হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-১২

0
308

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১২

সাঝের আকাশে সূর্যটা লাল হয়ে ডুবতে লাগল। সূর্যের রক্তিম আভায় আকাশটাও লাল রঙে রঙিন হয়ে গেল। দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। আর আমার চোখে শুধু যেদিকে তাকাচ্ছিলাম উানাকেই দেখছিলাম। সারারাত না ঘুমাতে ঘুমাতে সকালে হালকা ঘুম হলো। কিন্তু সকালে মায়ের চেঁচামেঁচিতে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে উঠি। মা যেভাবে চেঁচাচ্ছিল মনে হচ্ছে কি’না কি হয়েছে। আমার মনে হলো তাহলে কি আমার বিয়ে ভেঙে গেল আর এজন্য কী মা চেঁচাচ্ছে?

আমি বুঝে উঠার আগেই বাবা আমার রুমে এসে জোরে জোরে কেঁদে বলল

“ওরা কালকে তোকে আংটি পড়িয়ে দিয়ে যাবে। তোকে নাকি ওদের অনেক পছন্দ হয়েছে তাই বিয়ের কাজ দেরি করতে চায় না। অবশেষে আমার মেয়েটাও শ্বশুড় বাড়ি যাবে।”

বাবার কথা শুনে বিশ্বাসেই করতে পারছিলাম না যে, কেউ আমাকে বিয়ে করার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছে। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। বাবার মতো আমিও কাঁদতে লাগলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“থাক মা কাঁদিস না। আমি যাই বাজার সদাই করতে হবে। কালকে তোকে আংটি পরিয়ে যাবে। একটু ভালো মন্দ তো ওদের খাওয়াতে হবে। মা রে এতদিন বিয়ের জন্য শুধু মন খারাপ হত এটা ভেবে যে, কবে তোর বিয়ে হবে। আজকে মন খারাপ হচ্ছে এটা ভেবে যে তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেলে এ ঘরটা যে শূন্য হয়ে যাবে মা।”

এ বলে বাবা হুহু করে কেঁদে দিল। বাবার কথা শুনে বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে এটা মনে করে আমিও হুহু করে কাঁদতে লাগলাম। বাবা আমার চোখ মুছতে মুছতে বলল

“তুই থাক। আমি বাজারে গেলাম। তোর কিছু লাগলে বল।”

“না বাবা কিছু লাগবে না। তুমি তোমার মতো করে যা ইচ্ছা নিয়ে এসো।”

বাবা পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে আমার হাতে গুজে দিয়ে বলল

“এ টাকা কয়টা দিয়ে একটা ভালো শাড়ি কিনিস। ওদের সামনে গেলে তো একটু গুছিয়ে যেতে হবে।আমার মা টা কে পরীর মতো লাগতে হবে।”

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

“নাহ বাবা তোমার মেয়ে কালো, পরী কেন হবে তোমার মেয়ে তো পেত্নী।”

বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

“তুই জন্ম নেওয়ার পর থেকে আমি তোর গায়ের রঙ নিয়ে কখনও অসন্তোষ্ট প্রকাশ করিনি । আমার কাছে তুই সবসময় পরীর মতো সুন্দরী ছিলি এখনও তাই আছিস। তুই যে আমার রাজকন্যা মা।”

আমি বাবার কথা শুনে হেসে দিলাম। সত্যি বলতে একমাত্র এ লোকটা আমাকে কোনোদিন গায়ের রঙ নিয়ে কিছু বলেনি। এ লোকটা সবসময় আমাকে ভালোবাসার চাঁদরে ঢেকে রেখেছে। আমি বাবাকে হাসি মুখে বললাম-

“রাজা সাহেব এবার আপনি বাজারে যান। নাহয় আপনার রানীসাহেবা যদি দেখে এখনও আমার সাথে বসে আছেন বাড়ি মাথায় করে তুলবে চিল্লাতে চিল্লাতে।”

” আমি গেলাম তাহলে।”

বলেই বাবা হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল। আর আমি আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী তুরাকে কল দিয়ে আসতে বললাম। তুরার বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে। ওর স্বামী প্রবাসে থাকে। তুরাও স্বামীর সাথেই থাকত। তবে কিছুদিনের জন্য দেশে একাই ঘুরতে এসেছে। কারণ ভাইয়া ছুটি পায় নি। কল দিয়ে খবরটা বললাম।

“অবশেষে আমার বান্ধবীর বিয়ে হচ্ছে। সবসময় দোআ করতাম তুই যেন একটা ভালো বর পাস। আমি দুপুরেই আসতেছি। কী যে খুশি লাগছে নিরু।”

তুরার খুশি দেখে হাসতে হাসতে বললাম

“আরে হয়েছে হয়েছে এত খুশি হতে হবে না।এত খুশি হলে খুশির চুটে অক্কা পাবি। তাড়াতাড়ি আয় তোকে নিয়ে শাড়ি কিনতে যাব।”

এ বলে কলটা কেটে বসে বসে তুর্জের কথা ভাবতে লাগলাম। ওহ বলায় হয়নি আগত পাত্রের নাম তুর্জ। পুরো নাম তুর্জয় শাকিল। তবে ছোটো করে উনাকে সবাই তুর্জ ডাকে। এর মধ্যে মা ডাক দিতে লাগল।

“নিরা কই তুই? হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে আয়।খাবার নিয়ে বসে আছি। তোর খাওয়া শেষ হলে বাকি কাজ করব।”

মায়ের ডাক পেয়ে আমি ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে বসলাম। মা আমাকে পরোটা দিয়ে বলল

“এগুলা সব সবজি দিয়ে খাবি। এ কয়দিন সবজি খাবি তাহলে স্কিন সুন্দর হবে। দেখতে সুন্দর লাগবে।”

অট্ট হেসে বললাম

“কী যে বলো না মা। যে কালো তাকে ঝামা দিয়ে ঘষলেও ফর্সা হবে না। এটা ফেয়ার এন্ড লাভলির এড না যে সাতদিন মেখে ফর্সা হয়ে যাব।”

বিরক্ত গলায় মা জবাব দিল

“তুই এত কথা বলিস কেন? খেতে বলেছি খা।”

মায়ের বিরক্ত মুখটা দেখে হালকা হেসে বললাম

“খাচ্ছিতো। মা দুপুরদিকে তোরা আসবে। বাবা আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে শাড়ি কিনার জন্য। ও আসলে দুপুরের দিকে বের হব।”

মা রাগী গলায় বলল

“বের হওয়ার কী আর সময় পেলি না। এ ভর দুপুরে বের হলে এমনেই কালো আরও কালো হয়ে যাবি। দুপুরে বের হওয়ার কোন দরকার নেই।”

কথাটা বলেই মা রাগে সাপের মতো ফুসফুস করতে লাগল।

“তুমি পারও বটে। এত রাগ দেখাতে হবে না। তুরা আসলে বিকেলে বের হব এবার ঠিক আছে। আজকে তুমি একটু বেশিই আল্লাদ আর বকবক করছো।”

মা আমার বিলাপ জুড়ে দিয়ে বলল

“আমি যাই করি তা শুনেই তো তোর গায়ে লাগে।আমার কথা তো তোর ভালো লাগে না।”

জন্মের পর থেকে মায়ের এ বিলাপ শুনে বড় হয়েছি। বাবা তো মনে হয় বিয়ের পর থেকেই শুনেছে। আমি মাকে কিছু বলতে যাব এমন সময় কলিং বেল এর আওয়াজ আসলো কানে। মা দৌড়ে দরজা খুলল। দরজা খুলার সাথে সাথ তুরার কথা শুনতে পেলাম। তুরার কথা শুনে আমি দৌড়ে গিয়ে তুরাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

“তোর না দুপুরে আসার কথা। এত তাড়তাড়ি চলে আসলি যে।”

তুরা কোমরে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

“তাড়াতাড়ি চলে এসে সমস্যায় ফেলে দিলাম মনে হয়।”

“আরে ধুর কী যে বলিস না। তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

“তোর বিয়ের কথা শুনে আমার ঘরে আর মন টিকল না। তাই চলে আসলাম”

পাশ থেকে মা বলে উঠল

“এসেছিস ভালো করেছিস। এখন বিয়ের আগ পর্যন্ত থেকে যাবি।”

তুরা তার হাতটা পেটে ধরে মাকে বলল

“আন্টি আগে আমাকে কিছু খেতে দাও। তোমার হাতের রান্না খাব বলে না খেয়েই চলে এসেছি।”

” এই দেখ তোকে খেতে না দিয়েই বকবক করছি। তাড়াতাড়ি আয় পরোটা আছে খেয়ে নে।”

তারপর তুরার নাস্তা শেষে দুজন রুমে গিয়ে শুয়ে দুনিয়ার যত আজাইরা গল্প আছে করতে লাগলাম। কথায় আছে

“দুজন মেয়ে মানুষ যদি এক হয় আর তারা যদি বেস্ট ফ্রেন্ড হয়।তাহলে তাদের কথা কোন সুস্থ মানুষ শুনলেও পাগল হয়ে যাবে।”

আমাদের অবস্থাও ঠিক এমন কত কী যে বলছি হিসাব নেই। মোটকথা মুখের নিস্তার নেই। কখন যে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেল সেই হিসাব নেই। মায়ের ডাকে আমাদের আড্ডার ঘোর কাটল। মা ডাকতে ডাকতে বলল

“কিরে আর কত কথা বলবি? এদিকে যে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে সে খেয়াল আছে নাকি। কখন খাবি কখন শপিংয়ে যাবি ।”

মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বললাম

“আসছি মা। চিন্তা করো না। চটপট খাওয়া শেষ করে চলে যাব।”

দুপুরের খাওয়া শেষ করে দুজন শপিংয়ে গেলাম। মার্কেট ঘেটে একটা লাল শাড়ি কিনলাম। তবে আমার চোখ,মন পড়েছিল কালো শাড়িতে। জন্মের পর থেকে কালো হওয়ার জন্য কালো কিছু কখনও পড়তে পারি নি।

যাইহোক সে আফসোস করে এখন লাভ নেই। যা আমার জন্য বরাদ্ধ না সেটা পাওয়ার ইচ্ছা করাও উচিত না। টুকটাক আরও কিছু জিনিস কিনে বাসায় ফিরলাম দুজন।

তুরা যেতে চাইলেও তুরাকে জোর করে রেখে দিলাম। সারারাত রাত তুরার সাথে কথা বলতে বলতে পার করলাম। সকালে উঠেই টানা দুই ঘন্টা তুরা আর মা মিলে আমার উপর রুপচর্চার যত টিপস আছে সব প্রয়োগ করল। একটু পরেই পাত্র পক্ষ আসবে আমাকে আংকটি পড়াতে। ভেবেই যেন আমি আনমনা হয়ে গেলাম। তুরা আমাকে আনমনা হতে দেখে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল

“কিরে এখনেই এ হাল বিয়ের পর কী করবি কী জানি।”

“আরে কী যে বলিস না।”

এ বলে বেশ লজ্জা পাচ্ছিলাম তুরা আমার লজ্জা মাখা মুখ দেখে বলল-

“আরে আরে আমার বান্ধবী দেখা যায় লজ্জাও পায়।”
“থামবি তুই।”
“আচ্ছা থেমে গেলাম।”
এ বলে তুরা হুট করে নাক শুকে একটা টান দিয়ে বলল

” ও আন্টি মনে হয় মেজবানি রান্না করতেছে। কি সুঘ্রাণ বের হচ্ছে। আজকে তো আমি কব্জি ডুবিয়ে খাব। আমি যাই আন্টিকে একটু সাহায্য করি।”

কথাগুলো বলে তুরা মাকে সাহায্য করতে চলে গেল। আর আমি এদিকে আনমনা হয়ে তার কথা ভাবতে লাগলাম। তাকে ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগৎ এ হারিয়ে গেলাম। ভাবনার সুমিষ্ট নিপুণতায় নিজেকে রাঙিয়ে নিলাম। হঠাৎ তুরার আচমকা আওয়াজে ভয়ে ওওও… করে উঠলাম। বুকে থুথু দিয়ে বললাম

“কী হয়েছে এভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন?”

তুরা মাথা নাড়তে নাড়তে রহস্যময় মুখ করে বলল

” তোর নায়ক তো এসে পড়েছে।”

একথাটা শুনে কী যে ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারব না।বিয়ের আগে যে মেয়েরা এত আনমনা হয়ে যায় নিজেকে না দেখলে বুঝতাম না। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। চোখে মুখে লজ্জার বিস্তরণ ছেয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় মা এসে তুরাকে বলল

“তুরা… নিরাকে পাঠা, ওদের সামনে যেতে হবে।”

তুরা আমার হাতে একটা শরবরতের ট্রে ধরিয়ে বলল

” যা এ শরবত দিয়ে জাদু করে আয়।”
“তুই আমার সাথে চল।”
“না রে নিরু এক মেয়েকে দেখতে আসলে অন্য মেয়েদের যেতে নেই, মুরব্বিরা না করে তুই একাই যা।”

আমি কোনো কথা না বলে শরবতের ট্রে টা হাতে নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে গেলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here