#বিরহ_ভালোবাসা-০২,০৩
#Tahmina_Akhter
০২
সারা পথ জুড়ে আমি চুপ করে রইলাম। কিন্তু শাদাদ ভাই তো চুপ করে থাকার মতো মানুষ নয়। ড্রাইভারকে বলে, পুরনো যুগের ওয়েডিং সং লাগিয়ে তিনি যেভাবে চোখ বুজে গানের এক একটি শব্দ অনুভব করছেন মনে হচ্ছে বিয়েটা আমার মামার নয় বরং শাদাদ ভাইয়ের।
অবশেষে আমি মুক্ত হলাম কারাগার থেকে আই মিন শাদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে। গাড়ি এসে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পরেছে। যেহেতু বর আছে এই গাড়িতে তাই আশেপাশের সকল মানুষের দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। আমি, শাদাদ ভাই এবং ড্রাইভার আংকেল বের হয়ে গেলাম। কিন্তু, ছোট মামা বের হতে চাইছে না। কি একটা অবস্থা? এদিকে রোদে দাঁড়িয়ে আমার মেকআপ গলে যায় যায়। শাদাদ ভাই মামাকে শেষবারের মতো বের হওয়ার জন্য রিকুয়েষ্ট করলো। কিন্তু মামা সেই আগের মতো গো ধরে বসে আছে। শাদাদ ভাই আমার পাশে সরে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
— তোর মামা বুড়ো কালে বিয়ে করে ভীমরতিতে পেয়েছে। এ্যহ উনার লজ্জায় আমরা রোদে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি। এই মধু শোন তোর মামাকে এখন কি করে গাড়ি থেকে বের করে আনবি তুই বুঝ। আমি গেলাম ভেতরে।
শাদাদ ভাই সত্যি সত্যি ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছেন।
দুঃখের তাড়নায় সেদিন প্রথমবারের মতো আমি রণচণ্ডী রুপ ধারণ করে আমার মা অর্থাৎ মামাকে উনার বড়ো বোন নায়লা আহম্মেদের কথা বলে হুমকি দিলাম।
কাজেও লেগে গেল। মামা ধীরগতিতে গাড়ি থেকে নেমে রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেললেন। আহা, মামার সঙ্গে দাঁড়ানোর ফলে দুতিনটা ক্যামেরা এবং ভিডিওম্যানের স্বসম্মানি বাক্য শুনে বিগলিত বদনে তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে স্থীর হয়ে। ফটো সেশন শেষ হওয়ার পর মামার একঝাঁক শালা-শালীর দল এসে গেটের কাছে লাল ফিতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিজের এবং মামার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমরা মামা-ভাগনি ছাড়া কেউই নেই বরপক্ষ থেকে। এখন যদি গেটে ফিতা কেটে ভেতরে যাওয়ার জন্য বড়ো ধরণের এম্যাউন্ট দিতে হয় তবে কোত্থেকে দিব আমি? এমন সময় শাদাদ ভাই আর রুপা সহ আমার অন্যান্য কাজিন এবং মামার দুএকজন বন্ধু চলে এলেন। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
গেটের কাছের শরবত খাওয়া, দাবি দাওয়ার ঝামেলা মিটিয়ে মামাকে নিয়ে রওনা হলাম আমরা। কিন্তু, ভীড়ের মাঝে কে যেন আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে গেটের বাইরে এককোনায় সম্ভবত গার্ডেন এরিয়া।
— দেখ মধু বিয়েতে এসেছিস ভালো কথা। কিন্তু, ছেলেদের সাথে দাঁত কেলিয়ে কথা বলে আমাদের বংশের নাম ডুবস না যেন।
ভূতের মুখে আল্লাহর নাম শুনে আমি মুখ ভেঙচিয়ে বললাম,
— বাব্বাহ কে বলছে এই কথাগুলো! আপনি নিজেই তো মেয়েদের সাথে কথা বলতে বলতে এদিক-ওদিক হেলেদুলে পরে যান। আর আমি মাধবীলতা এতটাও ক্যারেক্টারলেস না যে মামার বিয়েতে এসে নিজের লাইন সেটআপ করব।
শাদাদ ভাই হয়তো আমার কথাটি পছন্দ করলেন না। এগিয়ে এসে আমার ডানহাত বাঁকিয়ে নিজের দিকে টেনে নিলেন। ফোসফাস করতে করতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— এই যে এত্তবড়ো খোঁপা করে রেখেছিস তুই কি ভাবছিস তোকে সুন্দর দেখাচ্ছে? মোটেও সুন্দর দেখাচ্ছে না বরং তোকে ওসব মহিলাদের মতো দেখাচ্ছে যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরুষদের দৃষ্টি আর্কষণ করে কিছু পয়সা ইনকাম করার জন্য। পিঠ দেখিয়ে আর যাই ভদ্রতা বজায় রাখা যায় না। বরং, ছেলেদের লালসা দেখিয়ে শরীরী প্রেমে ফেলা যায়।
কথাগুলো বলে আমাকে একঝটকায় ছেড়ে দিয়ে সেন্টারের ভেতরে চলে গেলেন। আর আমি তার দেয়া ব্যাথায় নয় বরং তার বলা এক একটি বিষাক্ত শব্দ শুনে মরণ জ্বালায় কাতরাচ্ছি। আমাকে বুঝি সেসব মহিলাদের মতো করে ভাবছেন শাদাদ ভাই। তার তাচ্ছিল্যের সুরে বলা কথায় আমি স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল না ভেতরে গিয়ে সবার সঙ্গে হৈ-হুল্লোর করতে। রাগে নিজের চুলের খোপা খুলে ফেললাম। এবার তো পিঠ ঢাকা পড়বে। চোখের কার্নিশে জমে থাকা বিন্দু জল টিস্যু দিয়ে মুছে ফেললাম। তারপর,নিজেকে স্বাভাবিক রেখে এগিয়ে যাচ্ছি ভেতরে।
ভেতরে যেতেই সর্বপ্রথম দেখা হলো মায়ের সঙ্গে। মা আমাকে দেখে হাসিমুখে বললো,
— এত দেরি হলো কেন? এই যে মাউইমা ও হচ্ছে আমার একমাত্র মেয়ে মাধবীলতা। লতা উনি হচ্ছেন তোমার ছোট মামার শ্বাশুড়ি।
আমি তৎক্ষনাৎ মামার শ্বাশুড়িকে সালাম দিয়ে ফেললাম। ভদ্র মহিলা আমার সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— পড়াশোনা করছো তো নাকি?
— জি পড়াশোনা করছি। এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী।
— বেশ ভালো। যাও সবার সঙ্গে গিয়ে আনন্দ করো।
হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। এমনসময় রুপা আপার ডাক শুনলাম বোধহয়। ডান-বামে তাকিয়ে দেখলাম অদূরেই আমাদের কাজিনের দলেরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাদাদ ভাইও আছে দেখছি। শাদাদ ভাইকে দেখেও না দেখার ভান করে রুপা আপার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। রুপা আপা আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
— মামার আশপাশে থাকতে হবে। জানিসই তো কখন না জানি মামার জুতো চুরি করে বসে উনারা ।
বিজ্ঞ জ্ঞানী সেজে সোজা মামার পাশে গিয়ে বসে রইলাম। মামা আমাকে দেখে ফিসফিসিয়ে বললো,
— বিয়েটা এত সোজা না রে লতা। তোর জুই মামী ঠিকই বলেছিল, ঘটা করে বিয়ে করলে সারা দুনিয়ার অনুষ্ঠান, রিচ্যুয়াল পালন করে তবেই আমাদের বিয়ে হবে। যদি কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করি তবে ধরো তক্তা মারো পেরেক। কবুল বললেই বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন। কেন যে ওর কথা শুনলাম না?
মামা বসে আফসোসের সুর গাইছেন। আমি মামাকে ভয় দেখানোর জন্য বলেই ফেললাম,
— কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করলে কি হতো জানো মামা? নানাভাই তোমাকে আর জুই মামিকে মেনে নিতো না। ঠিক যেমনটা আগেরকার সিনেমাতে দেখাতো। আলমগীর শাবানাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে গেছে। অথচ গোলাম মোস্তফা আলমগীরকে তেজ্য পুত্র করে দিয়েছে। শেষমেষ বড়োলোক বাড়ির একমাত্র পুত্র রাস্তায় গিয়ে ঠেলাগাড়ি চালাতো।
আমার কথায় বোধহয় মামার টনক নড়েছে। মামা নড়েচড়ে বসলেন। তবে আমার দিকে আর তাকালেন না।
কিন্তু, এরইফাকে কখন যেন মামার কোন শালী এসে ছবি তোলার বাহানায় মামা জুতো চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি তো হা করে আছি। মানে এত কড়া সিকিউরিটির মাঝে কি করে জুতো চুরি করলো?
সবাই তো পারছে না আমাকে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলতে। মামা সবার ভাবমূর্তি দেখে শাদাদ ভাইকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে বললো,
— দেখো শাদাদ আমার লতাকে কেউ কিছু বলবে না। জুতো চুরি হয়েছে তো কি হয়েছে? ওরা যত টাকা দাবি করবে আমি দিয়ে দিব। কিন্তু, লতা যদি কারো কাছ থেকে বকা শুনে তবে তার কাছ থেকেই আমি জুতো চুরির টাকা নিয়ে আমার শালা এবং শালির দলকে দিয়ে দিব।
শাদাদ ভাই চুপসে যায়। তবে আমার দিকে কটমট করে তাকায়। আমিও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বুফের দিকে চলে গেলাম।
প্রচুর খুদা লেগেছে। আগে খেয়ে নেয়া যাক তারপর অন্যকিছু দেখা যাবে। খেতে গিয়েও যেন বিপদে পরলাম। আমার পাশে এক অচেনা ছেলে বসেছে। যতবারই তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হচ্ছে ঠিক ততবারই সে হাসি বিনিময় করছে। আমি তো বোকার মতো ভাবছি লোকটা আমার পরিচিত কি না এই ভেবে। যদি পরিচিত সে আমার পরিচিত হয় এবং আমি তাকে চিনতে পারছি না তখন কি ভাববে আমাকে নিয়ে?
খাওয়াদাওয়ার শেষ পর্যায়ে এসে ছেলেটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনার নামটা যেন কি?
আমি থতমত খেয়ে জবাব দিলাম,
— মাধবীলতা। তবে ইনশর্টে পরিবারের লোকেরা লতা বলেই ডাকে। আমরা কি পূর্ব পরিচিত?
সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে বেচারা মুখ কালো করে ফেললেও পরক্ষণে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
— পরিচিত নই তবে পরিচিত হতে বাঁধা কিসের? আমি তেহজীব রহমান। বর্তমানে বেসরকারী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছি।
তার পরিচয় জেনে ভদ্রতা বজায় রাখতে মুখে হাসি ফুটিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলাম। লোকটাও আমার সঙ্গে সঙ্গে ওঠে দাঁড়ালো। আমি কিছুটা বিরক্তবোধ করলাম তার আচরণে। কিন্তু, বিরক্তিকর চেহারার তোয়াক্কা না করে তেহজীব নামের লোকটা বললো,
— চলুন না এক জায়গায় গিয়ে বসি। চেনা-জানাও হয়ে যাবে আমাদের।
— চেনা জানা তো হলোই। আমার নাম আপনি জানেন আর আমি আপনারটা। ব্যস, এতটুকুতেই হলেই হলো।
কিন্তু, লোকটা এমন সময় যে কথাটি বললো তাতে যেন মনে হলো আমি ভুল কিছু শুনেছি। তাই তো তেহজিব নামক লোকটাকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
—কি বললেন বুঝিনি আমি! আপনার আমার সম্পর্ক অদূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে মানে?
— মানে হলো আমরা একে অপরকে যতটা জানতে পারব ঠিক ততটাই আমাদের বিয়ের পরবর্তী জীবনের জন্য মঙ্গল হবে।
কিছুটা লজ্জা মিশ্রিত গলায় কথাগুলি বলে শেষ করলেন তেহজিব। আমি তেহজীবকে কিছু বলব তার আগেই আমার চোখ পরলো তেহজিবের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শাদাদ ভাইয়ের ওপর।
চলবে…
#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
৩.
— যেই মেয়ে ঘুমের ঘোরে পাশে শুয়ে থাকা মানুষকে লাথি মেরে উগান্ডা পাঠিয়ে দিতে পারে। সেই মেয়েকে আপনি বিয়ে করে কই থাকবেন? আমি তো নিশ্চিত বিয়ের প্রথম রাতে আপনাকে মঙ্গলে পাঠিয়ে দিবে আমাদের মাধবীলতা।
শেষের কথাগুলো বলার সময় শাদাদ ভাইয়ের মুখে গর্ববোধের রেখা ফুটে উঠেছে। এদিকে আমি তো পারছি না শাদাদ ভাইয়ের মাথা ফাটিয়ে দেই। আমি আবার কখন কাকে ঘুমের ঘোরে লাথি মেরে উগান্ডা পাঠিয়েছি! এই লোক নিজেই তো আমার সম্মান রাখতে পারে না। সু্যোগ পেলে আমার বদনাম করতেও পিছ পা হয় না।
—কিন্তু, মি.??
— সৈকত চৌধুরী তবে কাগজে কলমে। পরিবার এবং বন্ধু মহলে শাদাদ নামে পরিচিত।
— আপনি কি করে জানেন মধু.. আই মিন মিস. মাধবীলতা রাতে ঘুমের ঘোরে ক্যারাটে করে?
কিছুটা হতবিহবল হয়ে প্রশ্ন করলো মি. তেহজিব। তেহজিব সাহেবের প্রশ্ন শুনে শাদাদ ভাইয়ের মুখে শয়তানি হাসি ফুটে উঠেছে। যার অর্থ হলো, আমার মিশন সম্পন্ন হয়েছে। বিজ্ঞ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ফুটিয়ে শাদাদ ভাই এসে আমার হাত ধরে বললেন,
— দেখুন তেহজিব সাহেব আপনি আমাকে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ভাবতে পারেন। কিন্তু, আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ার আগে থেকে মধু মানে মাধবীলতার সঙ্গে আমার আত্মা এমনকি রক্তের সম্পর্ক আছে। তাই মাধবীলতার এমন জটিল সমস্যার কথা আমি কি করে জানি আপনাকে বলতে পারব না। আমি খুবই দুঃখিত। বাট ট্রাস্ট মি মাধবীলতা ইজ গুড গার্ল।
শাদাদ ভাইয়ের কথা শেষ হবার আগে আমি উনার কাছ থেকে নিজের হাত মুক্ত করিয়ে চলে এলাম মামার কাছে। কি দরকার ওমন দুটো উল্লুকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাথা নষ্ট করার?
— আমাকে কথায় কথায় অপমান করবে। যার তার সাথে আমার বদনাম গাইবে। সবশেষে এসে বলবে,মাধবীলতা ইজ গুড গার্ল।
কথাগুলো বলতে বলতে লতা কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু, কে যেন এসে লতাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়। লতা দুরুদুরু বুকে চোখ খুলে তাকাতেই ফ্রিজড হয়ে গেলো। কারণ, ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং লতার বড়ো জেঠু সাদিক চৌধুরী। লতা আমতাআমতা করে ওর জেঠুকে সরি বলতেই সাদিক সাহেব বললেন,
— তুমি, রুপাসহ বাকি সব বাচ্চারা বাড়িতে চলে যাও। আমরা মামুন আর ওর বৌকে নিয়ে ফিরে আসছি।
— জি, জি.. জেঠু।
— যাও গেটের বাইরে গেলে সবাইকে পেয়ে যাবে। তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
জেঠুর কাছ থেকে অনুমতি পেতে দেরি আর আমার দৌঁড় দিতে দেরি হলো না। একদৌঁড়েে সোজা মেইন গেটের কাছে। যেতেই দেখলাম রুপা আপা, পলাশ, শিপলু, নূর আপা সবশেষে খচ্চর শাদাদ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আমার উপস্থিতি সর্বপ্রথম শাদাদ ভাই টের পেয়েছেন হয়তো। ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বললো,
— চল মধু বাড়িতে ফিরে যেতে। বাবা আদেশ করেছেন গিয়ে যেন অগোছালো বাড়িটা চটজলদি গুছিয়ে ফেলি আমরা সবাই মিলে।
আমি শাদাদ ভাইয়ের কথায় গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লাম। মাইক্রোবাস হওয়াতে অনায়াসে আমরা সকল কাজিনরা আরামে বাড়ির পথে রওনা হলাম। জানালার পাশে বসতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু, শিপলু বাঁদরটার জন্য পারলাম না। আহ্ হা হা কত সুন্দর করে কানে ইয়ারফোন গুজে চোখ বুজে আছে। মন চাচ্ছে ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে বের করে দেই। শয়তান শিপলুর জন্যই তো এখন আমাকে শাদাদ ভাইয়ের সঙ্গে বসতে হয়েছে। এই লোক তো পারছে না ঘুমের ঘোরে আমার ওপরে এসে শুয়ে থাকতে। আর তেহজিব সাহেবের সঙ্গে বলে কিনা আমি মানুষকে লাথি মেরে উগান্ডা পাঠিয়ে দেই!
— এই মধু তুই গায়ে কি মাখিস বল তো? বারো মাস তোর গায়ের থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ বের হয় যে।
কথাটি বলে আমার কাঁধের কাছে নাক ডুবিয়ে জোরে ঘ্রাণ নিলেন। আমি তো অজানা কারণে শক্ত হয়ে রইলাম। এই প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ! তাও আবার এমন পুরুষ যে কিনা কথায় কথায় আমাকে অপমান-অপদস্ত করতে পিছুপা হয় না। নিশ্চয়ই আজ উনার ঘাড়ে ভূত চেপেছে। নয়তো, আমার গা থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ আসে এমন কথা বলার মতো মানুষই নন শাদাদ ভাই। শাদাদ ভাই আমার গা ঘেঁসে বসে থাকার কারণে অস্বস্তি হচ্ছে খুব। তাই আমি শিপলুর দিকে সরে বসতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু, আমার কোমড়ে হাত পেচিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলো শাদাদ ভাই। আমি চট করে শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কড়া জবাব দেওয়ার জন্য। কিন্তু, অন্ধকার গাড়িটায় মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পরছে। সেই আলোতে শাদাদ ভাইয়ের চোখে আমি অজানা কিছু একটা দেখলাম। যা আমি কখনোই মনে-প্রাণেও ভাবিনি কিংবা ভাবতে চাইনি। শাদাদ ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, বিনা পলক ফেলে। ধীরে ধীরে আমার মুখের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। আমি ভয়ে কুঁকড়ে কাত হয়ে সরে যাচ্ছিলাম পেছনের দিকে। কিন্তু, শাদাদ ভাই সরতে দিলেন না। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আমার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বললো,
— তেহজিব না কি যেন নাম ওই বোকারাম তোর যোগ্য না রে। দেখতে সুদর্শন হলে কি হবে ব্যাটার চোখ ভালো না। খালি তোর শরীরের এদিকসেদিক তাকিয়ে থাকে। চরিত্রহীন লোককে বিয়ে করলে আজীবন চিন্তায় ডুবে মরে যাবি।
এমন সময় গাড়ির কষে ব্রেক করতেই শাদাদ ভাই আমাকে ছেড়ে গাড়ি থেকে বের সোজা বাড়িতে ঢুকে পরলেন। একে একে সবাই বের হয়ে গেলো শুধু আমি রয়ে গেলাম। মাথায় একগাদা প্রশ্নের সমারোহ। উত্তর মিলবে কার কাছে? শাদাদ ভাই হুট করে এমন আচরণ করছেন কেন?
— মামনি গাড়ি থেকে বের হোন। আমাকে আবার বিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে হবে।
জলিল চাচার কথায় আমার ধ্যান ভঙ্গ হয়। হাতের পার্সটা নিয়ে বাগানের পথ ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ড্রইংরুমে যাওয়ার পর দেখতে পেলাম, শাদাদ ভাই আর পলাশ বাদে সবাই এটা সেটা গুছিয়ে রাখছে। রান্নাঘর থেকে রুপা আপার কথা শোনা যাচ্ছে। হয়তো, মিষ্টি আর জুস সাজিয়ে রাখছে ট্রেতে করে। নতুন বৌ এলে তো বৌ দেখার ধুম পরবে। আশেপাশের বাড়িতে থাকা মানুষেরাও আসবে।
আমি ধীরপায়ে আমার ঘরের দিকে যাচ্ছি। এমনসময় দোতলা থেকে পলাশ ভাইয়ের ডাক শুনলাম। আমার নাম ধরে ডাকছে। উপায়ন্তর না পেয়ে দীর্ঘ শ্বাস চেপে হাতের পার্সটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় মামার ঘরে চলে গেলাম।
মামার রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই কাঁচা ফুলের মিষ্টি সুবাস এসে আমার নাসরন্ধ্রে প্রবেশ করে। অজানা এক ভালো লাগার শিহরণ জাগে মনে। পলাশ ভাই আমাকে দেখে বললো,
— তুই তো আবার খুব ভালো করে ফুল দিয়ে বাসর সাজাতে পারিস। আজ তোর মামার বাসরটা না হয় সাজিয়ে দে।
— তোমরাই তো সাজিয়ে ফেলছো। নতুন করে আর কি সাজাবো?
— খাটের ওপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে মামুন+জুঁই নামখানি সাজিয়ে দিয়ে যা।
ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতে শাদাদ ভাই কথাগুলো বললেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কেমন যেন অস্বস্তি আর সংকোচ আমাকে ঝেকে ধরেছে। পলাশকে খাটে থেকে নেমে যেতে বললাম। পলাশ খাট থেকে নেমে এলে আমি আমার শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে এনে কোমরে গুজে কাজে লেগে পরলাম। পলাশ আর শাদাদ ভাই বাকি ফুলগুলো ব্যাগে ভরে রাখছেন। এত বেশি ফুল আনার দরকার কি? কথাগুলো ভাবছি আর লাভ শেইপ দিচ্ছি গোলাপের পাপড়ি দিয়ে। মাথা নিচু করে আছি। কারণ, শাদাদ ভাইয়ের দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি মেলাতে আজ মন চাইছে না।
— কতদিন পর এবার ছুটিতে এলাম রে মধু?
শাদাদ ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে আমি উঁচু করে তাকালাম। দেখলাম শাদাদ ভাই খাটের এককোণায় বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার চোরা চোখে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে পলাশকে দেখলাম না। তারমানে পলাশ এই ঘরে নেই? আমার শরীর কাঁপছে। অথচ, এর আগেও শাদাদ ভাইয়ের ঘরে একা কত বসে থেকেছি। কিন্তু, আজ সেই সাহসটুকু মনের মাঝে নেই। নিজেকে বেশ দূর্বল মনে হচ্ছে আজ। হয়তো দূর্বলতার রেশটুকু শাদাদ ভাইয়ের উদ্ভট আচরণ থেকে পাওয়া।
—ছয় মাস পর বাড়িতে এসেছেন। এ আর নতুন কি? ছয়মাস একবছরে পাঁচ ছয়দিনের ছুটি পান। হুট করে আসেন আবার হুট করে চলে যান।
মাথা নিচু রেখে উত্তর দেয় লতা। শাড়ি পরিহিতা লতাকে আজ অষ্টাদশী কন্যা ভাবতে ইচ্ছে করছে না শাদাদের। লতাকে দেখে মনে হচ্ছে রুপকথার কোনো রূপসী যে অমৃত পান করে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী হয়ে পুরুষের চোখে হয় একমাত্র সুন্দরী। শাদাদের আজ নিয়ম মানতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না মনকে কোনো বাঁধা দিতে। আজ মনটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সকল বাধা পেরিয়ে আজ লতাতে বিলীন হতে চায়। কিন্তু, কেন? কেন শব্দটার উত্তর জানা নেই শাদাদের। জানতেও চায় না।
— বাবার ইচ্ছে একমাত্র ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে। বাবার ইচ্ছে রাখতেই পরিবার থেকে দূরে আছি। ট্রেনিং শেষ হয়ে গেলে কোন শহরের বুকে ঠাঁই মিলবে কে জানে?
শাদাদ মন খারাপ করে উত্তর দেয়। কিন্তু, মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুটে আছে। কেউ দেখলে বলতেও পারবে না শাদাদের এই মূহুর্তে মন ভীষণ মন খারাপ।
এদিকে লতার ফুল দিয়ে সাজানো কাজ কমপ্লিট। ধীর পায়ে খাট থেকে নেমে বিছানার চাদর টানটান করে বিছিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবে। সেই মূহুর্তে পেছন থেকে কেউ হাত টেনে ধরে। লতা চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারণ, মানুষটা আর কেউ নয় শাদাদ ভাই। লতা হাত ছারানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। শাদাদ বেশ শক্ত করে হাত ধরে আছে। শাদাদ লতার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। লতা ব্যাথার চোটে চোখ দিয়ে জল বের হয়ে আসে। শাদাদ লতার চোখের কার্নিশে জমে থাকা বিন্দু জল মুছে দিলো। লতা অবাক হয়ে তাকায়। শাদাদ লতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— একটু ব্যাথায় চোখের জল ফেলিস! যেদিন মনের মাঝে হারানোর কিংবা না পাওয়ার ব্যাথা পাবি সেদিন কি করবি?
— আপনার ওত শক্ত কথা বুঝি না আমি। হাত ছাড়ুন নীচে যেতে হবে। মা এসে আমাকে খুঁজে না পেলে বকবে।
— এই তুই কি সাতবছরের শিশু যে তোর মা তোকে খুঁজে না পেলে বকবে? সঠিক বয়সে বিয়ে দিলে তোরই একটা বাচ্চা থাকত।
এই যে মহাশয় নিজের মাঝে ফিরে এসেছেন। ভূতটা নিশ্চয়ই চলে গেছে।
— তেহজিব সাহেবকে তোর মা তোর জন্য পছন্দ করেছে। তোর যদি পছন্দ হয় তবে তোর পরীক্ষার পর বিয়েটা হতে পারে।
বিয়ের কথা শুনে আমার কেন জানি মনটা ভীষণ খারাপ হয়! এদিকে শাদাদ ভাই উনার কথা বলেই যাচ্ছেন।
— তুই তেহজিব সাহেবকে বিয়ে করবি না। উনাকে তোর পছন্দ না। এটা বলতে পারবি না তোর মাকে?
শাদাদ ভাইয়ের কথায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। মানে উনি আমাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন, আমি যেন আমার মায়ের পছন্দের পাত্রকে অগ্রাহ্য করি! কিন্তু, কেন?
— কখনোই বলতে পারব না। কারণ, মায়ের সিদ্ধান্ত মানে আমার সিদ্ধ…।
কথাটি শেষ হয়নি তার আগেই শাদাদ ভাই আমাকে আক্রমণ করে বসেন। যেই আক্রমণে আমার কণ্ঠনালি শব্দ এসেও ঠোঁটের কাছে এসে থেমে যায়।
কিছু মূহুর্ত এভাবে কেটে যায়। শরীর কাঁপছে। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে যেকোনো মূহুর্তে আমি মরে যাব। লজ্জায় মাথা উঁচু করে তাকাতে পারছি না। চোখের জল গালে গড়িয়ে পরছে। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শাদাদ ভাইকে আজ আমার বড্ড অচেনা মনে হচ্ছে। কারণ, তার আজকের আচরণ বড্ড অচেনা। হাসোচ্ছোল শাদাদ ভাই যে কিনা কথায় কথায় আমাকে অপমান করে, ঘৃনা করে। তার কাছ থেকে হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পেয়ে আমি আজ অন্য এক শাদাদ ভাইকে আবিষ্কার করেছি।
— আজ এই মূহুর্তে আমার কথা শুনে রাখ মধু। তুই তেহজিব কেন অন্য কোনো ছেলেকেও বিয়ে করতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবি না। কারণ, সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমার দেয়া স্পর্শ তোর মনের দৃশ্যপটে হানা দেবে।
কথাটি বলে মামার ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন শাদাদ ভাই। আর আমি ভেতরে ভেঙে গুমরিয়ে যাওয়া মনটাকে সামলাতে ব্যস্ত। কিছু পরিস্থিতি কেন আমাদের এতটা অসহায় বানিয়ে দিয়ে যায়? চেনা মানুষটা কেন অচেনা মানুষে পরিণত হয়?
#চলবে