বিরহ_ভালোবাসা-০৪

0
233

#বিরহ_ভালোবাসা-০৪
#Tahmina_Akhter

মামা এলেন নতুন মামীকে নিয়ে। বাড়িতে সে কি হইচই। নানী আর আমার মা নতুন মামীর সঙ্গে আসা মেহমানদের সামলাতে ব্যস্ত। বাবা, জেঠু, নানা সবাই মিলে তখন ছাঁদে বসে আগামীকাল বৌভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে নিজেদের মাঝে আলাপ করছে। রুপা আপা , পলাশ, শিপলু ছোট মামীকে ঘিরে বসে আছে। সবার মাঝে আজ আনন্দ আছে। নেই শুধু আমার মাঝে। মাথায় একঝাঁক দুশ্চিন্তার দল এসে একটু পরপর হানা দিচ্ছে। যার দরুন প্রচন্ড মাথাব্যাথা নিয়ে নানুর ঘরে এককোনায় নিচে মাদুর পেতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি।

শাদাদ ভাই মানুষটা আমার কাছে রহস্যময় মনে হয়। তাকে দেখলে মনে হয় সে আগাগোড়া নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছে মায়াজালে। তাকে যেই দেখবে মায়ায় পরে যাবে। তার কথায় উঠতে বসতে স্বাচ্ছন্দ্যেবোধ করবে। তার একটা আদেশ পেলে নিজের জীবনটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিবে। এই যে কিছুক্ষণ আগে সে আমার অনুমতি না নিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দিলো। আমার কিন্তু তাকে রাগ দেখানোর উচিত ছিল। কিন্তু, রাগ দেখাতে পারলাম কই! বরং, তার স্পর্শ পেতে মন কেমন বাক-বাকুম করছে। কারো ছোঁয়ায় বুঝি ভাইরাস থাকে। একবার ছুঁয়ে দিলে প্রেম জ্বর আসে। ঔষধ খেয়েও এই প্রেম জ্বর যেতে চায় না। বরং, আরও জেঁকে বসে থাকে।

— কি রে সন্ধ্যা হতে না হতেই শুয়ে পরলি যে? নিচে সবাই কত আনন্দ করছে? মহারানী কি না কাঁথা গায়ে পেচিয়ে ঘুমানোর পায়তারা করছে! এই লতা ওঠ। ওঠ বলছি।

রুপা আপার কথা শুনে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু, পারছি না। চোখে কেমন জ্বালা করছে? রুপা আপা আমার পাশে এসে বসলেন। কপালে হাত রেখে শিউরে ওঠে বললেন,

— সেকি রে লতা! তোর তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কাউকে বলবি তো নাকি যে তোর শরীর ভালো নেই। একটু আগেও তো দিব্যি ভালো ছিলি। হুট করে গায়ে জ্বর বাঁধলো কি করে?

রুপা আপা চিন্তিত ভঙ্গিতে ওঠে বাথরুম থেকে একমগ পানি আর ছোট গামছা এনে আমার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দেয়া শুরু করলেন। শীতল পানির স্পর্শে চোখে এবং কপালে বেশ আরাম পাচ্ছিলাম। কখন যে ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গেছি নিজেও বুঝতে পারিনি। তবে, এতটুকু অব্দি মনে আছে, শেষবার আমার শিয়রের কাছে আমি শাদাদ ভাইকে দেখেছিলাম। যে কিনা চিন্তিত হয়ে আমার কপালে হাত রেখে কার কাছে কল দিয়ে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করছিল।

সকালের নরম রোদ হাতের পিঠে এসে লাগছে। আরাম পাচ্ছিলাম। পাখির কলরবে কান দুটোতে যেন বসন্তের আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে। কিন্তু, বসন্তের আসার সময় ঢের বাকি। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাই। মাথার ওপরে সিলিংফ্যানটা লাটিমের মতো ঘুরছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম, রুপা আপা আমার মাথার কাছে হেলান দিয়ে কোনোমতে শুয়ে আছে। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। এবার পুরো ঘরের দৃশ্য দেখে আমার চক্ষু চরাক গাছ। বাবা আর মা নীচে মাদুরে শুয়ে আছে। হয়তো, সারারাত আমার পাশে বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।

নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে ছোট ছোট পা ফেলে ওয়াশরুমের ভেতরে চলে গেলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পারছি না। গাল মুখ ফুলে ওঠেছে। দেখলে মনে হবে যেন মৌমাছিতে কামড় দিয়েছে। কোনোরকমে ব্রাশ করে চোখে মুখে পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলাম। শরীর কাঁপছে হয়তো দূর্বলতার জন্য। খাটের কাছে যেতেই দেখলাম, রুপা আপা নেই। হয়তো নীচে চলে গেছে। মা আর বাবা জেগে ওঠেছেন। মা আমার পাশে এসে বসলেন। বাবা আমার অন্যপাশে গিয়ে মাথায় হাতে রেখে বললেন,

— এত জ্বর নিয়ে একা ঘরে শুয়ে ছিলি কেন? কাউকে ডাক দিয়ে বলতে পারতি।

বাবার হাত ধরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— শরীরটা কেমন ব্যাথা করছিল। সাথে মাথাব্যাথা। তাই নানুর ঘরে এসে নীচে শুয়ে পরেছিলাম। কিন্তু, জ্বর এসে যে আমার ভর করবে কে জানে? চিন্তা করো না জ্বর গায়ে নেই এখন।

— জ্বর আসার আগেই চল কিছু খেয়ে নিবি। তারপর ডক্টর দেয়া ঔষধ গুলো খেয়ে নে।

মায়ের কথা শুনে গতকাল রাতের অস্পস্ট দৃশ্য টুকু মনে পরে গেল। যেখানে শাদাদ ভাই কাউকে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করছিল। তবে কি উনি ডক্টরকে আসতে বলেছিলেন?

মা ওয়াশরুমে চলে গেলেন আর বাবা নীচে চলে গেছেন। বৌভাতের অনুষ্ঠান কতশত কাজ পরে আছে। মা ওয়াশরুম থেকে এসে চলে গেলেন রান্নাঘরে আমার জন্য খাবার আনতে।

জ্বরে মুখটা তেঁতো হয়ে আছে। পানি গলা দিয়ে নামছে আর মনে হচ্ছে নিমগাছের পাতা দিয়ে তৈরি শরবত খাচ্ছি। এমনসময় দরজা খুলে ভেতরে কেউ এলো। আমি মা এসেছে মনে করে সটান হয়ে বসে পরলাম। কিন্তু, ভরাট পুরুষালী কন্ঠ শুনে তাকিয়ে দেখি শাদাদ ভাই স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছেন আমার চোখের সামনে তাও আবার নাশতার প্লেট হাতে নিয়ে। গতকাল রাতের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের কথা মনের দৃশ্যপটে ফের দৃশ্যমান হলো। লজ্জায় কুকরে গেলাম। মনে মনে দোয়া করছিলাম মাটি দুইভাগ হোক তাতে আমি ঢুকে পরি। কিন্তু, দোয়া কবুল হলো না আর আমার মাটিতে ঢুকাও হলো না। শাদাদ ভাই নাশতার প্লেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

— নে নাশতা খেয়ে আরও শক্তিশালী হো। আর আমাকে উদ্ধার কর। ছুটিতে এসে একটুও শান্তি পেলাম না। এই কাজ করো, ওরে সামলাও। শেষমেশ পেলাম এই বাড়ির সবচেয়ে গাধা মেয়েটাকে নাশতা খাওয়ানোর বর।

শাদাদ ভাইয়ের কথায় আমার দুচোখ ছাপিয়ে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। হুহ্, আমি কি তাকে বলেছি যে, আমাকে নাশতা এনে খাওয়ান। আপনার হাতে নাশতা খেতে না পারলে আমি আমরণ অনশন জারি করব। এক পাহাড় অভিমান জমিয়ে নাশতার প্লেট থেকে একটা ডিম সিদ্ধ নিয়ে চারভাগ করে ধীরে ধীরে এক একটা ভাগ পানি দিয়ে গিলছিলাম। সর্বেশষ ডিমের ভাগটা খেতে গিয়ে মনে হলো, পেটের ভেতরে যা কিছু আছে সব উগড়ে দিব। হলোও তাই গড়গড়িয়ে বমি করে দিলাম। বমি তো করলাম, কিন্তু বমি গিয়ে শাদাদ ভাইয়ের পায়ের কাছে পরলো। বেচারার পা দুটো মেখে টেখে একাকার।

— তুই যে গাধা এটা আমি জানতাম কিন্তু সেই সঙ্গে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ্য কানার খেতাব পেয়েছিস এটা জানতাম না ? চোখে দেখিসনি আমি যে এখানে বসে আছি? আমার ছত্রিশ’শ টাকার জিন্স প্যান্টটা দিলি তো নষ্ট করে। সঙ্গে করে বাড়তি প্যান্ট নিয়ে আসিনি এবার কি পরব আমি? বল?

শাদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে ধমক খেয়ে খালি পেট ভরে গেছে। বেচারার মুখটা দেখে মায়া হলো ভীষন। তাই আস্তে করে বললাম,

— আপনি প্যান্টটা খুলে আমাকে দিন। আমি ধুয়ে দিব। এখন ধুয়ে দিলে দুপুরের আগে শুকিয়ে যাবে।

— এই মেয়ে কানে শুনিস না। প্যান্টটা খুলে তোকে দিয়ে দিলে আমি কি ন্যাংটো হয়ে ঘুরব!

শাদাদ ভাইয়ের কথায় আমি লজ্জা পেলাম। ভাবছিলাম কি করে শাদাদ ভাইয়ের সমস্যা সমাধান করা যায়। হুট করে নজরে পরলো, আলনার ওপর। নানার লুঙ্গি দেখা যাচ্ছে। আমি উঠে গিয়ে আলনা থেকে লুঙ্গিটা নিয়ে শাদাদ ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,

— ওয়াশরুম থেকে প্যান্টটা বদলে লুঙ্গিটা পরে নিন।

শাদাদ ভাই লুঙ্গির দিকে একবার তাকিয়ে আমাকে দিলেন এক রামধমক। আমি কেঁপে উঠলাম।

— বিয়ে বাড়িতে কত সুন্দরী মেয়েরা আসবে। আর আমি কি-না লুঙ্গি পরে মফিজ সেজে ঘুরে বেড়াবো? তোর কি আমাকে দেখে পাগল মনে হচ্ছে?

মনে মনে সাহস সঞ্চার করে শাদাদ ভাইকে বলি,

— আপনাকে আমি সাহায্য করতে চাচ্ছি কারণ আমার কারণে আপনার ছত্রিশ’শ টাকার প্যান্ট নষ্ট হয়েছে। এখন আপনি বলুন আপনি কি করবেন? লুঙ্গি পরে আমাকে প্যান্ট দিন ধুয়ে দেই মেহমান আসার আগে আপনার প্যান্ট শুকিয়ে যাবে। আর যদি মনে হয় দরকার নেই তবে এভাবে ঘুরতে থাকেন। একটুপর যখন গন্ধ বের হবে তখন মেয়েরা আপনার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করবে।

শাদাদ ভাই আমার হাত থেকে লুঙ্গি নিয়ে ওয়াশরুম গিয়ে স্ব শব্দে দরজা লাগিয়ে দিলেন। এদিকে দরজার শব্দে মনে হলো পুরো ঘরের সঙ্গে আমিও কেঁপে উঠেছি। এরইফাকে, বুয়াকে ডেকে এনে ঘর পরিষ্কার করিয়ে ফেললাম। ড্রয়ার থেকে ঔষধ খেয়ে বসে অপেক্ষা করছিলাম শাদাদ ভাইয়ের জন্য।

একটুপর দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখি, আমাদের হিরো শাদাদ ভাই আজ মফিজের লুঙ্গি পরেছেন। কালো পাঞ্জাবির সঙ্গে সাদা ধবধবে লুঙ্গি। আহ্ পুরাই হিট! এবার হিরো খান থেকে জিরো খানের মতো দেখাচ্ছে তাকে।

হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্যান্টটা ভেজা হয়তো শাদাদ ভাই ধুয়ে ফেলেছেন। আমার তাকানোর মানে হয়তো বুঝতে পেরেছেন। নিজের মাঝে বীরত্ব ফুটিয়ে অহংকারী হয়ে বললেন,

— ট্রেনিংয়ে নিজের কাজ নিজেই করতে হয় বুঝলি। তোর মতো মেয়েকে একটা প্যান্ট ধুতে দেই আর তুই প্যান্ট ধুয়ে অচেতন হয়ে পরে যা। আর তোর হাবি গুষ্টিশুদ্ধো ডাক্তারকে ডেকে ডেকে গলা শুকিয়ে ফেলুক।

— আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন, শাদাদ ভাই?

— তোকে অপমান করলাম কই? যা সত্য তাই বলছি। যেই মেয়ে সামান্য একটা চুমুর ধকল সহ্য করতে পারে না। জ্বর এসে যায় সেই মেয়েকে নাকি আবার বিয়ে দিবে ! হুহ্ বাসর রাতে স্বামীর মেইন আদর পেলে তুই সোজা স্বর্গবাসী হবি, আমি শাদাদ বলে রাখলাম। এ্যহ, আসছে বিয়ে করতে…

মুখ ভেঙচিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে বের হতে গিয়েও শাদাদ ফিরে এসে লতার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— আরেকটু বড়ো হো। বেচারা তোর স্বামীটার জন্য হলেও তুই একটু বড়ো হয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিস। নয়তো, বেচারা তোকে বিয়ে করেও ব্যাচেলার থাকতে হবে। কারণ, তুই তো চুমু খেয়ে একশ চারের জ্বর বাধিয়ে ফেলছিস। পাশে বৌ রেখে কে আদর ছাড়া থাকতে পারে বল??? আমি হলে অন্য কথা। আমার বৌকে আমি একটু কষ্ট দিব না। বৌ যদি বলে এখন রাত তারমানে এখন রাত। ও যা বলবে তাই সই। অন্য পুরুষেরা এতটা ছাড় দেয় না বুঝলি। কিন্তু, আমি শাদাদ ভদ্র ছেলেকে কিনা। তাই আমারটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমি আমার বৌকে কষ্ট দিব না। বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে আগে আদর খাওয়ার বয়সে পরিণত হ। তারপর, বিয়ে করিস। আমার তো তোর জামাইয়ের জন্য কঠিন দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

কথাগুলো বলতে বলতে শাদাদ ভাই চিন্তিব মুখল বের হয়ে গেলেন। আর আমি কি বলব কিংবা কি রিয়াকশন দিব বুঝতে পারলাম না। তবে, শাদাদ ভাই যে চূড়ান্ত পর্যায়ের অসভ্য আজ বুঝতে পারছি। ছিহ্ কি করে একটা মানুষ ওসব কথাতে চলে যেতে পারে?

যার কপালে এই অসুরটা আছে তারচেয়ে পোড়াকপালি বোধহয় আর কেউ নেই। গতকাল রাতের ঘটনার পর তার জন্য মনের আঙিনায় বসন্তের বাতাস লেগেছিল। আজ তার কথা শুনে কালবৈশাখির তান্ডবে সব অনুভূতি হাওয়া হয়ে গেছে। ভ্যানিস… এমন মানুষের কাছে না ঘেসাই ভালো। ভালোবাসা তো দূরের কথা।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here