গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ২৪

0
357

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৪

“রাগিনী, তোমার নাদিম আঙ্কেলের কথা মনে আছে?”

রাগিনী রাশেদ সাহেবকে সকালের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল। তাড়াহুড়ো রয়েছে তার আজ ভীষণ। আবারও হসপিটালে দৌড়াতে হবে। তবে এর মাঝে রাশেদ সাহেবের প্রশ্নে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবুক হয়ে পড়ে রাগিনী। নামটা তার চেনা চেনা লাগছে। একটু ভাবতেই যেন স্মরণে এলো তার। বলে উঠল,
“ইন্ডিয়ায় যিনি থাকেন উনার কথা বলছো?”

“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো। তোমাকে বলব বলব করে বলা হয়ে ওঠেনি। ওর ছেলে তো আমাদের এখানে এসেছে। অভিরূপ চৌধুরী! তোমার চেনার কথা। তো আমি চাইছিলাম না সে আমাদের দেশে এসে কোনো হোটেলে থাকুক। তাই ভাবছিলাম আজ ওকে নিয়ে আসব।”

এবার টনক নড়ে রাগিনীর। খানিকটা চকিতে তাকায়। বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“নাদিম আঙ্কেলের ছেলে দ্যা ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরী?”

“হ্যাঁ। তোমার ভুলে যাওয়ারই কথা। তুমি তখন তো অনেক ছোট ছিলে।”

রাগিনী আর কোনো কথা বলল না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে ভাবলো গতকালকের ঘটনা। কীভাবে তাড়াহুড়ো আর খাপছাড়াভাবে কথাবার্তা বলে একরকম পালিয়ে এসেছে সে। ব্যাপারটা হয়ত একদম ঠিক হয়নি। এবার মুখোমুখি হলে কী হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই নিজেকে সামলে নিল রাগিনী। যা হবার হবে। এখন এতো কথা ভাবার সময় নেই। তাকে বের হতে হবে।

সিঙ্গেল একটা বেডে উপুড় হয়ে পড়ে থেকে গভীর ঘুমে মগ্ন কোহিনূর। বেডের সাথে লাগানো জানালা দিয়ে তার মুখে রোদের তীব্র আলো পড়াতে মাথার নিচে রাখা বালিশটা মাথার উপরে মুখ ঢেকে রয়েছে সে। বেড ছোট হওয়াতে তার একটা পায়ের অর্ধেক বাহিরে চলে গিয়ে ঝুলছে। হঠাৎই তার তীব্র ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো কেউ। মুখের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো বালিশ। ফোলা ফোলা সেই মুখে এসে পড়ল রৌদ্রজ্বল রেখাগুলো। শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। কোনোরকমে সোজা হয়ে শুয়ে হাতিয়ে কাছে থাকা একটা চাদর নিয়ে মুখ ঢেকে অস্পষ্ট সুরে ধমকের সুরে বলে উঠল,
“মেহরাজ! মাথা গরম করে দিও না সকাল সকাল। এমনি বিগত কয়েকদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। মাঝখান থেকে ঘুম বিগড়ে দিলে একটানা পাঁচ দিন তোমায় রাত জাগিয়ে কাজ করে নেব।”

বলেই কাছে থাকা কোলবালিশ চেপে ধরল কোহিনূর। অতঃপর সেটা দিয়ে মুখ ঢাকল। তার মুখে বিরক্তির ছাপ প্রবল এখনো। তার বিরক্তি বাড়ানোর জন্য যেন কোলবালিশটাও চট করে টেনে নেওয়া হলো। চোখ মেলতে ইচ্ছে করল না কোহিনূরের। তীব্র রেগে বলে উঠল,
“আহহ…এমনি ঠেলায় পড়ে এই গরমে এসি ছাড়া ফ্যানের নিচে ঘুমোতে ঘুমোতে আমি শুঁকিয়ে যাচ্ছি। আর একবার যদি জ্বালিয়েছো মুখের ভেতর পরপর তিনটা গু’লি ঢুকিয়ে দেব। রাবিশ!”

“তা আপনি রি’ভলবার কোথায় পাবেন গু’লি মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য?”

কোহিনূর এবার চুপ থাকে। ঘুমটা ছাড়তে চাইছে না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবে মেয়েলি কন্ঠ শুনে নড়েচড়ে উঠল সে। শ্রবণেন্দ্রিয় কি ভুল শুনলো নাকি? বড় একটা হাই তুলে প্রশ্ন করল,
“মেহরাজ! আজকাল কি মেয়েদের কন্ঠস্বর প্র্যাক্টিস করছো? এমন মেয়ে মেয়ে লাগছে কেন?”

“বিকজ, আই এম অ্যা গার্ল। আমি রাগিনী।”

এখনো ঘুমের ঘোর কাটাতে পেরে ওঠেনি কোহিনূর। ঘুম জড়ানো কন্ঠে এবার ফট করেই বলে দিল,
“রাগিনী আবার কে?”

কোহিনূরের মুখ থেকে যখন রাগিনী নামটি বের হলো তখন মস্তিস্ক যেন এক কঠিন আ’ঘাত দিল কোহিনূরকে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটা’তে থাকল। হম্বিতম্বি করে চোখ মেলে তাকালো সামনে থাকা সেই মানবীর দিকে। রাগিনী কোমড়ে হাত দিয়ে সন্দিহান হয়ে চেয়ে আছে। কোহিনূরের চোখেমুখে তখন স্পষ্ট আতঙ্ক দেখতে পায় রাগিনী। কোহিনূর ঘুমের কিছু মূহুর্তের জন্য ভুলে বসেছিল তার বর্তমান জীবন! অনেক কথায় বলে বসেছে সে। ঢক গিলে নিল এবার। চোখটা বড় বড় করে আনন্দিত হবার চেষ্টা করে বলল,
“রা…রাগের রানী, রাগের রানী। তুমি এসেছো।”

বালিশটা বিছানায় রাখল রাগিনী। কোহিনূরকে কটাক্ষ করে প্রশ্ন করল,
“এসেছি তো বটেই। কিন্তু আমাকে কার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছিলেন আপনি?”

কোহিনূর থতমত খায় এবার। ঠিক চুরি করার পর চোর ধরা পড়লে যেমন অবস্থা হয় ঠিক তেমন হয়েছে তার চেহারা। সে তার ঘন এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলোতে হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“কার সঙ্গে?”

“মেহরাজ কে?”

কোহিনূর আবারও চুপ থাকে। কপালে পড়ে কিঞ্চিৎ ভাঁজ। একটু চুপ থেকে বলে ওঠে,
“জানি না তো। তুমি জানো!”

“আশ্চর্য! আমি কী করে জানব? আপনি ঘুমের মধ্যে বলছিলেন তার কথা।”

কোহিনূর এবার বোকা হাসি দিল। রাগিনীর হাতটা টেনে ধরে বলল,
“ঘুমের মধ্যে কত কী বলে! ওসব পাত্তা দিতে নেই। আগে বলো কাল আসো নি কেন?”

রাগিনী এবার বেডের সাইডে বসে। আর ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“কারণ আছে নিশ্চয়। ব্যস্ত ছিলাম।”

“ব্যস্ত ছিলে নাকি থাকার চেষ্টা করছিলে?”

“ব্যস্ত ছিলাম। এখন যদি কাইন্ডলি ফ্রেশ হয়ে আসতেন তাহলে দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে আমরা বের হতাম।”

ফ্যালফ্যাল করে তাকায় কোহিনূর। বিস্ময়ের সুরে বলে,
“কোথায়?”

“আপনার শ্বশুরবাড়ি।”

দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ে আওড়ালো রাগিনী। কোহিনূর তা শুনে মুখ হা করে অবাক হওয়ার ভং ধরে মুখে হাত দিয়ে বলল,
“এতো বড় অপবাদ তুমি দিতে পারলে? আমি বিয়েই করলাম না আর তুমি শ্বশুড়বাড়ি বানিয়ে দিলে।”

সরু চোখে তাকালো রাগিনী। কোহিনূর বালিশ সরিয়ে এগিয়ে রাগিনীর কাছে এসে বসল। রাগিনীর দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
“বাই এনি চান্স তুমি আমাকে ফাঁসানোর প্ল্যান করছো না তো? লাইক আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করা? হয়, হয়। আমার মতো একটা ড্যাশিং ছেলেকে সামনে দেখলে সব মেয়েরই এমন ইচ্ছা জাগে। এটা তোমার দোষ নয়। আমার এই হ্যান্ডসাম লুকের দোষ।”

কোহিনূর নিজের মাথার চুল স্টাইলের সাথে ঠিক করতে থাকলো বেশ ভাবসাব নিয়ে। রাগিনী তবুও চুপ রইল। কোহিনূরের কথা শেষ হবার পর সে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসি দিয়ে বলে,
“বর্তমানে আপনার এই অ্যামাজন জঙ্গলের মতো চুল, আলুর থেকে বেশি ফুলে যাওয়া চোখমুখ দেখলে আপনার জন্য পাগল হয়ে যাওয়া সো কলড মেয়েরা দৌড়ে পালাবে। বিলিভ মি!”

তৎক্ষনাৎ কোহিনূরের হাতটা চলে যায় তার মুখে। আসলেই তাকে এমন লাগছে! কি বিশ্রী ব্যাপার। প্রেস্টিজ সব ফুটো হয়ে গেল। রাগিনী মেয়েটা শান্ত ভাবে কী করে বাঁশঝাড় গছিয়ে দিতে হয় সেটা বেশ ভালো করে জানে। সে কথাটুকু বলার পর একেবারে সাইলেন্ট মুডে চলে গেছে। আর কোহিনূর সে আর বিলম্ব না করেই উঠে দাঁড়িয়ে ছুট লাগালো ওয়াশরুমে। তার কান্ড দেখে পিছনে বসে থাকা রাগিনীর মুখে ফোটে চাপা হাসি। মুখে হাত দিয়ে হেঁসে ফেলে ঝংকার বয়ে যায় ছোট্ট ঘরে। হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
“পাগল লোকটা একটু বুঝতে পারতেন যে উনার ঘুম থেকে ওঠার পর ফুলিয়ে রাখা চোখমুখে কঠিন স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লেগে ছিল তবে হয়ত এতো তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হতে যেতেন না।”

কোহিনূর তখন টাওয়াল নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করল। টাওয়াল মুখ থেকে সরিয়ে বেডের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চোখ ছানাবড়া হলো তার। দ্রুত নিকটে এসে বসল ধপ করে। রাগিনী দুটো টিফিনবক্স থেকে একেক পদের খাবার বের করতে আরম্ভ করেছে। খাবারের পদ যেন শেষ হচ্ছে না। দুটোই বড় বড় টিফিনবক্স। কোহিনূর আশ্চর্য হয়ে বলে,
“তুমি কি শুধু আমাকে খাওয়াতে এসব এনেছো নাকি আজকে এখানকার সবাইকে খাওয়ানোর প্ল্যানিং করেছো?”

রাগিনী একটা একটা করে সবচেয়ে শেষের বক্সের পার্ট খুলে রেখে কোহিনূরের দিকে মাথা উঠিয়ে তাকায়। ছেলেটার কপালে এখনো বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। চুলের কিছু অংশ ভিজে নেতিয়ে পড়েছে। রোদের আলোয় পানির ফোঁটাগুলো কেমন চিকচিক করছে। রাগিনীর হাত যেন আপনাআপনি চলে গেল কোহিনূরের চুলে। বেশ উচ্ছ্বাসে সাথে ঝেড়ে দিল চুলের পানি। তার মুখ দেখে মনে হলো বেশ মজা পেয়েছে সে। কোহিনূর নিজের মাথা নিচু করে বেশ কোমল সুরে বলে ওঠে,
“ম্যাসাজে খুব আরাম লাগল। আরো ম্যাসাজ করে দিতে পারো। মাইন্ড করব না। বিনা ফি তে এতো সুন্দর কোমল হাতের ম্যাসাজ কে না চায়!”

রাগিনী ভ্রু আর নাক কুঁচকায়। তারপর হাত বাড়িয়ে কোহিনূরের চুল ফট করে টেনে বলে ওঠে,
“আরো লাগবে?”

মাথা সোজা করে চুলগুলো সযত্নে নেড়ে ঠিক করে কোহিনূর। কিছু বলার আগেই রাগিনী আবারও খাবারের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলে,
“মনে আছে? আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন? ওইতো সেদিন গ্রামের রাস্তায় পুলিশের লোকের এট্যা’ক থেকে। আপনি বলেছিলেন না? আপনার জন্য অন্তত পাঁচ আইটেমের খাবার করে আনতে? আমার মন আবার অনেক বড়। তাই দশ আইটেমের খাবার এনেছি। আজকে এগুলো না শেষ করে উঠলে আমি আপনাকে ধরে বেঁধে খাওয়াব।”

কথাটা কোহিনূরের কর্ণকুহরে আসা মাত্র তার হাত চলে যায় পেটে। দৃষ্টিও নিচু হয়ে পেটে চলে আসে। কত পারফেক্ট তার বডি! কোনো মেদের চিহ্ন নেই পেটে। এই পেটে এতোগুলো খাবার ঢুকলে ঠিক কী কী হতে পারে ভেবেই বিষম খেয়ে ওঠে সে। চেহারা জড়িয়ে তুলে ক্লান্ত আর ব্যথিত ভঙ্গিমায় আধশোয়া হয়ে বলে,
“আমার শরীর আজকে ভালো নেই। মাথাব্যথা, পেট ব্যথা! আজকে না হয় থাক। অন্য একদিন এসব হবে। আমি তো ওসব মজা করে বলেছিলাম।”

রাগিনী একটা খাবারের বাটি হাতে তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“খুব খাওয়ার শখ আপনার। আপনার আজকে পুরো শরীর ব্যথা করলেও ছাড়ব না। এখনি আজিম আর পলাশ ভাইকে ডেকে আপনার দুহাত বেঁধে মুখে ঠুসে দেব। ডিসিশন ইজ ইউরস।”

কোহিনূর কিছু বলতে গিয়েও পারে না। ফেঁসে গেছে নিজেরই বলা কথায়। সে উঠে সোজা হয়ে বসে বাটি ধরে। লোভনীয় সব খাবারই। তবে এতোগুলো পেটের কোন স্থানে জমা হবে সেটাই সে ভেবে উঠতে পারছে না। কোহিনূর আরো কিছু বলতে উদ্যত হয়। তাকে থামিয়ে রাগিনী আগেই বলে ওঠে,
“খাবার পর কথা হবে। স্টার্ট করুন।”

কোহিনূর খাবার দেখে জোরপূর্বক হাসে। শেষবারের মতো নিজের পেটের দিকে তাকায়। পেট এবার শহীদ হতে চলেছে। একটা খাবার হাতে তুলে খাওয়া শুরু করে সে। বুঝতে বাকি থাকে না মেয়েটা পাকাপোক্ত পরিকল্পনা করে এসেছে কোহিনূরের খাবার আবদার সারাজীবনের জন্য ঘুচিয়ে দেওয়ার। এই প্রথম কোহিনূরের এতো খাবার দেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাঁদলেও এক নারীর সামনে মানসম্মানের দফারফা হয়ে যাবে! সব দিকেই যেন বিপদের অন্ত নেই।

জানালের ধারের সামান্য জায়গায় বেশ ভালোমতো বসেছে অভিরূপ। পরনে একটা চকলেট কালার টিশার্ট আর কালো টাউজার। সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে সে। তার চুলগুলো একটু বড় বড় এবং ঝাঁকড়া হওয়ায় শুঁকাতে সময় লাগে কিছুটা। তাই ভেজা গুলো খুব সুন্দরভাবে সামনের সবটা কপাল পড়ে থেকে ভ্রু জোড়াও ঢেকে দিয়েছে। ছোট ছোট দুটো চোখ বন্ধ। মনোযোগ পড়েছে গিটারের সুরে এবং চোখ বন্ধ করে এঁকেছে সেই সাহসী দৃষ্টি। সেই টানা চোখে ভয়হীন এক নজর কেন যেন ভুলতেই পারা যায় না। মন মেতেছে এক গানে।
“Pehli nazar mein
Kaise jaadu kar diya
Tera ban baita hai Mera jiya..”

এই গানটা যেন সেই রাগযুক্ত রাজরানীর জন্যই বানানো। প্রথম নজরেই কাবু করার ক্ষমতা রয়েছে তার। চোখ মেলে আকাশে তাকালো অভিরূপ। স্বচ্ছ সেই মেঘেও যেন সেই নেত্রপল্লবের প্রতিচ্ছবি। অভিরূপ দৃষ্টি বানিয়ে নিল। মুখ খুলে গেয়ে উঠল,
“Jaane kya hoga
Kya hoga kya pata
is pal ko milke Aa jee le zara…”

আর গাওয়া হলো না অভিরূপের। থামালো সে গিটারে সুর তোলা। হাত বাড়িয়ে একটু দূরে থাকা নরম বিছানায় গিটার রাখল। গভীর কিছু চিন্তা করে ভাবল,
“কেন যেন আপনার সেই অস্থির দৃষ্টির থেকে আপনার ভয়হীন দৃষ্টি আমার কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। কেন আমি জানি না। বার বার মন চাইছে সেই দৃষ্টিটাকে যদি কোনোভাবে বন্দি করতে পারতাম। সারাদিন পলকহীন ভাবে সেই দৃষ্টি দেখে কাটিয়ে দিতে পারতাম।”

“সিউর হলাম। আমি একটা আস্ত পাগলের সাথেই থাকি। এতোদিন একটু হলেও ডাউট ছিল। বাট নাউ আই এম সিউর। একা একা কথা বলতেও শুরু করে দিয়েছে।”

নিজের ভাবনায় মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় চোখেমুখ কুঁচকে ওয়াশরুমের দিকে তাকালো অভিরূপ। নোমান সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে শুধুমাত্র একটা খয়েরী টাওয়াল আর আরেকটা টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে চলেছে অনবরত। এখনো আধভেজা শরীরে ঘরে এলো নোমান। অভিরূপ নোমানের কথার জবাব দিয়ে বলল,
“পাগলের সাথে ঘুরলে তো পাগল হবোই তাই না?”

চুল মুছতে মুছতে থামলো নোমান। ঘাড় ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“আমি তোর মতো নই। তোকে সামলাতে আমি আসলেই কোনদিন যেন পাগল হই।”

অভিরূপ ভেংচি কাটে এবার বাচ্চা ছেলেদের মতো। অতঃপর গিটারে হাত দিয়ে বলে,
“যাহ্। তোকে এবারের মতো তর্কে জিততে দিলাম। শুধুমাত্র আমার গিটারটা আনতে মনে রেখেছিস বলে। তুই কী করে জানলি এটা আমার লাগবে?”

“এটা তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হবার পর থেকে হয়ে আসছে। যে তোর কী কী দরকার তোর নিজের থেকে বেশি আমাকে জেনে নিতে হয়।”

সহজ ভাবে বলে দিল নোমান। এবার সোফায় সেভাবেই গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘাড়ে নিজেই জোরে চাপ দিতে থাকল। ঘাড় ব্যথা করছে তার। চোখ একটু মেলতেই অভিরূপের ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে মারা চোখে পড়তেই সে তড়তড় করে বলে উঠল,
“ওগুলো তোর কাছেই রাখ। আমার লাগবে না। গার্লফ্রেন্ড বা বউ পেলে তাকে দিস। এসব স্টুপিড জিনিস লাগবে না আমার।”

বলেই একটু থেমে থেমে সে আবার বলল,
“কাল থেকে এতো দখল গেছে যে এখনো ঘাড়ের ব্যথা সাড়েনি।”

এবার ফোনের রিংটোন বেজে উঠল সজোরে। দুজনেরই নজর দুজনের ফোনের দিকে গেল। অভিরূপের ফোন বাজছে। অভিরূপের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। আন্দাজ করতে পারল কিছু। তবুও সাহস করে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে ধরতেই স্ক্রিনে নজর পড়তেই বুঝতে পারে সে যা ভাবছিল তাই। কিন্তু কল ইগনর করার উপায় নেই। এর পরিণতি আরো বাজে হতে পারে। সে ফোনটা রিসিভ করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হ্যালো, বাবা।”

ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো বয়স্ক কন্ঠ ভেসে এলো এবার।
“আমি জানতাম। এমন কিছুই ঘটবে। তুমি তো আমার কথা এই জন্মে কোনোদিন শুনবে না বলে ঠিক করে রেখেছো। আমার হেঁসেই উড়িয়ে দেওয়া যায়। ফলাফল দেখো এখন। কোথাও লেগেছে নাকি তোমার?”

এতো ঝাঁঝ পূর্ণ কন্ঠ হজম হলো না অভিরূপের। ফোনটা কান থেকে একটু দূরে ধরে চুপসানো মুখে নোমানের দিকে তাকায় সে। অভিরূপের উত্তর না শুনতে পেয়ে ওপাশ থেকে আবার কঠিন সুরে ভেসে আসে নাদিম সাহেবের গলা।
“অভি! তুমি শুনেও এন্সার করছো না। আমাকে রাগিয়ে দিও না। ভালো করে বলছি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাদের এখানে চলে এসো। আমার কথাটা শোনো এবার।”

অভিরূপ এবার বেশ ভেবেচিন্তে কন্ঠস্বর চিকন করে মেয়েদের মতো করে বলার চেষ্টা করল,
“হ্যালো, হ্যালো! হু আর ইউ? কে আপনি? রং নম্বরে ফোন করেছেন। ডোন্ট কল মি এগেইন। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলেই তড়িঘড়ি করে কল কাটলো অভিরূপ।

ওপাশ থেকে হতভম্ব হলেন নাদিম সাহেব। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন ফোনের দিকে। উনার রাগ বাড়ল এবার। সবে ঘরে প্রবেশ করছিলেম উনার স্ত্রী অর্থাৎ অভিরূপের মা মিসেস. সুরভী। তাকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষনাৎ নাদিম সাহেব কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলেন,
“তোমার ছেলেকে দেখেছো? কত বড় সাহস হয়েছে। আমার মুখের উপর কল কেটে দেয়। আর বলে কিনা আমি রং নম্বরে কল করেছি!”

“ও তো ওমনই দুষ্টু ছোটবেলা থেকে। একটু বুঝিয়ে বলছি আমি। ফোনটা আমায় দাও। ওখানে থাকা ওর সেফ নয়।”

মিসেস. সুরভীর বলা কথা নাকচ করলেন নাদিম সাহেব। আবারও অভিরূপের নম্বরে কল লাগিয়ে বলে বললেন,
“তোমার এই নরম সুর শুনলে তোমাকেই উল্টে কনভিন্স করে দেবে। আমিই ওকে বলছি।”

ক্ষ্যান্ত হলো না অভিরূপ। ফোনটা বেজে উঠতেই হাতটাও কেঁপে উঠল তার। কী করবে ভেবে আর পাচ্ছে না। নোমানের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মুচকি হাসলো। ছুটল নোমানের দিকে। তাকে পেছন থেকে ধরে মিনতির সুরে বলল,
“ম্যানেজ করে দে এবারের মতো প্লিজ! প্লিজ!”

আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হয়ে নোমান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। সেও এখানে থাকতে চায় না। এখানে থাকা মানে বিপদ বয়ে আনা। তাই সে বলল,
“ইম্পসিবল। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বিদায় নেওয়া যায় তত ভালো। পারলে আমি আরো কল করে আঙ্কেল কে বলব যাতে দ্রুত দেশে ফিরতে পারি।”

“এমন করিস কেন আমার সাথে? দ্যাটস্ নট ফেয়ার ইয়ার।”

“ফেয়ার আনফেয়ার বুঝি না। ছাড় তো আমাকে।”

দুজনের একপ্রকার ধস্তাধস্তি লেগে যায়। ফ্লোরে দুজনই শুয়ে পড়ে। অভিরূপ নোমানকে চেপে ধরে বলে,
“দে না ভাই প্লিজ! আমার এদেশে থাকা দরকার। ওই মেয়েটার দেখা না পেলে তোর বন্ধুর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”

“তুই উঠবি আমার উপর থেকে? নাকি খাবি কয়েকটা কি’ল ঘু’ষি? দেখ এই মূহুর্তে আমার উপর থেকে না উঠলে আমার টাওয়াল খুলে যাবে। ইজ্জত রাখ একটু।”

অভিরূপ ছাড়ার পাত্র নয়। টাওয়াল কথা টা শুনে শয়তানি বুদ্ধি মাথায় চাপে তার। ফট করেই নোমানের পড়ে থাকা টাওয়ালে হাত দিয়ে বলে,
“আজ তুই আমাকে বাঁচাবি নয়ত তোর ইজ্জতও বাঁচবে না!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেকেই হয়ত গল্পের অপেক্ষায় ছিলেন। আমি বিয়ে বাড়িতে আটকে যাওয়ায় গল্প দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তার জন্য আমি দুঃখিত। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here