#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৮
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২২.
বিয়ে বাড়িতে দলবেঁধে আত্মীয়-স্বজন আগমনের আনাগোনা ও প্রতিবেশীদের উৎসাহিত পদাচরণ ঘণীভূত হচ্ছে। চারপাশে নতুন নতুন মুখ, উচ্ছল ছেলেমেয়েদের রঙ-বেরঙের সাজ ও প্রানবন্ত গল্পের বহর।
আমার বয়সী মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছিলাম। আমার সহজ ভঙ্গির ব্যবহার ও তাতে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধে নিগূঢ়তা তৈরিও হয়েছিল।
কিন্তু আমাকেই পিছপা হতে হলো।
বিয়ে বাড়িতে আলোচনার উদ্বোধিত নানা বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমি ও ফাহাদ সংযুক্ত হলাম।
ফাহাদের একটা খচ্চর ফুফাতো বোন আছে। মূলত সে-ই সবাইকে বলে বেড়িয়েছে আমার সঙ্গে ফাহাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বাদবাকিরা প্রবল উৎসাহে ফাহাদকে জিগ্যেস করতে সে-ও দ্বিগুণ প্রণোদনায় মাথা নাড়ছে।
মানুষ আমার মেজাজের পিছনে এতো কেন লেগেছে বুঝতে পারছি না। তারা কি চাইছে একটা দুটো খুন করে আমি এই বাসা থেকে বের হই? প্রথম দুজনের মধ্যে ফাহাদ আর তার ফুফাতো বোন মাস্ট থাকবে!
বিরক্ত হয়ে বাড়ির পিছনের দরজার অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। দরজার পাশে ছাঁদে যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়িতে পা রাখবো তখন দ্রুত গতিতে চলা কারও সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লেগে ধাক্কা খেলাম। আমি প্রায় উপুড় হয়ে সিঁড়ির গোড়ায় পরে যাই। চোখে আগুন জ্বালিয়ে পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি প্রিয়ল!
প্রিয়ল আমার মতো হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে ঘাড় কাত করা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
“ফাবলীহা!”
“প্রিয়ল!”
দুজনেই বিস্ময় বিহ্বলে পতিত হলাম।
“আপনি এখানে কি করছেন?”
প্রিয়ল মৃদু হেসে বললো,
“বিয়ে খেতে এসেছি।”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।
সে আমাকে ধরে ওঠালো। চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে পেছনের দরজাটি খুলে বাহিরে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রিয়ল আমার বাহুতে হাত রেখে বললো,
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। তুমি না বলেছিলি তোমার চাচার বাড়ি যাবে?”
আমি এখনও হতবুদ্ধি হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। মিনমিনে গলায় বললাম,
“মোজাম্মেল চাচ্চুকে চেনেন? উনি আমার বাবার বন্ধু।”
“হ্যাঁ চিনি, চিনবো না কেন? আমি তো ফায়াজের বিয়ে খেতেই এলাম। ও আমার মামীর..”
তখন কয়েকটা বাচ্চা কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো। একে অপরকে থাবা মারার উদ্দেশ্যে একজনের পেছনে আরেকজন ধাবমান।
আমাকে আর প্রিয়লকে কয়েকবার প্রশিক্ষণ করে অন্যদিকে ছুটে চলে গেলো।
তখন ভেতর থেকে আমার মায়ের গলা শুনতে পেলাম,
“কেউ ফাবলীহাকে দেখেছো?”
প্রিয়লও আমার মায়ের গলা পেলো।
আমার গাল টিপে বললো,
“আমার শ্বাশুড়ি মা? দেখা করে আসি?”
আমি প্রিয়লের বুকে মৃদু আঘাত করে দৌঁড়ে ছুটলাম সদর দরজার দিকে। আম্মু পিছনের দরজার কাছাকাছি আসতেই তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম।
“উফ ফাবলীহা। ভয় পাইয়ে দিলি।”
আমি মুখে বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি যে নার্ভাস তা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না।
আম্মু ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
“খেয়েছিস কিছু?”
আমি মাথা নাড়লাম।
আম্মু চোখ গরম করে আমায় ধমকে ওঠলো,
“একটা থাপ্পড় দেব মিথ্যা কথা বলবি তো আর। আয় তোর আব্বু তোর জন্য কেক আর আইসক্রিম এনেছে।”
আম্মুর পেছনে যাওয়ার আগে একবার পিছনের দরজা দিয়ে বাহিরে উঁকি মেরে দেখলাম। প্রিয়ল নেই। স্বপ্ন দেখিনি তো?
আম্মুর সঙ্গে রুমে গিয়ে দেখলাম। আব্বু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন। আম্মুও তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে পরিতোষপূর্ণ হাসি প্রদান করলো।
মহিলাটি আমাকে দেখে হাসি দিয়ে জিগ্যেস করলো,
“এটা আপনার মেয়ে?”
আম্মু জবাবে বললো,
“হ্যাঁ, আমার মেয়ে ফাবলীহা।”
মহিলাটি চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে পরিলক্ষণ করে কাছে ডাকলেন,
“এদিকে আয় তো।”
আমার গালে হাত রেখে বললো,
“কেমন আছিস?”
প্রথম সাক্ষাতেই উনাকে আমার বেশ পছন্দ হলো। উনার আচার-ব্যবহার গুছানো। নিয়মনীতির আওতায় বাধাপ্রাপ্ত সুপরিচালিত সংবিধানের মতো। চোখের পাতা-পল্লবে বিচক্ষণতা ছাপ, ঠোঁটের কোণায় ন্যায়পরায়ণতার সস্মিত।
কিছুক্ষণের আলাপে আমি উনার সঙ্গে একদম মিশে গেলাম। উনি হলেন ফাহাদের মায়ের বোন। কিন্তু আমি উনাকে আন্টি আন্টি বলে আলগা ভাব না দেখিয়ে মানসুরা খালা বলে ডাকলাম।
ফাহাদের মা আমাদের কথাবার্তার মাঝে নাস্তার প্লেট নিয়ে হাজির হলেন। উনার মুখ সেই পূর্বের মতো তিমিরাচ্ছন্ন নিয়ে জাহির।
তিনি আসতেই মানসুরা খালা ধমকে ওঠলো,
“এই মহিলা, তোর সমস্যা কি? যৌতুক দেয়নি বলে মন খারাপ? এতো অভাব হলে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নাম। নতুন থালা আমি কিনে দেব।”
ফাহাদের মা বেজার মুখে জবাব দিলেন,
“আমি কি বলেছি আমার মন খারাপ?”
“তাহলে ছেলেদের বিয়েতে এমন করে থাকিস কেন? তোর এমন চেহারা দেখতে এখানে আসিনি।”
ফাহাদের মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“জিনিসপত্র দেবে না বলে রাগ করিনি, কিন্তু যে সে ছোটলোক বলবে কোন সাহসে!”
“কে ছোটলোক বলেছে?”
ফাহাদের মাতা তখন আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন।
মানসুরা খালা আমাকে একবার দেখে চোখ সরিয়ে নিয়ে আব্বুর উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভাই আপনি বাহিরে যান তো।”
আব্বু গেলে উনি আবার বলতে লাগলেন,
“ছোট লোকের মতো কাজকর্ম করবি কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে যে সে। বলি, আত্মসম্মানে এতো ঘা লাগলে কর্মের পূর্বে তা খেয়াল হয় না? খেয়াল তখন হয়েছে, যখন ফার্নিচারের আশা ত্যাগ করে শূণ্য হস্তে বসতে হয়েছে!”
খালা আমার ধরে টেনে ফাহাদের মায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
“তুই না ওর প্রশংসা করে আনন্দে আটখানা হয়ে গিয়েছিলি? মেয়েটা আসলেই প্রশংসার যোগ্য। নাহলে এতো ছোট বয়সে তোর ছোটলোকী কর্ম বিশ্লেষণ করতে পারতো না। জিনিসপত্রের জন্য তোর রাগ নেই? তোকে আমি চিনি না? তুই আমার বোন। মেয়ের বাড়ির দামি দামি ফার্নিচারের জন্য যে তোর ভেতরের জল শুকিয়ে গেছে তা স্বীকার করবি না। তুই না করেছিলি? বরং এই নেই, সেই নেই বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলি। মোজাম্মেল ভাই থেকে সব শুনেছি। দুইটাই তো আবার এক জাতের! তালে তালে নাচুনি।”
মানসুরা খালা এতগুলো কথা বলে থামলেন। তার বোন প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না।
খালা আবার ধমকে ওঠলেন,
“থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেব। ছোটলোক কি তোকে শখে বলেছে? তুই আমাকে বুঝ দিস!”
আম্মু বললেন,
“হয়েছে আপা বাদ দিন। দুদিন বাদে বিয়ে। বোনদের মধ্যে এমন করার দরকার নেই।”
ফাহাদের মায়ের চোখে জল দেখা গেলো। তার বোন আবার ধমকে ওঠলেন,
“এই আমার সামনে নাটক করবি না। ভালো না লাগলে বল, চলে যাই। কিন্তু অন্যায় কোনোকাল সহ্য করিনি, বোনের সঙ্গে রসের সম্পর্ক রাখতে এখন করবো ভাবিস না। উনার যৌতুক লাগবে, যৌতুক।”
ফাহাদের মা ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বললেন,
“আমার যৌতুক লাগবে না।”
খালা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“ঠিক আছে, কাঁদিস না।”
যেন তিনি তার বোনের উপচে পড়ে আদর চাওয়ার আশাতেই ছিলেন। তাই বোনকে আদরে আলিঙ্গন করে উপুড় করে ভালোবাসা ঢেলে দিলেন।
আমি তাদের দেখে মুচকি হাসলাম।
দুই বোন মিলে এরপর ছুটলো নানা গল্পের আটি বেঁধে বিয়ের অন্যান্য কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে।
তারা চলে গেলে আমি আম্মুকে জিগ্যেস করলাম,
“এমন ভালো মানুষের এমন বেক্কল বোন কিভাবে হলো।”
আম্মু কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে তাকালো।
আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
“চোখ রাঙিয়ে লাভ নেই। যাহা সত্য তাহা আমি বলিবোই।”
(চলবে)