হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-১৩

0
319

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৩

পাত্র পক্ষের সামনে গিয়ে প্রথমেই আমার চোখ গেল তুর্জের দিকে। এত মায়ার টান জড়িয়ে আছে তুর্জের মুখে যেকোনো মেয়ে তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যাবে। আমি শুধু আড়চোখে তুর্জের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পাশে থাকা ভদ্রমহিলা আমাকে বলল

“কী গো মা শরবতের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?”

ইশ কী করলাম আমি! তু্র্জের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার হাতে শরবতের ট্রে। কেন যে এত আনমনা হয়ে যাচ্ছি বারবার বুঝতে পারছি না। আমি তুর্জের ভাবনা থেকে নিজেকে বের করে এনে শরবতটা টেবিলের উপর রাখলাম। শরবতটা রেখে আবার দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশে থাকা ভদ্রমহিলাটায় আমার হবু শ্বাশুড়ি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার হবু শ্বাশুড়ি আমাকে পুনরায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল

“কী গো মেয়ে দাঁড়িয়েই থাকবে নাকি বসবে?”

এই বলে তুর্জকে বলল

“তুর্জ নিরাকে একটু এদিকে এসে জায়গা করে দে।”

তুর্জ আমার হবু শ্বাশুড়ির কথা শুনে মাথাটা একটু উপরে তুলে পাশে জায়গা করে দিয়ে আবার মাথাটা নীচে নামিয়ে ফেলল। আর আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বলল

“এই যে মা তুর্জের পাশে বসো তো।”

আমি তুর্জের পাশে বসতে নিলাম। মনে হচ্ছিল আমার সারা শরীর কাঁপতেছে। ভয়ও পাচ্ছিলাম আবার ভালো লাগাও কাজ করছিল। কী যে এক অনুভূতি বলে বর্ণনা করা সম্ভব না। কী যে ভালোলাগা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। উফ! ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। মনের মধ্যে আবেগের ব্যাপক যুদ্ধ হতে লাগল। আবেগের যুদ্ধে নিজেকে জয়ী করে তুর্জের পাশে বসলাম। আমার হবু শ্বাশুড়ি তুর্জের পাশে বাসার পর বলল

“বাহ! দুজনকে তো বেশ মানিয়েছে।”

তারপর উনি আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

“বেয়াই সাহেব আমাদের তো আপনার মেয়েকে অনেক পছন্দ হয়েছে। তুর্জের বাবা থাকলে উনিই সবটা করত। তবে নিয়তির লিখন তো খন্ডানো যায় না তাই উনি নেই বলে আমাকেই সবটা করতে হচ্ছে। আংকটিটা কী আমি পরাব নাকি আপনি পরাবেন।”

বাবা হাসতে হাসতে বললেন

“একজন পরালেই হলো। আমরা আমরাই তো। তবে ছেলেকে দিয়ে পরালে কেমন হয়। আপনি সম্মতি দিলে ছেলেই না হয় মেয়েকে আন্টি পরাক।”

“এ তো উত্তম প্রস্তাব। তাহলে তাই করা হোক।”

তারপর আমার শ্বাশুড়ি আংটিটা তুর্জের হাতে দিয়ে বলল-

“বাবা তুমি নিরাকে এ আংটিটা পরিয়ে দাও।”

তুর্জ আংকটিটা হাতে নিয়ে আমাকে পরাতে নিল। আমার তখন হাত কাঁপতেছিল,বুক টা ধপধপ করতে লাগল। ভালো লাগার একটা অনুভূতি জাগল। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। আমার কাঁপা হাতটা তুর্জ ধরল। তুর্জের স্পর্শ পেয়ে অনুভূতিরা যেন আকাশে ডানা মেলল। তুর্জ আমার হাতটা আরও কাছে নিল তারপর আমার হাতে আংটিটা পরিয়ে দিল।

আংকটি পরানোর পর তুর্জের মা বলল

“ওদের একটু একান্তে কথা বলতে দেওয়া উচিত।”

আমার বাবাও বলল

“হ্যাঁ তা তো দেওয়া উচিত।”

তারপর আমাকে আর ওকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো। আমি প্রথমেই রুমে ঢুকে তুর্জের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তারপর তুর্জকে বললাম

“আমাকে বিয়ে করতে আপনার আপত্তি নেই তো।”
“আপত্তি কেন থাকবে সেটা বলুন তো।”
“এই যে আমি কালো আপনার তো আপত্তি থাকতেই পারে। বউ মানুষ নাকি সুন্দর হওয়ায় ভালো।”
“সংবিধানের কোথায় লিখা আছে যে বউদের সুন্দর হতে হবে।”

তুর্জের কথাটা শুনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নীচু করে বললাম

“তা লিখা নেই। তবে এর আগে আমাকে যারা দেখতে এসেছে তারা বলেছে।”

“সবার চোখে সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটা এক না। আমার কাছে আপনি অনেক সুন্দরী। আপনার গায়ের রঙ আমার কাছে কিছু না। আপনার ঐ চোখ দুটোই আমাকে টেনে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। আচ্ছা আপনি চোখে কাজল পরেন নি কেন?”

এ প্রথম আমাকে কেউ প্রশংসা করছে। তাই অনেক আবেগী হয়ে বললাম

“মা আমাকে কাজল পরতে দেয় নি। কারণ কাজল পড়লে নাকি আমাকে কালো দেখায় তাই।”

তুর্জ আমার দিকে তাকিয়ে বলল-

” বিয়ের পর কাজল কিনে দিলে পরবেন তো।”

আমি খুশিতে আটখানা হয়ে বললাম

“পরব না কেন? আমার তো কাজল পড়তে অনেক ভালো লাগে।আপনি কিনে দিলে তো খুশি হয়ে পরব। আচ্ছা আমার গায়ের রঙ কালো এতে আপনার সমস্যা নেই তো সত্যি করে বলেন।”

“আপনি বড্ড হাস্যকর একটা প্রশ্ন করলেন”

“যেমন?”

“এই যে আপনি বললেন আমার সমস্যা আছে কি ‘না।সমস্যা থাকলে কী আর আমি বিয়ে করি। সমস্যা নেই বলেই তো বিয়েতে রাজি হয়েছি।”

উনার কথা শুনে মনের অজান্তেই চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু ছলছল করছিল। উনি আমার কাছে এসে বললেন

“আপনার ঐ চোখে জল মানায় না। কাজল মানায়। শুধু শুধু কাঁদবেন না।”

আমি চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম

“আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ এভাবে বলে নি। কারও মুখে কখনও এত প্রশংসা শুনে নি। দিনের পর দিন অযোগ্য পাত্রদের হাতেও রিজেক্ট হয়েছি বারবার। এরপর থেকে মনের সব আত্নবিশ্বাস চলে গিয়েছিল।মআজকে নতুন করে মনে হচ্ছে সে আত্নবিশ্বাস টা ফিরে পাচ্ছি। আচ্ছা আমাকে নিয়ে আপনি আপনার বন্ধুদের সামনে যেতে পারবেন?”

” অবশ্যই পারব।”

উনার সাথে কথা বলে উনার প্রতি তীব্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জন্মাল। কথা শেষে দুজনেই ড্রইং রুমে গেলাম। আমার হবু শ্বাশুড়ি বলল

” আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকলে আমার একটা চাওয়া ছিল।”

মা আর বাবা দুজনেই হাসতে হাসতে বললেন

“কী চান বলুন। এতে এত সংকোচিত হওয়ার কী আছে?”

আমার হবু শ্বাশুড়ি মৃদু একটা হাসি দিয়ে আমার থুতনির নীচে হাত দিয়ে আমার মুখটা উপরে তুলে বলল

“আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি চাচ্ছি আগামি শুক্রবারেই নিরার সাথে তুর্জের বিয়ে হোক।”

বাবা একটু আপত্তি জানিয়ে বলল

” কিন্তু তিনদিন পর বিয়ে হলে এতকিছু সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে।আয়োজন তো করতে হবে।”

তুর্জের মা বাবার তাকিয়ে অট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল

“বেয়াই সাহেব আমার এসব অণুষ্ঠান ভালো লাগে না।আমরা খুব সাদাসিধা মানুষ। তাই বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে সাড়তে চাই যদি আপনার কোন দ্বিমত না থাকে।”

পাশ থেকে মা হাসতে হাসতে বলল-

” দ্বিমত থাকবে কেন? আমাদের মেয়ে আপনাদের কাছে গিয়ে সুখে থাকলেই হবে।”

আমার শ্বাশুড়ি মাকে ভরসা দিয়ে বললেন-
” আপনার মেয়ে কি আমার মেয়ে না বেয়াইন? এসব নিয়ে একদম ভাববেন না। তাহলে ঐ কথায় রইল যে আগামি শুক্রবার বিয়ে। এর মধ্যে তো কথা হবেই।”

তারপর উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

“এই যে নিরা মা কালকে একটু সময় রেখো তুর্জ তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে।তোমার যা যা দরকার মনমতো তুমি পছন্দ করে কিনবে কেমন। এই যে এ কাগজে তোমার হবু বরের নম্বর দেওয়া আছে। সময় করে কল দিও ওকে। ও তো একটু লাজুক তোমার নম্বর নিয়েও কল দেওয়ার সাহস পায় নি। তুমিই কল দিও ওকে।”

হবু শ্বাশুড়ি মায়ের কথা শুনে বেশ লজ্জামাখা মুখে কাগজটা নিয়ে মাথায় নেড়ে বললাম

“আচ্ছা।”

তারপর উানারা দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেল। আমি দৌঁড়ে কাগজ হাতে নিয়ে তুরার কাছে আসলাম। তুরার কাছে আসতেই তুরা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

“তোর বিয়ে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলাম দোস্ত। কারণ কেউ তোর ভেতরের সৌন্দর্য টা দেখত না। আজকে এমন একটা মানুষের সাথে তোর বিয়ে হচ্ছে যে কি’না তোর ভেতরের সৌন্দর্যটা অণুভব করেছে। দোআ করি অনেক সুখী হ।”

এ বলে তুরা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমিও তুরাকে ধরে একটু কাঁদলাম। আমার কান্না দেখে তুরা হাসি দিয়ে বলল

“এই যাহ আমি তো কান্নার অভিনয় করছিলাম। আর তুই এতেই কেঁদে দিলি। এমন করলে হবে? কী যে করিস না। তোর হাতে ঐটা কিসের কাগজ দেখি।”

লজ্জায় মাথা নত করে বললাম

“তুর্জের নম্বর।”
“ওরে আমার বান্ধবী কি লজ্জা পাচ্ছে রে।”

এভাবেই তুরা আর আমার কথোপকথন হতে লাগল। কখনও দাঁড়িয়ে কখনও শুয়ে আবার কখনও বসে কথা বলতে লাগলাম। শরীর ক্লান্ত হলেও মুখ যেন বেশ সচল। এত বক বক করেও মুখে কোনো ক্লান্তি নেই, নেই কোনো জড়তা। কথা বলতে বলতে কখন যে রাত হয়ে গেল টেরেই পেলাম না। কথা মাঝে হুট করে তুরা বলে উঠল

“এবার তো উনাকে কল দে নাকি তুই ও লজ্জা পাচ্ছিস।”

আমি সত্যিই লজ্জা পাচ্ছিলাম। প্রথমে কল দিয়ে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমার দুটানা দেখে তুরা আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে তুর্জকে কল দিল। ওপাশ থেকে তুর্জ কলটা ধরে হ্যালো বলতেই তুরা বলে উঠল

“বলুন তো আমি কে?”

“আপনি কল দিয়েছেন আমি কী করে বলব আপনি কে?”

তুরা তুর্জের সাথে মজা করতে লাগল আর তুর্জ ও বাচ্চাদের মত ক্ষেপতে লাগল। এক পর্যায়ে বেশ ক্ষেপে গেল। পরিস্থিতি সামাল দিতে তুরা নিজের পরিচয় দিল।পরিচয় শুনে তুর্জ বেশ লজ্জা পেল। আমতা আমতা করতে লাগল। তুরা হালকা হেসে বলল

“থাক ভাইয়া আর লজ্জা পেতে হবে না। এবার আপনার হবু বউ এর সাথে কথা বলুন।
বলেই তোরা আমাকে ধরিয়ে দিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here