হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-৭

0
358

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭

সকালে হালকা হালকা ঘুম নিয়ে চোখ মেলে দেখলাম বারান্দা দিয়ে আসা কড়া রোদ আমার মুখে লেপ্টে পড়ছে। পাশে তাকালাম খেয়াল করলাম নিলয় পাশে নেই। ঘঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এগারোটা বাজে। এগারোটা বাজতে দেখেই আমি খপ করে উঠে পড়লাম। এর মধ্যেই খালা রুমে এসে বলল

“সেই কখন থেকে ডাকতেছি তুমি এত ঘুমিয়েছ যে টেরেই পাও নি। তোমাকে ঘুমাতে দেখে নিলয় তোমাকে না বলেই চলে গিয়েছে।”

খালার কথা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ নিলয়কে শেষবার দেখতে পারলাম না। এত শরীর দুর্বল হয়েছে যে ঘুমে তাকাতেও পারছিলাম না।

আমি চুপ করে দম ধরে কিছুক্ষণ বসে থেকে খালাকে বললাম

“কেন জানি না এত ঘুম হলো বুঝতে পারছি না। আমার ইদানিং খুব ঘুম পায়। কী যে হলো আমার আল্লাহ ভালো জামেন। নিলয়কেও এ ঘুমের জন্য শেষবার দেখতে পারলাম না।”

“আরে কিচ্ছু হয় নি তোমার। নিলয় সুস্থ হয়ে তো ফিরে আসবেই, এরমধ্যে একটু ভালমন্দ খেয়ে শরীর স্বাস্থ্য ভালো করতে হবে। শরীর দুর্বল তাই এত ঘুম পাচ্ছে তোমার।”

আমিও খালার কথায় বেশ ভরসা পেলাম।সেদিনের পর থেকে আমার জীবনটায় অন্য একটা মোড় নিল। খালার কাছে সব আদর পেয়েছিলাম। বিয়ের পর ঐ সময়টা ছিল আমার কাটানো সবচেয়ে ভালো সময়।
খালা আমাকে কোনো কাজেই করতে দিত না। এক মাসে আমি বেশ বদলে গিয়েছিলাম। আমার শরীরের ওজন বাড়ল। আমার চেহারার রুপ খুলতে লাগল। শরীরে আগের থেকে বেশি শক্তিও পাচ্ছিলাম। তবে একটাই সমস্যা হত আমার রাতে কড়া ঘুম হত। খালার প্রতিদিন কাজেই ছিল আমার যত্ন নেওয়া। সারাদিন আমাকে এটা ওটা খেতে দিত। আর রাতে এক গ্লাস দুধ দিয়ে যেত। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমার খেতে হত। কারণ খালাকে নাকি নিলয় কড়া করে বলে গিয়েছে প্রতিরাতে যেন আমাকে দুধ দেয় খাওয়ার জন্য। তাই খালা নিলয়ের কথা রাখতে আমাকে রাতে এক গ্লাস দুধ দিতে ভুলত না। নিলয়ের সাথে মাঝে মাঝে খালার ফোন দিয়ে কথা হত।দেখতে দেখতে দুইটা মাস সুখেই কেটেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা ঘটনা আমার সামনে স্পষ্ট হয়। প্রতি রাতেই দুধ খেলেও সেদিন খালা দুধ দিয়ে যাওয়ার পর তেমন খেতে ইচ্ছা করল না। আমি দুধটা পাশে রেখে খালাকে বললাম

“আমি খেয়ে নিব আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে যান।”

খালা তার রুমে যেতে যেতে বলল-

” মনে করে খেয়ে নিও। আমি এসে দেখে যাব কিন্তু।”

এ বলে খালা পাশের রুমে চলে গেল। আমি দুধটা পাশে রেখে দরজাটা হালকা চাপিয়ে দুধটা বাথরুমে ফেলে দিলাম। কারণ খালা দুধের গ্লাস খালি না দেখলে জোর করে খাওয়াবে। আর এখন আমার মোটেও দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই এ কাজ করতে বাধ্য হলাম। দুধের গ্লাসটা খালি করে বিছানার পাশেই রেখে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর খালা এসে বলল

“কি গো বউমা দুধটা খেয়েছ।”

আমি খালি গ্লাসটা খালাকে দিয়ে বললাম-

“এই যে খালা খেয়ে নিয়েছি। এখন ঘুম পাচ্ছে ঘুমাব।”

“আচ্ছা ঘুমাও।”

এ বলে খালা চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ চোখ বুজে হালকা ঘুমিয়ে গেলাম। নিস্তবতা জানান দিচ্ছে রাত কিছুটা গভীর হলো। হঠাৎ বিড়বিড় আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙল। অন্ধকারে আওয়াজ টা কোথায় থেকে আসছে বুঝতে পারছিলাম না। তবে চুপটি মেরে আওয়াজটা শুনার চেষ্টা করছিলাম। খালা কাকে যেন বলছিল

“তুই ঐখানে দাঁড়া আমি দেখে আসি মেয়েটা ঘুমিয়েছে কি’না।”

এ বলে খালা আমার রুমে আসলো। আমি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। ব্যবহারটা কেন জানি খুব রহস্যময় মনে হল। তাই ঘটনা যেন উদঘাটন করতে পারি সেজন্য ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইলাম। খালা আমার রুমে এসে রুমের লাইটটা জ্বালাল। আমি লাইট জ্বালানোর পরও ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম। খালা লাইট জ্বলিয়ে আমার কাছে এসে আমাকে ডাকতে লাগল। খালার ডাকে সাড়া দিব কি’না বেশ দুটানায় পড়ে গেলাম। তবে কেন জানি না মনে হলো এখন সাড়া দিলে বিপদে পড়তে পারি। তাই ঘুমঘুম ভাব নিয়েই শুয়ে রইলাম। খালা আমাকে কতক্ষণ নেড়ে চেড়ে লাইটটা বন্ধ করে রুমে থেকে চলে গেল। পুরো বাড়ি তখন অন্ধকার অথচ খালার ফিসফিসের আওয়াজ আমার কানে আসছে। আমি আস্তে আস্তে উঠে পা টিপে টিপে দরজার সামনে গেলাম। দরজার কাছে গিয়ে হালকা উঁকি মেরে দেখলাম একটা ছেলে খালার সাথে কথা বলতেছে। ড্রয়িং রুমটা অন্ধকার হওয়ায় মুখটা এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। খেয়াল করলাম খালা ছেলেটাকে নিয়ে নিজের রুমে গেল। রহস্যময় লাগল বিষয়টা। আমিও পা টিপে টিপে খালার রুমের পাশে দাঁড়ালাম। ছেলেটা ফিসফিস করে কথা বলছে তাই ছেলেটার কথা এত স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম না। তবে খালা একটু আওয়াজ করেই কথা বলছে। ছেলেটা হয়তো বলেছিল দরজাটা লক করে দিতে। খালা অট্ট হাসি দিয়ে বলল

“ধুর পাগলা ঐ মেয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে দরজা লক করতে হবে না। তুই তোর কাজ চালা। আয় আমার কাছে আয়।”

আরও কতগুলো নোংরা কথা যেগুলো আমার মুখ দিয়ে বলতে পারছি না। আমি বিষয়টা আন্দাজ করতে পারলেও পুরোপুরি পরিষ্কার হতে পারছিলাম না। তাই আস্তে করে খালার রুমে উঁকি মারলাম। উঁকি মেরে যা দেখলাম তা দেখে আমি চমকে গেলাম। খালা ঐ ছেলেটার সাথে কুকর্ম করছে। তবে ঘরের আলো কম হওয়ায় ছেলেটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। আমি চুপ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। আর ভাবতে লাগলাম ঐ ছেলেটা কে? এতদিন খালুর কথা আমার মনে না আসলেও আজকে প্রশ্ন জাগল খালু কোথায় আছে? খালার কী কোনো ছেলে মেয়ে নেই। এসব ভাবতে ভাবতে এক ঘন্টা পার হলো। ছেলেটা এক ঘন্টা পর বের হয়ে গেল। আমি সারারাত ছটফটাতে ছটফটাতে কাটালাম। যে মহিলাকে আমি মায়ের চোখে দেখেছিলাম সে মহিলার এমন কুকর্ম মানতেই পারছিলাম না। সকালে উঠেই খলার কাছে গেলাম তবে চেহারাটা প্রতিদিনের মতই স্বাভাবিক রাখলাম। যাওয়ার সাথে সাথে খালা বলল

” কি গো মা ঘুম হয়েছে?”

খালার এমন কথা শুনে ঘৃনায় গা জ্বলে গেলেও নিজেকে সংবরণ করে খালাকে বললাম

“হ্যাঁ।”

খালা বলল

” এদিকে এসো তোমার চুলে তেল দিয়ে দেই।”

আমি ও চুলে তেল দেওয়ার জন্য খালার পাশে গিয়ে বসলাম। খালা চুলে তেল দিতে থাকল। এসময় খালাকে হুট করে প্রশ্ন করে বললাম

“খালা বাসায় আসার পর থেকে আপনাকে দেখছি।খালুকে দেখলাম না। খালু কোথায়? আপনার কী কোনো ছেলে মেয়ে নেই?”

এ বলে খালার মুখের দিকে তাকালাম। খালা আমার এরকম প্রশ্নে মোটেও প্রস্তুত ছিল না সেটা খালার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। খালা অপ্রস্তুত গলায় বলল

‘আমি তো বিয়ে করেছিলাম অনেক আগে। বিয়ের এক বছর পরেই তোমার খালু মারা যায়। বাচ্চা কাচ্চা হয় নি। তারপর থেকে নিলয়ের কাছে থাকি। নিলয়েরও কেউ নেই। নিলয়ের বাবা মা নিলয়রে জন্মের পরেই মারা যায়। তাই আমি নিলয়ের কাছেই থেকে যাই। তবে পুরোপুরি মানুষ করতে পারিনি ছেলেটাকে।”

এ বলে খালা হুহু করে কাঁদতে লাগল। আমি খালাকে মিথ্যা স্বাত্ত্বনা দেওয়ার ভান করে বললাম

“খালা কাঁদবেন না। আমরা আছি তো।”

সারাদিন কোনোরকমে কাটল। রাতে খালা দুধ নিয়ে আসলো। আমি দুধটা খেলাম। খেয়াল করলাম দুধটা খাওয়ার পর খুব ঘুম আসতেছিল। আমার মাথায় প্রশ্ন জাগল গতকাল আমি দুধ খাইনি তাই আমার তেমন ঘুম হয়নি। আর আজকে দুধ খাওয়ার পর থেকেই ঘুম ঘুম লাগছে। তাহলে কী খালা দুধে কিছু মিশিয়ে দেয় যাতে করে আমি তার কুকর্ম ধরতে না পারি। এসব ভাবতে ভাবতেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে খালার ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। খালা বলতে লাগল

“কী গো মা আর কত ঘুমাবে উঠো?”

এ মহিলাকে ঘুম থেকে উঠেই দেখতে খুব বিরক্ত লাগছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম

“হ্যাঁ খালা উঠতেছি।”

আমি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গেলাম। খেয়াল করলাম খালা খাবার নিয়ে বসে আছে। প্রতিদিনের মতো সেদিন ও আমাকে জিজ্ঞেস করল

” রাতে ঘুম ভালো হয়েছে তো? ”

আমিও বরাবরের মতো উত্তর দিলাম

“হ্যাঁ”

সেদিনও সারাটাদিন আমার অসহ্য ছটফটানিতে কাটল।রাতের বেলা আমার নজর ছিল খালার উপর। আমি জানতাম খালা দুধ নিয়ে আসবে। আমার ধারণা খালা দুধে কিছু মিশায়। তাই আমি খালাকে একটু নজরে রাখলাম। রাত ঠিক দশটা বাজে খালা গেল আমার জন্য দুধ বানাতে আমিও চুপি চুপি রান্না ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম খালা প্যাকেট থেকে তিনটা ট্যাবলেট দুধে মিশিয়ে নাড়তে থাকল। আমার বুঝতে বাকি রইল না খালা দুধে ঘুমের ঔষধ মিশাচ্ছিল। খালা বুঝে উঠার আগেই আমি সে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলাম।খালা প্রতিদিনের মতো আমার রুমে এসে দুধ খেতে বলল। আমি খালাকে বললাম

“খালা রেখে যান আমি একটু পর খাব আমার এখন গা গুলাচ্ছে।”

” আমি রেখে যাচ্ছি খেয়ে নিও। আমি এসে কিন্তু দেখে যাব। নিলয় ও ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে খেয়েছ কি’ না।”

“আরে খালা চিন্তা করবেন না। আমি কতক্ষণ পর খেয়ে নিব।”

খালা আমার কথা শুনে রুম থেকে চলে গেল। আমি সুযোগ মতো দুধটা বাথরুমে ফেলে দিলাম। খালা কিছুক্ষণ পর এসে বলল-

“কি গো মা দুধটা খেয়েছ?”

আমি ঘুমঘুম চোখের ভাব নিয়ে খালাকে খালি গ্লাস দেখিয়ে বললাম

” এই যে খালা খেয়ে নিয়েছি। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।”

খালা হাসতে হাসতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

” তুমি ঘুমাও মা।”

বলেই খালা খালি গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল। আর আমি ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইলাম। আগের রাতের মতোই কিছুক্ষণ পর একটা ফিসফিসের আওয়াজ পেলাম।আওয়াজটা পেয়ে আমি একদম মরার মতো পড়ে রইলাম। গত রাতের মতো খালা আমার রুমে আসলো। একইভাবে চেক করল আমি ঘুমিয়েছি কি’না। তারপর লাইট টা বন্ধ করে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ এভাবে শুয়ে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে খালার রুমে গেলাম। আজকে খালার রুমে লাইট জ্বলানো ছিল। আমি একটু খুশি হলাম এটা ভেবে যে আজকে ছেলেটার মুখ আমি দেখতে পারব। এ ভেবে আমি যখন উঁকি মারলাম আমি ছেলেটাকে দেখে চমকে গেলাম। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এভাবে আমি কিছু দেখব তা কল্পনাও করতে পারিনি। কারণ ছেলেটা আমার স্বামী নিলয় ছিল। নিজেকে যাচ্ছিল। ঘৃনায় মনটা বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছিল। আদৌ কী নিলয়ের খালা ঐ মহিলা নাকি অন্য কিছু।আমার সন্দেহের মাত্রাটা বেড়ে গেল। ।আমার সন্দেহের মাত্রাটা বেড়ে গেল। তবে এখন না জেনে চিল্লাচিল্লি করা ঠিক হবে না,কারণ এর আগে এসব করে অনেক আঘাত পেয়েছি। ইশ! কতটা কষ্ট যে হয়েছিল সেদিনের কথা মনে হলে এখনো বুকটা ফেটে যায়। সারারাত কি যে ছটফটানিতে কেটেছে আমি বলে বুঝাতে পারব না। এক বিন্দু ঘুমও চোখে আসে নি। সকালে খালা এসে আমাকে ডাক দিল কী গো মা বলে। খালার মুখটা দেখে এত ঘৃনা হচ্ছিল যে বলে বুঝাতে পারব না। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম।শুরু হল আমার নতুন যন্ত্রণা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here