হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-১০

0
334

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১০

তুলির নিজেকে বেশ হালকা লাগছে আজকে। এতগুলো কথা চেপে রেখে যেন তার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল। আজকে সে যন্ত্রণার একটু পরিত্রাণ মিলল।

তুলি হাতে নেওয়া ডায়রিটা খুলে খেয়াল করল ডায়রিটার প্রথম পৃষ্ঠায় কোনো লিখা নেই। পরপর কয়েক পৃষ্ঠা দেখল।তারপর কয়েক পৃষ্ঠায় লিখা না পেয়ে তুলি ভাবল, অরন্য হয়তো ইচ্ছা করে তুলির সাথে মজা করেছে। তুলি রাগে ডায়রিটা বিছানায় ছুরে মারার সাথে সাথে একটা মেয়ের ছবি বের হয়ে আসলো। তুলি ডায়রিটা আবার হাতে নিয়ে মেয়ের ছবিটা ভালো করে দেখল। তুলি বুঝতে পারল এ ডায়রিটার মালিক এ ছবির মেয়েটা। ডায়রিটা পুনরায় খুলে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে খেয়াল করল কয়েক পৃষ্ঠা পর একটা কাহিনি লিখা ছিল। কাহিনিটার প্রথম টুকু পড়ে তুলির বেশ আগ্রহ জাগল ডায়রিটা পুরোটা পড়ার। তাই পুনরায় সে
ডায়রিটা পড়তে লাগল। সে সাথে কাহিনিতে ডুব মারল।

আজকে আমার পাকা দেখা। এ নিয়ে মোট তেরো বার আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে। আর প্রতিবারেই ঠিক একটা করণে বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছে। বিয়ে ভাঙ্গার বিষয়টা প্রথম প্রথম অস্বাভাবিক লাগলেও এখন অতি স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ কোনকিছুর পর্যায়ক্রমিক অভ্যাস মানুষকে সে বিষয়টার প্রতি স্বাভাবিক করে তোলে।

প্রতিবারের মতো আজকেও নিজেকে প্রস্তুত করছি পাত্র পক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য আর আমি এটা নিশ্চিত যে, পাত্রপক্ষ আমাকে দেখার পর সে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলেই জুটবে।

বিয়ে ভাঙ্গার কারণ বলার আগে আমি আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি সাবিহা জান্নাত নিরা। অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করে বেকার জীবনযাপন করছি। আমার মা এবং বাবাকে নিয়ে এ শহরে বাস। স্বাভাবিকভাবে মেয়েদের যে গুণ গুলো থাকা দরকার সবকিছুই আমার মধ্যে আছে। তার মধ্যে সেলাই কাজ, রান্না,সুতার কাজটাও রপ্ত করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার এসব গুণ গুলো চাপা পড়ে গিয়েছে আমার শরীরের রঙয়ের কাছে। প্রথম প্রথম কয়েকবার বিয়ে ভাঙ্গা নিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তবে এখন আর সেটা লাগে না। ঐ যে বললাম পর্যায়ক্রমিক অভ্যাস।

বিয়েতে বাতিল হয়ে যাওয়ার কিছু কাহিনি বলি তাহলে। প্রথম আমাকে দেখতে এসেছিল আমার বাসায়। ছেলে সরকরি চাকুরি করে। অনেক আশা নিয়েই তাদের সামনে গিয়েছিলাম। আমাকে ছেলে প্রথম দেখেই বলল

“আপনি পড়াশুনা শেষ করে চাকুরি করছেন না কেন?”

সাবলীল গলায় উত্তর দিলাম

“মন মতো চাকুরি জুটছে না।”

ছেলেটা এবার আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করে সরাসরি মুখের উপর বলে দিল

” গায়ের এরকম রঙ দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপনার চাকুরি করার যোগ্যতা নেই।”

সেদিন আমার অনেক কষ্ট হলেও পাত্র পক্ষের সামনে মুচকি হেসেছিলাম। তারপর পাত্র পক্ষ কল দিয়ে বলল আমার নাকি যোগ্যতা নেই, তাই তারা বাদ দিয়েছে আমাকে। আমার গায়ের রঙ কালো ছিল তবে আমি যোগ্য না এটা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না।

পরের বার দেখতে আসলো যে পাত্র সে পাত্রের ও নিজের একটা মস্ত বড় ভূড়ি আর গায়ের রঙ কালো ছিল। সে পাত্র আমার সামনে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখল। তারপর বলল

“আমি একটা ফর্সা সুন্দর মেয়ে খুঁজছিলাম, আপনি বেশ কালো। যোগ্যতাও নেই তেমন।”

লোকটার মুখে এমন কথা শুনে সেদিন আর চুপ থাকি নি। নিজেকে এত অপমানিত হতে দিইনি। আর যাইহোক গায়ের রঙ দিয়ে যোগ্যতা বিচার করার বিষয়টা আমার আত্মসম্মানে আঘাত হানল। তাই লোকটাকে মুখের উপর বললাম

“আপনি আমার গায়ের রঙ দেখেই বুঝে ফেললেন আমার যোগ্যতা নেই। আপনার আমাকে পছন্দ না সরাসরি বলে ফেলুন তবে যোগ্যতা নেই এ কথাটা কেন বললেন? আর আপনি নিজেও কালো তাহলে আমাকে কালো বলার আগে একটু ভেবে বলা দরকার ছিল না?”

পাত্র মুখের উপর আমাকে বলে দিল

” ছেলেরা কালো হলে কিছু যায় আসে না। কারণ ছেলেরা সমাজের সিংহ।”

এবলে লোকটা চলে গেল। আর আমার পরিবারকে কল দিয়ে বলল এরকম কালো মেয়ে তাদের পরিবারের বউ হওয়ার যোগ্য না। আমি কথা গুলো শুনে ভাবতে লাগলাম এ কেমন সমাজ ব্যবস্থা? একটা মেয়ের গায়ের রঙ কালো হলে সমস্যা। আর একটা ছেলের গায়ের রঙ কালো হলেও সে সমাজের সিংহ। কেন কালো একটা মেয়ে সমাজের সিংহী বা বাঘিনি হতে পারে না। কেন এত প্রভেদ ছেলে আর মেয়ের মধ্যে। সমাজে তো দুজন মানুষকে দরকার। অবদান তো দুজন মানহষেরেই। তাহলে কেন এত বৈষম্য। কিন্তু এসব ভেবে লাভ নেই কারণ সমাজ কখনও পাল্টাবে না।

পরেরবার আবার দেখতে আসলো। পাত্র আমাকে দেখে বলল

” সত্যি বলতে আমি পরীর মতো সুন্দর বউ চাই। বউরা একটু সুন্দর হওয়া লাগে।”

হালকা ব্যাঙ্গ হাসি দিয়ে বললাম

“কেন বউকে দিয়ে কি মডেলিং করাবেন? আমি জানতাম মডেলরা সুন্দর হওয়া লাগে। এটা জানতাম না যে বউদের সুন্দর হওয়া বাঞ্চনীয়।”

লোকটা কথার জাবাব না দিয়ে চলে গেল। হয়তো লোকটার কাছে এর উত্তর ছিল না।

আর একবার এক পাত্রের কাহিনি দেখে খুব হেসেছিলাম। সেদিন পাত্রের সাথে আমার রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা ছিল। আমি পাত্রের আগে রেস্টুরেন্টে পৌঁছালাম। পাত্র আমাকে দেখে দৌঁড়ে পালাল। এটা দেখে হাসতে হাসতে বাসায় আসার পর মা জিজ্ঞেস করল

“কিরে পাত্রের সাথে কথা হয়েছে?”

অট্ট হেসে বললাম-

“পাত্র আমাকে রেস্টুরেন্টে দেখতে গিয়ে পেত্নী ভেবে চলে গিয়েছে। কথা বলার সুযোগ পাই নি।”

“কি বলছিস? একটু গুছিয়ে বল হেয়ালি রেখে।”

বুকে কষ্ট চেপে মুখে এক বিন্দু মিথ্যা হাসি নিয়ে বললাম

“পাত্র আমাকে দেখে কোনো কথা না বলেই চলে গিয়েছে।মেনে নিলাম আমাকে পছন্দ হয় নি। তার মানে এই না যে আমাকে রেখে চলে যেতে হবে। আমি তো জোর করে ধরে উনাকে বিয়ে করতাম না। মা এবার আমাকে ক্ষমা করো।আর পাত্রের কাছে গিয়ে নিজেকে ছোটো করতে পারব না। আত্মসম্মানে আঘাত লাগে খুব।”

মা আমার মাথায় তার ডান ডান দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল

“পড়াশুনা শেষ করে তো বেকার বসে আছিস। তোকে ঘরে পালব নাকি। একটা চাকুরি করলে নাহয় মেনে নিতাম। তাও তো জুটাতে পারিস না। রিটেনে টিকিস ভাইবা তে গেলেই বাদ পরিস, এর মানে বুঝলাম না। ভাইবাতে গিয়ে কী কিছু বলতে পারিস না নাকি?”

পুনরায় অট্ট হাসলাম।”

“ভাইবাতে তো আমাকে প্রশ্নই করে না। ভাইবাতে আমাকে দেখে বলে আমাদের এ পদের জন্য একটা স্মার্ট মেয়ে দরকার। অথচ যেসব মেয়েরা সিলেক্ট হয় তারা আমার থেকেও অযোগ্য। শুধু মাত্র আমার চামড়ার জন্য আমাকে বাদ পড়তে হয়। সেখানে কেউ আমার যোগ্যতা দেখে না মা। সেখানে সবাই আমার চেহারা দেখেই বলে ফেলতে পারে আমি সে কাজটা করতে পারব না। সত্যি বলতে এরকম কালো হওয়ার পেছনে আমার দোষটা কোথায় বলতে পারবে?”

মা আমার কথা শুনে জবাব না দিয়েই চলে গেল। আর এদিকে আমি ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে যাচ্ছিলাম, আবার নিজেকে গড়ে নিচ্ছিলাম।

অনার্সে উঠার পর একটা প্রেমও হয়েছিল। সে প্রমটা দুই মাসের উপর টিকে নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ছেলেটা আমাকে ভালোবাসে না। কারণ রিলেশনের এক মাস পর থেকে শুধু শারিরীক সম্পর্কের জন্য বলত। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ছেলেটা আমাকে বিকৃতভাবে পাওয়ার জন্য আমার সাথে প্রেমের নাটক করছে। তাই শারিরীক সম্পর্ক করতে রাজি হয়নি। আর এজন্য আমার বি এফ আমাকে কালো বলে ব্রেক আপ করে দিল। কয়েকদিন পর দেখলাম একটা সুন্দর মেয়ে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার সেদিন কী যে কষ্ট হয়েছিল বলার ভাষা নেই। অথচ ছেলেটাকে মনে প্রাণে অনেক ভালোবেসেছিলাম। এভাবেই বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দিয়েই আমি আমার জীবনের এতটা বছর পার করেছি।

যাইহোক এবার কাহিনিতে আসা যাক। পাত্র পক্ষ আসলো আমাকে দেখতে। মা আমাকে ডাক দিয়ে হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে বলল

“যা মা ওদের সামনে যা।”

মায়ের কথা শুনে শরবতটা নিয়ে যখনই যেতে নিলাম ঠিক তখনেই মা আমাকে ডেকে তার কাপড়ের আঁচল দিয়ে আমার চোখ থেকে কাজল মুছতে লাগল। আমি মাকে এরকম করতে দেখে বললাম

“মা তুমি কাজল মুছতেছ কেন?”

মা রাগ রাগ গলায় জাবাব দিল

“এমনেই গায়ের রঙ কালো। তার মধ্যে কাজল আরও কালো। কাজলটা মুছলে একটু ফর্সা লাগবে।”

অসহায় গলায় মাকে বললাম

” মা কাজল পড়তে আমার ভালো লাগে মুছো না দয়াকরে।”

মা আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে বলল

“ভালো লাগলেও আজকে পড়া যাবে না। কাজল ফর্সা মেয়েদের জন্য কালোদের জন্য না।”

আমি আর কিছু বললাম না। মা কাজলটা ভালো করে মুছে, হাতে এক গাদা পাউডার নিয়ে আমার মুখে দিয়ে বলল

“এবার যা। এবার তোকে একটু ফর্সা লাগছে।”

আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। চোখের কোণে শিশিরবিন্দুটা মুছে নিলাম শাড়ির আঁচল দিয়ে। অতঃপর হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে গেলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here