নার মিয়ে যাওয়া মুখখানা দেখে অর্জুনের ঠোঁটে ফুটে উঠলো দুষ্টু হাসি। মনে মনে বললো,
“বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,
এবার ঘুঘু তোমার ব”ধিব পরাণ”

******

কলেজে মুখ লম্বা করে বসে রয়েছে অন্না। একেই অর্জুন দায়ের অত্যাচার, উপরে মাও পেয়েছে হাজারে একটা। বাড়ি থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে অন্নার মনে হয়, এটা কি আমার ই মা? এদিকে মীরজাফরের দলের মুখে মুখে এক কথা “অর্জুনদা অন্নাকে পড়ায়, এবার অন্নাকে ঠেকায় কে?” তাই তো তামিমা ঠেস মেরে বলেই দিলো,
“অর্জুনদা তোকে পড়াতে রাজী হলো কিভাবে এটাই বুঝে পাচ্ছি না। সে তো আমাদের দেখলেই অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করে! কাহিনী কি বল তো”

তামিমার কথায় চোখ কুচকে তাকালো অন্না। বিরক্তি মুখশ্রী থেকে চুয়ে চুয়ে পড়ছে। বার তিরিশেক তাদের বলেছে কিন্তু তাদের বিশ্বাস হয় না। একেই অশান্তিতে প্রাণ যায়, উপরে বান্ধবী তো নয় যেনো আস্তো শত্রু। অন্নাও কম যায় না। সেও বেশ ভাব দেখিয়ে বললো,
“আসলে আমার বলতে লজ্জা হচ্ছে, কি করে বলি বল”
“আরে বল ই না, এতো ভাও খাচ্ছিস কেন?”

এবার খানিকটা লজ্জামাখা কন্ঠে বললো,
“আসলে অর্জুন দা আমাকে ভালোবাসে। একটু ব’লদ টাইপ তো তাই লজ্জা পায়। এতোদিন লজ্জার জন্যই আমার দিকে তাকাতো না। তাই তো যেই মা আমার পড়ানোর কথা বললো, ওমনি রাজী হয়ে গেলো। প্রেয়সীকে পড়ানোর সুযোগ কি কেউ হারায়?”

অন্নার কথা মীরজাফরের দলে বি’স্ফো’রকের মতো কাজ করলো। সকলের মুখ হা, কারোর মুখে কথা নেই। তারা যেনো হজম ই করতে পারছে না অন্নার কথা। এদিকে অন্না মনে মনে হাসলো, বান্ধবীদের এরুপ বিস্ফারিত মুখগুলো বাধাই করে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সে তো জানে না, তার জন্য কি অপেক্ষা করছে!

*****

কথা আগুনের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়। ছড়াবার আগে তার হাজারো শাখা প্রশাখা মেলে, সেই শাখা প্রশাখায় থাকে নিজেদের সাজানো মতবাদ। “অর্জুন অন্নাকে ভালোবাসে” কথাটাও আগুনের মতো ছড়ালো। দুদিনের মধ্যে পুরো পাড়ার যুবসমাজ তা জেনে গেলো। দিনটি ছিলো সোমবার। গোধলীলগ্ন, সূর্যের তেজ কম। কলেজ থেকে হেটে ফিরছিলো অন্না। ঠিক সেই মূহুর্তে অর্জুন তার রাস্তা আটকালো। অর্জুনের চোখ লাল, মুখশ্রী শক্ত। হুট করে রাস্তা আটকাতেই অন্না চমকে উঠলো। অন্নার বিস্মিত, ভীত মুখ উপেক্ষা করেই অর্জুন প্রশ্ন ছুড়লো,
“তুই আমার প্রেমিকা?”

প্রশ্নটি মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। মিনিট খানেক সময় লাগলো বিষয় বুঝতে। যখন ধাতস্থ হলো ব্যাপারখানা ঠিক কি এবং কি ঘটতে যাচ্ছে অমনি অন্না উলটো দৌড় দিলো। ভেবেছিলো এই যাত্রায় রক্ষে কিন্তু তখন ই অর্জুনের মোটা পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো,
“এই অন্না শোন, দাঁড়া বলছি। অন্নার বাচ্চা দাঁড়া”

পেছনে তাকাতেই ছোটার গতি বাড়ালো অন্না, কারণ অর্জুনদাও তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে আর চেচাচ্ছে…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here