যাও পাখি বলো তারে – পর্ব শেষ

0
714

যাও পাখি বলো তারে

শেষ পর্ব.
‘তুমি কি জানো লাজুকতা?
তুমি আমার শ্রেষ্ঠতম উপহার।
তুমি কি জানো প্রেয়সী?
তুমি আমার একলা জীবনের সঙ্গী।
তুমি কি জানো প্রিয়তমা?
আমার মতো পিপাসিত পথিকের তৃষ্ণা মেটানোর একরাশ জল তুমি।

তোমার এক চিলতে হাসি,
মরুভূমির মতো বিশালতার চেয়েও বেশি মুগ্ধতা দেয় আমাকে।
কেন জানো?
কারণ, তুমি হলে আমার অস্তিত্ব।
আমার একান্ত হৃদয়হরণী মরুভূমি।’

কালো রঙের কাগজে সাদা কালিতে লেখা ছোট্ট চিরকুট-টি পড়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল আমার। ঘুম থেকে উঠে পাশের ছোট টেবিলটায় এই চিরকুট-টি পেয়েছি আমি। নিশ্চয়ই রাতে রেয়ান এসেছিলেন রুমে। তা নাহলে চিরকুট-টা আসলো কোত্থেকে?

বালিশের কাছ ঘেঁষে থাকা রবার ব্যান্ড-টা নিয়ে চুল বেঁধে নিলাম আমি। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে প্রথমেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এক মুহুর্তের জন্য চমকে উঠলাম। আপনা-আপনি চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে গেলো আমার। গালে, নাকে হলুদ লাগানো আছে আমার। যা শুকিয়ে দানা দানা আকার ধারণ করেছে। নিশ্চয়ই রেয়ানই করেছেন এমনটা। আমি বুঝি না, আমাকে জ্বালাতে উনার এত ভালো লাগে কেন? এত এত ভালো লাগা কোথা থেকে আসে উনার?

বাড়ির আশপাশটা ফুল আর ছোট ছোট মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারদিকে আনন্দ আর ব্যস্ততা যেন ঘিরে ধরেছে সবাইকে। বিয়ের পাত্র হওয়া সত্ত্বেও সেই সকাল থেকে কাজ করে চলেছেন রেয়ান। ফুল ঠিক ভাবে লাগানো হচ্ছে কিনা, স্টেজ সাজানোতে কোনো কমতি হলে, অথবা কর্মচারীরা তাদের কাজ ঠিক ভাবে করছে কিনা তা দেখাশোনা করছেন রেয়ান। মাঝে মাঝে কর্মচারীদের কাজ দেখাতে গিয়ে নিজেই করে দিচ্ছেন কিছু কিছু কাজ। এতে আত্মীয়রা অবাক হলেও আনন্দটা যেন আরো বেড়ে গেছে।

সন্ধ্যার দিকে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে আমাদের। আপাতত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। দৃষ্টি, কাজরত অবস্থায় রেয়ানের দিকে। উঠানে স্টেজের কাছে দাঁড়িয়ে সবার কাজ দেখছেন উনি। আনমনে উপরে তাকাতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল উনার। মুচকি হাসলেন উনি। চোখ উঁচিয়ে ইশারায় বললেন,
— “এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

ইশারায় ‘এমনি’ বললাম। উনি এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ঁলেন আমার দিকে। রুমে চলে যেতে বললেন। অথচ আমি তখনো দাঁড়িয়ে। প্রতিজ্ঞা করেছি রুমে যাবো না। উনার নজর এবার আরো তীক্ষ্ণ হলো। তবে কিছু বললেন না আর। নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আবার। এর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটা ছোট্ট ছেলে আমার রুমে এসে ঢুকলো। সরাসরি বারান্দায় এসে আমার পাশে দাঁড়ালো সে। অবাক হলাম। এখানে তো কারো আসার কথা না। এই ছেলে এখানে এসেছে কিভাবে? হারিয়ে গিয়ে ভুলে রুমে ঢুকে নি তো? সন্দেহ কাটাতে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম ছেলেটির সামনে। মুচকি হেসে বললাম,
— “বাবু তোমার নাম কি?”

ছেলেটি ফোকলা দাঁতে হেসে বলল,
— “মাই লেম ইস, তম্ময়।”

ছেলেটির গাল টেনে আরেকটু হেসে বললাম,
— “তোমার নাম তন্ময়?”
ছেলেটি মাথা ঝাঁকালো। আমি আবারো বললাম,
— “তো মিস্টার তন্ময়? আপনি এখানে এসেছেন কিভাবে? হারিয়ে গেছেন বুঝি?”

ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানালো। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো সে। বারান্দার রেলিং গলিয়ে, নিচে তাকিয়ে রেয়ানকে উদ্দেশ্য করে তন্ময় বলল,
— “ও-ই যে আনকেল, তোম্মাকে দিতে বলেচে আম্মাকে।”
— “তাই?”

বলেই ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সাথে সাথে আমাকে টেনে নিজের দিকে আনলো সে। আচমকা আমার গালে চুমু দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেল রুম থেকে। আমি ‘থ’ বনে রইলাম। পরপরই মুচকি হাসলাম। হাতে থাকা কাগজ খুলতেই দেখলাম সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা,

‘রুমে যাও। নাহলে তন্ময়ের বদলে আমি আসছি এখন।’

সরু দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকালাম আমি। রেয়ান গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে কেমন গম্ভীর ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছেন। চোখ সরাচ্ছেন না একদমই। আমি ইশারায় ‘কি’ জিজ্ঞেস করলেও উনার পরিবর্তন ঘটলো না। সে নিজের মতোই তাকিয়ে। এবার বেশ অস্বস্তি হতে লাগলো আমার। অস্বস্তি কাটাতে চলে এলাম রুমে। বারান্দার দিকে ফিরেও চাইলাম না আর।

______________

সন্ধ্যার শেষভাগ। স্টেজে পাশাপাশি বসানো হয়েছে আমাকে আর রেয়ানকে। চারদিকে আত্মীয়রা ঘিরে ধরেছে আমাদের। এবং ঠিক সামনেই বসে আছেন কাজী সাহেব। যেহেতু একবার কোট ম্যারেজ আর ইসলামিক ভাবে বিয়ে হয়েছে আমাদের। তাই এখন শুধু ধর্মীয়ভাবেই বিয়ে হবে। কাজী প্রথমে রেয়ানকে বললেন কবুল বলতে। সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে ফিরে বসলেন রেয়ান। লোকলজ্জা ভুলে গিয়ে সবার সামনে আমার হাত ধরে বসলেন। আমি লজ্জা আর ভীতি নিয়ে তার দিকে তাকাতেই সে চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন,
— “কবুল, কবুল, কবুল।”

চারদিকে এক ধরণের খুশির গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল মুহুর্তেই। রেয়ানের এহেন নির্লিপ্তভাব দেখে হাসি-ঠাট্টা আরো প্রবল হলো যেন। আমি লজ্জায় মাথা উঁচু করতে পারছি না। কাজী সাহেব এবার আমাকে বললেন ‘কবুল’ বলতে। কিভাবে বলবো শব্দটা? আমার অস্বস্তি বেড়েই চলছে। মনে মনে তীব্র সাহস নিয়ে মাথা উঁচু করে রেয়ানের চোখে চোখ রাখলাম। উনার মতো করেই কাঁপা গলায় বললাম,
— “কবুল, কবুল, কবুল।”

ব্যস! আরো একবার ধর্মীয়ভাবে বিয়ে হয়ে গেলো আমাদের। আরো একবার দুজন দুজনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।

এদিকে সবার হৈ-হুল্লোড় আরো বেড়ে গেলো। সবচেয়ে বেশি হৈ-হুল্লোড় করলেন ইয়াসিন ভাইয়া আর সবুজ ভাইয়া। ক্যামেরা দিয়ে আমাদের দু’জনের ছবি তুললেন বেশ কয়েকটা। তারপর রেয়ানকে উদ্দেশ্য করে দাঁত কেলিয়ে ইয়াসিন ভাইয়া বললেন,
— “কি ভাগ্য তোমার আব্রাহাম ভাই। দুই দুইবার বিয়ে করেছো। আহা!”

রেয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ইয়াসিন ভাইয়া চুপ হয়ে গেলেন সাথে সাথে। সবুজ ভাইয়া বললেন,
— “ভাই, ইয়াসিন কিন্তু ঠিক বলেছে। তোর একটা কপাল!”

সবুজ ভাইয়ার কথায় সায় দিলো আবদ্ধও। রেয়ান স্থির কণ্ঠে বললেন,
— “আমি কিন্তু একজনকেই দু’বার বিয়ে করেছি। তোদের বাজে চিন্তার মতো দুজনকে বিয়ে করিনি।”

তিনজনেই চুপসে গেলো এবার। কেননা, তাদের চিন্তা ভাবনা কিছুটা এমনই ছিল। তাছাড়া পাশে নিজেদের প্রেয়সীরা দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেই রেয়ানের এহেন কথায় তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তারওপর রেয়ান মানেই তাদের ইজ্জতের ফালুদা। মেয়েদের সামনে ইজ্জতের হামলা তো মানা যায় না। সুতরাং এখন চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করছেন আবদ্ধ, সবুজ আর ইয়াসিন ভাইয়া।

দীঘি তেমন কিছু না বললেও মেহেরুন আর কুহু রেগে গেল প্রচুর। সবুজ আর ইয়াসিন ভাইয়াকে ভেঙ্গচি দিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো তারা। কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “মীরু? আমরা তো এখনো বিয়েই করতে পারলাম না। আর তুই? একেবার দুই দুইবার! বাহ্!”

আমি মৃদু ভাবে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
— “তোরাও শুরু করে দিয়েছিস? ভাইয়া আর তোদের মধ্যে আর পার্থক্য কি রইলো?”

মেহেরুন দাঁত বের করে হেসে বলল,
— “আমরা সবাই তো একই ক্যাটাগরির। বুঝিস না কেন? হুদা, হুদা ওদের সাথে রাগ করে একটু মজা নিচ্ছি আর কি।”

মাথা নিচু করে ছোট্ট নিশ্বাস ফেললাম আমি। এদের কিচ্ছু হবে না। কখনো না।

.

পাশাপাশি বসে থাকা আমাদের সামনে লাইটিংয়ের সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে। সবার ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা, সরাসরি লাইটের আলো মুখে পরা এবং ক্যামেরা ম্যানদের এভাবে সেভাবে পোজ দিতে আদেশ দেওয়া প্রায় এক’দু ঘন্টা ধরে সহ্য করছি আমি। এখন রীতিমতো বিরক্ত লাগছে আমার। উহু না! প্রচন্ড আকারে রাগ হচ্ছে। পানির পিপাসাও পেয়েছে প্রচুর। কোনো মতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছি আমি। এ সময় রেয়ান শান্ত কণ্ঠে বললেন,
— “তোমার কি খারাপ লাগছে? ক্ষুধা লেগেছে?”

ধরা গলায় বললাম,
— “পানি খাবো।”

সঙ্গে সঙ্গে ইয়াসিন ভাইয়াকে ইশারায় ডাকলেন রেয়ান। ভাইয়া আসতেই পানি আনতে বললেন উনি। পানি আনতেই সেটা ধীরে সুস্থে পান করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললাম আমি। পুরোপুরি না হলেও আগের চেয়ে একটু আরাম পাচ্ছি এখন। তবে লাইটের আলো অসহ্য লাগছে। সঙ্গে ক্যামেরা ম্যানদের বকবক তো আছেই। রেয়ান হয়তো বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। ক্যামেরা ম্যানদের ডেকে বললেন,
— “আর কত ছবি তুলবেন? যতটুকু তুলেছেন, ততটুকু যথেষ্ট। আর তোলা লাগবে না।”

ক্যামেরা ম্যানও মেনে নিলো। আর আমিও বেঁচে গেলাম সে রাস্তায়। সত্যিই কি বেঁচে গেলাম? উহু না। রেয়ান নামক ব্যক্তিটি যে আমাকে সর্বদা জ্বালাতে প্রস্তুত। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন উনি,
— “তুমি তো দেখি অনেক উইক মরুভূমি। খাবার-টাবার খাও না? ভাত দেয় না কেউ?”

রাগী চোখে তাকালাম রেয়ানের দিকে। উনি নিঃশব্দে হাসলেন। সময়ের সাথে সাথে উনার হাসির তীব্রতাও বাড়ছে। সঙ্গে ফাজলামি তো আছেই। উনি আবারো বললেন,
— “চিন্তা করো না। আমি কিন্তু তোমাকে ভাত খেতে দেবো। এতটা নির্দয় নই আমি।”

ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
— “ঠিক বলেছেন। আপনি নির্দয় নন, আপনি পাষাণ!”
— “তাই?”
— “হ্যাঁ, তাই।”
— “উহু, মিথ্যা।”
— “আমি বলেছি না সত্যি?”
— “উহু! বলো নি তো।”

তার নির্বিকার কণ্ঠ। প্রচন্ড রাগ হলো আমার। আচ্ছা, কথায় কথায় ‘উহু’ শব্দটা বলা কি খুব প্রয়োজন? হয়তো। নাহলে কি আমাকে জ্বালাতে পারবেন উনি? মোটেও না। প্রবল রাগ নিয়ে বললাম,

— “এ সময়েও কি আপনার ফাজলামি করা প্রয়োজন রেয়ান?”

সে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “তোমাকে বলে ফাজলামি করবো নাকি আমি?”

এক মুহুর্তের জন্য বোকা বনে গেলাম। পরক্ষণেই অতি বিরক্তিতে কথাই বললাম না আর।

____________

দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে দীঘি। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবদ্ধ। বুকে দু’হাত ভাঁজ করে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দীঘির দিকে। পরপরই ঘড়ির দিকে তাকালো সে। রাত ১২টা বাজছে। একটু আগেই অনুষ্ঠান শেষ করে রুমে ঢুকেছিল তারা। সেই থেকেই দীঘিকে এহেনভাবে আটকে রেখেছে আবদ্ধ। চোখ ঘুরিয়ে আবারো দীঘির দিকে তাকালো আবদ্ধ। দীঘির অস্বস্তি হতে লাগলো। কাঠকাঠ কণ্ঠে বলল,
— “আমার অস্বস্তি হচ্ছে। সামনে থেকে সরুন।”

আবদ্ধ কাতর হয়ে গেল মুহুর্তেই। এক কদম এগিয়ে এলো। করুণ স্বরে বলল,
— “এত অভিমান কিসের জন্য দীঘি? আমাদের মাঝে না সব ঠিক হয়ে গেছে? তাহলে এসব কি?”

দীঘির পরিষ্কার কণ্ঠ,
— “আমার সময় লাগবে।”
আবদ্ধ প্রশ্ন করে উঠে,
— “আর কত সময় নেবে? তোমার এই সময় ফুরাবে কখন? আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে তারপর?”

দীঘি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। আবদ্ধ দীঘির সাথে একদম ঘেঁষে দাঁড়ায়। দীঘি শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তখনই ধীরভাবে আবদ্ধর গলা শোনা যায়,
— “কে তুমি?”

দীঘি চমকে উঠে আবদ্ধর প্রশ্নে, এহেন কণ্ঠে! অবাক হয়ে তাকায়। আবদ্ধ আগের ন্যায়ই বলে,
— “আমি তো এই দীঘিকে চিনি না। কে তুমি? আমার দীঘি তো এমন না। চঞ্চল, দুষ্টো সে। সবাইকে ক্ষমা করতে জানে সে। তুমি তো সেটা পারো না। আমার দীঘি কখনোই হতে পারো না তুমি। কখনো না। এই মেয়ে? আমার দীঘিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো? তাকে ফিরিয়ে দাও না প্লীজ। তাকে ছাড়া যে আমি বড্ড একলা। প্লীজ ফিরিয়ে দাও।”

দীঘির বুক কেঁপে উঠে। কথা গলায় দলা পাকিয়ে যায়। কিচ্ছু বলতে পারে না সে। আবদ্ধ টলমলে চোখে দীঘির পানে তাকিয়ে থাকে। উত্তরের আশায়! অথচ দীঘি নিরুত্তর। আবদ্ধর উত্তর হিসেবে একরাশ কান্না এসে ভর করে দীঘির মাঝে। কেঁদে দেয় সে। আবদ্ধকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে বলে,
— “আমি তোমাকে একলা থাকতে দেবো না আবদ্ধ। নিঃস্ব হওয়ার আগেই নিজের মাঝে জড়িয়ে নেবো। অথবা নিয়ে নিয়েছি..! তুমি শুধু আমার আবদ্ধ। শুধুই আমার।”

সঙ্গে সঙ্গে একরাশ শান্তি বয়ে গেলো আবদ্ধর সর্বাঙ্গে। তার চেয়েও বেশি খুশি হলো দীঘির তাকে ‘তুমি’ বলায়। আজ প্রথম আবদ্ধকে তুমি বলেছে দীঘি। আনন্দ আনন্দ লাগছে আবদ্ধর। প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো আবদ্ধ।

______________

রাত বাজে ১টা। মিস্টার রায়হান আহমেদ রেয়ান এখনো রুমে আসেন নি। তার অপেক্ষায় বিছানায় ঘোমটা এঁটে বসে আছি আমি। অস্বস্তিতে ভুগছি। উনি কি আসবেন না? ভাবনার মাঝেই এসে পড়লেন রেয়ান। রুমে ঢুকেই তড়িৎ গতিতে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দরজার ওপাশ থেকে ইয়াসিন আর সবুজ ভাইয়ার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। দরজায় জোড়ে আঘাত করতে করতে ইয়াসিন ভাইয়া চেঁচিয়ে বলছেন,
— “এটা ঠিক করলে না আব্রাহাম ভাই। আমাদের দাবী না মেনে ভেতরে ঢোকা মোটেও ঠিক হয় নি তোমার। তোমার ব্যাংক থেকে আমাদের টাকা দিতেই হবে।”

রেয়ান উঁচু গলায় জবাব দিলেন,
— “ব্যাংক থেকে চেয়ে নেয়। মানা করেছে কে?”
সবুজ ভাইয়া বললেন,
— “তার জন্য ক্রেডিট কার্ড, পাসয়ার্ড তো দেয়।”

রেয়ান জবাব দিলেন না। আস্তে আস্তে উনাদের গলার স্বরও কমে এলো। তবে যাওয়ার আগে ইয়াসিন ভাইয়া আবারো চেঁচিয়ে বললেন,
— “এ বিষয়ে কিন্তু মিছিল হবে, মিছিল। বাসর রাত নিয়ে এ প্রথম মিছিল করবো আমি। প্রখর মিছিল! ইতিহাসে সোনালী অক্ষর দিয়ে নাম লেখা হবে আমার।”

কিন্তু আমরা কেউই তার কথায় বিন্দু মাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেছি বলে মনে হয় না। বরং তুচ্ছ ভাবে ডাস্টবিনের সবচেয়ে নিচের স্তরে ছুঁড়ে মেরেছি।

অদ্ভুদ চিন্তা ভাবনার মাঝেই রেয়ান এগিয়ে এলেন আমার দিকে। পাশে বসলেন। ঘোমটা-টা তুলতেই প্রথমে ভ্রু কুঁচকালেন উনি। গম্ভীর গলায় বললেন,
— “আটা-ময়দা লাগিয়ে তো পেত্নী সুন্দরী হয়ে গেছো মিসেস। যাও, ফ্রেশ হয়ে আসো।”

আমি মাথা নাড়ালাম। তারপর চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। লাল রঙের একটা শাড়ি পড়ে বেড়িয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। ইতোমধ্যে উনি ভারী পাঞ্চাবীটা পাল্টে একটা নরম ধূসর রঙের পাঞ্চাবী পড়েছেন। আমি তার সামনে এসে দাঁড়াতেই আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একবার পা থেকে মাথা অব্দী দেখলেন উনি। তারপর বললেন,
— “রুমের লাইট অফ, চাঁদের আলো রুমে ছড়িয়ে যাচ্ছে, তুমি লাল রঙের শাড়ি পড়ে আছো, এখন আর কিসের অভাব জানো?”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি মুচকি হেসে বলে উঠলেন,
— “একটা মোমবাতির অভাব। তোমার হাতে মোমবাতি ধরিয়ে দিলেই সম্পূর্ণ রুপে পেত্নী হয়ে যাবে তুমি।”

ভড়কে গেলাম। রাগে শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল আমার। উনি শব্দ করে হাসছেন। অন্য সময় হলে, হয়তো তার এই হাসিটা অনেক মধুর মনে হতো আমার। কিন্তু এই মুহুর্তে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। গা জ্বলে যাচ্ছে হাসিটা দেখে। রেয়ান হাসি থামালেন। আমার দিকে ঝুঁকে গেলেন হঠাৎ। আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সরতে চাইলে বাহু ধরে বাঁধা দিলেন উনি। মুচকি হেসে ডান গালে চুমু দিলেন পর পর দু’বার। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— “সেনি সিভিউরুম মরুভূমি।”

আমার মনে হলো আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম। রেয়ান সরে এলেন। আচমকা আমার হাত ধরে বললেন,
— “চলো। হাঁটবো।”

পাল্টা প্রশ্ন করলাম না। নির্বাক ভাবে তার সঙ্গে চলে এলাম একটা নির্জন, নিরিবিলি সরু রাস্তার ধারে। যার একপাশে আছে নদী, আর অন্য পাশে গাছগাছালি। উনি হেঁটে চলছেন আমার হাত ধরে। তার হাতের বাঁধনে আবদ্ধ আমার হাত। পাশাপাশি হাঁটতে থাকা আমাদের মনে অনুভূতিগুলো আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্যে। ভালোবাসা তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মাঝে। এটাই তো পথ চলা! এটাই তো শুরু!
হঠাৎ রেয়ান গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন,

সোনারও পালঙ্কের ঘরে,
লিখে রেখে ছিলেম দ্বারে
যাও পাখি বলো তারে,
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেক, ভালো থেক
মনে রেখ এ আমারে ।

বুকের ভেতর নোনা ব্যাথা
চোখে আমার ঝরে কথা
এপার ওপার তোলপার একা
মেঘের ওপর আকাশ ওড়ে
নদীর ওপার পাখির বাসা
মনে বন্ধু বড়ো আশা ।

যাও পাখি যারে উড়ে
তারে কয়ো আমার হয়ে
চোখ জ্বলে যায় দেখব তারে
মন চলে যায় অদূর দূরে

যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেক, ভালো থেক
মনে রেখ এ আমারে …

____________

সমাপ্ত।
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here