তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ৭

0
300

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_৭
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৭.
ফাহাদ আমাকে দেখলেই তার মামণির শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে থাকে। আমি ডানে গেলে সে বামে যায়, আমি সোজা গেলে সে খাটের তলায় ডুবে যায়। তখন আমার একটা গান মনে পড়ে, ‘ডুবেছে তোমার চোখের ঐ অনন্ত মায়ায়।’
তার সেই প্যাঁচার মতো কুঁচকানো মুখ যে কি ভালো লাগে!
আব্বু বোধহয় বুঝতে পেরেছে তার ফাহাদের সঙ্গে আমার প্রণয় সংঘটিত করার পরিকল্পনায় মই পড়েছে।

“কি ব্যাপার? আজকাল তোমাকে দেখছি খুব খুশি খুশি লাগে।”
ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে সুতোয় পুঁতি গাঁথছিলাম। ইচ্ছে আছে এই মালা ফাহাদের গলায় ঝুলিয়ে ফাঁস দেব। এরপর মাথার চুল ছিঁড়ে, হাতে বালা পরিয়ে বাদাম বাদাম গান গাওয়াবো। সিটি গোল্ড এর চুড়িমালা, মোবাইলের বডি ভাঙা– ভাঙা মোবাইলের দেহটার মতো তার দেহটাকেও চুরমার করে দেব, যেন ভবিষ্যৎ বউ যে-ই হোক না কেন শরমে দেখাতে না পারে।
আব্বু সজোরে মাথায় চাটি মেরে বললেন,
“কার কথা ভাবো? আবার দেখি মুচকি মুচকিও হাসো।”
“আজব, খুশি থাকতেই পারি। হাসিখুশি মানুষ আমি।”
সোফায় বই নিয়ে বসে থাকা ফাহাদকে উদ্দেশ্যে করে বললাম,
“আমি তো আর ছেলে না যে মেয়েদের ভয়ে মুরগির ডিম সরিয়ে মুরগির তলার উম নিয়ে বসে থাকবো। আই হ্যাভ অ্যা লং লাইফ টু লিভ।”
ফাহাদ আকস্মিক চমকে ওঠলো। চমকের জন্য তার হাত থেকে বই শব্দ সহিত মেঝেতে পড়ে গেলো। আব্বু মাথা ঘুরিয়ে ফাহাদের দিকে তাকালেন। সে কাঁচুমাচু করে বইটি মেঝে থেকে তুলে দ্রুত বেগে তার জন্য বরাদ্দ করা রুমের দিকে অগ্রসর হলো। আব্বু তার প্রস্থান নেওয়া দেখে কিছুক্ষণ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
এরপর খানিক ঝুঁকে নিচু গলায় আমাকে বললো,
“এই ফাবলীহা, সত্যি করে বলো তো। তুমি ফাহাদের সঙ্গে কি করেছো?”
আমি চোখ পাকিয়ে আব্বুর দিকে তাকালাম। বললাম,
“কি করেছি মানে? তুমি কী বুঝাতে চাইছো? বাহিরের মানুষের জন্য তুমি কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছো!”
আব্বু ইতস্তত করে সোজা হয়ে বললো,
“আরে না। কিসের থ্রেট। আমি তো জিগ্যেস করছি ফাহাদকে কি তুমি কিছু বলেছো?”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। আব্বুকে কিভাবে বলি, কিভাবে মনের কথা ব্যক্ত করি?
আব্বু আবারও নিচু হয়ে বললো,
“বলো, বলো। চিন্তা নেই। আব্বু বকা দেব না।”
আমি অসহায় মুখে বললাম,
“আমি উনাকে বলেছিলাম আমার সঙ্গে বাহিরে ঘুরতে যেতে। এই ধরো, কাছে কোনো রেস্টুরেন্টে। আমার বান্ধবীরা উনাকে দেখতে চেয়েছিল। ওইদিন তুশিরা এসে তো উনাকে ভালোমতো দেখতেও পারেনি।”
আব্বু এক ভ্রু উপরে তুলে জিগ্যেস করলেন,
“তোমার বান্ধবীরা কেন ফাহাদকে দেখতে চায়?”
আমি লজ্জার ভঙ্গিতে বললাম,
“না মানে, আমিই বলেছিলাম। বলেছিলাম যে আমার একটা ব্রিলিয়ান্ট ভাই আছে। তার থেকে অনেক জ্ঞান ও লাইফ টিপস নেওয়া যাবে।”
আব্বু হেসে বললেন,
“ওহ, আচ্ছা আচ্ছা। সেটা কোনো সমস্যা না। আজকে তো কোচিং নেই। তাহলে আজকেই যাও। আমি ফাহাদকে বলে রাখছি। আর কোন কোন বান্ধবী দেখা করবে? তুশিরা আর চাঁদনীই তো?”
তখন চাঁদনীর আগমন ঘটলো। সে বড় করে ঘোমটা দিয়ে আব্বুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমরা আমরাই বলছিলাম দুলাভাই, থুক্কু, ফাহাদ ভাইয়ার সঙ্গে এখানে সেখানে একটু..”
আব্বু হঠাৎ করে আহ্লাদিত হয়ে বললো,
“আচ্ছা, আচ্ছা। সেটা কোনো সমস্যা না। দরকার হলে আরও বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করাও।”
বিড়বিড় করে বললেন,
“আগে থেকে পরিচয় করিয়ে রাখলে ভালো।”
আমি শুনেও না শোনার ভান ধরলাম। আগে থেকে পরিচয় করিয়ে রাখলে তো অবশ্যই ভালো। তাহলে মানুষ দেখলেই চিনবে, ফাহাদ– দ্যা ফাকাদ নামক তেলাপোকার এন্টেনার মতো দেখতে এক কচি পুত্রকে, ফাবলীহা নামের এক বুদ্ধিমতী কন্যা বাঁশময় জীবন উপহার দিয়েছে।

৮.
রেস্টুরেন্টে আবারও আমাদের ডাইনিং রুমের চিত্র চিত্রিত হলো। তবে একটু পার্থক্য। ওইদিনের মতো পাশাপাশি তিনটি সারিবদ্ধ চেয়ারে তিন বান্ধবী বসে নেই। আজকে চাঁদনী ফাহাদের সঙ্গে মাখো মাখো হয়ে বসে আছে। আর আমি নাচোস কুচুর মুচুর শব্দ তুলে খাচ্ছি।
“হেই সোনা।”
চাঁদনীর ডাকে ফাহাদ তাকাতেই চোখ মারলো। ফাহাদ চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পরপর করুণ দৃষ্টিতে বেচারা আমার দিকে তাকাচ্ছে।
চাঁদনী তার কাঁধ দ্বারা ফাহাদের কাঁধে মৃদু ধাক্কা মেরে বললো,
“একাই খাবে? আমাকে খাইয়ে দেবে না? তোমার হাতে খাবো বলে আমি গতকাল থেকে অনশন করে আছি। আমার শুকিয়ে যাওয়া চেহারা দেখে তুমি কি তা বুঝতে পারছো না প্রিয়? দাও, খাইয়ে দাও।”
ফাহাদ খানিক সাহস সঞ্চয় করে বললো,
“আমি কেন আপনাকে খাওয়াবো? অপরিচিত মেয়েদের আমি খাওয়াই না। আমি খাওয়ালে ফাবলীহাকে খাওয়াতে পারি।”
আমি ভ্রুযোগল উঁচু করে তার দিকে তাকালাম। বাহ বাহ, ফাবলীহাকে খাওয়াতে চায়। এতো শখ, এতো কারেন্ট! পশ্চাদ্দেশের বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য শালা দেখছি বসতেই পারছে না।
চাঁদনী ফাহাদকে ধমকে ওঠলো,
“কি বললি তুই! খাওয়াবি না? তুই আমাকে খাওয়াবি না?”
নিকট টেবিলের মানুষগুলো আকস্মিক চিৎকারে অদ্ভুতভাবে তাকালো।
ফাহাদ বোধহয় উঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। চাঁদনী এবার চাপা গলায় তার উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার পাশ থেকে উঠে যদি এক ইঞ্চিও নড়িস, আজকে খাবার না খেয়ে তোকে খাবো।”
ফাহাদ দুই হাত দিয়ে নিজের বুক ঢাকার চেষ্টা করলো। আতঙ্ক ও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চাঁদনীর দিকে চাইলো।
চাঁদনী অবাক হওয়ার গলায় বললো,
“ছিঃ! তুমি তোমার বুক আবৃত করছো কেন? আমি কি তোমার বুকে.. ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। ফাহাদ তুমি এতো দুষ্টু!”
বলেই সে মুখ ঢাকলো।
আমি আর তুশিরা খুব কষ্টে হাসি আটকে রাখছি।
ফাহাদ বুক থেকে হাত সরিয়ে মাথায় হাত দিলো। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। সেকেন্ডের মধ্যে কেউ মুখভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারার গুণ নিয়ে যে জন্মাতে পারে এটা বুঝি বেচারার জানাই ছিলো না।

“কিরে পাঠা, খাইয়ে দিতে বললাম না!”
চাঁদনীর ধমকে ফাহাদ চামচে আইসক্রিম নিয়ে তার দিকে হাত এগিয়ে দিলো।
খেয়ে এরপর লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
“এবার আঙ্গুলে খাইয়ে দাও। খেতে খেতে আমি তোমার আঙ্গুলে চুমু খাবো।”
হাসির শব্দ প্রতিহত করার জন্য তুশিরা মাথা নিচু করে তার মুখ চেপে ধরলো।
“ফাবলীহা..”
ফাহাদের করুণ ডাকে আমি ভেটকি মেরে তাকালাম।
“জি, বলুন। আর কিছু খাবেন? এই রেস্টুরেন্টে ভালো নাগা পাস্তা পাওয়া যায়। এতো সুস্বাদু ঝাল। সারাজীবন মনে থাকবে।”
তখনই আমার নাচোসের প্লেটটি কেউ টেনে নিলো। তাকিয়ে দেখলাম রিজওয়ান। তার সঙ্গে আবার পাঁচ-ছয়জন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
“কেমন আছো ফাবলীহা? এটাই তাহলে তোমার বাগদত্তা। হাঁহ।”
রিজওয়ান ফাহাদকে ইঙ্গিত করে বললো।
আমি অবাক হয়ে তুশিরার দিকে তাকালাম। কারণ ফাহাদের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক এটা তুশিরা আর চাঁদনীই শুধু জানে। আর এখানে আমাদের আসার কথা তুশিরা কাউকে বলে থাকলে তার বয়ফ্রেন্ডকে বলবে। তার মানে নাহিয়ান রিজওয়ানকে এই তথ্য দিয়েছে!
আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে তাচ্ছিল্যপূর্ণ গলায় বললাম,
“তুমি এখানে কি দৃষ্টান্তমূলক কর্ম সাধনে এসেছো রিজওয়ান?”
“তোমার পাখা ভাঙার জন্য।”
“রিজওয়ান!”
“আহা, রাগ করো কেন? তোমার পাখা ভেঙে আমার মনের খাঁচায় বন্দি করবো। তুমি তো তা বুঝতেই চাও না। তাই আজকে তোমাকে ভালো করে বুঝাবো।”
তুশিরার দিকে তাকিয়ে বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বললো,
“ভাবি, ভালো আছেন? উঠুন তো দেখি। আপনার দেবরকে একটু বসতে দিন।”
তুশিরা রাগান্বিত গলায় বললো,
“কি অসভ্যতা এসব!”
“উঠুন, উঠুন।”
বলতে বলতে রিজওয়ান এমন অঙ্গভঙ্গি করলো যে সে তুশিরার গায়ে হাত দিয়ে তাকে ওঠাবে। তুশিরা থতমত খেয়ে তার স্পর্শ থেকে বাঁচতে উঠে দাঁড়ালো। সেই সুযোগে সে-ও আমার পাশে এসে বসলো।
“আমি কিন্তু নাহিয়ানকে বলবো এসব। তুমি যে অসভ্য, ইতর, ছোট লোক!”
তুশিরার ধমকে রিজওয়ান তার দিকে ভয়ংকরভাবে তাকালো,
“ভাবি! সম্মান দিচ্ছি সম্মান ধরে রাখুন। নাহলে কিন্তু অনেক কিছু হয়ে যাবে। আর আপনার বেয়াক্কল বয়ফ্রেন্ডকে বললেই কি হবে? উল্টো হাতে চুড়ি পরে বসে থাকবে।”
তার সাঙ্গো-পাঙ্গোরা তার কথায় সায় দিয়ে হাসতে শুরু করলো।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে বন্ধু মহলের মধ্যে হাসিঠাট্টা চলছে।

“তুমি ঠিকই বলেছো। নাহিয়ান যদি গাধা না হতো তোমার মতো দশ টন ওজনের গোবর ভর্তি মস্তিষ্কের হাতির সঙ্গে কখনো বন্ধুত্ব করতো না।”
রিজওয়ান আমার দিকে ফিরে বললো,
“তুমি আমাকে যা ইচ্ছা তা বলতে পারো। আমি একদমই রাগ করবো না।”
এরপর ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি বাচ্চা মানুষ। এখানে কোনো কাজ নেই। যাও বের হও। উঠ বেটা!”
আমি তাকিয়ে দেখলাম ফাহাদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার পাশে চাঁদনী নেই। চাঁদনীর ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না।

ফাহাদ চুপচাপ হেটে হেটে রেস্টুরেন্টের দরজার নিকট চলে গেলো। আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উল্টোপথে ফিরে এলো হাসি হাসি মুখে।
রিজওয়ানের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি যে তোমার বড় সেটা কী তুমি জানো? এই যে বাচ্চা, বেটা বলছো। এগুলো তো ভালো না ভাইয়া। এসব শিক্ষা কিন্তু পরিবার থেকেই আসে। তুমি কি এতিম?”
রিজওয়ান কিড়মিড় করে ওঠলো,
“এই শালা!”
রেস্টুরেন্টের সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কেউ কেউ সমালোচনাও করছে, ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের বন্ধুত্ব। আবার একসঙ্গে মিলিত হয়ে চেঁচামেচি।

আসল কাহিনী তো তা না।
আমি এদিকে মনে মনে দোয়া-দরূদ পড়ছি। রিজওয়ান একটা ইতর ছেলে জানতাম, কিন্তু এতটা জোচ্চুর হতে পারে তা ভাবিনি।

রিজওয়ানের সঙ্গে আসা একটা ছেলে ফাহাদের বুকে ধাক্কা দিলো। কর্কশ গলায় তার উদ্দেশ্য বললো,
“ভাগ্য ভালো থাকতে এখান থেকে সরে যা। নাহলে মাইরের চোটে নিজের হাত-পা-ও খোঁজে পাবি না।”
ফাহাদ হো হো করে হেসে ওঠলো,
“ওরে পিচ্চি কি কস তুই! বুকে আয় বাপ, বুকে আয়।”
ছেলেটি হতভম্ব হয়ে গেলো। ফাহাদ সত্যি সত্যি আদরণীয় ভঙ্গিতে ছেলেটিকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ঠোঁট গোল করে গালে একটা চুমুও খেলো। দুই গালে হাত দিয়ে মাথা কাত করে ছেলেটির ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটি ঝটকা মেরে ফাহাদকে সরিয়ে পিছনে দাঁড়ালো। রিজওয়ান উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত চিবিয়ে বললো,
“তোরা একে এখনই বের করে দিয়ে আয়। এই বেটা বহুত ঝামেলা সৃষ্টি করছে।”
প্রথম ছেলেটি ফাহাদের দিকে তাকালে ফাহাদ চোখ টিপে তর্জনী আঙুল দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলো। তা দেখে ছেলেটি উল্টো পিছু হটলো। অন্য আরেকটি ছেলে ওই ছেলেটিকে মৃদুস্বরে গালি দিয়ে ফাহাদের দিকে এগিয়ে গেলো। ছেলেটি ফাহাদের শার্টের কলার চেপে ধরলে ফাহাদ তার কোমরে হাত রেখে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেটির পেটে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললো,
“তুমি অনেক নরম, ঠিক স্পঞ্জের মতো। তুমি মেয়ে হলে এখনই তোমাকে জম্পেশ আদর করে তোমার পেটে আমার বাচ্চা দিতাম।”
বলেই ফাহাদ লজ্জা ভঙ্গিতে ছেলেটির কাঁধে মাতা গুঁজলো। ছেলেটি কতক্ষণ অক্ষিগোলক থেকে চোখগুলো বের করে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হুশ আসতেই যথাস্থানে চোখ রেখে পূর্বের জনের ন্যায় ফাহাদকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো।
“এই শালা কি কস তুই?”
“আমি তো কিছুই বলিনি। তুমি একটু তোমার পেটে হাত রাখো তো। কয়েক মূহুর্তেই ফোলে গেলো কেন? আমি তো এতোটা শক্তিশালী নই।”
ছেলেটি পেটে হাত রাখলো। তৎক্ষণাৎ সরিয়ে রিজওয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,
“এই ছেলে আস্ত লুইচ্চা ভাই। আপনিই একে বাহিরে রেখে আসুন। আমরা ভাবিকে দেখে রাখছি।”
আমি ছেলেটির দিকে ভ্রুজোড়া উপরে তুলে তাকালাম। এখন ঘটনা পরিষ্কার হচ্ছে। রিজওয়ান তবে আমাকে পছন্দ করে! এই হাতিটা? মাই গড, মাই গড!

রিজওয়ান তাদের কষিয়ে ধমক দিলো,
“এই শালাকে যদি আমি এক মূহুর্ত সামনে দেখি তবে তোদের গাড়ির নিচে ফেলে পিষবো।”
তৃতীয় ছেলেটি আবার দুই হাত শূন্যে ছড়িয়ে ফাহাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“আমি অন্যদের মতো এতো তিড়িং বিড়িং জানি না। পছন্দও করি না। আদর করবি? আয়, বাইরে নিয়ে তোকে আদর করছি।”
তার কথা শুনে ফাহাদ চোখ পাকিয়ে তাকালো। কোমর হাত রেখে গলা উঁচিয়ে বললো,
“এই বেয়াদব। লজ্জা করে না ছেলে হয়ে ছেলের সঙ্গে খারাপ কাজ করতে চাস? এইজন্য আজকে আমাকে এখানে ডেকে এনেছিস? ছিঃ, তোরা বন্ধু নামে কলঙ্ক!”
এবার রেস্টুরেন্টে উপস্থিত সব মানুষের পূর্ণ দৃষ্টি আমাদের দিকে স্থাপিত হলো। ওয়েটার যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে নাক কুঁচকালো। মূহুর্তেই ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ বৃদ্ধি পেলো।
তুশিরা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় চাঁদনী কোথায় জানতে চাইলো। আমি কাঁধ ঝাকালাম।

একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে ফাহাদকে জিগ্যেস করলো,
“কোনো সমস্যা স্যার?”
“আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি একদম নির্ভেজাল এবং সুস্থ মানুষ। কিন্তু এই ছেলেগুলো শারীরিকভাবে মারাত্মক অসুস্থ। আমার শরীর হাতাতে চায়।”
সবাই ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ সমস্বরে বলে ওঠলো। তৃতীয় ছেলেটি সশব্দে গালি দিয়ে ফাহাদের মুখে ঘুষি মারলো। ফাহাদ সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মুখের এক পাশে আঘাত লাগলো। তখন চাঁদনী হাতে খুন্তি, থালা-বাসন, একটা ছুরি নিয়ে হাজির হলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ছুরি দিয়ে গরুর ঘাসও কাটা যাবে না।
সে হাপাতে হাপাতে বললো,
“ফাহাদ জানু। এই ধরো অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়েই এই শয়তানগুলোকে আমরা বদ করবো।”
ফাহাদ এক হাতে খুন্তি, আরেক হাতে ভারি দেখতে একটা প্লেট হাতে নিলো। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। কাকে আজকে হস্পিটাল নিয়ে যেতে হবে কে জানে। আগের থেকে কি একটা অ্যাম্বুলেন্স কল করে এনে রাখবো?
রিজওয়ানও আমার পাশ থেকে উঠে ফাহাদের দিকে এগিয়ে গেলো। ফাহাদও মধ্যস্থতা করা হতভম্ব চেহারার ওয়েটারকে সামনে থেকে সরিয়ে এগিয়ে গেলো। পাশে চাঁদনী খাইয়ালামু ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। দুই দল কাবাডি কাবাডি বলা শুরু করলো।

কাবাডি কাবাডি কাবাডি। কুত কুত কুত কুত..
কুত কুত মূলত চাঁদনী বলছে। একবার কাবাডি কাবাডি, আরেকবার আ চো চো কুত কুত কুত।

দুই দল কয়েকবার চক্রাকারে ঘোরার পর ফাহাদ থালা দিয়ে সবচেয়ে চিকন ছেলেটির মাথায় আঘাত করলো। ছেলেটি মাথা ঘুরিয়ে একটা আঙ্কেলের কোলে বসে পড়লো। উনার সঙ্গে বসা মহিলাটি চিৎকার করে বলে ওঠলো,
“এই সমকামী সর, সর! আমার জামাইয়ের উপর থেকে সর!”
আরেকটি ছেলে চাঁদনীকে ধাওয়া করতে চাইলে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“এই শালা, ঘরে মা-বোন নাই? মায়ের হাতে তো নিশ্চয়ই এহনও ছ্যাঁচা খাস। তাইলে আমারে মারতে দেস না কেরে প্রতিবন্ধী!”
ছেলেটি সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। সে বুঝতে পারছে না নিজেকে মার খাওয়ার হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে চাইলে কেউ প্রতিবন্ধী কিভাবে হয়। এই সুযোগ লুফে চাঁদনী ছেলেটির নাকে ঘুষি মেরে ভোঁতা ছুরিটি ছেলেটির নাকে ঢুকানোর চেষ্টা করলো। আমি উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠলাম। তুশিরা আমার থেকে ভালো শান্ত ভঙ্গিতে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
রিজওয়ান তার বিশাল দেহটা নিয়ে ফাহাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুজনেই সপাৎ করে নিচে পড়ে গেলো। নিচে ফাহাদ, তার পেটের সঙ্গে পেট লাগিয়ে উপরে রিজওয়ান। এই দৃশ্য দেখার জন্য আমি আজকে এখানে এসেছিলাম? এই দৃশ্য দেখার জন্য!
এপ্রোন পরা রেস্টুরেন্টের তিনজন রাঁধুনি দৌঁড়ে এলো। চাঁদনী তাদের দেখে লাফিয়ে উঠে অবশিষ্ট ছেলেটির দিকে এগিয়ে তাকে খামচে ধরলো।
“এই ছেমড়া আমাকে বাঁচা।”
তার সঙ্গী তিনজনেরই নাজেহাল অবস্থা। চাঁদনীর খামচি বুঝি ছেলেটির আর সহ্য হলো না। ফলে সে জ্ঞান হারালো।
রাঁধুনি চাঁদনীকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“ম্যাম আপনি আমাদের জিনিসপত্র ফেরত দিন। এগুলো দিয়ে আপনি কি করবেন?”
চাঁদনী কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
“এগুলো দিয়ে আমি কি করবো, হ্যাঁ! দেখতে পারছেন না আমার বয়ফ্রেন্ডকে ওই লাল পাঞ্জাবি পরা ড্রামটা পিষে ফেলছে। বাঁচান ওকে!”
রিজওয়ান ও ফাহাদ এখনও মেঝেতে ধস্তাধস্তি করছে।
রাঁধুনি ও ওয়েটার রিজওয়ানকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো। অনেক কষ্টে তোলার পর সে জঘন্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলো। তার অশ্রাব্য ভাষা শুনে তারা প্রচন্ড রেগে লাল হয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো তার কেলানী খাওয়ার পর্ব। আমি, চাঁদনী, তুশিরাও ফাঁকে ফাঁকে দুই-চারটা চড়-থাপ্পড় মারলাম।
রেস্টুরেন্টের মানুষজন ফ্রিতে আজকের অনাকাঙ্ক্ষিত বিনোদন গ্রহণ করছে, আর স্মরণীয় মূহুর্তটি ক্যামেরা বন্দী করছে।

রাস্তার ধারে চারজন দাঁড়িয়ে আছি। ফাহাদ এসে চাঁদনী ও তুশিরাকে বললো,
“তাহলে শালীরা তোমরা এখন আসতে পারো। তোমাদের বান্ধুবীকে নিয়ে আমি তবে রওনা হই।”
চাঁদনী ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আমি তোমার শালী হই কিভাবে?”
ফাহাদ চাঁদনীর কাঁধে হাত রেখে বললো,
“তুমি তো আমার অন্যরকম শালী। আমার সুইটি কিউটি শালীটা।”
বলে চাঁদনীর গাল টিপে দিলো।
চাঁদনী তৎক্ষণাৎ তার হাত ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। গালে হাত বুলিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও রাগান্বিত দৃষ্টিতে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ফাহাদ আমার দিকে ফিরে বললো,
“তাহলে যাওয়া যাক। রিকশা ডাকি?”
“না! আমি আপনার সঙ্গে রিকশায় যাবো না।”
“তাহলে কী হেঁটে যাবে? আমি কোলে নেব?”
আমার হাত ধরতে আসলেই আমি ধমকে ওঠলাম।
“ধুর!”
চাঁদনী আর তুশিরাকে একবার দেখে নিয়ে গটগট করে হাঁটা দিলাম। ফাহাদ আমার সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই আমার কানের কাছে এসে বলতে লাগলো,
“ফাবলীহা, পরিবেশটা সুন্দর না? পাশাপাশি তুমি আর আমি। মনে হচ্ছে বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। তুমি চাইলে কিন্তু সেটা সত্য করতেই পারি।”
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। এই ছেলেটা কয়েক ঘণ্টা পূর্বের মায়ের আঁচলে মুখ লুকানো ইঁদুরটা? এটাই সেই আমার চোখ পাকানো দেখে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ মুখায়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা? এটাই আমার বান্ধবী চাঁদনীর ডলা খেয়ে পিষ্ট হয়ে যাওয়া স্যান্ডউইচটা?
আমি মাথায় হাত রেখে আবার হাঁটা শুরু করলাম।
ফাহাদ গান গাইতে শুরু করলো,
“তুমি বন্ধু কালা পাখি, আমি যেন কি। সাদা সাদা, কালা কালা।”
ইয়া মাবুদ!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here