#বিরহ_ভালোবাসা-০৮,০৯
#Tahmina_Akhter
৮.
শাদাদ ভাই পরদিন চলে গেলেন কাউকে কিছু না বলেই। বিষন্ন মনে তার কথা ভাবছিলাম। ইদানীং বিশেষ একটা সমস্যা আমার মাঝে বেড়ে ওঠছে। তা হলো কোনো কারণ ছাড়া যে কোনো জায়গায় আমি শাদাদ ভাইয়ের অস্তিত্বকে খুঁজে বেড়াই। অথচ, তিনি ট্রেনিংয়ে আছেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে। এটি চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী ভাটিয়ারী নামক স্থানে।। হুট করে রাস্তায় কারো মাথায় হ্যাট দেখলেই মনে হলো শাদাদ ভাই। কিন্তু, চোখের সামনে এলে বুঝতে পারি মানুষটা অন্য কেউ। এই যে আমার তাকে কারণে অকারণে দেখার অসুখ হলো আমি কাকে গিয়ে বলব? যার জন্য আমার এই রোগ তাকে বললে কি ফলাফল পাব? আর সে আমার রোগে আক্রান্ত কিনা সেটাও তো জানি না। কিন্তু, সে যদি আমাকে পছন্দ না করে তখন আমার কি করণীয় থাকবে? হুট করেই সে আমার পছন্দের মানুষ বনে গেছে। কিন্তু, চাইলেই কি আর হুট করে তাকে আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে বের করা যাবে?
এত প্রশ্ন অথচ উত্তর নেই। সবকটা প্রশ্নের সমীকরণ সমাধান করতে চাই। কিন্তু, ঘুরে ফিরে সেই শূন্যস্থানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি আমি।
পরীক্ষা শেষ করে একটা দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীন হয়ে ঘুরছি। পড়ালেখার চাপ নেই। মায়ের শাসন নেই। বাবা প্রত্যেক শুক্রবারে বাবার বাইকের পেছনে বসিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছেন। আসার সময় মায়ের জন্য একটা করে গোলাপ আনতে বাবা ভুল করছেন না। বাবার এই দিকটা কেন যেন ভীষণ ভালো লাগে আমার! বাবার হাজার ব্যস্ততার মাঝেও মায়ের জন্য গোলাপফুল আনতে ভুলেন না। এতবছরের সংসার ; মাঝে মাঝে তাদের মাঝে ছোট বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় কিন্তু দিনশেষে তারাই একে অপরের পরিপূরক।
তেহজীব সাহেবের সঙ্গে একদিন সকালে দেখা হলো পাবলিক লাইব্রেরীর ভেতরে। আমি সবে ভেতরে ঢুকছিলাম আর তিনি বের হচ্ছিলেন। আমাকে দেখা মাত্র অনুরোধ করছিলেন পাশের এক রেষ্টুরেন্টে বসতে। উনার নাকি কথা আছে আমার সাথে। এতবার অনুরোধ করলো যে বারণ করতে পারিনি।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। দুটো কোল্ড কফির অর্ডার দিলেন তেহজিব সাহেব। কফি এলে উনি আমার দিকে কফি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
— আমি অনেক অনেক দুঃখিত মাধবীলতা। আসলে সেদিন আপনাকে হুট করে দেখে ভালো লেগে যায় আমার। তাই মায়ের কথায় রাজি হয়ে যাই। কিন্তু, আপনার কাজিন কি যেন নাম সৈকত চৌধুরী যিনি ট্রেনিংয়ে আছেন। উনার কথায় আমি ভীষণ হার্ট হয়েছি। একজন মানুষের ভালো লাগা , মন্দ লাগা থাকতেই পারে। আমার আপনাকে ভালো লেগেছে এতে দোষের কিছু তো নেই। কিন্তু, উনি আমার বাসায় এসে গালমন্দ করে এসেছেন।
অনেকক্ষণ ধরেই তেহজিব সাহেবের কথা শুনছিলাম। কিন্তু, শাদাদ ভাইয়ের বিপক্ষে কথা শুনে আর ভালো লাগছিল না। তাই এবার মুখ খুলে কিছু শক্ত জবাব দিলাম।
—- আপনি একজনের সঙ্গে কমিটমেন্টে আছেন। অথচ, আমাকে দেখেই আপনার ভালো লেগে গেল? ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন? মানে হলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সমস্যা আছে। আর রইলো শাদাদ ভাইয়ের কথা উনি ঠিক কাজই করেছেন। সেদিন যদি সঠিক সময়ে উনি খবরটা না জানতেন। তবে আমার পরিবার আপনার মতো একটা নীচু লোকের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেলতেন। যেই লোক একজনকে ভালোবাসার কথা বলে অন্য একজনকে পছন্দ করতে পারে। সে আর যাই হোক ভদ্রলোক হতে পারে না।
কথাগুলো বলে আর দেরি না করে সেদিন আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসি।
——————————
হুট করে একদিন বিকেলে আমার নামে একটা চিঠি এলো পোস্ট অফিস থেকে। মা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমার হৃদপিন্ড যেন বুকের পাঁজর ভেঙে বের হয়ে আসবে। কোন হতচ্ছাড়া আমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেললো কে জানে?
চিঠির খামটা নিয়ে প্রায় আধঘন্টা ধরে বসে আছি। সাহসের অভাবে খাম খুলে চিঠি বের করে পড়ার সাহস পাচ্ছি না। কিন্তু, মনটা আকুপাকু করছে কার চিঠি হতে পারে ভেবে? অবশেষে দোয়া-দরুদ পড়ে খামটা হাতে নিয়ে চিঠি বের করলাম। হলুদ খামে লেখা চিঠি।
তোকে প্রিয় বলতে বাঁধে
মধ,
খুব তো চিল মুডে আছিস দেখছি। অথচ ট্রেনিংয়ে এসে আমি রোদে-পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছি। মাঝেমাঝে দুএকটা চিঠি লিখলেও তো পারিস। জিজ্ঞেস তো করতে পারিস শাদাদ ভাই কেমন আছেন? কিন্তু, না আপনার তো বলতে বাঁধে। জানিস না আমি কতটা মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছি। কিন্তু, বাবার আমাকে নিয়ে স্বপ্নের কথা মনে হলে এসব কষ্ট তুচ্ছ মনে হয়। বিএমএর ট্রেনিংয়ে থাকা মানে মরণ কষ্টে থাকা। ছুটি পাচ্ছি না। ট্রেনিংটা শেষ হলো সাই করে সেকেন্ড ল্যাফটেন্টেট। তারপরই শুরু হবে বেসিক কোর্স।
অনেক তো হলো কাজের কথা। এবার আসল কথায় আসি।
ইদানীং আমার স্বপ্নে একটা মেয়ে আসে। সে আমার পরিচিত। ডাগরডাগর চোখদুটো দিয়ে আমার দিকে অনেক অভিমান নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় যেন কিছু বলতে চায়। আমারও জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগে সকাল হয়ে যায় আর স্বপ্ন গায়েব।
মেয়েটাকে এখন আমি বাস্তবে দেখতে পাই। মনে হয় কালো কাতান শাড়ি আর বড়ো খোঁপায় বেলীফুল গুঁজে আমার কাছে হাত বাড়িয়ে দেয় একটুখানি ভালোবাসা পাবার আশায়। ইসস্ কথাগুলো বলতে বলতে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে রে মধু।
মধু, তুই একটু আশেপাশে খোঁজ খবর নিয়ে দেখিস তো বড়ো চোখের, টিয়াপাখির মতো লাল ঠোঁট ওয়ালা, কাজল চোখের মেয়ে আছে কিনা?
ইতি,
শাদাদ ভাই
চিঠিটা শেষ অব্দি পড়ার পর লতার মনে একটাই অভিযোগ কেন সে এই চিঠিটা খুলে পড়েছে? না পড়লে বরং ভালো হতো। তার প্রেমিকার বর্ণনা শুনে লতার কানা তালা লেগে গেছে মন হচ্ছে।
—- স্বপ্নে মেয়ে দেখে না! ঢং দেখলে বাঁচি না। বাস্তবে কোন মেয়েকে দেখে তার ভালো লেগে গেছে আর এখন স্বপ্নের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে।
লতা রাগ করে চিঠিটা দুমড়েমুচড়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও ফেললো না। চিঠিটা নিয়ে রিডিংটেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রাখল।
এরপর, থেকে লতার একটা দিনও ভালো কাটে না। এত সুন্দর মূহুর্তগুলো যেন বিষাদময় ক্ষণে পরিণত হয়েছে। নাহ্ আর কতদিন এভাবে কাটাবে? তাই লতা সিদ্ধান্ত নেয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য এখনই কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। বাবাকে বলে কাছের এক কোচিংয়ে ভর্তি হলো। পড়াশোনার মাঝে ডুব দিয়ে আশেপাশের ঘটনা থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে লাগল লতা। ভাবসাব দেখলে মনে হবে মেয়েটার জীবনের একটাই লক্ষ্য আর তা হলো পড়াশোনা। কিন্তু, দিনশেষে যখন রাত হয়। তখন লতার বালিশ গুলো জানে লতার মনে কেউ একজন আছে। নয়তো তার জন্য রোজ নিয়ম করে কেঁদে কেটে বালিশ ভেজানোর মানে কি?
পনেরোদিন পরের কথা…
লতা এইচএসসি পরীক্ষায় A পেলো। ওর মা তো পারছে না ওকে ধরে ইচ্ছামতো কেলানী দিতে। কিন্তু, লতার বড়ো জেঠু আর বাবার জন্য পারছে না। উনাদের কথা লতা ভালো করার চেষ্টা করেছে এটাই অনেক। সামনের দিকে আরও ভালো রেজাল্ট করবে।
লতা মনে মনে তখন শাদাদ ভাইকে বকছিল। কারণ,উনার জন্যই তো লতার রেজাল্ট খারাপ হলো। পরীক্ষার খাতায় লিখতে গেলে উনার চেহারা খাতার মাঝে ভেসে ওঠতো। এই শাদাদ ভাইয়ের জন্য ওর মনটা তো ভেঙেছে সেই সঙ্গে রেজাল্টও খারাপ হলো।
শাদাদ ভাইয়ের ওপর ভীষণ রাগ করে চিঠি লিখলো লতা।
অপ্রিয়
শাদাদ ভাই।
নিশ্চয়ই অনেক অনেক ভালো আছেন। ভালো থাকারই কথা। আপনি তো সবসময় চেয়েছেন আমার যাতে কোনদিকেই ভালো না হয়। হলোও তাই আপনার কারণে আমার এইচএসসির রেজাল্ট খারাপ হলো। এখন এলাকার মানুষ জানবে লতার মাথায় গোবরে ভরা। নয়তো, এত সহজ পরীক্ষায় শুধু A পেয়েছে।
দোয়া করি আপনার সেই পছন্দের মানুষের যেন মাথার চুল পরে টাক বেরিয়ে আসে। তার ডাগরডাগর চোখদুটো যেন চুলের চিন্তা দেবে যায়। তখন আপনিও কি করে তার চিন্তায় ডুবে থাকেন আমিও দেখব।
ইতি
মাধবীলতা।
#চলবে…
#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
৯.
চিঠি পাঠিয়েছি মাসখানেক কিন্তু শাদাদ ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোনো জবাব এলো না। বিষয়টা আমার খটকা লাগে। মানে একটা লোক তার পছন্দের মানুষের বিরুদ্ধে এমন কঠিন বদদোয়া শুনে কি করে এতটা কুল থাকতে পারে!
আবার মাঝে মাঝে চিন্তা করি শাদাদ ভাই হয়তো চিঠিটা পায়নি। চিঠি অন্যকারো ঠিকানায় চলে গেছে। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম শাদাদ ভাই আর উনার জন্য প্রেরণকৃত চিঠি নিয়ে ভাবনা আজ থেকে বন্ধ দিব।
ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। নতুন পরিবেশ। নতুন টিচার এবং নতুন বন্ধুবান্ধব। রোজ নিয়ম করে রিকশায় চড়ে ভার্সিটিতে যাচ্ছি। ছুটির সময় বাবা বাইকে বসিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসছেন। বাসায় এসে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া। গভীর রাত অব্দি জেগে পড়াশোনা। ব্যস লাইফটা এতটুকুতেই অব্দি সীমাবদ্ধ।
মাঝে মাঝে যখন বিকেলে বসে থাকি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দূর আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় শাদাদ ভাইয়ের মুখটা ভেসে ওঠে। তখন হুট করে মনটায় বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। দুচামচ চিনি দেয়া চায়ে চুমুক দিলে মনে হয় নিমপাতার জুস খাচ্ছি। ভালোবাসায় এত তিতা যদি আগে জানতে পারতাম। তবে হৃদয়কে কড়া শাসনে বেঁধে রাখতাম যাতে করে শাদাদ ভাইয়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভে না পরতো।
একদিন সকালে নাশতা খাওয়ার সময় বড়ো জেঠু ঘোষণা দিলেন, আজ বিকেলে রুপা আপাকে দেখতে পাত্রপক্ষের দশজন আসবে। আমি তো মনে মনে ভীষন এক্সাইটেড। রুপা আপার মুখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আপা ভীষন লজ্জা পাচ্ছেন। সুযোগ বুঝে আপা চলে গেলেন নিজের ঘরে।
এদিকে আমি, মা আর জমিলার মা মিলে বাড়ির খুটিনাটি কাজ থেকে শুরু করে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করে ফেললাম।
বিকেল পাঁচটার পর পাত্রপক্ষের ছয়জন লোক এলেন দশকেজি মিষ্টি, চার হাড়ি দই, চার কেজি রসমালাই সঙ্গে মৌসুমি ফল নিয়ে। আমি দোতলায় আড়ালে দাঁড়িয়ে উনাদের পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কারণ, মা আজ বারণ করেছেন আগত মেহমানদের সামনে যেতে। দুজন নারী, তিনজন পুরুষ সঙ্গে সাত বছর বয়সী একটা ছেলে। ড্রইংরুমে বসলেন উনারা মা আর জমিলার মা মিলে নাশতা দিলেন উনাদের সামনে। উনি হালকা কিছু মুখে দিয়ে, রুপা আপাকে দেখতে চাইলেন। বড়ো জেঠু মাকে ইশারা করলে মা এসে রুপা আপকে নিয়ে গেলেন। আপাকে দেখে পছন্দ করলেন পাত্রপক্ষরা। তাছাড়া, এমন মেয়ে কে না পছন্দ করে! মাস দুয়েক হলো ব্যাংকে চাকরি করছে। ভালো বেতনের চাকরি। তবে আপার জন্য আসা ছেলেটা নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সবদিক দিয়ে মিলিয়ে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে চলেছে।
ছেলের পক্ষ থেকে আপার হাতে আংটি পরিয়ে দেয়া হলো। এবং, একসপ্তাহ পর আপার বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হলো।
বাড়িতে আনন্দের মাত্রা বেড়ে গেছে। একে একে সব আত্মীয়-স্বজন আসা শুরু করেছে। আসেনি শুধু শাদাদ ভাই। প্রত্যেকদিন দরজার দিকে তাকিয়ে আমার সকালে শুরু হয় আর রাত শেষ হয়। তবুও, মানুষটা আসে না। লজ্জায় মাকে কিংবা রুপা আপাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না তার কথা। যদি উল্টাপাল্টা ভেবে বসে সেই ভয়ে।
আপার সঙ্গে একদিন বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়ে রুপা আপার হবু দেবরের সঙ্গে দেখা। নাম রবিন। আমাদের ভার্সিটিতে নাকি পড়ছে। আগামী বছর উনার সেমিস্টার শেষ। অথচ, উনাকে কখনো দেখেছি বলে আমার মনে হয় না। তবুও, কিছু বললাম না। কারণ,গুনে গুনে তো ভার্সিটির সকল লোককে চিনে নেয়ার দায়িত্ব তো আমার একার নয়। যতক্ষণ অব্দি কেনাকাটা চললো ততক্ষণ অব্দি রবিন সাহেব আমার সাথে এই কথা সেই কথা বলে চলেছেন। মনে মনে আমি তার ওপর ভীষন বিরক্ত কিন্তু হাসিমুখে সবটা মেনে নিচ্ছি। কারণ, যতই হোক রুপা আপার দেবর বলে কথা। আসার সময় রবিন সাহেব আমার দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
— লতা এটা রাখেন। প্লিজ ফিরিয়ে দেবেন না। নয়তো আমি ভীষন কষ্ট পাব।
আমি নিতে চাচ্ছিলাম না কিন্তু রুপা আপা চোখের ইশারায় অনুরোধ করলো রাখার জন্য। মন না চাইতেও রাখতে হলো আমার। রুপা আপার হবু স্বামী জাভেদ ভাই আমাদের সিএনজিতে উঠিয়ে দিলেন।
বাড়িতে পৌঁছানোর পর দেখলাম, ড্রইংরুমে নতুন কয়েকটি মুখ দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা মুখ আমার বড্ড চেনা। শাদাদ ভাই এসেছেন! হাসিমুখে উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব কিন্তু তার আগে মনে পরলো কিছু মাস আগে আমি তার পছন্দের মানুষটার জন্য আমি বদদোয়া করেছি। এখন যদি উনার সামনে যাই তবে আমাকে মেরে আলুভর্তা বানিয়ে ফেলবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শাদাদ ভাইয়ের দল থেকে নিজেকে আড়াল করে চুপিচুপি ঘরে চলে এলাম। চটজলদি পরনের কাপড়টা বদলে খয়েরী রঙের সুতির একটা থ্রী-পিছ পরে নিলাম। চুলটাকে ছেড়ে দিলাম কারণ ভেজা চুল। মার্কেটে যাবার আগে গোসল করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু, চুল শুকানোর সময় পাইনি।
চুপিচুপি ছাঁদে চলে গেলাম তবে যাওয়ার আগে জমিলার মাকে বলে এসেছি, আমার জন্য এক কাপ চা ছাঁদে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য ।
ছাঁদে এসে দেখলাম সূর্য পশ্চিমের আকাশে জায়গা করে নিয়েছে। সূর্যের অস্তিমান সময়টা আমার কাছে দারুণ লাগে। দিনের পুরোটা সময় নিজের তাপমাত্রা দিয়ে পুরো পরিবেশে তান্ডব চালিয়ে অস্তিমান বেলায় ধীরে ধীরে শীতল রুপ ধারণ করে।
এমন সময় লতার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়। লতা হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে জমিলার মাকে বললো,
— তুমি এত দেরিতে চা আনলে কেন? মাথাটা প্রচুর ধরে আছে। আর কিছুসময় এভাবে থাকলে মাথা ফেটে যেতো আমার।
বলেই এক চুমুক চা মুখে দিলাম। উত্তরের আশায় জমিলার মায়ের মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু জমিলার মায়ের মুখ দেখার সৌভাগ্য হলো না আমার। দেখতে পেলাম শাদাদ ভাইয়ের মুখটা । হাতদুটো বুকের মাঝে ভাজ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। শাদাদ ভাইকে দেখে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। মানে যার ভয়ে ছাঁদে পালিয়ে এসেছি সে কিনা ছাঁদে চলে এসেছে। আমারই সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে! যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত পোহাতে হয়!
— বাহ্ আমাদের পরিবারের মেয়েদের বেশ উন্নত হয়েছে দেখছি! রেজাল্ট খারাপ করছে নিজে কিন্তু দোষ চাপানো হচ্ছে অন্য কারো ঘাড়ে। যার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে আবার তারই পছন্দের মানুষকে বদদোয়া দেয়া হচ্ছে।
— দে..দেখুন শাদ…শাদাদ ভাই আমি কিন্তু ভুল কিছু লিখিনি। আপনার জন্য আমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।
লতা ভয়ে ভয়ে কথাগুলো বললো। শাদাদ ভাই আরও এককদম এগিয়ে এসে লতার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। এরপর, ফিসফিসানো কন্ঠে বললেন,
— কেন রে আমার জন্য তোর রেজাল্ট খারাপ হবে কেন? আমি কি তোর পরীক্ষার খাতায় ভুলভাল কিছু লিখে দিয়েছি? নাকি আমি পরীক্ষার হলে তোর খাতার ওপর আসন নিয়েছিলাম যে তুই লিখতে পারিসনি বলে তোর পরীক্ষা খারাপ হয়েছে।
শাদাদ ভাই কথাগুলো বলে লতার মাথার উপরে হাত দেখতে লাগলেন, লতার চুল কতটা পাতলা হলো? বোকা লতা চট করে শাদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে সরে এসে বললো,
— আপনাকে কারণটা বলব, কেন?
— আমাকে না বললে কাকে বলবি? তোর চিঠিতে লেখা এক একটি শব্দ আমার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে, মধু। আর তোকে কে সাহস দিয়েছে আমার পছন্দের মানুষকে বদদোয়া দেয়ার জন্য?
— বেশ করেছি তার জন্য বদদোয়া করে। দোয়া করি তার সকল সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যাক। আর আপনি তার সৌন্দর্যের চিন্তায় পথের ফকির হয় যান।
বলেই একদৌঁড় ছাঁদ থেকে নেমে চলে যায় লতা। লতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে শাদাদ ভাই। তারপর, ছাঁদের কার্নিশে রাখা চায়ের কাপটা হাতে তুলে চুমুক দিয়ে চা-টা শেষ করলো। আনমনা হয়ে অস্তমিত সূর্যটার দিকে তাকিয়ে শাদাদ ভাই বলছেন,
— নে নিজেকে নিজে বদদোয়া দিয়ে মাথার চুল পাতলা করে ফেলেছিস। এত সুন্দর চোখদুটো দেবে গেছে তোর। সাধে কি আর তোকে বোকারানী বলি! নিজের দোয়ায় এবার নিজে লতা ফকিন্নি হ। আর আমার জন্য মনে মনে বদদোয়া করে বলবি, শাদাদ ভাইয়ের পছন্দের মানুষটার যেন সকল সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যায়। আর শাদাদ ভাই যেন পথের ফকির হয়ে যায়।
কথাগুলো বলতে বলতে শাদাদ ভাইয়ের ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখা ফুটে ওঠে। লতার মনে যে শাদাদ ভাইয়ের পছন্দের মানুষের জন্য ঈর্ষা আছে তা খুব ভালো করে টের পাচ্ছে শাদাদ ভাই।
এখন শুধু অপেক্ষার পালা কে আগে কার খোলস থেকে বের হয়ে নিজের ভালোবাসা জাহির করবে অপরপক্ষের কাছে? নাকি দুজনের মান-অভিমানের রোষানলে পরে ভালোবাসা হারিয়ে যাবে কালক্রমে?
#চলবে…