#ভুল ১১তম পর্ব
#jannat_Nur
আমিরুল ইসলাম একেবারে বাংলাদেশের চলে আসবে সেটা তার পরিবারের কেউ ভাবতে পারেনি! বিশেষ করে রফিক মিয়া খুবই চিন্তিত হলেন। ভাবনায় পড়ে গেলেন এখন যদি আমিরুল ইসলাম তাকে তার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে বলে কোথায় যাবে, তাই তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলেন রফিক মিয়া।
বড় ভাইজান তো দেশে ফিরে আসছে তুমি তার সাথে এবং সিরাতের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করবে, আদর যত্ন করবে! তাদের খাবার-দাবার তুমি রান্না করে দিবে, যেন কোন কিছু কমতি না হয়।
আমার মনে হচ্ছে তুমি ভয়ে আছো, ভাবছো ভাইয়া বাসা থেকে বের করে দিবে? এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই, তার কি পরিবারে আরো লোক আছে নাকি। তারা বাপ ছেলে দুইজন থাকবে তাদের তো দুই রুম হলেই হয়ে যাবে। আর দুই সাইডে দুইটা ফ্ল্যাটে ছয়টা রুম তাহলে তুমি সেই ভয় পাচ্ছ কেন।
তার পরেও মানুষের মন বলা যায় না, যদি বলে এতদিন থেকেছো, এখন আমরা আসছি তোমরা চলে যাও। আমাদেরই তো বেশি রুম দখল করা, আমার ছেলে ছেলের বউ মেয়ে সবাইকে নিয়ে সপরিবারে আমরা থাকছি। সিরাতকে যদি বিয়ে করায় তখন তো তাদের রুম লাগবে আরো বেশি।
আচ্ছা শোনো থেকে অবন্তীকে বলবে সিরাতের সাথে মিশতে, ভালো ব্যবহার করতে। অবন্তী যদি সিরাতকে হাতের মুঠোয় নিতে পারে, তাহলে বড় ভাইজানকে রাজি করিয়ে সিরাতের সাথে অবন্তীকে বিয়ে দেওয়া যাবে কোন সমস্যা হবে না।
রফিক মিয়ার কথা শুনে রুমা বললেন, আমি ভাইয়ের সাথে এটা নিয়ে কথা বলব! আমি চাই সিরাতের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে হোক, ছেলেটা কিন্তু মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর, অনেক ভদ্র আছে।
আমার মেয়েও কিন্তু অনেক সুন্দর এবং ভদ্র, সেও দেখতে শুনতে কম নয়। অবন্তীকে বল যেভাবেই হোক সিরাতকে হাতের মুঠোয় নিতে! আমার মনে হয় কি জানো, রবিনের মেয়েকে সিরাতের কাছে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্ল্যান করতেছে রবিনের বউ।
আরে না না, সিরাত রবিনের মেয়েকে পছন্দ করবে না! বৃষ্টি কিন্তু অনেক মোটা দেখতে, আমার অবন্তীর মত সুন্দর নয়। আমার মন বলেছে সিরাত বৃষ্টিকে পছন্দ করবে না, করলে আমার মেয়েকে পছন্দ করবে, কথাগুলো বললেন রুমা আক্তার।
বাংলাদেশে আসার পর থেকে সিরাত ভাবছে কাকে জিজ্ঞেস করলে তার মায়ের ব্যাপারে জানতে পারবে। তার মামার বাড়ি কোথায় সেটাও সে জানে না, যে সেখানে তার মায়ের খুঁজে যাবে। সিরাত তার রুমা ফুপির এত আদর আপ্যায়ন দেখে তাকেই জিজ্ঞেস করলো তার মায়ের সম্বন্ধে।
আচ্ছা আমার মা কেন চলে গিয়েছে সেটা তুমি সত্যি করে বলতো, সে চলে গেছে নাকি তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে?
এটা শুনে রুমা আক্তার ভাতিজার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন, তুমি এখনো জানো না তোমার মায়ের পরপুরুষের সাথে সম্পর্ক ছিল? তোমাকে তিন বছরের রেখে চলে গিয়েছে।
এটা নতুন কিছু নয়, ছোট থেকে শুনে আসছি।
যা সত্যি তা আমি শুনতে চাই! আমার কেন জানি বিশ্বাস হয় না আমার মা এমনটা করেছে। আমি আশা করব তুমি সত্যিটা বলবে।
রুমা আক্তার বললেন, আমি যা বলছি তাই সত্যি! তোমার কেন বিশ্বাস হচ্ছে না,আমরা কেন মিথ্যা বলব তোমার সাথে।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন বল আমার মায়ের বাবার বাড়ি কোথায় ছিল, মানে আমার নানুর বাড়ি।
রুমা আক্তারের মুখটা কালো হয়ে গেল সিরাত কেন তাকে এত প্রশ্ন করছে, সে বুঝতে পারছে না! রুমা আক্তার নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন।
তোমার নানা নানি কেউ বেঁচে নেই, তাদের বাড়ি কোথায় সেটা এখন আমার জানা নেই।
আমার মামা খালা অবশ্যই আছে, আমার মায়ের বাবার বাড়ি কোথায় ছিল সেটা ফুপি তুমি ঠিকই জানো! বাট আমাকে বলবেনা সেটা আমি বুঝতে পারছি।
আরে বাবা আমি জানিনা, শুনেছিলাম তাদের বাড়িঘর কিছু নেই। তোমার মামা খালা কখনো এখানে আসেনি, তাদের সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। জানলে তোমার বাবা জানতে পারে তাকে প্রশ্ন করো এগুলো, সেই সঠিক তথ্য দিতে পারবে। সত্যি বাবা আমি এগুলো কিছুই জানিনা।
সিরাত বুঝতে পারলো তার ফুপি এ বিষয়ে কিছুই বলবে না তাকে। তিন চাচীকে জিজ্ঞেস করেও একই উত্তর শুনতে হয়েছে সিরাতকে। সে বুঝতে পারল এই ফ্যামিলির মানুষগুলো সবাই এক পক্ষ রয়েছে কেউ তাকে সত্যি বলবেনা। আশেপাশের কারো কাছ থেকে জানতে হবে তাকে, তাই গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে! কিন্তু গ্রামের বাড়ির আশেপাশের কাউকে তো চিনেনা কিভাবে কি জিজ্ঞেস করবে সেই ভাবনায় সিরাত। সন্ধ্যেবেলা ছাঁদে বসে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে ভাবনায় ডুবে আছে সিরাত, তার পাশে এসে দাঁড়ালো অবন্তী। সিরাত অবন্তীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলবে।
আসলে আপনি আসার পর থেকে দেখি চুপচাপ আছেন, কথা বলেন না তেমন! কারণ কি জানতে পারি?
আসলে কারণ কিছুই না আমি একটা ভাবনার মধ্যে আছি, সত্যিটা জানতে চাই, কিন্তু সত্যিটা আমি জানতে পারছি না। আচ্ছা তুমি আমাকে একটা কথা বলবে সত্যি বলবে কিন্তু, আমি আশা করি তোমার কাছ থেকে সত্যিটাই জানতে পারবো।
অধিক আগ্রহ নিয়ে অবন্তী সিরাতকে জিজ্ঞেস করলো বলেন কি জানতে চান, আমি যদি সত্যি জানি তাহলে আপনাকে অবশ্যই বলব! মিথ্যা কথা বলা আমি কখনো পছন্দ করি না।
তুমি আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু জানো, যদি জেনে থাকো সত্যিটা বল।
আসলে আমার জন্মের আগেই তো বড় মামিকে এই বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে! তাই তার সম্বন্ধে আমি কিছু জানিনা, আম্মুর মুখে এবং মামিদের মুখ থেকে এমনটাই শুনেছি।
কি বললে আম্মুকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? কিন্তু কি কারণে।
হ্যাঁ আমি এটাই শুনেছি সে যেতে চায়নি নাকি, তাকে বড় মামা জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বড় মামি নাকি খুব বড় অন্যায় করেছিল, তাই মামা তার সাথে সংসার করেনি ডিভোর্স দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
কি অন্যায় করেছিল সেটা কি তুমি শুনেছ।
মামা তখন আমেরিকায় থাকতো, আর আপনাকে নিয়ে বড় মামি থাকতো গ্রামের বাড়িতে। একদিন রাতে নাকি আব্বু ওয়াশরুমে যাবার জন্য উঠে তখন দেখে বড় মামির রুম থেকে একটা পুরুষ মানুষ বের হয়ে যাচ্ছে। আব্বু সাথে সাথে আম্মুকে ডাক দেয় এবং আম্মু উঠে লোকটাকে দেখতে পেয়ে মামাদের ডাক দেয়। তারা সবাই লোকটাকে দেখে, মেজ মামা সেজ মামা যখন লোকটাকে ধরার জন্য যায়, লোকটা তখন দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ কথা জানানো হয় মামাকে, মামা আমেরিকা থেকে এসে মামিকে ডিভোর্স দেয়। মামি নাকি বারবার বলেছিল সে এমন অন্যায় কাজ করেনি! আপনাকে রেখে মামিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, মামি পুলিশ নিয়ে এসেছিল আপনাকে তার কাছে নেবার জন্য। তবু মামা আপনাকে দেয়নি, তারপর আপনাকে নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে ই আমেরিকা চলে যায়। আপনাকে নিয়ে যাবার পর মামি নাকি একবার এসেছিল তখন তার অবস্থা খুবই খারাপ পাগল প্রায় এমন টাইপ ছিল। তারপর থেকে আর কখনো আসেনি, বড় মামি।
সিরাতের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তাকে বলা হয়েছে তার মা তাকে রেখে অন্যজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অবন্তীর কথাতে বুঝা যাচ্ছে তার মা অন্য জনের সাথে পালিয়ে যায়নি, তার জন্য থানা থেকে পুলিশ পর্যন্ত নিয়ে আসছে! তবু ছেলেকে কাছে না পেয়ে হতাশ হয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছে একজন মা। সে মা কিভাবে অন্য জনের সাথে পালিয়ে যাবে, এখনো কি তার মা বেঁচে আছে ভাবতে ভাবতে কান্না করে দিলো সিরাত। কেন সে এতদিন তার মায়ের খোঁজ করতে চাইলো না, এতদিন শুনে আসছে তার মা অন্য জনের সাথে পালিয়ে গেছে। আজকে অবন্তীর কাছ থেকে শুনতে পেল সবাই দেখেছে তার মায়ের রুম থেকে কে যেন বের হয়ে গিয়েছে। অবন্তী যা বলল এ কথাটা তার ফুপি চাচিরা কেন তাকে বলল না। এখানে অবশ্যই কোন রহস্য আছে তার মায়ের সাথে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
অবন্তী সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে! শৈশবকাল থেকে আপনি মা হারা, কখনো মায়ের মুখ দেখতে পারেননি। মা যেমনই হোক তবু সন্তানের কাছে ভালো, সন্তান যদি খারাপ হয় মা কখনো ফেলতে পারে না! আবার মা যদি কোন অন্যায় করে তবু সন্তান তাকে ফেলতে পারেন না।
অবন্তী তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ তুমি আমাকে যা জানালে সেটা আমি দীর্ঘ ২৩ বছরে জানতে পারিনি। আমাকে জানানো হয়েছিল আমার আম্মু আমাকে রেখে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে। আর এখন জানতে পারলাম অন্য ঘটনা, আমার সাথে কেন এমনটা বলা হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না।
অবন্তী সিরাতকে বলল সেটা আমিও তো বুঝতে পারছি না। আমি ছোট থেকে এ ঘটনাটাই শুনে এসেছি, আপনার সাথে কেন এমনটা বলা হয়েছে। আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করবো কেন আপনার সাথে এমনটা বলল তারা।
সিরাত অবন্তীর হাতটা ধরে বলল, তুমি যেটুকু বলেছ সেটা যথেষ্ট এখন তুমি তোমার আম্মুর সাথে কিছু বলবে না! তুমি আমাকে কথা দাও এ বিষয়ে তুমি তোমার পরিবারের কাউকে বলবে না।
অবন্তী সিরাতকে দেখার পর থেকে তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে। অবন্তীর মনে হয় সিরাত যতই অর্থ সম্পদের মধ্যে বড় হোক তার মনে খুব কষ্ট। মা হারা সন্তানের মনের সব সময় একটা হাহাকার থাকে সেটা অবন্তী বুঝতে পারছে, তাই সিরাতের প্রতি তার ভালো লাগা তৈরি হয়েছে।
সিরাতকে কথা দিল ঠিক আছে আমি কাউকে কিছু বলবো না।
আর একটা হেল্প করতে পারবে তুমি আমাকে?
যদি আমার সাধ্যের মধ্যে হয় অবশ্যই হেল্প করবো।
আচ্ছা এই আমাদের বাসায় যে কাজের মানুষগুলো আছে এগুলো কি আমাদের গ্রামের নাকি অন্য জায়গার।
ছোট মামীর কাজের মহিলা আমাদের গ্রামের, সবাই তাকে শাপলার মা বলে ডাকে।
ওকে, তুমি তাকে জিজ্ঞেস করবে সে কত বছর ধরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে কাজ করেছে! তার আগে কি অন্য কেউ কাজ করতো, এ বিষয়ে ইনফরমেশন তুমি আমাকে এনে দিবে তার কাছ থেকে। আর কি বললাম এ কথা কাউকে বলবে না, আমি সত্যিটা বের করতে চাই। আমার খুব জানার ইচ্ছা আমার মা কেন আমাকে রেখে চলে গিয়েছে।
ঠিক আছে আমি শাপলার মায়ের সাথে কথা বলবো! সে তো আমাদের গ্রামের বাড়িতে কাজ করতো, আমি ছোট থেকে দেখেছি সে আমাদের বাড়িতে আছে।
ঠিক আছে তাহলে তুমি আমাকে হেল্প টা করো।
অবন্তী ভাবতে থাকলো সে যদি সিরাতকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে সিরাত তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। ভালোলাগার মানুষকে সাহায্য করতে পারলে তারও ভালো লাগবে।
চলবে….