বিষ_করেছি_পান(৩০)

0
442

#বিষ_করেছি_পান(৩০)

(কপি করা নিষেধ)
— ওখানে কি করছিস? এদিকে আয়।
বাঁধনের ডাক পেতেই ছুটি একতলা থেকে লাফ দিলো। বাঁধন চমকে গিয়ে এই এই করতে করতেই ছুটি বাঁধনের সামনে মাটিতে খাড়া হয়ে পড়লো। বাঁধন থমকালো। কোমড়ে হাত রাখলো। শাসনের স্বরে বললো,
— বড় হচ্ছিস না? এতো গেঠোপানা কিসের?
— আমি কি গ্ৰামের মেয়ে? মোটেই নয়। এটাকে বলে প্রতিভা। এই প্রতিভা কজনের মধ্যে আছে? মূল্যায়ন করতে শিখুন।
— আমার কাছে মূল্য তখনি পাবি যখন দেখবো তোর আর ঝিমার খাতার নম্বর পাশাপাশি।
— খাতার নম্বর পাশাপাশি হোক বা না হোক বাড়িতো পাশাপাশি ।
— মুখে মুখে চাপা? অংকে ডাব্বা মারিস! শোন সন্ধ্যা করে আমার কাছে দেখিয়ে নিবি যা না পারিস।
— মান সম্মান আর থাকবেনা।
— কেনো?
— অংক স্যারের মেয়ে হয়ে আপনার কাছে পড়তে গেলে এই মুখ কাকে দেখাবো?
— ঢেকে রাখবি। এমনিতেই দিন দিন চেহারা ফুটে উঠছে আশেপাশের কু নজর লাগতে শুরু করেছে। রিতীর মতো রোরখা পড়বি। আমার কথা শুনে চলবি।
— আচ্ছা।

সন্ধ্যায় ছুটি পড়তে যায় বাঁধনের কাছে। বাঁধন ছুটিকে দেখেই চোখ উপরে তুলে ফেলে। ছুটি রিতীর ঢোলাঢালা বোরখা পড়ে আসছে। কালো বোরখায় ছুটিকে মাজারের রক্ষাকারী মনে হচ্ছে। বাঁধন একটু চেঁচিয়ে উঠে,
— এটা কি পরেছিস? সন্ধ্যা বেলায় বাসার ভিতরে তোকে এই ডিলেডালা আলখাল্লা পড়তে কে বলেছে? খুল এটা।
ছুটি বই সেন্টার টেবিলে রেখে সোফায় ধপ করে বসলো। মুখ দিয়ে ফু করে বাঁধনের দিকে তাকালো।
— উফফ! বারবার খুলা আবার পরা ভালোলাগেনা। একেবারে বাড়িতে গিয়েই খুলবো। রাস্তায় দেখলাম কয়েকটা লোক অনবরত যাতায়াত করছে। ওদের সামনে বোরখা ছাড়া যাই কি করে!
বাধন আর কি বলবে ভেবে পায়না।ঝিমা এসে রুমে ঢুকলো বই নিয়ে। ছুটির বোরখা দেখেই হাসতে হাসতে টানাটানি শুরু করে দিলো। ছুটি চেঁচিয়ে উঠলো।
— এই ছাড় ছাড়। এই বোরখা আপুর। কিছু হলে আমাকে খবর করে ছাড়বে।
ঝিমা জেদ করে বললো,
— আমাকে ছাড়া তুই বোরখা পড়া শুরু করেছিস। এতো বড় সাহস! তোকে আপুর হাতের মার খাইয়েই ছাড়বো।
ছুটি সোফার উপর উঠে গেলো। ঝিমা ছুটিকে নিয়ে পড়লো। বাঁধন ধমক দিচ্ছে। ওদের কানে গেলো না। দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটি বোরখায় পা বেজে দরজার চৌকাঠে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। বাঁধন ঝিমা একসাথে চিৎকার করে উঠলো। ছুটি তেমন ব্যাথা পেলো না। কিন্তু ওদের চিৎকার শুনেই ভয়ে সিটিয়ে উঠলো। ঝিমা দৌড়ে এসে ছুটিকে ধরলো। বাঁধন বাহু তুলে ছুটিকে ভেতরে নিয়ে গেলো। নাক বেয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে দেখে বাঁধন প্রচন্ড রেগে গেলো। রাগের বসে ঝিমার গালে সপাটে চড় বসালো।
— থামতে বলেছি কখন কানে যায়নি? একটা এক্সিডেন্ট ঘটিয়েই তোকে থামতে হলো। এই ছুটি বোরখা খুল। এক্ষুনি তোর এই আলখাল্লা খুলবি।
ঝিমা গালে হাত দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। শক্ত হাতের চড়! যখনি খায় তখনি মনে হয় গালের উপর দিয়ে ট্রলার মেশিন গৌড় দিলো। ফ্লোরের উপর থেকে পা তুলে আবার পা ফেলে ঘ্যান ঘ্যান করে
— সবসময় তুমি ওর জন্য আমাক মারো বলে নাকে কান্না করতে করতে চলে গেলো।
ছুটি ঝিমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাঁধন এসে একটানে বোরখা খুলে ফেললো। আঙুলে শাসালো,
— আর কোনদিন বোরখা পড়বিনা ঠিক আছে?
ছুটি মাথা দুলালো। বাঁধন কটন দিয়ে ছুটির নাক পরিষ্কার করে দিলো। গালে হাত রেখে বললো,
— আরো কোথাও ব্যথা পেয়েছিস?
— উহু।
নিচ থেকে বীনা চেঁচাতে চেঁচাতে রুমে ঢুকলো। ছুটিকে ধরে বললো,
— ব্যথা নাকি পেয়েছিস? দৌড়াদৌড়ি না করলে তোদের এর চলেনা না? আয় আয়তো দেখি। ইসরে নাকটা লাল করে ফেলেছিস। ব্যথা লাগছে না এখন?
— না।
ছুটির সোজাসাপটা উত্তর। এতোবড় একটা ব্যথা পেলো অথচ বলে ব্যথা লাগছে না! একফোঁটা চোখের জল ও পড়তে দেখা গেলো না। ঝিমা হলে এতোক্ষনে বিছানা ভিজিয়ে ফেলতো। বাঁধন ধীরে ধীরে সগোক্তি করলো,
— এই মেয়েটা এতো স্ট্রং কেনো?

বাঁধন একটা আমেরিকান কোম্পানিতে সিলেক্ট হয়েছে। ভালো স্যালারী। বাবার কথা আর কয়দিন পর স্টার্ট করলে হতোনা? বাধন আপত্তি জানায়। এতো ভালো চাকরী ছাড়াটা ঠিক হবেনা। সুযোগ সব সময় আসেনা। তাছাড়া আজকালকার বাজারে চাকরী পাওয়া এতোটা সহজ না। এপোয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পাবার পর বাঁধন জয়েন করে। দশটা টু পাঁচটা ওয়ার্ক টাইম। একটু দূরে হয়ে যাওয়ায় লাঞ্চ টাইমে আর ঝিমাকে ড্রপ করতে পারেনা। তবে যাবার সময় ড্রপ করে দেয়। আগে রিতীর সাথে স্কুলে গেলেও এখন ছুটির একা যেতে হয়। সেজন্য বাঁধন বাইকে এগিয়ে বসে ঝিমাকে বলে দু পা দুদিক দিয়ে বসতে যাতে ছুটির ও জায়গা হয়। ছুটিকে ডেকে ছুটির রিকশা ছুটিয়ে দেয়। ঝিমার মতো করে পেছনে বসতে বলে। ছুটি কি যেনো ভেবে চটপট উঠে বসে। প্রতিদিন সকালে স্কুলে ছেড়ে দেবার সময় অফিসে যাওয়ার আগে দুজনের হাতেই টিফিনের টাকা গুঁজে দিয়ে যায়। ছুটি ঝিমা খুশি মনে নিয়ে নেয়। একেতো বাবা মা দেয় তার উপর বাঁধনের থেকেও পায়। টাকা জমিয়ে জমিয়ে ছুটি ঝিমা এক্সটা ক্লাসের কথা বলে সিনেমা দেখে আসে। একদিন সিনেমা হলে গিয়ে টিকিট পায়না। দুজনের ই মন খারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে এক্সটা ক্লাসের কথা বলেছে এখন এই সময়টুকু কি করবে? ভাবতে ভাবতেই হল থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু পছন্দমতো কোন উপায় পায়না। যেটাতে তারা তুষ্ট হবে। গেইটে আসতেই মুখোমুখি হয় সোহাগের। ছুটি সোহাগকে দেখে লম্বা একটা হাসি টানে। ঝিমার হাত ধরে দৌড়ে যায় সোহাগের কাছে।
— দুলাভাই?
ডাকতেই সোহাগ ফিরে তাকায়। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
— এখানে কি? স্কুল নাই?
— শেষ করেই আসছি। টিকিট পেলাম না। কত রিকুয়েস্ট করলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো তাও দিলোনা।
— কে দিলোনা? দেখি আসতো।
ছুটি সোহাগের পিছু পিছু যায়। সোহাগ টিকিট কাউন্টারে গিয়ে বলে,
— এইযে মামা। দেখছো দুজন! আমার শালিকা। যখনি আসবে সিটে বসিয়ে দিবে। খবরদার টাকা নেবে না।
— আচ্ছা মামা। চেনা থাকলো।
— হুম।
সোহাগ ওদের নিয়ে সোজা হলে ঢুকে গেলো। ছুটি ঝিমা তো খুশিতে গদগদ করছে। এবার থেকে আর টিকেট কাটতে হবেনা। ফ্রিতে মুভি দেখা যাবে। সোহাগ সামনে সিরিয়ালে গিয়ে তিনজনকে উঠিয়ে দিলো। ইশারায় ছুটি ঝিমাকে বসতে বললেই দুজনে হুরমুর করে গিয়ে বসলো। সোহাগ বেরিয়ে গেলো। ফিরলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। দুজনের হাতে পপকর্ণ আর চিপস ধরিয়ে দিলো। ঝিমা ধন্যবাদ জানালো। সোহাগ ও ছুটির পাশে বসে পড়লো। ছুটি মুভি ইনজয় করছে। শাকিব বুবলির মুভি।
— আমার পিরিতীর খবর কি ?
সোহাগের প্রশ্নে ছুটি লাস্ট চিপসটা শেষ করলো। হাতে বারি দিয়ে সোহাগের দিকে চেপে বসলো।
— আপু এখন এডমিশন টেস্ট নিয়ে খুবই ব্যস্ত। বাবা বলেছে আপু যদি ঢাবিতে চান্স পায় তাহলে স্কলারশিপের আবেদন করতে অনুমতি দিবে। নয়তো আপুর সপ্নপূরণ বাংলাদেশেই অফ।
সোহাগ একটু নড়ে চড়ে বসলো। তার পিরিতি এতোদূর ভেবে রেখেছে! একটু অবাক ই হলো। এতো টেলেন্টেট জন্য ই তো সোহাগকে ট্রাপে ফেললো। মাথায় ঘিলুতে ভরপুর আর ভাবখানা দেখায় হাবাগোবা। সোহাগ বুঝতে পারছে কোন লেজে পা দিয়েছে। অন্য কেউ হলে ফিউচার বালিশ ভিজিয়ে এতোদিনে ধূয়ে যেতো। ঘরবন্দি থাকতো। আর তার পিরিতি জীবনের এতোবড় একটা কান্ড ঘটিয়ে তরতর করে গাছ বেয়ে চলছে। ধীরে ধীরে সগোক্তি করলো,
— এই মেয়েটা এতো স্ট্রং কেনো? ছুটিকে বললো,
— আমার কথা কিছু বলে?
— হ্যা। একটু একটু করে আপনার বুদ্ধি খুলছে বলেছে।
— কিরকম?
— আমি জানিনা। আপনি জেনে নিয়েন।
— তোমার আপু চান্স পেলে আমার তরফ থেকে গিফট আছে। গিফটা এক্সেপ্ট করানোর জন্য তোমার হেল্প লাগবে।
— কি গিফট?
— এইসব ছোটোখাটো সিনেমা হল ছেড়ে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সের টিকিট পাবে।যদি তোমার আপুকে নিয়ে আসতে পারো।
— সত্যি? আলবাদ পারবো। ওটাতো আপুর গিফট। আমার জন্য?
— আনলিমিটেড খাওয়া দাওয়া।
— তাহলে ঠিক আছে।

সন্ধ্যায় বাঁধনের কাছে পড়তে গেলে বাঁধন প্রশ্ন করে,
— তোদের কয়েকদিন পর পর এক্সটা ক্লাস কোন টিচার নেয়?
এইতো হয়ে গেলো! ঝিমা ছুটি একসাথে ঢুক গিলে দুজনের দিক তাকালো। ইশারা করলো
— এবার কি বলবে?
কোন স্যারের কথা বলবে? যদি গিয়ে ঐ স্যারের সাথে কথা বলে? তখন?
বাঁধন আবার জিজ্ঞেস করলে দুজনেই বাঁধনের কথা না শোনার ভান ধরে মন দিয়ে অংক করতে থাকে। যেনো কতো ভালো অংক পাড়ে! ছুটি পারছেনা ঝিমারটা আড়চোখে দেখে দেখেই খাতা ভরিয়ে তুলছে। ওদের ভাব সাব দেখে বাঁধন শক্ত গলায় বলে,
— সিনেমা হল আমার মতে কোনো খারাপ জায়গা নয় যে লুকিয়ে চুরিয়ে মিথ্যা বলে যেতে হবে। তবে এইটুকু বয়সে যদি অন্যকাউকে এড করো তাহলে সেটা অবশ্যই খারাপ কাজ। মনে করো না যে সারাদিন থাকিনা জন্য তোমাদের পথিবাক্য আমার জানা থাকবেনা। মা বাবা ঘাস খেয়ে চললেও ভাই ঘাস খেয়ে চলে না। ঐ সিনেমা হলে আমার পরিচিত অনেকের যাতায়াত আছে। কারো জন্য আমি মাথা নিচু করবোনা।মনে থাকবে?
ছুটি ঝিমা আমতা আমতা করতে থাকে। তার মানে বাঁধন ভাই সব জানে? বাঁধন খাতাটা ঝিমার সামনে থেকে হাতে তুলে নেয়। মিনিট খানেক চোখ বুলিয়ে বলে,
— লেখাপড়া ঠিক রেখে খারাপ কাজ ব্যতিত যা ইচ্ছা তাই করতে পারো। আমার তরফ থেকে কোন বাঁধা পাবেনা। তবে লেখাপড়াটা ঠিক রেখেই অন্যপথে এগোতে হবে নয়তো আমি মেনে নিবোনা।
ছুটি মাথা নাড়ে। বাঁধন ছুটির দিকে একচোখে তাকিয়ে বলে,
— সিনেমা হলে না গেলেই খুশি হবো।
ছুটি চটপট বলে ,
— যাবোনা।
— কেনো যাবিনা?
— আপনি বলেছেন তাই।
— আমি যা বলবো তাই করবি?
— হ্যা।
— বিনিময়ে কি চাই?
— সুমি আপুকে ডিভোর্স দেওয়া যাবেনা।
— এখানে সুমি কোথা থেকে আসছে?
— আমার মাথা থেকে। সুমি আপুর কথা সব সময় মাথায় ঘুরে। অসহায় একটা মানুষ। এই অবস্থায় তো ডিভোর্সের কথা মুখ থেকেও বের করা উচিত হবেনা।
— তুই কেনো আমাকে সাপোর্ট করিস?
— যেটা ভালো সেটা আমি সবসময় সাপোর্ট করি। তাই ঝিমা?
ঝিমাও সাথে সাথে মাথা নাড়ায়। সে সহমত। সেদিনের ছুটির কথা গুলো ঠিকঠাক তার মাথায় গেঁথে গেছে। অনেক চিন্তা করে দেখলো ছুটিই ঠিক বলেছে। তাই সে ছুটিকে সাপোর্ট করলো। বাঁধন অবাক হয়ে গেলো। যে বোন এতো দিন তার বিরোধিতা করলো সে আজ তাকে সাপোর্ট করছে। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? ছুটি কি ঝিমাকে বুঝাতে সক্ষম হলো?

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here