#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ১৬
.
সরু রাস্তার প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ প্রায় আমরা। চারপাশের সবুজ গাছগাছালিগুলো যেন এদেশের এক একটা রত্ন। এই রত্নগুলো দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছে গেলাম রিসোর্টে। সেখানে মোট পাঁচটা রুম নেওয়া হয়েছে আমাদের। রেয়ান, ইয়াসিন ভাইয়া, সবুজ ভাইয়া এক রুমে। আবদ্ধ আর দীঘি এক রুমে। আমি, মেহেরুন, শ্রেয়া আর হিমানী এক রুমে। চাচ্চু, ফুফা, আব্বু, মাংখাই আর তার বন্ধুবান্ধব এবং চাচী, ফুফিরা সব আলাদা দুটো রুমে। এখানে এসেই প্রথমে দুই-তিন ঘন্টার মতো রেস্ট নেই আমরা। পরে সবাই রেডি হয়ে রওনা হলাম কাপ্তাই লেকের উদ্দেশ্যে। রিসোর্ট থেকে কিছু দূরই এই কাপ্তাই লেক। আঁকাবাঁকা প্রশস্ত লম্বা হৃদ এটি। একপাশে বড়, ছোট নৌকা ও বোর্ড রাখা। সবাই ওখান থেকেই একটা বোর্ড ভাড়া করে উঠলাম। হৃদটির পানিগুলো অনেকটা সবুজ সবুজ। দুই’পাশ উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঢাকা আর তার মাঝখানে এই হৃদ। অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। চোখ ধাধানো সুন্দর যাকে বলে। আমি আশপাশটা মুগ্ধ নয়নে দেখছি। তখনই পাশ থেকে কেউ কেশে উঠল। তাকিয়ে দেখি রেয়ান দাঁড়িয়ে। তাকে নিজের পাশে দেখে বিন্দু মাত্র খারাপ লাগলো না আমার। বরং উত্তেজনায় মুখের হাসি প্রশস্ত করে বললাম,
— “জায়গাটা অনেক সুন্দর তাই না?”
উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
— “হুম অনেক সুন্দর!”
আমি আবারও বললাম,
— “গাড়িতে শুনেছি আপনি নাকি এখানে আগেও একবার এসেছিলেন। আচ্ছা, আমাদেরকে এখন কোথায় নিয়ে যাবে?”
— “একটা ঝর্ণার কাছে যাবো।”
— “সত্যি? নাম কি ঝর্ণার?”
উনি সরু দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে বললেন,
— “বলতে ইচ্ছে করছে না।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে। এ মানুষটা সব কিছুতেই একটু বেশি বেশি৷ সোজা উত্তর কখনোই দিবেন না উনি। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে উনার কথায় বিশেষ রাগ হলো না আমার। জায়গাটার মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে সব কিছুই ভালো লাগছে আমার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বললাম উনাকে,
— “পাহারগুলো অন্যসব পাহাড় থেকে একটু ছোট তাই না? তবে সুন্দর। এক একটা পাহাড় মাটি আর পাথরের মিশ্রণে তৈরি, সাথে সবুজ সবুজ ছোট ছোট গাছ লেগে আছে। সুন্দর লাগছে! তবে আমার ইচ্ছে ছিল বড় বড় পাহাড়ে ওঠার। উফফ! যদি উঠতে পারতাম!”
— “মানা করেছে কে? এভারেস্ট জয় করতে যাও। দেখাও হয়ে যাবে, উপরে উঠতেও পারবে। আর বাই চান্স যদি এভারেস্ট জয় করে ফেলো তাহলে দেশের নামও উজ্জ্বল করতে পারবে।”
তার নির্বিবাক কণ্ঠ! মানে আমাকে জ্বালাতে উনার প্রচুর ভালো লাগে। একদম প্রচুর থেকেও প্রচুর! উনার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
— “আমি এদেশের পাহাড়গুলোর কথা বলেছি। ওইযে, যেখানে মেঘ ধরা যায়। আচ্ছা, ওখানে কি যাবো আমরা?”
— “হয়তো না। আর যদি যেতে চাও তাহলে তোমার সাজেক যেতে হবে।”
আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— “আপনি গিয়েছেন কখনো ওখানে? মেঘ ধরেছেন?”
— “হুম।”
— “আচ্ছা, মেঘ ধরতে কেমন?”
— “বাষ্প! ছুঁলেই পানি হয়ে হয়ে যাবে।”
আমি আরো কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই উনি বলে উঠলেন,
— “আর একটা ওয়ার্ডও না। তুমি বেশি বকবক করো পিচ্চি।”
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
— “আমি পিচ্চি?”
— “অবশ্যই তুমি পিচ্চি। তবে সবার ক্ষেত্রে না। বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ পিচ্চি।”
তার কথা বুঝলাম না আমি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিয়ে তাকাতেই উনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন। সুদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
— “স্টপ মরুভূমি। এভাবে তাকাবে না।”
আমিও চোখ ফিরিয়ে নিলাম সাথে সাথে। লজ্জাও পেলাম অনেকটা। নিজের লজ্জা দেখে নিজেই হেসে দিলাম। তখনই কানে নেশাভরা কণ্ঠ ভেসে উঠল,
— “তোমার হাসি সুন্দর। ভালো লাগছে দেখতে।”
পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি রেয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে৷ তার বিড়াল চোখি চোখ জোড়ায় আজ যেন অন্য কিছু খেলা করছে। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। লজ্জায় পুরো মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে আমার। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। উনিও চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আর আমি! নৌকার একটু ঢোলে পড়া, পানির বুকে তরতর করে ভেসে চলার দৃশ্যটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সবকিছু আরো ভালো ভাবে দেখার জন্য একটু সামনে এগোতেই মনে হলো কিছুর সাথে হোচট খেয়ে এখনই পরে যাবো আমি। তবে না, পরে যাওয়ার আগেই ধরে ফেললেন সে। তীব্র ধমকে বলে উঠলেন,
— “কেয়ারলেস! ফেলে দেই তোমায় লেকে? দিবো?”
আমি চুপসে গেলাম। একটা শব্দও বের হলো না মুখ থেকে। মাথা নিচু করে রইলাম মাত্র। উনি আরো কিছু বলতে গিয়েও আর বললেন না। চোখ মুখ শক্ত করে ফিরে রইলেন অন্যপাশে। তবে হাত ছাড়লেন না। আমি বার কয়েকবার ছাড়াতে চাইলেও পারলাম না। উনি শক্ত করে ধরে আছেন হাত। বাধ্য হয়ে মুখ গোমরা করে আশপাশে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এমন পরিবেশে কি মন খারাপ করে থাকা যায়? মোটেও না। আমিও থাকতে পারলাম না। মুখে হাসি ফুটে উঠল নিমিষেই। আর উনি! আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। একাধারে, একদৃষ্টিতে কিছু একটা দেখতেই রইলেন। যেন এই প্রকৃতি থেকেও ঐ কাঙ্কিত জিনিসটি তার কাছে বেশি মনোমুগ্ধকর!
________________
নৌকার এক পাশে বসে আছে আবদ্ধ আর দীঘি। দীঘির চোখ মুখে এক ধরণের উজ্জ্বলতা। আবদ্ধের বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে ধীর কণ্ঠে বলল সে,
— “একটা কথা বলি?”
আবদ্ধ জবাব দিলো না। দীঘি আবারও বলল,
— “বলি?”
— “না!”
আবদ্ধর সোজা জবাব। যা মোটেও ভালো লাগলো না দীঘির। ভ্রু কুঁচকে আবদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “বলি না প্লীজ!”
— “এতক্ষণ ধরে তো শত কথা বলে ফেলেছো। আমি না বলা সত্ত্বেও! তাহলে এটার জন্য পারমিশন নিচ্ছো কেন?”
আবদ্ধের কথায় পাত্তা দিলো না দীঘি। খানিকটা লজ্জার সঙ্গে বলে উঠল,
— “আপনাকে না… আপনাকে না অনেক সুন্দর লাগছে এই নীল শার্টে। ইসস! আমার কামড়াতে ইচ্ছে করছে।”
‘খু-খু’ করে কেশে উঠল আবদ্ধ। দীঘির দিকে চোখ পাকিয়ে বলল,
— “তোমার মতো মেয়ে আমি আজ পর্যন্ত দেখি নি। এগুলো কি ধরণের কথা?”
দীঘি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। আবদ্ধের কাঁধে আরেকটু ভালোভাবে মাথা রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল,
— “সত্যি! আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। আপনার ওই বাদামী চোখগুলো দেখলে ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে। আচ্ছা, আমার মধ্যে আপনার কি পছন্দ?”
আবদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “কিছুই পছন্দ না।”
দীঘির মনটা খারাপ হয়ে গেল একটু। আর একটা কথাও বলল না সে। এটা দেখে খারাপ লাগলো আবদ্ধর। ধীর কণ্ঠে বলল,
— “তোমার ভ্রু গুলো সুন্দর।”
সাথে সাথে আবদ্ধের দিকে তাকালো দীঘি। আবদ্ধ তার দিকেই তাকিয়ে। তবে দীঘি তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। এক আলাদা আনন্দে নেচে উঠল দীঘি। আবদ্ধকে আরেকটু ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরল!
০১.
প্রায় আধা ঘন্টা – এক ঘন্টার পথ অতিক্রম করতেই কিছু দূর একটা ঝর্ণা দেখতে পাই আমরা। আশেপাশে গাছগাছালিতে ভরপুর আর তার ঠিক মাঝখানটায় অল্প একটু প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা। অনেকটা ধূসর-কালো রঙের মিশ্রণ। ফাঁকা জায়গার উপর থেকেই পানি পরছে। এটা দেখে সাথে সাথে উত্তেজিত হয়ে পাশে বসে থাকা উনাকে বললাম,
— “এটাই কি সেই ঝর্ণা?”
— “হুম। পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঝর্ণা এটা।”
আমি আরো একবার দেখে নিলাম ঝর্ণাটা। তারপর উনার দিকে তাকিয়ে অনুরোধের কণ্ঠে বললাম,
— “বলুন না, এ ঝর্ণাটার নাম কি!”
রেয়ান কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন,
— “শুভলং ঝর্ণা।”
— “এখানে কি আর কোনো ঝর্ণা নেই?”
— “আছে। এখান থেকে একটু দূরেই।”
— “তাহলে আমরা ওখানেও যাবো?”
উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
— “একটাতেই খুশি থাকো মিস! তোমার ভাগ্য ভালো যে ঝর্ণা দেখার সৌভাগ্য পেয়েছো তুমি। নাহলে এখানে মাঝে মাঝে পানি থাকে না।”
আমি আর কিছু বললাম না। উনার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালাম। অতঃপর সবার সঙ্গে নামতে লাগলাম বোর্ড থেকে। উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মাত্র।
ঝর্ণার কাছে যাওয়ার জন্য প্রথমে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়েছে আমাদের। ছোট-খাটো মাটির সিড়ি! সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ইয়াসিন ভাইয়া মেহেরুন আর সবুজ ভাইয়াকে বললেন,
— “আর কত চিপকা-চিপকি করবি? একটু তো দূরে সরে দাঁড়া। সবুজ ভাইয়া, তুমিও এই ডাইনীর মতো চিপকুস? এ মেয়ে তোমাকেও নিজের মতো করে ফেলেছে।”
মেহেরুন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আশপাশটা ভালোভাবে দেখে নিলো। না চাচ্চুরা নেই এখানে। ওরা একটু সামনে সামনে হাঁটছে। তাই এসব শোনার চান্স নেই। তবুও মেহেরুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— “লাথি খাবি ইয়াসিন। আল্লাহ্-র রস্তে চুপ থাক। প্রেমের বারোটা ক্যান বাজাচ্ছিস শুধু শুধু?”
ইয়াসিন ভাইয়া মুখ তেঁতো করে বললেন,
— “তোদের প্রেম দেইখা আমার গা জ্বলে। তোর বড় হয়েও একটা গফ কেন জুটলো না আমার কপালে? ফাঁটা কপাল! তারওপর সিঙ্গেল মানুষের সামনে এত চিপকা চিপকি? হুদাই জেলাস ফিল করাচ্ছিস কেন?”
ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে খারাপ অবস্থা আমাদের। রেয়ানও হাসছেন মৃদু ভাবে! এর মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই শুভলং ঝর্ণার একদম নিকটে। চোখ ধাধানো সুন্দর জায়গাটা দেখে এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। দুইপাশে ৪-৫ জন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকার হতো জায়গা রেখে তা শেষপ্রান্তে এসে মিলিত হয়েছে এবং মাঝখানটায় সরু পানি বহমান। প্রেসার কম হওয়ায় এবং ঝর্ণার পানি পড়া পাহাড়ের অংশটা থাক থাক ভাবে ভাঙ্গা থাকায় সহজেই ঝর্ণার পাহাড়টার ওপরে ওটা যায়। কিছু কিছু মানুষও উঠেছেন ওখানে। এক প্রকার গোসলই করছেন ওরা। তবে মানুষ তেমন নেই। যারা যারা আছেন তারা সংখ্যায় খুবই কম। বলা যায়, আমরাসহ ১৯-২০ মানুষ হবেন। তবুও এদের সামনে গোসল করা বা পানিতে ভেঁজা যা-ই বলি, তা সম্ভব না আমাদের পক্ষে। তাছাড়া আলাদা জামাও আনি নি আমরা। তা নাহলে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত! এক প্রকার হতাশা কাজ করলো আমাদের মাঝে। তবে আনন্দটা মাটি হতে দিলাম না। সবাই হালকা ভেঁজা, হালকা শুকনো জায়গায়ই পা ভিঁজিয়ে বসে পরলাম। আপাতত এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাবো আমরা।
এদিকে ইয়াসিন ভাইয়াকে আমাদের সমস্যার কথা বলেও কিছু হয় নি। সে ঝর্ণার পানিতে ভিঁজবেই। আমরাও আর মানা করি নি। সে নিজেরটা নিজে ভালো বুঝবেন। ঠান্ডার মাঝে গোসল করছেন তাও আবার আলাদা কাপড় নেই সাথে। এমতাবস্থায় পরবর্তীতে কি হবে তা জেনেও না জানার ভান করলে তো আমাদের কিছু করার নেই। তাই সে তার মতো আর আমরা আমাদের মতো রইলাম। খানিকবাদ পর দেখলাম হিমানী আর শ্রেয়া রেয়ানের কাছে গিয়ে কি যেন বলছে হেসে হেসে। মুডি কিংও ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে উত্তর দিচ্ছেন। আমি বুঝি না উনার ওদের সামনেই যত্তসব হাসি আসে কেন? আমার সামনে তো এত আদুরী ভাবে হাসেন না। কেন হাসেন না? পরপরই এসব চিন্তা বাদ দেওয়ার সিধান্ত নিলাম আমি। ঝর্ণা দেখায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারছি না কেন যেন। বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছি উনার দিকে। তবে কিছুক্ষণ পর আর তাকাতে ইচ্ছে করলো না। কি আছে ওখানে? দুইটা বেহায়া মেয়ে আর একটা অসভ্য ছেলে ছাড়া কিচ্ছু না। কিছুই না!
চোখ ফিরিয়ে ঝর্ণার দিকে তাকালাম। ইয়াসিন ভাইয়া পাহাড়ে যতটুকু ওঠা সম্ভব ততটুকু উঠে মনের সুখে ঝর্ণার পানিতে ভিঁজছেন। তার আরেকটু ওপাশে তাকাতেই দেখলাম দীঘি আবদ্ধকে টেনে ঝর্ণার কাছে নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরপরই পানির ছিটে দিচ্ছে আবদ্ধের মুখে। যাতে বেজায় বিরক্ত আবদ্ধ। বারবার চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে সে। তবে এতে বিশেষ খেয়াল নেই দীঘির। সে তার কাজেই ব্যস্ত। একসময় আবদ্ধও তার বলিষ্ঠ হাতে একগাদা পানি নিয়ে ছুঁড়ে মারলো দীঘির মুখে। দীঘি চমকে গেল অনেকটাই। পরপরই রাগী চোখে আবদ্ধের দিকে তাকিয়ে আরো বেশি করে পানি ছিটতে লাগলো আবদ্ধের মুখে। আবদ্ধও চুপচাপ দাঁড়িয়ে এখন। বিরক্ত হলেও মেনে নিচ্ছে সব!
দেখতে দেখতে যাওয়ার পালা হয়ে গেল। প্রথমে চাচ্চুরা সবাই বোর্ডে চলে গেলেন। আমরা আরেকটু পরে যাবো। এই ফাঁকে সবুজ ভাইয়া আর মেহেরুনও ঝর্ণার পানিতে নিজেদের কিছু স্মৃতি এঁটে নিলেন। শেষে সবাই যখন বোর্ডের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল ইয়াসিন ভাইয়া তখন কাঁপতে কাঁপতে যাচ্ছিলেন সবার সঙ্গে। পানিতে হওয়ায় এতক্ষণ শীত টের পান নি উনি। পানির স্পর্শ থেকে সরতেই দমকা হাওয়া এখন ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে, বিধায় সে ঠান্ডার মাত্রাধিকতা বুঝতে পারছে বেশভাবে। তাকে দেখে সবাই হাসছি আমরা। আমারও ইচ্ছে ছিল ঝর্ণার পানি ধরার। তবে ইচ্ছে পূরণ করতে কেন যেন ইচ্ছে হয় নি আর। সবার শেষে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ হতেই হাতে টান অনুভব হলো আমার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন ঝর্ণার দিকে। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি রেয়ান নিয়ে যাচ্ছেন আমায়। বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। মৃদু চেঁচিয়ে বললাম,
— “ওখানে কেন যাচ্ছেন? সবাই চলে গেছে তো। আমাদেরও চলে যেতে হবে।”
উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— “সার্ট আপ! চেঁচাচ্ছো কেন? পাবলিক থেকে মার খাওয়াতে চাইছো নাকি আমাকে? ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি মার খাই না মার দেই। সো এসব চেঁচিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া একটু দেড়ি হলে কিছু হবে না।”
বলতে বলতেই উনি ঝর্ণার পানির একদম কাছে চলে এলেন। আমার এক হাত নিজের দিকে টেনে নিজের এক হাত আমার হাতের নিচে রাখলেন। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছি উনার কান্ড। পরক্ষণেই দুজনের হাত একসঙ্গে ঝর্ণার পানিতে ছোঁয়াতেই কেঁপে কেঁপে উঠলাম আমি। উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমাদের হাতের দিকে। আমার মনে হচ্ছে এক অদ্ভুদ কিছু ঘটে যাচ্ছে এখন। তবে মন বলছে এ অদ্ভুদ কিছুটা যেন থেমে যাক! অথবা সারা জীবনই এমন অদ্ভুদ কিছু ঘটতে থাকুক আমার জীবনে। এই অদ্ভুদ কিছুর জন্য আমি সদা প্রস্তুত। সদা!
_________________
শুভলং ঝর্ণার একটু দূরে রয়েছে শুভলং বাজার। রেয়ান, আবদ্ধ আর সবুজ ভাইয়া সেখানে গিয়েছেন আমাদের জন্য খাবার পেক করে আনতে। ইয়াসিন ভাইয়া যেতে চেয়েছিলেন উনাদের সাথে তবে নিজের শীতে কাঁপাকাঁপির জন্য যেতে পারেন নি। পুরো ভিঁজে যাওয়া শরীরটা একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছেন উনি। পরনে শুধু একটা লুঙ্গী। মাঝি ভাই থেকে বহু কষ্টে লুঙ্গী জোগার করে নিজের জামা কাপড় মেলে দিয়েছেন বোর্ডের ছাদে। রোদের অল্প তাপে যদি এটা শুকিয়ে যায়। তার এহেন অবস্থা দেখে আমাদের খারাপ লাগা থেকে হাসি পাচ্ছে প্রচুর। লুঙ্গীর সাথে কম্বল একটা বিরাট কম্বিনেসন। জোকার থেকেও কম লাগছে না তাকে। চাচ্চুরা সহ সবাই মুচকি মুচকি হাসছি আমরা। ইয়াসিন ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন মাত্র।
রেয়ান, আবদ্ধ আর সবুজ ভাইয়া খাবার আনতেই বোর্ড আবারও চলতে শুরু করল। আপাতত ইয়াসিন ভাইয়ার অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় সবাই ফিরে যাচ্ছি আমরা। যাওয়ার পথে বোর্ডেই খাবার শেষ করবো সবাই!
_______________
চলবে…
(কাপ্তাই সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না আমার। গুগল, ইউটিউব থেকে দেখে দেখে বিশ্লেষণ করেছি সব। ভুল থাকলে অবশ্যই জানাবেন। ধন্যবাদ…)