যখন_দুজনে_একা ৩০ পর্ব

0
697

#যখন_দুজনে_একা

৩০ পর্ব

মাহি রুবার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে । ওর হাতের স্পর্শে রুবার ঘুম ভেঙ্গে গেল !
চোখ মেলে দেখে মাহি বসে আছে সামনে ! ওর চোখ ছলছল করছে ! কি ব্যাপার কিছু হয়েছে ? তোমার চোখে পানি কেন ?
মাহি হাসলো শুধু!
কখন এলে তুমি ? আমি ঘুমাচ্ছিলাম টের ই পাই নি কখন সন্ধ্যা হলো!
রুবা উঠে বেডে হেলান দিয়ে বসলো !
মাহি একদম ওর গা ঘেঁষে পেছনে বসল!
হঠাৎ পেছন থেকে রুবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, থেঙ্কস রুবা ! তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা র শেষ নেই! রুবার গালে নিজের গালটা ছুঁয়ে বলল, তুমি সত্যি অসাধারণ রুবা!
রুবার খুব লজ্জা লাগছে ! আমি কি করলাম ? আজ এত মাস পর বাবা আবার আগের মত নিজের জীবন টা খুঁজে নিচ্ছে আমরা আমাদের বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি! সব তোমার জন্য সম্ভব হলো!

আমি কিছুই তো করিনি ! বাবা কি আমার কেউ না ? তুমি এভাবে বললে আমার খারাপ লাগবে!
দরজায় টোকা দিল কেউ?
মাহি বলল, কে ?
আমি ভাইজান!
বুয়া প্লিজ পরে আসো !
রুবা বলল, দরকারে আসছে মনে হয়!
না প্লিজ রুবা তুমি উঠে যেও না এভাবে বসে থাকো ।মাহি শক্ত করে ধরে রাখলো পেছন থেকে রুবাকে!
রুবা টের পাচ্ছে মাহির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ওর গাল ভিজে যাচ্ছে!
রুবা বলল তুমি এদিকে আসো প্লিজ বলে মাহিকে সামনে আনলো রুবা। মাহি রুবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো!
রুবা মাহির চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে ! কি ব্যাপার তুমি এভাবে কাঁদছো কেন ?
আজ সারাদিন এত ব্যস্ত ছিলাম লাঞ্চ করার ও সময় পাইনি! তোমাকে কোন মেসেজ কোন ফোন ও দিতে পারিনি! বাসায় ফিরছিলাম আর চিন্তা করছিলাম আগে এরকম ব্যস্ত দিন শেষে বাসায় ফিরে দুই ভাই গল্প করতাম, তখন টায়ার্ডনেস কেটে যেত! রাতে সবাই একসঙ্গে ডিনার করার সময় পুরো দিনের সব কষ্ট শেষ হয়ে যেত! এখন বাসায় ঠিকই ফিরি কিন্তু শুধুই নিজের ঘরে ফেরা হয় , ভাইয়াও নেই বাবাও নেই ডাইনিং টেবিলে ! মা আমি আর শুধু তুমি আমাদের বাড়ি টা কেমন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন! ভাইয়া কে তো ফিরিয়ে আনতে পারবো না কিন্তু বাবা আবার আগের মত ফিরে আসছে রুবা ! আর বাবাকে তুমি ফিরিয়ে আনলে! বহুদিন পর বাবাকে আগের মত দেখব ! কত অপেক্ষা করেছি রুবা জানো!
জানি আমি ! রুবার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে!
মাহি বলল, থেঙ্কস রুবা !
রুবা মাহির চোখ মুছে দিল আবার!
আজ শিহাবের আত্মাও শান্তি পাবে দেখো!
হুঁ।
মাহি রুবার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে! অনেক দিন পর কাঁদছে দুজন । আজ আর একা লাগছে না তাদের !
দরজায় আবার নক করার শব্দ!
মাহি বলল, থাকি না এভাবে প্লিজ ।
বারবার আসছে নিশ্চয়ই মা পাঠিয়েছে ওঠো ।
শুনি কি বলে ?
না রুবা শোনার দরকার নেই!
ওঠো মাহি ! তোমার তো বাবার সঙ্গে নিচে যাওয়া উচিত । আজ বাবার সঙ্গে তার ছেলে র থাকা উচিত না ?
তাই তো ঠিক বলেছো!
মাহি উঠে বসলো! রুবা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল !
লাইলি বুয়া দাঁড়িয়ে !
রুবাকে বলল, নিচে অনেক মেহমান আসছে আম্মা আপনারে ডাকে!
বাবা কি নিচে গেছে !
না এখনো যায় নাই তয় যাইব ।
আমি আসছি যাও !
মাহি ফ্রেশ হ‌ওয়ার জন্য ওয়াস রুমে ঢুকে গেছে।
ঝটপট রেডি হয়ে গেল মাহি!
রুবা বলল, দুই মিনিট দাড়াও আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে আসছি!

দুজনে রেডি হয়ে ডাইনিং এর কাছে এসে দাঁড়ালো যখন, আজগর সাহেব আর সাফিয়া বেগম নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে আসলেন!
মাহি ‌এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল ।
রুবার ও শ্বশুরের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, থেঙ্কস বাবা।
তিনি রুবার মাথায় হাত রেখে আদর করলেন।
তারপর মাহি আর আজগর সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন।
রুবা এসে শ্বাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরলো !
সাফিয়া বেগম বললেন, রুবা থেঙ্কস মা তুমি পারলে যা আমরা কেউ পারিনি।ঐ অবস্থা থেকে কখনো তোমার শ্বশুর বের হবে ভাবিনি আমি রুবা! মায়ের চোখের পানি মুছে দিল রুবা!
মা আমি কিছুই করিনি যার জন্য এতদিন বাবা কষ্ট পাচ্ছিল ,সে ই বাবাকে ঠিক করে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
আপনার বড় ছেলে শিহাব! ওর কথা বলেছি বাবাকে । আপনি আমাকে যেভাবে অন্ধকার থেকে বের করে এনেছিলেন সেভাবেই বাবাকে বের করে আনলাম মা !
সাফিয়া বেগম রুবার চোখে র পানি মুছিয়ে দিল।

মাহি বাবার সঙ্গে তার স্টাডি রুমে ঢুকলো ! একটা সময় শিহাব পড়াশোনা শেষ করে যখন দেশে ফিরে এসেছিল তখন বাবা আর ছেলে একসঙ্গে মোটামুটি সব জায়গায় যেত।
মাহির আজ খুব ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে। বাবাও হয়তো ভাইয়াকে এই ঘরের সব জায়গায় খুঁজবে!
তার বাবার ফার্মের সব জুনিয়র, সিনিয়র ল’ইয়ার রা আসছে । এত দিন তারা বাবার কোন গাইডলাইন পায়নি। এখন থেকে বাবা আবার ওদের বস হয়ে সব ডাইরেকশন দিবে!
সবাই বাবাকে সাদরে গ্রহণ করলো।
খবর পেয়ে বাবার কিছু বন্ধু ও এসেছে। বাবা সবার সঙ্গে গল্প করছে মাহি আশেপাশে থেকে শুধু দেখছে বাবা কে।
মোবাইল বের করে সে রুবা কে থেঙ্কস লিখে ইনবক্স করলো!
রুবা লাভ ইমোজি পাঠালো।
বাবার পিয়ন আর কুদরত ভাই সবার জন্য চা নাস্তা নিয়ে ঢুকলো।
মাহি বের হয়ে এল রুম থেকে বাবা এখন নিজের মত সব হ্যান্ডেল করে নিবে!
মাহি নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো!
গাড়ি দেখেই বুঝলো মাহি উপরে ওর ছোট চাচা চাচী এসে গেছে ! মা অলরেডি খবর দিয়ে দিয়েছে সবাই কে। হাসলো মাহি।
আজ মনে হচ্ছে এই বাড়িটা আবার আগের মত উৎসব মুখর হবে ।

ওর সামনেই নিঝুমদের গাড়ি টা, তার পিছনে ছোট মামিদের গাড়ি টা এসে থামলো। সিগারেট ফেলে দিল মাহি।
নাহার খালা, রিয়া আপু, নিঝুম এসে দাঁড়ালো সামনে।
মামা, মামি আর তাদের দুই মেয়ে । সব হৈচৈ করতে করতে গাড়ি থেকে বের হলো।
মাহির খুব ভালো লাগছে এত ভীড় !
খালামনি জিজ্ঞাসা করল, দুলাভাই কোথায় রে?
নিচে বাবা স্টাডিতে !
খবর টা শুনে কি যে ভালো লাগছে বিশ্বাস করবি না ! বড়পা তো বলল, তাড়াতাড়ি আসো তোমরা।
মা উপরে যাও তোমরা উপরে !
হু।
সবাই উপরে উঠে গেল ! নিঝুম যাওয়ার সময় বলল, তোকে দেখে বুঝা যাচ্ছে তুই আনন্দে আছিস!
মাহি মাথা নাড়ল!

সবাই মিলে হৈচৈ করছে । মাহি এসে সবার সঙ্গে বসলো। আজ সবার মাঝে খুব থাকতে ইচ্ছে করছে!
রুবাকে দেখছে না ! আশেপাশে তাকালো মাহি ! মাহি মা কে জিজ্ঞাসা করল মা রুবা কোথায় ?
ও মনে হয় তোমাদের রুমে গেছে ।
মাহি উঠে যাবে মা বলল বসো বাবা রুবাকে নিয়ে কয়টা বলব তুমি থাকো এখানে!
মাহি বসলো।
আমি মেয়েটাকে যখন প্রথম দেখি সিঙ্গাপুরে তখন সে অসুস্থ মাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন, চিন্তায় অস্থির । তার ভেতরে ও দেখি বাবার জন্য ও খুব কেয়ারিং সে।
ওর ফ্যামিলি দেখে ওদের ভেতরে একেঅপরের জন্য ফিলিংস দেখে আর সত্যি কথা অস্বীকার করব না ওর সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এরকম একটা মেয়ে যে কোন মা তার ছেলের জন্য চায়!
তারপর রুবা বিয়ে হয়ে এলো এ বাড়িতে । যা বুঝলাম ও একটা পুতুলের মত ওকে যে যেভাবে আপন করবে সে ওর মনের মত হয়ে উঠে।
শিহাব যেমন শান্ত ছিল , ধীর স্থির ছিল রুবাকে আমি তখন দেখেছি শিহাবের মত শান্ত , শিহাবের মনের মত আর আজ ঘটনার প্রেক্ষিতে সে আমার মাহির ব‌উ । জীবনে সব হারিয়ে রুবা এখন মাহির মনের মত , মাহি যেমন চঞ্চল, মাহি যেমন পাগলাটে রুবাও দেখি তেমন!
আজ সে মাহির মনের মত ঠিক বললাম কিনা মাহি?
মাহি শুধু মাথা নিচু করে মায়ের কথা শুনছে!
আমি আমার ছেলে দের চিনি তাই আমি জানি । আজ শিহাব বেঁচে থাকলে মাহির জন্য রুবার মত আরেক জন খুঁজে আনতে পারতাম কিনা জানিনা কিন্তু শিহাব যাওয়ার পর রুবা কে আমি হারিয়ে ফেলতে পারিনি ।
কারণ আমি জানি এই মেয়ে আমার বর্তমানে কিংবা অবর্তমানে এই সংসারে র জন্য আমার মাহির জন্য যা ভালো হয় সব করতে পারবে।
আমি ওকে ওর কষ্ট থেকে সেদিন বের করতে পেরেছি । মা হয়ে বুকে পাথর রেখে। আজ রুবা আমাকে স্ত্রী হিসেবে যে কষ্টে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম ,ওর বাবার এবনরমাল জীবন টা দেখে দেখে। রুবা আজ কে ফিরিয়ে আনল মাহির বাবাকে স্বাভাবিক জীবনে ! আমি সে জন্যই বলি আমার মাহির জন্য সেদিন ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি ও নিজেকে নিয়েই ভালো থাকতে চাওয়া মেয়ে না ও আমাদের সবাই কে নিয়ে ভালো থাকতে চায়।
মাহি তোমার কাছে আমার অনুরোধ , তুমি এই মেয়ে টাকে কখনো কষ্ট দিবে না । ওকে তোমার মত করে বানিয়ে নিতে পারবে, তুমি যদি চাও ।
তোমাদের মনে আমার সেদিনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে তাই আজ এত মাস পরে আমি সবার সামনে এই কথা গুলো বললাম!
মাহি চুপ করে বসে আছে !
রিয়া বলল, খালাম্মা কে কি ভাবছে জানি না আমি প্রথম দিন থেকেই জানতাম আপনি সঠিক ডিসিশন নিয়েছেন। আর আমি নিঝুম কে এবং মা কেও বলি , দুটো কে দেখলে একসঙ্গে কি ভালো লাগে !
কি নিঝুম বলি না রে ?
নিঝুম কথার কোন উত্তর দিল না।
মিনহাজ মামা বলল, বড়পা তোমার ডিসিশন দুলাভাই এর মত ব্যারিস্টার মানুষ এক বাক্যে মেনে নিসে সারাজীবন আমরা তো কিছুই না।
সাফিয়া বেগম , মাহির মাথায় হাত রাখলেন!

রুবা এসে ঢুকলো তখনই ! সবাই কে দেখে খুব খুশি হলো !
মা বলল, এদিকে আমার কাছে এসে বসো রুবা !
রুবা শ্বাশুড়ি র পাশে গিয়ে বসলো ! সাফিয়া বেগম ওর মাথায় হাত রাখলেন!
তারপর সবার সঙ্গে আড্ডা য় মেতে উঠলো রুবা।
রুবার দিকে মাহির দুটো চোখ মুগ্ধতা আর কৃতজ্ঞতায় বারবার দেখে যাচ্ছে।
আরো দুটো চোখ দেখছে ওকে কিন্তু সেখানে কিছুটা ইর্সা, কষ্ট, ঘৃণা মিশে আছে !

সেদিন সবাই মিলে আগের মতই গল্প , হৈচৈ আর খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যা টা পাড় করলো। নিঝুম মাহির সঙ্গে কথা বলার চান্স ই পায় নাই। মাহি ই নিঝুম কে এড়িয়ে যাচ্ছে একরকম। একটা ব্যাপার খেয়াল করছে মাহি নিঝুম ওকে দেখলেই বেশি পাগলামী করছে! তাই দেখা কম হলেই ভালো। কিন্তু তা আর হয় কিভাবে , এক জায়গায় কাজ করে তারা।

রুবার হাতের প্লাস্টার খুলা হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে ! এখন পায়ের ও কোন সমস্যা নেই ! মাহি হসপিটালে ব্যস্ত সাফিয়া বেগম আর রুবা আগের মতই নিজেদের মধ্যে গল্প আর সংসার নিয়ে থাকে । মাহির বাবা নিয়মিত কোর্টে না গেলেও তিনি মামলা মোকদ্দমা নিয়ে নিজের এসিস্ট্যান্ট দের সঙ্গে ব্যস্ত থাকেন । ধীরে ধীরে তিনি নরমাল হচ্ছেন।

সকালে মাহি হসপিটালে চলে যাওয়ার পর রুবার কিছুই করার থাকে না ! সে নিজের ঘর গোছায় , কখনো নিজেই রান্নার দ্বায়িত্ব নেয় তারপরও তার অঢেল সময় হাতে থাকে!
সে আর মাহি মেসেঞ্জার এ মেসেজ আদান-প্রদান করেই দিন টা কাটায়।
রুবার ফ্রেন্ডদের সাথে কথা হয় গল্প হয় কিন্তু সে মাহিকে ছাড়া বের হয় না কোথাও।
ছোট থেকে মা ওকে একা বের হতে দিত না এরপর একা বের হয়ে ঘুরবে শপিং করবে এটা রুবার চিন্তা ও করতে পারে না ।
তবে মাহি বলে তুমি ফ্রেন্ড দের গেট টুগেদার এ যাও ভালো লাগবে।
ওর আর যাওয়া হয় না ।
ওর খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড শিমু স্কুল কলেজ ভার্সিটি সব একসঙ্গে পড়েছে বিয়ের পর ও যোগাযোগ ছিল কিন্তু শিহাব মারা যাওয়ার পর আর যোগাযোগ নেই রুবার সঙ্গে । রুবা ই রাখেনি কারো সঙ্গে যোগাযোগ ।
এত দিন পর মাহির অনুরোধে সব ফ্রেন্ডদের সাথে যোগাযোগ । শিমু র সঙ্গে আবার আগের মত কথা হয়।
প্রায় দিনই কথা হয় তাদের।
আজ শিমু আসছে রুবার বাসায় ! রুবার বিয়ের পর এসেছে শিমু এই বাসায় এবার অনেক দিন পর আসছে।
বিকেলে শিমু এসে তাকে দেখেই প্রথম যে কথাটা বলল, সেটা হলো তুই আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছিস রুবা!
রুবা বলল মোটেও সেরকম কিছু না !
খাই দাই ঘুমাই মোটা হচ্ছি , রুবা বলল!
দুজনে প্রথমে অনেকক্ষণ সাফিয়া বেগম এর সঙ্গে বসে গল্প করলো ।
তারপর রুবা ওকে পোর্চের ছাদে নিয়ে এলো । দুজনে সেই স্টুডেন্ট লাইফে র মত হাসাহাসি গল্পে মশগুল ।
শিমু বলল, তোর শ্বাশুড়ি র মত মানুষ আছে এই জগতে রুবা ?
আছে রে তাই তো দেখছি ।
কিভাবে তিনি তার অবিবাহিত , সুদর্শন , ডাক্তার ছেলে কে বিয়ে দিলেন বিধবা ছেলের ব‌উ এর সঙ্গে ! কতটা বড় মনের মানুষ হলে এমন হয় রুবা?
রুবা বলল, মা আমার নিজের মায়ের চেয়েও বেশি আমার কাছে শিমু।
শিহাব যাওয়ার পর আমি মায়ের জন্যই বেচতে পেরেছি রে । তা না হলে আমার আত্মীয় স্বজন আমাকে ছিঁড়ে খেতো!
আর মাহি ! উনার সাথে তোর জীবনটা কেমন যাচ্ছে রে ?
শিমু ঐ দুটো রুম দেখেছিস , রুবা ছাদ থেকে আঙ্গুল দিয়ে শিমুকে ইশারায় দেখাচ্ছে তাদের রুম গুলো। একটা শিহাবের , একটা মাহির রুম!
জীবন আমার সাথে কি করলো দেখ ঐ দুই জনের সঙ্গে ই আমি বিয়ের বন্ধনে জীবনে জড়ালাম।
দুটো মানুষ এক আত্মা হলেও দুটো মানুষ আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের মানুষ । শিহাবের সঙ্গে আমার কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না , বিয়ের পর‌ই ওকে জেনেছি। ও অনেক শান্ত , স্থির ধীর , চুপচাপ, দারুন মেরিটোরিয়াস মানুষ ছিল । ফ্যামিলির জন্য সব সময় ভাবত । আমাকে খুব ভালোবাসত । আমি ও ওর ভালোবাসায় মগ্ন ছিলাম ওর মনের মত হয়ে উঠতে চাইতাম । ও ছিল এতটা চুপচাপ কোন কিছু নিজ থেকে আদায় করে নিবে সেটা ভালবাসা হোক আর তার প্রতি মনোযোগ কখনোই না। কিন্তু
তুমি নিজ থেকে দাও ,সে বুক ভরে তা গ্রহণ করবে ! রাগ জিনিস টা কখনও দেখিনি ।
দ্বায়িত্ব পালন করা ওর ধ্যান জ্ঞান ছিল।
আর মাহি , চঞ্চল, এই রেগে যাচ্ছে আবার এই আদর করে কথা বলছে । অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারে এক নিমিষেই , এত কেয়ারিং , শিহাব যাওয়ার পর ফ্যামিলি টাকে বুক দিয়ে আগলে রাখছে । আমাকে শাসন করছে আবার আমাকে পশ্রয় দিচ্ছে ! এই সে আমার সামনে নিজেকে আড়াল করছে আবার কখনো সে নিজেকে এমন ভাবে মেলে দিচ্ছে আমি ওর কথাতেই শিহরিত হয়ে যাই।
আমি জানি না কোথায় ছিল আমার মাঝে এত চঞ্চলতা কোথায় ছিল এত অস্থিরতা মাহির জন্য আমি কখনো চঞ্চল কখনো অস্থির কখনো রেগেও যাচ্ছি !
আমি আমার ভেতরে আমাকে খুঁজে পাচ্ছি না !
আমি শিহাব কে ভালোবেসেছি বিয়ের পর একটু একটু করে কিন্তু মাহি আমার জীবনে আসার পর ওর সব কিছু আমাকে ওর প্রেমে পড়তে বাধ্য করছে ! ও এক পা এগিয়ে আসে আমি দুই পায়ে ওর কাছে চলে যাই !
আমি কিভাবে এমন হয়ে গেলাম রে শিমু?
শিমু রুবার হাত ধরলো । রুবা এটাই তো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক রে ! একবার বন্ধনে জড়িয়ে গেলে মন ওর দিকে টেনে নিবেই ! আর যে পরিস্থিতি তে তোর বিয়ে হয়েছে একটু ভালোবাসা র জন্য তোর এই তৃষ্ণা তো থাকবেই। ছোট থেকেই ভালোবাসা পাওয়ার আগেই তো হারিয়ে যায় যে তোর জীবনে।

জানিস মিসক্যারিজ এর পর যেদিন বাসায় আসলাম ,আমার শ্বাশুড়ি আমার রুমে এলেন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন , রুবা আমি তোমাকে যত ভালোবাসিই না কেন,আমি তোমার মা তার আগে মাহির মা ! আমি তোমার কাছে অনুরোধ করব তুমি মাহিকে তার সকল অধিকার দিবে ! একটা কথা বলি , স্বামী স্ত্রীর মাঝে এক কোদাল মাটির গর্তের দূরত্ব একদিনে হয় এক খাল দূরত্ব , দুই দিনে হয় এক নদী দূরত্ব আর দশ দিনে হয় এক সমুদ্র দূরত্ব। দূরত্ব যত বাড়বে সম্পর্কে র জটিলতা বাড়বে । এই কথাটা মনে রেখো। আমি শিহাবের মা তারপরও বলছি , শিহাব নেই কোথাও নেই । তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মাহি শুধু মাহি । এই সত্য তুমি মত তাড়াতাড়ি বুঝবে তত মঙ্গল তোমার জন্য মাহির জন্য ।
সে রাতে আমি অনেক চিন্তা করলাম ,আমি কি ? কচুরিপানা ! শুধু ভেসে ভেসে যাচ্ছি এই কূল থেকে আরেক কূলে! কোথাও আমি স্থির হতে পারব না । আমার নিজের জীবনের উপর প্রচন্ড ঘৃনা হলো আমাকে যে ভালোবাসে সেই চলে যায় ! কেন ? আমি একটা অপয়া মেয়ে।
[ ] জানিস মা বলতো মেয়েদের রূপ তার সম্পদ যদি হয় , এই রূপ ই আবার তার সবচেয়ে বড় বিপদে র কারণ । আমি নিজেই আমার সবচেয়ে বড় বিপদে র কারণ তাহলে ! কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! বাবার বাড়িতে একা থাকতে পারব সেই নিরাপত্তা কোথায় ? সেই রাতে আমি পুরাই পাগলের মত হয়ে গেলাম আমি সব রাগ সব ঘৃণা নিজের উপর ঝাড়তে চাইলাম মরে যাব যখন ভাবছি, তখন মাহি আমার সামনে হাজির সে আমাকে দেখে দিশেহারা । আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল আমি ওর উপর সব রাগ ঝাড়লাম খামছে, কিল , ঘুসি মেরে কামড়ে দিয়েছিলাম কিনা খেয়াল নেই এত কিছুর পরও মাহি আমাকে তার বুকের সাথে জাপটে ধরে রাখলো । আমি ওকে মেরেই যাচ্ছি সে আমাকে ছাড়ছে না । একটা সময় আর মনে নেই আমি জ্ঞান হারালাম পরে শুনেছি ও ঘুমের ইনজেকশন পুশ করেছিল ।
সারারাত ও আমার জন্য অস্থির হয়ে ছিল ।
এর পর থেকে ও আমাকে এক মুহূর্তের জন্য একা থাকতে দেয় নাই। আমি কি করলে ভালো থাকব , আমি কি করলে খুশি হব মাহি সেই খেয়াল রাখছে । আমার একটু কষ্টে সে অস্থির হয়ে যাচ্ছে।
আমি ওর সব কিছু অনুভব করি আর চিন্তা করি আমার মত একজন ভাগ্যাহত মানুষের ভাগ্যে এরকম স্বামী সত্যিই তো ! আমি কি পূণ্য করেছি স্বামী হিসেবে যে দুজন মানুষ পেলাম এত ভালো তারা! আমি বুঝি না আল্লাহ আমার সঙ্গে কি করে?
আমার আবার সব হারানোর খুব ভয় হয় রে !
আমি মাহির কাছে যেতে চেয়েও পারি না যদি বালির ঘরের মত সব ভেঙ্গে যায় ! আমার তো জীবনে কেউ নেই, না আছে বাবা-মা, একটা ভাই বোন, না আছে একটা ভালো চায় আত্মীয়-স্বজন। মাহি আর তার পরিবার ছাড়া কেউ নেই ! পৃথিবীতে এত নিঃস্ব কোন মানুষ হয় বল?
শিমু শক্ত করে রুবার হাত ধরে বলল, কিচ্ছু হবে না রুবা শুধু শুধু চিন্তা করছিস!
তোর জীবনে যা খারাপ হ‌ওয়ার হয়ে গেছে দেখবি মাহি ভাইয়া তোর জীবনটা আনন্দ দিয়ে ভরে দিবে তুই শুধু একবার হাত বাড়িয়ে দেখ !
রুবা শিমুকে ধরে কাঁদছে !
সন্ধ্যা হ‌ওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিমু চলে গেল ! শিমু কে নিচে বিদায় জানিয়ে,
রুবা নিজের ঘরে ফিরে আসছে সাফিয়া বেগম ডেকে বললেন, রুবা এদিকে এসো !
জ্বি মা !
আমি একটু বের হব, নাহারের সঙ্গে রিয়ার বিয়ের জুয়েলারির অর্ডার দিতে । রিয়া সারাদিন অফিস করে তাই সময় পায় না এখন এই সন্ধ্যায় যেতে হচ্ছে। তোমার বাবা নিচে স্টাডিতে থাকবে তুমি ভয় পাবে না তো একা ? ফরিদা আছে এদিকে । ও আবার নিচে চা পাঠাতে ব্যস্ত থাকে তাই বললাম।

না মা আমি আমার রুমে ই আছি । আপনার ছেলেও তো চলে আসবে আপনি যান ।

রুবা নিজের রুমে এসে ঢুকলো । কিছুক্ষণ ফেসবুকে ঘুরাঘুরি করলো । তারপর হঠাৎ উঠে , আলমারি খুলল তার শ্বাশুড়ি নতুন যে শাড়ি এনেছেন সেখান থেকে একটা শাড়ি বের করলো ! ডীপ রয়েল ব্লু তে আকাশি কাজের একটা পিওর জর্জেট শাড়ি নিয়ে ইউটিউবে শাড়ি পড়ার টিউটোরিয়াল দেখে দেখে কয়েকবারের চেষ্টায় পরে ফেলল!
তারপর চুল টা টেনে একটা খোঁপা করে কাটা দিয়ে বেঁধে নিলো! সাজ বলতে চোখে কাজল আর হালকা পিঙ্ক লিপস্টিক!

ঘরটা গুছিয়ে সে মিউজিক অন করলো হোম থিয়েটারে ,তারপর পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো ! এত সুন্দর বাতাস বারান্দায় তার মন টা দারুন ভালো লাগায় ভরে উঠলো।

মাহি প্রতিদিন বাসায় ফিরে এখন আগে বাবার স্টাডি রুমে ঢুকে ! বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে তবেই সে উপরে উঠে !
আজ‌ও সে এসে বাবার সঙ্গে গল্প করছে ! বাবাকে কর্মব্যস্ত দেখে মাহির খুব শান্তি লাগে !
মাহি যাও ফ্রেশ হ‌ও গিয়ে , বাবা বলল!
যাচ্ছি বাবা !
প্রতিদিন বাবা না বলা পর্যন্ত সে যায় না !
স্টাডি থেকে বের হয়ে সে অভ্যাস যা সিগারেট ধরিয়ে টান দিবে !
আজ সিগারেট খাচ্ছে আর রুবার কথা চিন্তা করছে , আজ সারাদিনে একটা কল ও করা হয়নি ওকে! কয়দিন এত ব্যস্ত ছিল মাহি কয়েকজন একসঙ্গে ছুটিতে থাকায় এত ব্যস্ততা বেড়েছে যে রুবার সঙ্গে রাতে এসে ভালো করে কথা বলার আগেই তার চোখে রাজ্যের ঘুম চলে আসে !
রুবা নিশ্চয়ই ওর আসার অপেক্ষা করে !
এসব ভাবতে ভাবতে দোতলায় উঠল! হাত ধুয়ে মুখে পানি দিল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রীজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল খুলে পানি খেলো ।
ফরিদা কে দেখে বলল, মা কোথায় এদিকে সব অন্ধকার কেন বুয়া?
আম্মা খালাম্মা র সাথে বাইরে গেছে !
তোমার ভাবি?
নিজের ঘরে !
মাহি ল্যাপটপ এর ব্যাগ টা হাতে নিয়ে আর পানির বোতল টা নিয়ে নিজের রুমের দিকে আসছে !
দরজায় টোকা দিয়ে ঢোকা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে রুবা এই ঘরে যখন থেকে থাকে !
দরজায় শব্দ পেয়ে রুবা বারান্দা থেকে রুমে আসতেই দেখে মাহি ঢুকছে !

শাড়ি পরা রুবাকে দেখে মাহি একটু ধাক্কা র মত খেলো !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here