বিরহ_ভালোবাসা-০৬,০৭

0
224

#বিরহ_ভালোবাসা-০৬,০৭
#Tahmina_Akhter
৬.

পরদিন ভোরবেলা আমার নানুর ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম ঘুম চোখে নানুর দিকে তাকিয়ে আছি এটা জানার জন্য যে, কেন এত ভোরবেলা ডাকছে?

নানু জায়নামাজ ভাজ করতে করতে বললেন,

— তোর বড়ো জেঠুর পোলাডা আছে না শাদাদ একটু আগে তোরে ডাইকা গেছে। ট্রেনিং নাকি যাইব গা। যাহ্ গিয়া দেহা কইরা আয়। এরপর, সারাবেলা বিড়ালের লাহান পইরা ঘুমাইয়া থাকিস।

বিরক্তি এসে শরীরে ভর করেছে। তবুও, কষ্ট করে হলেও চোখের ঘুম একপাশে রেখে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছে ফেললাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুলে হাত খোঁপা করে ঘর থেকে বের হয়ে শাদাদ ভাই যে ঘরে থাকেন সেই ঘরের দিকে যাচ্ছি। দরজার কাছে যেতেই দেখলাম শাদাদ ভাই রেডি হয়ে বস আছেন। হলুদ টিশার্ট, কালো জিন্স ক্লিন শেভড পুরো টিপটপ সেজে বসে আছেন। হুট করে মনটা খারাপ হয়ে আসছে। চলে যাবেন শাদাদ ভাই। আবার কবে না কবে ফিরে আসবেন উনি? বাড়িতে এলে হাজারবার বিরক্ত করুক তবুও উনার উপস্থিতি বড্ড ভালো লাগে আমার। উনি মানুষটাই এমন দূরে গেলেও যন্ত্রণা, কাছে থাকলে আরও বেশি যন্ত্রণার।

— কি রে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস ক্যান? আয় আমার সঙ্গে গেট অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসবি।

ধ্যান-ভগ্ন হলো শাদাদ ভাইয়ের কথায়। দেখলাম হাতে ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি পা চালিয়ে শাদাদ ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটছি। বাড়ির সদর দরজা পের হতেই শাদাদ ভাই হুট করে দাঁড়িয়ে পরলো এরপর আমাকে বললো,

— ভালো থাকিস। আর শোন ওই তেহজিব না তেজপাতা ওই ব্যাটার সঙ্গে বিয়ের আলাপ এলে বারণ করে দিবি। ব্যাটার চরিত্র ভালো না। কলিগের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। অথচ, মা যখন বললো, বাবা বিয়ে করবি আমাদের পছন্দের পাত্রীকে। ব্যস, তিনি এখন ওই মেয়েকে ছেড়ে তোর পেছনে পরেছে।
এইসব লুচ্চা ক্যাটাগরির পোলারা যেখানে মেয়ে দেখে ওখানে জিহ্বা বের করে হা করে থাকে।
আয় তোর সঙ্গে একটা সেলফি তুলি। কবে না কবে দেখা হয় তোর সঙ্গে। তুই আবার আমার সঙ্গে ছবি তুলে রানী এলিজাবেথ বনে যাস না। তোর ছবি সঙ্গে রেখেছি যেন, ঘুম বেশি এলে তোর পেত্নিমার্কা চেহারা দেখে নিজের চোখের ঘুমকে তাড়াতে পারি।নয়তো, তোর ছবির যোগ্যতা আছে আমার আইফোনে থাকার!

মোবাইল বের করে ক্লিক করে দু’চারটা সেলফি তুলে ফেললেন শাদাদ ভাই। রাগে দুঃখে মনটায় চাচ্ছে শাদাদ ভাইয়ের মাথার চুলগুলো টেনে ছিড়ে ফেলি। আর উনি টাক হয়ে যাক। ব্যস, কাহিনী খাতাম।

— তেহজিবের গার্লফ্রেন্ড আমার বন্ধুর বড়ো বোন। গতকাল রাতে সুমনের সাথে তোর ব্যাপারটা আলোচনা করছিলাম। কথায় কথায় চেনা-জানা হলো। তখন সুমন বললো যে, ওর বোনের সঙ্গে আজ চার বছরের প্রেম। কিন্তু, ওর বাবা-মায়ের কথায় নাকি এখন সে সুমনের বোনকে বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে।

লতার তো ইচ্ছে করছে তেহজিব শয়তানকে সামনে পেলে মরিচ ডলে লাগিয়ে দিতো ওর চোখে। কত্ত বড়ো শয়তান লোক! এত বছর প্রেম করে এখন বাবা-মায়ের পছন্দের দোহাই দিয়ে একটা মেয়ের এত বছরের স্বপ্নকে পায়ে পিষে ফেলেছে।

কিন্তু, মনে একটাই প্রশ্ন শাদাদ ভাই এতকিছু কার কাছ থেকে জেনেছেন?

লতার রাগান্বিত মুখটা দেখে শাদাদ লতার গালে হাত রেখে বললো,

— থাক রাগ বাড়িয়ে নিজের বিপি হাই করিস না। নিজের খেয়াল রাখিস। আমার কিন্তু একটা কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে?

— কি কথা শাদাদ ভাই?

লতা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে শাদাদের দিকে উত্তরের আশায়।

— তোর বিয়ের স্বপ্নটা পূরণ হলো না।

কথাটি বলে শাদাদ ভাই রিকশায় চড়ে বসলেন। আর আমি রাগে-দুঃখে পারছি না নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলি। মানে একটা মানুষ নিজের কথা দিয়ে একটা মানুষকে কতটা বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে!

রিকশা চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। লতা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কিনারায়। অপেক্ষা কখন শাদাদ ভাইয়ের রিকশাটা চোখের সামনে থেকে আড়াল হবে।

রিকশা চোখের আড়াল হলেই লতা বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। একটিবার যদি পেছনে ফিরে তাকাতো তবে দেখতে পেতো, তৃষ্ণার্ত একজোড়া আঁখি অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে লতার দিকে। দুচোখে তার লতাকে হারানোর ভয়।

——————-

পুরোদমে লতার পড়ালেখা চলছে। একসপ্তাহ পর থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। রুপা আপা এবং বড়ো জেঠু সর্বাত্নক সাহায্য করছে লতাকে পড়াশোনার ব্যাপারে। তেহজিব সাহেবের পরিবারকে লতার বাবা বিয়ের জন্য বারণ করে দিয়েছে। উনার একটাই কথা ওমন মেরুদণ্ডহীন ছেলের কাছে উনার সোনার মতো মেয়েকে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তৃনা লতার বাবার ওপরে গিয়ে আর কিছু বলেনি। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায় কি করতে যাচ্ছিলেন তিনি? যদি শাদাদ সত্য ঘটনাটি না জানত। তখন তো ঠিকই লতাকে ধরে বেঁধে তেহজিবের সঙ্গে বিয়ে দিতেন তিনি।

প্রথম পরীক্ষার দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ার টেবিলে বসে বই খুলে পড়ায় মনোনিবেশ করে লতা। এক অধ্যায় পড়ে অন্য অধ্যায় পড়তে গিয়ে লতার মনে হলো সে জানালা দিয়ে শাদাদ ভাইকে দেখেছে। তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে নীচে যেতেই দেখতে পেলো সত্যি সত্যি শাদাদ ভাই এসেছেন।

কাঁধের ব্যাগটা সবে ড্রইংরুমের সোফায় রেখেছে। এমনসময় লতার উপস্থিতি টের পায় শাদাদ। লতার দিকে বললো,

— কি রে সকাল সকাল হাফপ্যান্ট পরে বাড়িতে ভূতের মতো ঘুরছিস ব্যাপার কি? লজ্জা শরম বেচে কি হাওয়াই মিঠাই খেয়েছিস ?

শাদাদ ভাইয়ের কথায় লতা নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে দিলো এক দৌঁড়। গতকাল রাতে অতিরিক্ত গরম লাগছিল বিধায় সে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর ফতুয়া পরে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু, সকাল সকাল শাদাদ ভাইয়ের আগমন ঘটেছে দেখেই তো লতা নিজের দিকে খেয়াল করেনি।

ঘরে এসে দরজায় খিল এটে ইংরেজি বইটা হাতে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু, কোনোভাবেই পারছে না। অসভ্য শাদাদ ভাইয়ের কথা মনে পরছে আর লতার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। এবার পরীক্ষার খাতায় কি লিখবে লতা?

সাড়ে আটটা বাজার আগে লতা গোসল সেড়ে ফেললো। কিছু সময় পর লতার মা এসে লতাকে রুটি খাইয়ে দিয়ে গেলেন। আরেকবার বইটা নিয়ে রিভিশন দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে পরীক্ষার যাবতীয় কাগজপত্র, কলম, স্কেল নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই একগাদা ফুল এসে লতার গায়ের ওপর বর্ষন হচ্ছে। লতা চোখ খুলে তাকাতেই দেখতে পেলো, ওর পরিবার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ফুলের ছিটা দিচ্ছে। রুপা আপা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুভকামনা জানালো। এরপর, একে একে বাবা, জেঠু এবং মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিলেন।

আমার দুচোখ তখন অন্য একটা মানুষকে খুঁজছে। সেই মানুষটাকে খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে শাদাদ ভাই। মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে? মনটা হুট করে খারাপ হয়ে গেলো। সবাই আমাকে শুভকামনা জানালো কিন্তু শাদাদ ভাই জানালো না কেন? বিষন্ন মনে বাবাকে বললাম,

— বাবা নিয়ে যাবে না আমাকে?

— আজ তো আমি যাব না। শাদাদ নিয়ে যাবে তোকে।

— ব্যস আজ আর পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে হবে না। শাদাদ ভাইয়ের সঙ্গে এক রিকশায় যেতে সব ভুলে যাব আমি, বাবা।

মনে মনে কথাগুলো বলতে বলতে লতা নুইয়ে পরছিল৷ না পারছে কাউকে বারণ করতে আর না পারছে শাদাদ ভাইয়ের সঙ্গে যাওয়াটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে।

এক রিকশায় পাশাপাশি বসে পরীক্ষার হলের উদ্দেশ্য রওনা হলো লতা আর শাদাদ ভাই। দুজনই চুপ। রাস্তার পাশে অসংখ্য গাড়ি ছুটে চলেছে নিজেদের গন্তব্যস্থলে। হুট করে একটা গান এসে শাদাদের কানে পৌঁছায়।

“এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো”

শাদাদ জানে আজ মনটা কতটা শান্তি পাচ্ছে। এতদিন তো বেশ অশান্তিতে কাটছিলো তার। হুট করে আজ সকালে মাধবীলতা নামক জীবন্ত এক ফুলকে দেখে শাদাদের দিনটা আজ বরকতময় আর প্রশান্তিময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু, মধু এভাবে চুপ করে আছে কেন? কোনো কিছু নিয়ে আবার দুশ্চিন্তা করছে না তো আবার?

— এভাবে টেংরা মাছের মতো ব্যাঁকা হয়ে আছিস কেন? সোজা হয়ে বস। দেখে মনে হচ্ছে উনাকে কেই রিকশায় জায়গা দিচ্ছে না।

শাদাদের কথায় লতা সোজা হয় বসলো ঠিকই তবে শাদাদের থেকে ডিস্টেন্স রেখেই। ভুল করেও যেন শাদাদের পায়ের সঙ্গে লতার পা যেন না লাগে। শাদাদ মনে মনে হাসছে লতার কান্ড দেখে। কিন্তু, মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে।

— নিরা ফ্রেন্ড হয় তোর?

শাদাদ ভাইয়ের কথায় চমকে উঠে লতা। নিরা কথা উনি কি করে জানলেন?

— এই সবই করিস স্কুলে এসে! টিপাটিপি শিখবা ওদের প্রেম দেখে। নাক টিপলে দুধ বের হবে এমন মেয়ে স্কুলে এসে বান্ধবীদের প্রেমের সময় পাহাড়া দাও। আজকের পর যদি শুনি নিরা না ফিরা নামের মেয়েদের সাথে চলতে। তবে তোকে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে চিড়িয়াখানার সামনে থালা দিয়ে বসিয়ে রাখব। তখন ভিক্ষা করে খেতে হবে। সবাই তখন তোকে এক নামে লতা ফকিন্নি বললে চিনবে।

শাদাদ ভাইয়ের কথায় লতা যতটা অবাক হয়েছে, তারচেয়ে বেশি চিন্তা করছে এই ভেবে যে ওকে লতা ফকিন্নি বেশে কেমন দেখাবে? নিজেকে নিয়ে এমন কল্পনা করতে গিয়েও অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল লতার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো আজকের পর থেকে নিরার সঙ্গে আর কখনো দেখাও করবে না কথা তো দূরের থাক।

#চলবে

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

৭.

পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র পেয়েও আমি হতাশ হলাম খুব। যা কিছু পড়েছিলাম সব ভুলে গেছি। ইচ্ছে করছিল নিজের চুলগুলো সব টেনে ছিঁড়ে ফেলি।

অশান্ত মনটাকে শান্ত করবার জন্য স্থীর হয়ে বসলাম। তারপর, কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে আসে। আবারও পরীক্ষার খাতায় মনোনিবেশ করলাম। ব্যস,ধীরে ধীরে সব প্রশ্ন যেন চোখের সামনে সলভ হয়ে যাচ্ছিল।

পরীক্ষা শেষ। কেন্দ্র থেকে বের হয়ে দেখি অদূরে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে সামনের ছোট বেঞ্চিতে বসে শাদাদ ভাই মনের সুখে সিগারেটের ধোঁয়া নির্গত করে পরিবেশ দূষণ করছেন। শাদাদ ভাইয়ের কিছু কাজ-কর্ম দেখলে রাগ না হওয়া মানুষের পর্যন্ত রাগ জন্মে যায় গায়ে। আমারও হলো তাই। সোজা শাদাদ ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। শাদাদ ভাই আমাকে দেখে হাতের সিগারেটটা একটান দিয়ে শেষ করে পায়ের নীচে ফেলে দুমড়েমুচড়ে ফেললেন। হাত বাড়িয়ে বললো,

— দেখি প্রশ্নটা? সব কমন এসেছে তো?

আমি প্রশ্নপত্রটা শাদাদ ভাইকে দেখালাম না। মুখ কালো করে বললাম,

— রিকশা ডাক দাও। বাড়িতে যাব।

শাদাদ ভাই কথা বাড়ালেন না। রিকশা ডেকে আনলেন। আমি রিকশায় চড়ে চুপচাপ বসে রইলাম। শাদাদ ভাই আমার পাশে উঠে বসতেই রিকশা চলতে শুরু করেছে। বেশকিছু সময় ধরে হয়তো আমার নিরবতা খেয়াল করেছেন শাদাদ ভাই। নিজেও কিছু বলার জন্য হাসফাস করছেন। উনার ছটফটে স্বভাব দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারবে।

— এই মধু পরীক্ষায় খারাপ করলি নাকি? চুপ করে আছিস যে? পরীক্ষায় খারাপ করলি কি করে? বছর ধরে বইয়ের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে রাখিস। কারো দিকে তোর তাকানোর সময় নেই। সেই যদি তুই পরীক্ষায় খারাপ করিস তাহলে কেমনে হবে?

— আমি কি একবারও বলেছি যে আমার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে!

শাদাদ ভাইয়ের কথায় রাগ যেন শতগুণ বেড়ে গেছে। একপ্রকার চিল্লিয়ে কথাটি বলেছি বিধায় রিকশাওয়ালা মামা রিকশা থামিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাদাদ ভাই একপলক আমার দিকে তাকিয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে অনুরোধ করলো, রিকশা চালানোর জন্য। রিকশা যখন তিন রাস্তার মোড়ে এলো হুট করে মুষল ধারে বৃষ্টি এসে সব ভিজিয়ে দেয়। এই তো কিছুক্ষণ আগেও কি সুন্দর তপ্ত রোদ মাথার ওপর জানান দিচ্ছিলো সূর্যমামার উপস্থিতি। এই মূহুর্তে পরিবেশের এমন পরিবর্তন দেখলে কে বলবে কিছু সময় আগেও রোদ ছিল!

হুট করেই খেয়াল করলাম শাদাদ ভাই রিকশাওয়ালা মামার সঙ্গে রাগারাগি করছে কেন রিকশার সামনে পলিথিন দিয়ে রাখেনি। এখন তো বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে। পরীক্ষার কাগজপত্র নষ্ট হয়ে গেলে তখন এর দায়ভার নিবে কে? আমি শাদাদ ভাইয়ের বামহাতের ওপর হাত রাখলাম। শাদাদ ভাই হুট করে চুপ হয়ে গেলেন। নিজের হাতের দিকে চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি হাত সরিয়ে শাদাদ ভাইকে বললাম,

— দেখছেন না ফাইলে আছে সবকিছু। কাগজপত্রের কিছুই হবে না। শাদাদ ভাই দেখেন না আজ কত চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে!

লতা কথাগুলো বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেয়। শাদাদ তখনি খেয়াল তার পাশে বসা সপ্তদশী এক কন্যা বসে আছে। বৃষ্টির তোড়ে ঝাপটে আসা বিন্দু বিন্দু জল সেই কন্যার মুখে জায়গায় করে নিয়েছে। কুসুম রঙা গায়ে স্বচ্ছ জল মিশে যেন অনন্য এক রুপের ঝলক সেই কন্যার গা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। শাদাদ চোখ ফিরিয়ে রাস্তার পাশে তাকালো। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসে শাদাদের। চোখ ধাঁধিয়ে অন্তরে আগুন লাগে। নিজের মনকে কোনো শাসনে বাঁধতে চায় না আজ। মন বলছে হোক না একটা অন্যায় তবুও তো একটিবার মধুকে ছুঁয়ে দেবার অদম্য আগ্রহ ঘুচে যাবে। কিন্তু, মস্তিষ্ক বলছে, সে পবিত্র। তাকে পবিত্র কোনো বন্ধন ছাড়া ছুঁয়ে দিয়ে নোংরা করো না।

শাদাদ যেন নিজের স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক। হুট করে রিকশাওয়ালা মামাকে অনুরোধ করলো। রিকশা থামিয়ে দিতে। রিকশা থামে। শাদাদ নেমে যায়। মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার তিনটি নোট দিয়ে অনুরোধ করে সামনে ১০নং বিল্ডিংয়ের সামনে লতাকে নামিয়ে দিতে। লতা শাদাদকে একটিবার জিজ্ঞেস করতে চায়। কিন্তু পারে না। শাদাদ ভাই মানুষটাই এমন হুটহাট এমন আচরণ করে কিছুই বোধগম্য হয় না তার।

রিকশা শাদাদকে রেখে চলে যায়। শাদাদ রাস্তার পাশে ফুটপাতের ধারে বসে আছে। বৃষ্টির পানিতে শাদাদ ভিজছে। চোখের সামনে লতার ভিজে যাওয়া মুখটাই ভেসে ওঠেছে। মনের কোণে লুকায়িত ভালোবাসা আজ হৃদয়কে ধিক্কার জানিয়ে নিজের অনুভূতির পঙক্তিমালা গাঁথতে চাইছে। শাদাদের মস্তিষ্কে তখন একটি বাক্য চলছে,

“ভালোবাসা চাইতে গেলেই কেন মরণ অনুভূতি হয়?”

লতা কাক ভেজা হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে। রুপা এসে শুকনো টাওয়াল দিয়ে লতার ভেজা মাথা মুছে দেয়। রুপা শাদাদের কথা জিজ্ঞেস করলে লতা জানায় শাদাদ মোড়ের কাছে নেমে গেছে। লতা নিজের ঘরে চলে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেড়ে বের হয়। গোসল করার পর মনে হলো যে কিছু খাওয়ার দরকার। তড়িঘড়ি করে নীচে চলে যায় ডাইনিং টেবিলের কাছে। গিয়ে দেখলো সবাই দুপুরের খাবার খেতে বসেছে। লতা গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। তৃনা লতার প্লেটে ভুনা খিঁচুড়ি আর গরুর মাংসের ঝালভুনা তুলে দিলেন। লতা খুশি হয়ে একলোকমা মুখে তুলতেই, মনে পরলো শাদাদ ভাইয়ের পছন্দের খাবার খাচ্ছে আজ সবাই। কিন্তু, শাদাদ ভাই কোথায় যে গিয়েছে?

খচখচানি ভাবটা নিয়ে খাবার শেষ করে ঘরের দিকে যাচ্ছিলো লতা। এমনসময় চোখে পরলো সদর দরজার দিকে। শাদাদ ভাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ির পথ ধরে এগিয়ে আসছেন। লতা একদৌঁড়ে সোফার ওপরে থাকা টাওয়াল নিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শাদাদ ভাই ভেতরে এলে লতা টাওয়াল এগিয়ে দেয় শাদাদের সামনে। হাত বাড়িয়ে দেয়া মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে শাদাদ কিছু না বলে লতাকে এড়িয়ে নিজের ঘরে দিকে চলে যাচ্ছে। এদিকে লতা হা করে শাদাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

লতা কিছুটা অপমানিতবোধ করে। হাতের টাওয়ালটা ছুড়ে মারলো সোফার ওপর। নিজের ঘরে চলে যায়। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লতা। মাঝে মাঝে শাদাদ ভাইয়ের কিছু কথা, কিছু আচরণ বুঝে উঠতে পারে না। রিকশায় উঠলো ভালো। কিন্তু, এরমাঝে এমন কি হলো যে শাদাদ ভাই এমন উইয়ার্ড বিহেভ করেছে?

লতা বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো ভাবছে। যেখানে শাদাদ ভাই কখনো বুঝিয়েছে তিনি লতাকে ভালোবাসেন। আবার কখনো কখনো এটা বুঝিয়েছেন লতার কোনো অস্তিত্ব নেই উনার জীবনে। যা কিছু আছে তা সবটাই একটা কাজিন অন্য কাজিনদের মধ্যে থাকে। এতকিছুর পরও একটা কিন্তু রয়ে যায়। আর সেটা হলো শাদাদ ভাই হয়তো লতাকে ভালোবাসে কিন্তু বলতে চায় না।

_____________________

রাত নয়টা…

রুপা আপা, লতা মিলে ড্রইংরুমে বসে লুডু খেলছিল। লতার হেরে যাওয়ার চান্স বেশি। মন খারাপ করে লতা লুডুতে চাল দিচ্ছে। রুপা তার তৃতীয় গুটি ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিলো। লতা হতাশ হয়ে হাতে বাড়ানোর আগে একটি হাত এসে লতার চাল দিলো। দুটো ছক্কা এবং একটি পাঁচ। ব্যস লতা অনেকখানি এগিয়ে যায়। রুপা রেগে গিয়ে বললো,

— শাদাদ মাইর খাবি আমার হাতে। তুই কোত্থেকে এসে খেলার মাঝে ঢুকে পরলি?

শাদাদ ভাই লতার পাশে পা গুটিয়ে বসলো। রুপা আপার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললো,

— আমাদের মধু হেরে যাবে ভেবেই মুখটা এইটুকুন হয়ে গেছে; দেখছো না? তাই একটু হাতের পরশ দিলাম। নে মধু এবার তোর চাল তুই দে।

লতা অবাক হয়ে কিছু সময় ধরে শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে খেলায় মনোযোগ দেয়। শেষমেশ আমাদের লতা জিতে যায়। রুপা আপা রেগেমেগে শাদাদ ভাইয়ের পিঠে দু’চারটা কিল-ঘুষি দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

শাদাদ ভাই এদিকে বোনের হাতে মার খেয়ে বোকার মতো হাসছে। লতা শাদাদ ভাইয়ের হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। শাদাদ ভাই হাসলে উনার চোখদুটো ছোট হয়ে আসে। ডানগালের খাজটা আরও দেবে যায়। এই প্রথম কোনো ছেলের হাসিতে বুঝি লতার মনে ফাগুনের হাওয়া লেগেছে।

লতা যখন পলকহীন চোখে শাদাদ ভাইকে দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনি শাদাদ ভাই প্রশ্ন করে,

—- কি রে পড়াশোনা বাদ দিয়ে লুডু খেলায় নাম লিখিয়েছিস কবে?

— বাংলা পরীক্ষা দুদিন পর। তাই একটু খেলছিলাম। বাইরে বৃষ্টি সাথে দুকাপ রং চা আর দুই বোন মিলে লুডুর খেলা; ব্যস জমে উঠেছিল খুব।

লতা মুগ্ধতার দেশ থেকে বের হয়ে শাদাদের প্রশ্নের জবাব দেয়। শাদাদ মুচকি হেসে ওঠে যাচ্ছিলো এমন সময় লতার প্রশ্ন শুনে পায়ের গতি থেমে যায় শাদাদের। শাদাদ ঘাড় ফিরিয়ে লতার দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অবিশ্বাস্যের সুরে জিজ্ঞেস করলো,

— কি বললি, মধু?

লতা কাঁপা কাঁপা বুকে শাদাদকে ফের প্রশ্ন করে।

—- ভালোবাসতে গেলে কি লাগে?

লতার প্রশ্নে চমকিত দৃষ্টিতে তাকায় শাদাদ। পায়ে হেঁটে লতার পাশে গিয়ে বসে। লতার চোখে চোখ রাখে। কিন্তু, লতা শাদাদ ভাইয়ের চোখে চোখ রাখতে পারে না। দৃষ্টি নিচে নামিয়ে ফেলে। শাদাদ ভাই কিছুটা সময় নিলেন উত্তর দিতে।

—- ভালোবাসতে গেলে প্রচুর সাহস লাগে। এতটাই সাহস লাগে যতটা সাহস নিয়ে একটা নির্যাতিত গোষ্ঠি নিজেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নামতে পারে।

— তারমানে আপনার কাছে ভালোবাসতে যাওয়া মানে মনে প্রচুর সাহস রাখা।

— হুম। সাহস ছাড়া ভালোবাসা যায় নাকি। তুই একজনকে ভালোবাসিস কিন্তু মনে সাহস জুটাতে পারছিস না বলে বলতে পারছিস না। তাহলে ভেবে দেখ ভালোবাসতে গেলে সাহসের প্রয়োজন আছে কি না?

শাদাদ ভাই যান্ত্রিক গলায় কথাগুলি বলে উঠে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে আনমনা হয়ে বলছেন,

—-মনে সাহস নেই বলেই তো তোকে “ভালোবাসি” শব্দটা বলতে পারি না রে মধু। ভালোবাসার আগে মনের সাহস কেন জুটালাম না আমি?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here