হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-১৫,১৬

0
317

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৫,১৬

১৫

স্নিগ্ধ সজীবতার নির্মল আবেশে সকালের মৃদু সূর্যের আলোর আঁচে ঘুমটা ভাঙল। যদিও সারারাত ঘুম হয়নি৷ কারণ আজকে আমার কাঙ্ক্ষিত পরিণয়। ঘরোয়া পরিবেশে বেশ শান্ত ভাবে আমাদের বিয়ে হলো। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে এক অচেনা গন্তব্যে নতুন জীবনের যাত্রাপথে রওনা হলাম।পাশেই তুর্জ বসে আছে। এরমধ্যে তুর্জের সাথে হালকা কথা বললাম। আবার একটু চুপ করে থাকলাম। এভাবেই ছয় ঘন্টার পথ পার করলাম। অবশেষে শ্বশুড় বাড়ি এসে পৌঁছালাম।

নামানো হলো আমাকে। কিন্তু আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম একটা বিষয় দেখে যে, সে বাড়ির আশে পাশে আর কোনো মানুষ নেই। সাধারণত নতুন বউ আসলে আশে পাশের মানুষ ছুটে আসে কিন্তু সে বাড়িটা খুব নিস্তব ছিল। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বরণ করে রুমে নিয়ে গিয়ে বলল

“শুনো বউমা এ বাড়িতে তুমি আমার মেয়ের মতো থাকবে।কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবে অথবা তুর্জকে বলবে।শুধু একটা আবদার যে, আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলতে যেও না। আশেপাশের লোকজন খুব খারাপ। তোমাকে উল্টা পাল্টা বলে তোমার খারাপ করে দিবে। আমরা মা মেয়েতে মিলে থাকলে হবে না?”

শ্বাশুড়ি মায়ের কথা শুনে উনার প্রতি তীব্র শ্রদ্ধা জাগল এটা ভেবে যে উনি হয়তো চাচ্ছেন না আমি কারোর হাসির পাত্র হই। আমি মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বললাম

‘আপনি পাশে থাকলে আর কিছু লাগবে না। আমরা মা মেয়েতেই হয়ে যাবে।”

আমার কথা শুনে আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বলল

“আমার মেয়ের মতো কথা বলেছ একদম। আচ্ছা তুমি তো তোমার মাকে মা বলো। তাহলে আমাকে কী বলে ডাকবে?

আমি একটু ভেবে বললাম

“আপনাকে আম্মু বলে ডাকলে কী খুশি হবেন?’

উনি এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল

“আম্মু বলে ডাকলেই খুশি হব। এবার চলো তোমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।”

বলেই আম্মু আমাকে নিয়ে নানীমার ঘরে গেলেন। নানীমার ঘরে নিয়ে গিয়ে আম্মু আমাকে ইশারা দিয়ে বললেন নানীমা কে যেন সালাম করি। আমি নানীমাকে সালাম করার জন্য এগিয়ে যেতেই নানীমা আমাকে ধরে বলল

“তুই বুঝি আমার তুর্জের বউ।বাহ! দেখতে তো ভারী মিষ্টি।সালাম করতে হবে না।”

নানীমার মুখে প্রসংশা শুনে আমার চোখের জল ছলছল করতে লাগল। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে প্রসংশা করে নি। চোখে ছলছল জল নিয়ে বললাম

‘নানীমা ঠিক বলেছেন আমি আপনার তুর্জের বউ। কেমন আছেন আপনি?”
“আর কী ভালো থাকা যাবে এখন তুই এসে গেছিস। এখন তো চাইলেও ভালো থাকা যাবে না।”

ভয়ে ভয়ে নানীমাকে জিজ্ঞেস করলাম

“কেন নানীমা আমি কী কোনো ভুল করেছি?”

আমার ভয় মাখা চেহারাটা দেখে নানীমা বলল

‘আরে বোকা ভুল করবি কেন? তুর্জ তোকে পেয়ে এখন এ বুড়িটাকে ভুলে যাবে তাই বললাম।”

নানীমার কথা শুনে একটা স্বাস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নানীমাকে বললাম

“আপনার মতো সুন্দরী রেখে তুর্জ আমাকে চাইবে না। এত অস্থির হওয়ার কিছুই নেই।”

“আহ! দেখা যাবে। খুব ভালো পাম দিতে পারিস তুই।”

পাশ থেকে আম্মু নানীমাকে বলে উঠল

” মা এবার বকবক থামাও। ওকে তুর্জের রুমে দিয়ে আসতে হবে। আর কিছু বলার থাকলে বলে দিও।”

নানীমা আম্মুকে বলল

“আরে তুই বলে দে। এখন তো আধুনিক যুগ। শ্বাশুড়িরা বান্ধবীর মতোই। যা বলার তুই বলে দিস।”

আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বলল-

“বউমা চলো আমার সাথে। একটু কথা বলব। তারপর তুর্জের রুমে দিয়ে আসব। এখানে বসে থাকলে মা তোমার মাথা খাবে কথা বলতে বলতে। পরে কথা বলো মায়ের সাথে।”

আমি শান্তভাবে নানীমাকে বিদায় জানিয়ে আম্মুর রুমে গেলাম। তবে ভয় লাগছিল এটা ভেবে যে না জানি আম্মু কী বলে। আম্মুর রুমে যাওয়ার পর আম্মু বলল

“শুনো মা সরাসরিই একটা কথা বলি আমার একটা নাতির শখ। তুমি কোনো ঔষধ খেও না। আমি চাচ্ছি তোমাদের কোল জুড়ে খুব তাড়াতাড়ি সন্তান আসুক।

মায়ের কথা শুনে লজ্জা মাখা মুখে মাকে বললাম

“আপনি চিন্তা করবেন না। যেভাবে বলবেন সেভাবেই চলব।”

এবলে লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললাম। এরপর আম্মু আমাকে তুর্জের রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বলল

“তুমি এখানে বসো।আমি তুর্জকে পাঠাচ্ছি। আর ঐ টেবিলে দুধ রাখা আছে তুর্জকে দিও।”

লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নেড়ে বললাম আচ্ছা। আম্মু চলে গেল। আর আমি তুর্জের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।মিনেট পনেরো পর তুর্জ আসলো।তুর্জ আসার সাথে সাথে আম্মুর কথা মতো তুর্জের জন্য টেবিলের উপর থেকে দুধের গ্লাসটা হাতে নিলাম। তারপর তুর্জের কাছে গেলাম। তবে বিপত্তি ঘটল যে আমি দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে তুর্জকে কীভাবে সালাম করব এটা ভেবে। কোনো উপায় না পেয়ে ভাবলাম দুধটা আবার টেবিলের উপর রেখে আসি তারপর সালাম করে দুধটা তুর্জকে দিব। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমি দুধের গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে যেতে নিলাম এসময় তু্র্জ আমার শাড়ির আঁচল ধরে টেনে বলল

“কী ব্যপার চলে যাচ্ছ যে?”

“নাহ মানে দুধের গ্লাসটা রেখে আপনাকে সালাম করব তো তাই।”

“আরে বোকা সালাম করতে হবে না। দাও দুধের গ্লাসটা আমি খেয়ে নিচ্ছি।”

লাজুক মুখে নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললাম

“নিন।”

তুর্জ আমার কথা শুনে রাগ গলায় বলে উঠল

“আমাকে কী তুমি বলা যায় না? এখনও আপনিতে পড়ে আছ যে?”
” নাহ মানে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি দুধটা খান।”
“আবার আপনি? এবার কিন্তু রাগ হচ্ছে খুব।”
“সরি তুমি।”
” এইতো গুড গার্ল”

তুর্জ দুধটা খাওয়া শেষে আমাকে হুট করে কোলে তুলে নিল।আমি ভয়ে উনার গলায় জড়িয়ে ধরে বললাম

“কী করছ কি? পরে যাব তো।”
“আমার উপর কি তোমার ভরসা নেই।”
“তা তো আছেই।”

এ বলে আমি উনার ঘাড়ে দু হাত আড়ষ্ঠ করে পেঁচিয়ে আরও শক্ত করে ধরলাম। উনি আস্তে করে আমাকে বিছানায় শুয়াল। ভালোবাসার গভীর সাগরে নিমজ্জিত হলাম দুজনে। আবেগের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম।ভালোবাসার উত্তাল ঢেউ যেন সব তছনছ করে দিয়ে শান্ত হয়ে গেল। শীতলতার অনুভুতিটা যেন সারা শরীরে শিহরণ দিল। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠে দেখলাম আমার এলো মেলো কুকরা চুলগুলো উনার বুকের উপর বিছিয়ে আছে। আমি উঠতে নিলাম উনি আমাকে শক্ত করে ধরে বলল

“আরেকটু শুয়ে থাকো”

লজ্জায় কিছুই বলতে পারছিলাম না। চুপ করে উনার হার্টিবিটের স্পন্দনটা শুনার চেষ্টা করলাম।

কিছুক্ষণ পর মা দরজায় নক করে বলল

“নিরা মা ফ্রেশ হয়ে তুর্জকে নিয়ে খেতে আসো।”

আমি মায়ের ডাক শুনে উনার কানের কাছে গিয়ে বললাম

“এবার তো আমাকে ছাড়ো। মা ডাকছে।”

উনি আমার কাপলে আলতো চুমু দিয়ে বলল

“যাও ফ্রেশ হও।”

আমি উঠে ওয়াশ রুমে গেলাম। নিজেকে ফ্রেশ করে ওয়াশ রুম থকে বের হয়ে খেয়াল করলাম তুর্জ ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে।তুর্জ আমাকে দেখে বলল

“তোমার মা কল দিয়েছিল। আমি ধরে কথা বলেছি। তুমি কল দিয়ে কথা বলে নিও।”

এ বলে তু্র্জ খাবার রুমে গেল। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে মাকে কল দিলাম। ওপাশ থেকে মা উৎসুক কণ্ঠে বললেন

“কী রে মা কেমন আছিস?”
“হ্যাঁ মা অনেক ভালো আছি। ওরা যে এত ভালো মা, আমি না আসলে বুঝতে পারতাম না। অনেক আদর করছে আমায়।কোন কষ্ট হচ্ছে না মা।”

মা স্বস্তিভরা কন্ঠে বলল

“মারে তোর কথা শুনে শান্তি পেলাম। কত চিন্তা ছিল তোরে নিয়ে আজকে তোর কথা শুনে সব দূর হলো। কাল পরশু তোর বাবা আসবে তোকে দেখতে।”

” মা তুমিও আসবে কিন্তু।”
“সে দেখা যাবে। এখন রাখলাম। শ্বাশুড়ির সাথে একটু কাজকর্ম করিস।”

মা ফোনটা রেখে দিল। খেয়াল করলাম তুরার দুইটা মিসকল তাই তুরাকে কল দিলাম। তুরাকে কল দেওয়ার সাথে সাথে তুরা কলটা ধরে বলে উঠল

“তা কেমন কাটল বাসর?”

লজ্জা মাখা মুখে বললাম

“অনেক ভালো।”
“তা কেমন আছিস সেটা বল ঐখানের মানুষ কেমন?”
“অনেক ভালো।”

তুরার সাথে কথা বলতে বলতে আম্মু ডাক দিল

“নিরা তাড়াতাড়ি আসো। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

আম্মুর ডাক শুনে তুরাকে বললাম
“আম্মু খাওয়ার জন্য ডাকছে পরে কথা হবে রাখলাম।”

মাথার তোয়ালে টা খুলে চুল গুলো মুছে বারান্দায় তোয়ালে টা নাড়তে গেলাম। বারান্দায় তোয়ালে নাড়ার সময় পাশের বাসার এক মহিলা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

“তুমি কী এ বাসায় কাজ করতে এসেছ?”

আমি একটু কষ্ট পেলাম এমন কথা শুনে। কষ্টমাখা মুখে জাবাব দিলাম

“না কাজ করতে আসি নি। আমি তুর্জের বউ। ”

মহিলাটা কথাটা শুনে বিস্ময় হয়ে বলল

“মনে কিছু নিও না ওভাবে বলা তোমাকে ঠিক হয়নি। কিন্তু তুর্জ আবার বিয়ে করেছে? পারেও তারা। যেমন মা তেমন ছেলে।”

মহিলার কথা শুনে অবাক হলাম এটা ভেবে যে, আবার বিয়ে করেছে এটার মানে কি? আমি মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিব এর মধ্যে আম্মু আবার ডাকতে লাগল খাওয়ার জন্য।নআম্মুর ডাকে সাড়া দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম মহিলা আর পাশের বারান্দায় নেই।

আমি ভাবনার একটা দেয়ালে আটকা পড়ে খাবার রুমে গেলাম। খেয়াল করলাম মা অনেক কিছু রান্না করে রেখেছে।মা আমাকে আদর করে খাওয়াতে লাগল। মহিলার কথাটা এত সুখের মাঝে বেমালুম ভুলে গেলাম। পরদিন সকালে বাবা, মা আসলো। রাতে মা আমাকে কাছে নিয়ে বলল

“কী রে এ বাড়িতে কী আশে পাশের কেউ আসে না?

“আরে মা আশেপাশের মানুষ দিয়ে কী করবে? আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করত। তাই হয়তো আম্মু না করে দিয়েছে।”

মা হাসতে হাসতে বলল
“কপাল করে এমন শ্বাশুড়ি পেয়েছিস।’
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম-
“একদম ঠিক কথা বলেছ।”

সজীবতার স্নিগ্ধ পরশ নিয়ে নতুন সকালের সূচণা হলো। নাস্তা খেয়ে মা বাবা চলে গেল। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু শ্বাশুড়ি মা দিল না। বলল পরে উনি নিয়ে যাবেন।তাই মা বাবাও জোর করল না। ভালোই যাচ্ছিল আমার সংসার বেশ আদরেই কাটল দুমাস। এত গ্লানি পার হয়ে আমার বিয়ে হয়। দুমাসের ভালোবাসায় সকল গ্লানি যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে।

দিনটা বেশ সজীব৷ জরাজীর্ণতা কাটিয়ে যেন সজীবতায় সেজেছে চারপাশ। তেমনি আমার আমিতে কারও বসবাসের খবরটা জানতে পারলাম। জানতে পারলাম আমার মধ্যে বেড়ে চলেছে ছোট্ট একটা প্রাণ। জানার পর কতটা যে খুশি হয়েছি লিখে বর্ণনা করা সম্ভব না। সন্ধ্যায় তুর্জ অফিস থেকে আসার সাথে সাথে আমি তুর্জকে জড়িয়ে ধরলাম।

“একটা কথা বলার ছিল। কীভাবে যে বলি?”

ইতস্ততা টের পয়ে তুর্জ আরেকটু জোরে জড়িয়ে ধরে বলল

“আমার বউটা আজকে এত খুশি কেন? কী হয়েছে শুনি?”

“আমি কী জন্য খুশি সেটা জানার পর তুমিও খুশি হয়ে যাবে।”
“তা বলো শুনি কী হয়েছে?”
“তুমি মা‌! উফ! না আমি মা আর তুমি বাবা হতে যাচ্ছ।”

তুর্জের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে খুশির আমেজ। আমার কানের কাছে মুখটা এনে বলল

“এখন কী বাংলা সিনেমার মতো তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরাব?”

মৃদু হেসে লজ্জা অবনত মাথায় জবাব দিলাম

“কী যে বলো না তুমি সবসময় এমন মজা করো। বাচ্চার বাবা হচ্ছ, এখনও বাচ্চামি করলে হবে?”

” হয়েছে এত পাকামি করতে হবে না। খবরটা মাকে দিয়ে এসো আগে।”

“আমি পারব না আমার লজ্জা লাগে তুমি দিয়ে এসো”

“আমার সাথে মায়ের রুমে চলো, দুজন একসাথে খবরটা দেই। তাহলে মা খুশি হয়ে যাবে। ”

তুর্জ আমাকে নিয়ে মায়ের রুমে গিয়ে আম্মুকে ডেকে বলল

“মা তোমাকে একটা খুশির খবর দেওয়ার ছিল।”

মা আমার মুখের দিকে প্রথমে তাকাল তারপর বলল

“নিরার মুখের দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পেরেছি তুই কী বলবি। এটাই তো বলবি যে, আমি দাদীমা হতে চলেছি। কী গো নিরা মা ঠিক বলে নি?”

আমি লজ্জায় মাথাটা আরও নীচু করে ফেললাম। মা আমার থুতনিটা ধরে উপরে তুলে বলল

“এত লজ্জা পেলে চলবে? এখন থেকে আমি যেভাবে বলি সেভাবে চলবে। আর তুর্জ বাসার বাইরে কম থাকবি।বউমাকে সময় দিবি বেশি। আমার কথা মতো চলতে হবে কিন্তু।”

আমি হাসতে হাসতে বললাম

“আপনি যা বলবেন তাই হবে।”

উনি আমার আমার মাথায় আলতো স্পর্শ করে বলল

“তোমার মাকে কি খুশির খবর টা দিয়েছ?”

আমি মাথা নেড়ে না বললাম। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

“আমি জানাচ্ছি। তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

কথাশেষে আমি আম্মুর রুম থেকে তুর্জকে নিয়ে চলে আসলাম।তুর্জ বাথরূমে গোসল করতে ঢুকল এর মধ্যে মা কল দিল। মায়ের কলটা ধরার সাথে সাথে মা ওপাশ থেকে বলে উঠল

“কী রে তোর শ্বাশুড়ি যে খুশির সংবাদটা দিয়েছে তা কি সত্যি? আমি নাকি নানীমা হতে যাচ্ছি?”

” হ্যাঁ মা সত্যি।”

“শুন এসময় কোনো চিন্তা করবি না। ভালো মন্দ খাবি। আর তোর শ্বাশুড়ি কে বলেছিলাম তোকে নিয়ে আসতে। তোর শ্বাশুড়ি বলল উনার নাতি উনার বাসায় হবে। তাই আমি আর বাড়াবাড়ি করিনি।”

“আরে মা চিন্তা করো না উনি আমার অনেক যত্ন নেন। তুমি শুধু শুধু এসব ভাবছ, কপাল গুণে এমন শ্বাশুড়ি পেয়েছি।’

মা স্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল

‘তা একদম ঠিক বলেছিস। আচ্ছা আমি রাখলাম তোর বাবাকে খবরটা দেই।”

বলতে বলতেই মা ফোনটা রেখে দিল। আমি তুরাকে একটা কল দিলাম। ও কে কিছু না জানালে আমার পেটের ভাত হজম হয় না। তুরাকে কল দেওয়ার সাথে সাথে সে কল ধরতেই হালকা চেঁচিয়ে বললাম

‘তুই খালা মনি হতে যাচ্ছিস।”

তুরা একটা জোরে চিল্লানি দিয়ে বলল

“আমার পরে বিয়ে করে আমার আগে খুশির সংবাদ দিলি।ওরে নিরা তুই সেই উইকেট ফেলছিস।”

“আরে ধুর কী যে বলিস না তুই।”

“হাহা…. ভালো থাকিস আর নিজের যত্ন নিস। সাবধানে চলিস।”

“আচ্ছা আচ্ছা সব ঠিকঠাক করে করব। এবার ফোনটা রাখি। মাথা খারাপ করিস না আর। পারিস ও এত বকবক করতে”

“হাহাহা….আচ্ছা.।”

বেশ সুখেই যাচ্ছিল আমার সময়। আম্মু আমাকে নিজের মেয়ের মতো যত্ন করতে লাগল। আমার মতো মেয়ে এতটা ভালোবাসা আর সম্মান পাবে কখনও বুঝেনি।নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছে এমন একটা পরিবারে বিয়ে হওয়ার পর। আজকে বেশ তেঁতুল খেতে মন চাচ্ছে তাই তেঁতুল হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে খাচ্ছিলাম।মএর মধ্যে আবার সেই মহিলা বারান্দায় আসলো। সেই মহিলাকে দেখেই আমার আগের কথা মনে হয়ে গেল। মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলমা

“ঐদিন আপনি কী বলেছিলেন আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি।তুর্জ আবার বিয়ে করেছে মানে কী?”

মহিলা গলার আওয়াজ টা একটু নীচু করে জবাব দিল

“আরে মেয়ে আস্তে কথা বলো তোমার শ্বাশুড়ি যদি দেখে আমাদের সাথে কথা বলছো তোমার বারোটা টা বাজাবে।আগে তুমি তোমার রুমের দরজা নক করে আসো, না হয় কখন তোমার শ্বাশুড়ি রুমে ঢুকে যাবে খেয়াল থাকবে না।আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।”

মহিলার কথা শুনে একটু রহস্যময় লাগছিল। আমি দৌঁড়ে আমার রুমের দরজা লাগিয়ে বারান্দায় এসে বললাম

“এবার বলুন কী হয়েছে?”

মহিলা এরপর যা বলল তা শুনে আমার ভেতরটা কেঁপে গেল। এরকম কিছু শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

“শুনো মেয়ে তুমি করেই বললাম। কারণ তুমি আমার ছোটো হবে। সময় থাকতে এ বাড়ি থেকে চলে যাও।”

“কেন চলে যাব? কী হয়েছে?”

“এটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি। কেউ এ বাড়ির আশে পাশে যায় না। তোমার আগে তুর্জ তিনটা বিয়ে করেছিল। আর প্রতিটা বউ এর মৃত্যু ঘটে গর্ভবতী হওয়ার পাঁচ মাস সময়ে। আর তুর্জ এত সুন্দর ছেলে হয়েও কেন জানি অন্যরকম মেয়ে বিয়ে করত। এর মানে বুঝলাম না এখনও?”

” অন্যরকম মেয়ে মানে?”

“প্রথম বিয়ে করেছিল মেয়ের চোখে কম দেখত। দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল মেয়ের বাবা গরীব অনেক। তৃতীয় বিয়ে করেছিল মেয়ের কথায় জড়তা ছিল। আর তুমি তো অনেক কালো।প্রতিবারেই বাচ্চা হওয়ার পাঁচ মাসের সময় কেন বউরা মরে সেটা আজও বুঝলাম না। আর উনাদের তো এত টাকা পয়সা ছিল না প্রথম বউ মারা যাওয়ার পর এত টাকা পয়সা হয়েছে। তুমি এ অসময়ে তেঁতুল খাচ্ছ যে তার মানে তুমিও গর্ভবতী। যাইহোক সাবধানে থেক। আমার বলার দরকার ছিল বললাম। এটা আবার তোমার শ্বাশুড়ি কে জিজ্ঞেস করো না।”

কথাটা বলে মহিলা চলে গেল। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম মহিলার কথা কি সত্যি নাকি মিথ্যা?এ বাড়িতে এসে কখনও খারাপ কিছু পাই নি। তবে একটা মহিলা শুধু শুধু এত মিথ্যা কেন বলবে? এটা বলে উনার তো কোনো লাভ নেই। আর সত্যিই তো এ বাড়িতে কেউ আসে না। আমি কী করব বুঝতে না পেরে তুরাকে কল দিয়ে সবটা জানালাম। তুরা বরাবরেই খুব বিচক্ষণ মেয়ে ছিল। তাই সে সবটা শুনার পর বলল

“দোস্ত আমার কাছে ব্যপার রহস্যময় লাগছে। এ আধুনিক যুগে অভিশাপ বলে এগুলো উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। মহিলার কথা সত্যি হলে এর পিছনে গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।আমাকে অনুমতি দিলে তোর শ্বাশুড় বাড়ি এসে ব্যপারটা খুঁজ নিতে পারি। এমন ভাবে নিতে হবে যেন কেউ টের না পাই।”

“অনুমতির কী আছে তুই কালকে চলে আয়। আমি মাকে বুঝাব নে। তবে এত ভালো মানুষের খারাপ দিক থাকতে পারে এটা ভাবতেই যেন কষ্ট লাগছে।”

“আরে বোকা আগে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে দে। আর একদম চুপ করে থাকবি। ওদের সাথে না জেনে এ ব্যাপারে কথা বলবি না। যদি ব্যাপারটা মিথ্যা হয় তাহলে ওরা কষ্ট পাবে।আর যদি বিষয়টা সত্যি হয় তাহলে রহস্য তো বের করতে হবেই। আমি কালকে চলে আসব বুঝছিস?”

আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিলাম।সারাদিনটা এসব চিন্তার মধ্যে গেল। খেতে ইচ্ছে করছিল না তবুও আম্মু জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে বলল

“আরে এসময় না খেলে চলবে?”

বলেই জোর করে খাইয়ে দিল। এমন মানুষ গুলোর খারাপ দিক আছে আমি ভাবতেই পারছি না। নাহ ঐ মহিলা হয়তো মিথ্যা বলেছে। একবার কী জিজ্ঞেস করব আম্মুকে, নাহ তুরা না করেছে কিছু বলার জন্য। তাই আমি শুধু মাকে বললাম

” মা তুরাকে কিছুদিন এর জন্য আপনাকে না জিজ্ঞেস করেই আসতে বলেছি। ওর সাথে সময় কাটালে একটু মন ভালো থাকবে তাই।”

“আসতে বলেছ ভালো করেছ। তোমার যা ভালো লাগে করো। এবার যাও বিশ্রাম নাও।”

আমি মায়ের কথায় বিশ্রাম নিতে রুমে আসলাম। তবে আমার চিন্তা পড়ে রইল সেই মহিলার কথার মধ্যে। রাতে তুর্জ আসলো। খুব বেশি কথা বললাম না। তুর্জ আমার নীরবতা দেখে জিজ্ঞেস করল

” কী ব্যপার আমার বউ এর কী হয়েছে? আজকে এত চুপচাপ কেন?”

তুর্জের কথা শুনে ভাবতে লাগলাম এমন ভালো মানুষ আমাকে ঠকাতে পারে বলে মনে হয় না।নএকবার কী তুর্জকে জিজ্ঞেস করব! নাহ থাক আগে তুরা আসুক। আমি তুর্জকে বললাম-

” নাহ একটু শরীর দুর্বল লাগছে তো তাই।”

তুর্জ আমার পাশে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

“এ সময় নাকি একটু এমনি লাগে। তুমি একটু চুপ করে শুয়ে থাকো।”
” হুম”

সারারাত ছটফট করতে করতে গেল। তুর্জের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনোভাবে মনে হচ্ছিল না যে তুর্জ এমন করতে পারে। প্রতিদিনের মতোই অজশ্র ভালোবাসায় সকালটা শুরু হলো। শ্বশুড় বাড়িতে এত আদর পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার ছিল। তবুও মহিলার কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। আর বিয়ের প্রথম দিন থেকে মা আমাকে কারও সাথে মিশতে দিত না। তাহলে কী এ কারণে মিশতে দিত না? এসব কথা মাথায় বাজতে লাগল। তুরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। হুট করে বিকেল দিকে কলিং বেলের শব্দ পেলাম আম্মু গিয়ে দরজা খুলল। তুরার কন্ঠ শুনে দৌঁড়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম তুরা আম্মুকে জিজ্ঞেস করছে

” আন্টি কেমন আছেন?”
” হ্যাঁ ভালো আছি তুমি?”
“ভালো আছি আন্টি।”
“যাও ভেতরে নিরা আছে।”

কথাটা বলে পাশ ফিরে তাকিয়ে আম্মু আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন

“অহ! এই যে নিরা চলে এসেছে। নিরা তুরাকে নিয়ে ভেতরে যাও।। আর ওকে ফ্রেশ হওয়ার পর টেবিলে শরবত রাখা আছে দিও। আমি একটু নাস্তা বানাই কেমন?”

জাবাবে বললাম

“আচ্ছা আম্মু।”

এরপর তোরাকে আমার রুমে নিয়ে এসে বললাম

“আমার খুব অশান্তি হচ্ছিল তোর এত দেরি হল কেন? সে কখন রওনা দিয়েছিস।”

” কারণ আছে। আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসছি। এসে তোকে সবটা বলছি। তুই একটু নিজেকে প্রস্তুত রাখ।”

“কেন কোনো কিছু কি হয়েছে? আমাকে বল দয়াকরে। আগে বলে তারপর যা।”

“আরে বোকা এত অস্থির হলে চলবে নাকি? একটু স্থির হ।অসময়ে এ অস্থিরতা অনেক বিপদে ফেলে।”

আমি তুরার কথা শুনে নিজেকে স্থির করে বললাম

“আচ্ছা ঠিক আছে তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।”

খানিকক্ষণ পর তুরা ফ্রেশ হয়ে আসার পর শরবত এনে দিলাম। তুরা শরবতটা খেতে খেতেই আম্মু তুরার জন্য নাস্তা এনে বলল

” রুমেই নিয়ে আসলাম। ভাবলাম নিরার সাথে কথা বলতে বলতে খাও। কিছু মনে করো না।”

” কিছুই মনে করে নি।বরং আরও খুশি হয়েছি।”

“আচ্ছা মা তুমি খাও আমি গেলাম।”

“আচ্ছা যান আন্টি।”

আম্মু চলে গেল আর তুরা নাস্তা খেতে খেতে বলল

“একটা বিষয় আমি আসার সময় জেনে এসেছি।”

“কী জেনে এসেছিস বল?’

“তুর্জের আগের বিয়ের বিষয়টা। আচ্ছা দরজাটা খুলা রেখে কথা বলা সমস্যা। কেউ এসে শুনে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। দরজা লক করলে কি কেউ কিছু বলবে?”

“আরে না কেউ কিছু বলবে না। দাঁড়া লক করে আসি।”

তুরা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল

“তোর এ শরীর নিয়ে বারবার উঠতে হবে না।তুই বস আমিই লক করে আসছি।”

তুরা হনহন করে দ্রূত পায়ে হেঁটে দরজাটা দ্রূত লক করে আমার পাশে এসে বসলো। কয়েকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আবারও নাস্তা খাওয়ায় মন দিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here