হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-৬

0
357

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬

বাইরে থেকে বেলকনি দিয়ে মৃদু বাতাস বয়ে আসছে। ঘরটা বেশ শীতল। ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছি আমি৷ কানে হালকা আওয়াজ আসল। কেউ একজন ডেকে বলছে

“কী গো উঠবে না? উঠে দুপুরের খাবার খাও। না খেতে খেতে তো শরীর অবস্থা খারাপ করে দিয়েছ। এভাবে মরার মতো পড়ে থাকলে হবে?”

ঘুম ঘুম চোখে কন্ঠটা চেনার চেষ্টা করলাম। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম খালা ডাকছে। কিন্তু চোখে ঘুমের এত তীব্রতা ছিল যে তাকাতে পারছিলাম না। বরাবরের মতো ব্যথার ট্যাবলেট খাওয়ার পর আমার তীব্র ঘুম হলো। এ ঘুমের জগৎ থেকে বের হয়ে আসতে মন চাচ্ছিল না। তাকাতে চাইলেও তাকাতে পারছিলাম না। তবে খালা অনবরত ডেকেই যাচ্ছিল। আমি খালার ডাকে শরীরের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে চোখ দুটো খুললাম। চোখ খুলেই খালার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখলাম। খালার হাসি মাখা মুখটা দেখে মায়ের কথা মনে পড়ল। মা ও ঠিক এমন করে খাবারের জন্য ডাকত। খালার দিকে তাকিয়ে ওষ্ঠ যুগল প্রসারিত করলাম। নেতিয়ে পড়া শরীরটা আরও নেতিয়ে যাচ্ছে। নিস্তেজ কণ্ঠে উত্তর দিলাম

” হ্যাঁ, খালা উঠতেছি। ব্যথার ঔষধ টা খাওয়ার পর কড়া ঘুম হলো। তাই ইচ্ছা করলেও উঠতে পারছিলাম না। আমি এক্ষুণি উঠছি।”

“সব সেড়ে যাবে। এখন উঠে খাও। তারপর আবার ঘুমিও। না খেলে শরীর আরও দুর্বল হয়ে যাবে।”

আমিও খালার কথায় উঠতে নিলাম। কিন্তু ঘুমের তীব্রতায় শরীরটা এত দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে উঠার শক্তি পাচ্ছিলাম না। উঠতে নিলেই মাথাটা চক্কর দিতেছিল আর শরীর অবশ অবশ লাগতেছিল। খালাকে ঘুম ঘুম চোখে বললাম

“খালা উঠার শক্তি পাচ্ছি না।”

“দাঁড়াও আমি ধরে বসাই। তারপর ভাত এনে খাইয়ে দিচ্ছি। ভাত খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

এই বলে খলা আমাকে দুহাত ধরে তুলল। আমি ঘুম ঘুম চোখ নিয়েই খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর খালা প্লেট ভর্তি ভাত নিয়ে আসলো। আর আমার মুখে লোকমা তুলে দিতে লাগল এবং বলতে লাগল

“না খেয়ে নিজের কী অবস্থা করেছ দেখেছো? সবসময় বেশি বেশি করে খাবে। শরীরের যত্ন নিবে। শরীর সুস্থ থাকলে মনও সুস্থ থাকে।”

খালার কথাগুলো শুনে মায়ের কথা বেশি মনে পড়ছিল। তবুও কিছু করার নেই । কারণ মাকে কল দিতে পারব না। কল দিলে পরিস্থিতি বিপরীত নিবে। তবে খালা আসার পর একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম। নিলয়ের পরিবর্তনটাতে যদিও সন্দেহ আছে তবে খালার ভালোবাসাতে কোনোমসন্দেহ নেই। খেতে খেতে খালাকে বললাম

“খালা নিলয় কোথায়?”

“মিস করতেছ নাকি?”

আমি শুধু খালার কথা শুনে একটু মৃদু হাসলাম। খলা আমার হাসি দেখে বলল

” আমি তোমার মায়ের মতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। নিলয় একটু বাইরে গিয়েছে।”

এর মধ্যে খালা খাওয়ানো শেষ করে পুনরায় বলল

“এখন ঘুমাও আরাম করে।”

আমার চোখে এত ঘুম ছিল যে, আমি আবারও ঘুমের নেশায় মাতাল হয়ে গেলাম। তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।

ঘুমের মধ্যে হুট করে কারও স্পর্শ করলাম।
স্পর্শটা পেয়ে আমি ভয় নিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়লাম। খেয়াল করলাম নিলয় পাশে বসে আছে । অহ! তার মানে নিলয় ছিল। আমার বেড়ে উঠা হার্টবিটটা নিলয়কে দেখে স্মিত হলো। নিলয় আমাকে এভাবে চমকে উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করল

“কি ব্যাপার ভয় পেয়ে গেলে নাকি?”

“হঠাৎ করে এভাবে স্পর্শ করেছ ভাবলাম কে না কে?”

নিলয় অট্টহাসি দিল। ওর এ হাসিতে ভীষণ মায়া জড়িয়ে আছে। এর আগে নিলয়কে হাসলেও হিংস্র লাগত। আজকে নিলয়ের এ হাসিতে কেন জানি না নিলয়কে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে।

“বোকা মেয়ে এ বসায় আর কে আসবে?আমি, তুমি খালা ছাড়া এ বাসায় কেউ নেই। যাইহোক ঘুম কেমন হলো বলো।”

আমি মুখে হাই তুলতে তুলতে বললাম

“আজকে ঘুম অনেক ভালো হয়েছে।”

“আর পিঠের ব্যাথাটা কমেছে তো?”

আমি নিলয়ের দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এ নিলয় কী সে নিলয় যে নিলয় আমাকে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে অত্যাচার করেছে নাকি এটা অন্য কোনো নিলয়। আমার অপলক চাহুনি দেখে নিলয় একটা অপ্রস্তত কাশি দিয়ে বলল

” কী ব্যপার এভাবে চেয়ে আছ যে, ব্যথাটা কমেছে কি’না জিজ্ঞেস করতেছিলাম।”

“হ্যাঁ ব্যথাটা কমেছে।”

নিলয় আমার পিঠের কাপড় টা আবার তুলে পুনরায় মলম লাগিয়ে দিল। এখন মলম লাগানোর সময়েও এত ব্যথা হলো না। ঔষধ টা খাওয়ার পর ব্যথাটা অনেক কমে গিয়েছিল।মলম লাগানোর শেষে নিলয় বলল

“আজকে অনেক ঘুমিয়েছ। এবার উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করো। না হয় শরীর বেশি দুর্বল লাগবে।”

নিলয় যতবারই ভালোভাবে কথা বলছিল ততবারই নিলয়কে আমার বেশ অপরিচিত লাগছিল। তার উপর বাসা পরিবর্তনের বিষয়টাও বেশ গোলমেলে লাগছিল। তবুও কিছু করার ছিল না কারণ যা হচ্ছিল তা জানার কোনো উপায় ছিল না।নিলয়ের কথায় হালকা হাঁটাহাঁটি করে ড্রইং রুমে বসলাম।খালা আমার পাশে বসে বলল

“কী গো মা এখন কেমন লাগছে?”

“এখন অনেক ভালো লাগছে।”

খালা হাসতে হাসতে বলল-

“শরীর ভালো হলে কিন্তু আমাকে সব কাজে সাহায্য করবে। আর নিলয় ও কিছুদিনের জন্য বাইরে থাকবে।বসায় শুধু তুমি আর আমি।”

নিলয় বাইরে যাবে শুনেই একটা অজানা ভয় বুকে চিলিক দিয়ে উঠল। আমি নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম-

“তুমি কোথায় যাবে?”

নিলয় আমার দিকে তাকিয়ে যখনই বলতে নিল আমি… ঠিক তখনই খালা নিলয়ের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল

“নিলয় রিহ্যাবে যাবে। রিহ্যাবে গেলে নিলয় নেশাটা ছাড়তে পারবে। তাই নিলয় তিনমাসের জন্য রিহ্যাবে যাবে।”

খালার মুখে এমন কথা শুনে সেদিন আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বুঝানোর ভাষা আমার নেই। কারণ আমার কাছে সবসময় মনে হত নিলয় নেশা করে বলেই নিলয়ের হিতাহিত জ্ঞান কাজে করে না। আর সেজন্য নিলয় আমার সাথে এমন করে। আর এখন নিলয় রিহ্যাবে গিয়ে কোনোরকমে নেশা ছাড়তে পারলে আমার সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বিয়েটা যে করেই হোক না কেন মেনে নিয়েছিলাম। এত কষ্ট দেওয়ার পরও আমি কেমন করে যেন নিলয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে মেয়েরা কারও কাছে হাজার বার আঘাত পেলেও সামান্য ভালোবাসায় গলে যায়।

“মেয়েরা খুব মায়াবী হয়। তাদের ভালোবাসা জড়ানো মন বাচ্চাদের মত মায়া মাখা।তারা একটু ভালেবাসায় গলে টইটুম্বুর হয়ে যায়”

আবেগ জড়িত কন্ঠে নিলয়কে জাবাব দিলাম

” এটা তো উত্তম সিদ্ধান্ত। তোমার যতদিন লাগে তুমি থেকে আসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”

নিলয় ভরসা দিয়ে বলল

“সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শুধু এ বাসায় খাবে ঘুমাবে আর খালার সাথে গল্প করবে। তিন মাস পরে আমরা নতুন ভাবে সংসার শুরু করব।”

ঐদিন নিলয়ের এরকম কথা শুনে অনেক শান্তি লেগেছিল। আমি একটা পরম শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এমতাবস্থায় খালা বলল

“আমি খাবার নিয়ে আসছি। সবাই একসাথে খাব।”

এ বলে খালা রান্না ঘরের দিকে রওনা দিল। খানিকক্ষণ পর খালা দুই হাতে দুইটা প্লেট নিয়ে আসলো। আমি খালার হাত থেকে দুইটা প্লেট নিয়ে টি টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করলাম

” খালা এখানে নিয়ে আসলেন যে খাবার।”

“ভাবলাম টেবিলে না বসে এখানে সবাই টেলিভিশন দেখতে দেখতে খাই। আচ্ছা দাঁড়াও আমি বাকি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে আসি।”

খালাকে আটকে দিয়ে বললাম

“খালা আমি নিয়ে আসি আপনি বসেন।”

খালা রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-

” তোমার শরীর ভালো না আর তুমি কাজ করবে? চুপ করে এখানে বসো। কাজ করার সময় তো চলে যায় নি।সামনে অনেক সময় আছে তখন কাজ করো। এখন নিজেকে একটু সময় দাও বিশ্রাম করো।”

খালা এমন ভাবে বলল আমি একদম বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লাম। তারপর খালা পুনরায় খাবার আনতে গেল। অতঃপর সব আনা শেষ হলে আমরা সবাই একসাথে খেতে বসি। সেদিন ছিল আমার বিয়ের পর কাটানো সবচেয়ে ভালো দিন। সেদিন খুব গল্প করে খাওয়া পর্ব শেষ করে যে যার রুমে গেলাম।

কিন্তু আমি রুমে যেতেই মাথাটা একটু ঘুরাতে লাগল।নিলয় আমাকে ধরে খাটে বসাল। তারপর হাতে এক গ্লাস দুধ ধরিয়ে দিয়ে বলল

“এটা খেয়ে শেষ করো।”

আমার তখন দুধ খেতে একদম ইচ্ছা করছিল না।অনেক গা গুলাচ্ছিল। আমি নিলয়কে নাক ছিটকাতে ছিটকাতে বললাম

“আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।”

নিলয় আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল”

” কালকে তো রিহ্যাব এ চলে যাব। তিনমাস আর কথা হবে না। দেখা হবে না। আজকে না হয় আমার হাতে দুধটা জোর করে খেলে। না হয় মন খারাপ লাগবে আমার। আর তোমার শরীর দুর্বল তাই মাথা ঘুরছে। দুধটা খেলে শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে।”

নিলয়ের এহেম কথায় আমি পুনরায় গলে গেলাম। হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে চট করে খেয়ে ফেললাম। দুধটা খেয়ে নিলয়কে বললাম

“আচ্ছা কথাও কি হবে না?”

নিলয় মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল-

“কথা হবে। তবে খালার ফোনে কল দিব।তোমাকে আলাদা ফোন দিয়ে গেলে তুমি আবার তোমার মা,বাবাকে কল দিবে। এত অনিশ্চয়তার মধ্যে তোমাকে রেখে যেতে পারব না। খালার ফোনে কল দিলেই তোমার সাথে কথা হবে।”

নিলয়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তাই শান্তভাবে মেনে নিলাম। এদিকে আর কথা বলার কোনো শক্তি পাচ্ছিলাম না। ঘুমে চোখটা একদম বুজে যাচ্ছিল। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে কথা বলতে বলতে ঘুমের রাজ্যে কখন যে পদার্পণ করেছি টের পাই নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here