দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ২০

0
614

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -২০

ফ্ল্যাশব্যাক_________

গোধূলি কাঁদতে কাঁদতে ছাদ থেকে চলে আসার পর সোজা গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।ওয়াশরুমে শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে ধপ করে নিচে বসে পড়ে গোধূলি।শাওয়ারের পানি যত গড়াচ্ছে গোধূলির কান্নার পরিমাণও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।কতক্ষণ ওইভাবে শাওয়ারের পানিতে ভিজেছে তা বলা মুশকিল।হাটুর ভাঁজে মুখ গুজে কান্না করছিল গোধূলি।দীপ্তের এমন রিয়েক্ট করার কারণ ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।সাধারণ একটা কারণে দীপ্ত ওর গায়ে হাত অবধি তুলেছে!

গোধূলি এক সময় লক্ষ্য করে ওয়াশরুমের ফ্লোরটায় রক্তমিশ্রিত পানি গড়াচ্ছে।পরক্ষণেই মনে পড়ে ওর কপালে আঘাত পাওয়ার কথা।কোথায় কেঁটেছে দেখার জন্য ওয়াশরুমের আয়নাটায় তাকাতেই মাথাটা হালকা চক্কর দিয়ে উঠে।কপালটা অনেকটাই কেটে গেছে।গোধূলির শরীরটা ক্রমশই দূর্বল হয়ে আসছিল।আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।ধপ করে নিচে পড়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই জ্ঞান হারায় গোধূলি।অবশ্য জ্ঞান হারানোর আরেকটা কারণও থাকতে পারে।হয়তো এই রাতের বেলায় অতিরিক্ত ভেজার কারনে শরীর মাত্রাতিরিক্তভাবে ঠান্ডা হয়ে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়।ফলে গোধূলি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

আদিবার ঘর থেকে গোধূলি চলে আসায় সবাই মনমরা হয়ে বসে ছিল।পরে কারেন্ট চলে যাওয়ায় সবাই আদিবার ঘর থেকে চলে এসেছিল।সবাই চলে আসার পর আদিবার ফোনে রায়ানের কল আসে।আদিবা রায়ানের সাথে কথা বলা শেষ করে যখন ঘুমাতে যাবে তখন দেখতে পায় গোধূলির ফোনটা ওর রুমে রয়ে গেছে। আদিবা ওর ঘর থেকেই গোধূলিকে ডাক দেয় কিন্তু গোধূলি শুনতে পায় নি বলে আদিবাই গোধূলির ঘরে যায়।কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখে গোধূলি ওর রুমে নেই।ব্যালকনিতে চেক করে ওইখানেও নেই। তারপর ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ শুনতে পেয়ে আদিবা দরজার কাছে গিয়ে গোধূলিকে ডাক দেয়। কয়েকবার ডাকার পরেও যখন গোধূলির কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না তখন দরজায় নক করে আদিবা।দরজায় ঠকঠক শব্দ করে কয়েকটা ডাক দিলো।কিন্তু গোধূলি তো কোনো কথাই বলছে না।জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে আদিবা কিন্তু তাও গোধূলির কোনো রেসপন্সই আসছে না।

আহান দীপ্তের গাড়িটা রিপেয়ার করতে দিয়ে বাড়িতে আসতে আসতে একটু দেরি হয় যায়।বাড়িতে এসে সোজা ওর রুমের দিকে যাচ্ছিলো তখন গোধূলির রুমে আদিবার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে গিয়ে দেখে আদিবা এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে গোধূলিকে ডেকেই চলেছে।আহান আদিবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলে,গোধূলিকে এইভাবে ডাকছে কেন?আদিবা আহানকে বললো, ও অনেকক্ষণ যাবৎ গোধূলিকে ডাকছে কিন্তু গোধূলি কোনো কথাও বলছে না আর দরজাও খুলছে না।আদিবার কথা শুনে আহানও বারকয়েক ডাকে গোধূলিকে।আহানের ডাকেও গোধূলি কোনো উত্তর দেয় নি।সেটা আদিবা আহান দুজনের কাছেই অবাক লাগে।কারণ আহান গোধূলির চোখের মনি!সেই ভাইয়ের ডাকেও সাড়া দেয় নি!এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে আদিবার। আদিবা আহানকে দরজা ভাঙ্গতে বলে।আহানও তাই করে।দরজা ভাঙ্গতেই গোধূলিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে আদিবা চিৎকার করে উঠে।আহান গোধূলিকে কোলে করে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দেয়।গোধূলিকে অনেক ডাকাডাকি করে কিন্তু গোধূলি কোনো রেসপন্সই করছে না।আহান গোধূলির পালস চেক করে কিন্তু পালস পায় নি।আদিবার চিৎকারে ইহান সবার আগেই চলে আসে কারণ ও সজাগ ছিল।ইহান এক মুহূর্তও দেরি না করে এম্বুল্যান্সকে কল করে।

বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরেছিল তাই তাদের সবটা বুঝতে একটু সময় লাগে।গোধূলির রুম থেকে আদিবার গলার স্বর অস্পষ্ট শুনা গেলেও ওটা যে আদিবার আওয়াজ সেটা সবাই বুঝতে পেরে গোধূলির রুমে এসে দেখে গোধূলির সারা শরীরে রক্ত মাখা।শিখা বেগম এক চিৎকার দিয়ে ওইখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।সবাই আদিবা আহানকে জিজ্ঞাস করছে গোধূলির কি হয়েছে?কিন্তু ওরাও তো জানে গোধূলির কি হয়েছে!কাউকে আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে এম্বুল্যান্স এর শব্দ পেয়েই আহান গোধূলিকে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

বর্তমান_______

– সাজি!তোর কি মনে করতে খুব কষ্ট হচ্ছে মা?

দীপ্ত নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে গোধূলির দিকে।শিখা বেগমের প্রশ্নে শব্দহীন তাচ্ছিল্যের হাসিও দিয়েছে বারকয়েক।দুচোখ ভরে দেখে নিচ্ছে গোধূলিকে।হয়তো আজই গোধূলির জীবনে ওর শেষ দিন হতে চলেছে!হয়তো এই দেখাই ওর শেষ দেখা হতে চলেছে!কোনো মা বাবাই তাঁদের মেয়ের জীবনে বা তাঁদের পরিবারে কোনো ঘাতকের অস্তিত্ব রাখতে চাইবে না!তাদের মেয়ের যে এই অবস্থা করেছে,তাদের মেয়েকে হয়তো সেই নির্দয় নিষ্ঠুরতম মানুষের ছাঁয়াও মারাতে দেবে না কোনোদিন।

কথাগুলো ভাবতেই দীপ্তের নয়নযুগল অশ্রু জলে ভরে উঠে!চোখের পাতা নড়লেই সেই জল চোখ বেঁয়ে নিচে গড়িয়ে পড়বে!যথাসম্ভব নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে দীপ্ত। মায়ের কথায় ভাবনার সুতো ছিড়ে গোধূলির।নিজেকে সামলে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুটস্বরে বলে,

– পড়ে গিয়েছিলাম!আম্মু আমি পা স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিলাম।ওয়াশরুমে হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে পড়ে যাই!তারপর কি হয়েছে আমার কিছু মনে নেই আম্মু।

গোধূলির কথা শুনে মাথা তুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় দীপ্ত!অবাধ্য চোখের জল সব বারণ অমান্য করে নিজের কার্য সম্পূর্ণ করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে!কেউ দেখে ফেলার আগেই বৃদ্ধা আঙ্গুলের সাহায্যে সেই জল মুছে নেয় দীপ্ত।সাজ্জাদ সাহেবের কাছে গোধূলির উত্তরটা একটুও যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না।তিনি ভাবছেন, ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে তা কোমড়,হাত-পা বা মাথায় লাগার কথা তাহলে গোধূলি কপালে আঘাত পেলে কি করে?আর ডাক্তার বললো ওর কপালে পেরেকের মাধ্যমে ক্ষত হয়েছে।তাহলে এখন ও কি বলছে এইসব?

পরক্ষণেই নিজের সন্দেহকে উড়িয়ে দিয়ে মেয়ের কথাই বিশ্বাস করলেন সাজ্জাদ সাহেব।কারণ গোধূলি কখনো মিথ্যা কথা বলে না।গোধূলিকে তো ওয়াশরুমেই পাওয়া গিয়েছিল।আর দরজাটা ভেতর থেকেই লক ছিল।তাই বিশ্বাস না করার কোনো উপায় নেই।কিন্তু তাও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।তাহলে বাথরুমে পেরেক আসলো কোথা থেকে?যাইহোক মেয়ে সুস্থ আছে এতেই আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।সাজ্জাদ সাহেব এগিয়ে গিয়ে মেয়ের কপালে চুমো দিয়ে মেয়েকে সাহস দেওয়ার জন্য জোর গলায় বলে উঠেন,

– আমার সাজি মা অনেক সাহসী!তাইনা সাজি মা?কিচ্ছু হয় নি তোর। আমরা আজকেই বাড়ি ফিরে যাব। তোকে এখানে রাখার মতো অসুস্থ তুই হোস নি মা।যারা ভীতু দূর্বল তারা হসপিটালে থাকে!তুই কোনো চিন্তা করিস না।আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।ডাক্তার বলেছে তোকে আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো।ডাক্তার বললো তোর দেখাশোনোর জন্য উনারা একজন নার্স পাঠিয়ে দেবে।

– আব্বু তুমি সত্যি বলছো?

বাবার কথা শুনে খুশিতে গোধূলির চোখ চকচক করে উঠে।সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দেন যে, তিনি সত্যি বলছেন।

– দীপ্ত তুই এবার বাসায় যা।কাল থেকে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছিস বাবা।সকাল থেকে সবাই কত করে বলল বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আসতে।কারো কথায় তো শুনলি না।সকাল থেকে কিছু খাসও নি।আহান তুই ওকে নিয়ে বাসায় যা।আমরা একটু পরেই বাসায় চলে আসবো।

সাজ্জাদ সাহেবের কথায় এতক্ষণে গোধূলি দীপ্তকে লক্ষ্য করে।চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে কপালের উপর লেপ্টে রয়েছে।চেহারায় মলিনতার ছাপ।শার্টের বোতলগুলোও অগুছালো ভাবে লাগানো।উনার মাথায়,হাতে ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে উনার?

গোধূলি দীপ্তকে পর্যবেক্ষণ করছিল আর মনে মনে কথাগুলো ভাবছিল!সাজ্জাদ সাহেবের কথা মতো রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে গোধূলির দিকে আরেকবার তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়।গোধূলি ক্ষানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।তাড়াতাড়ি ওর নজর অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয়। দীপ্ত ভাবছে, গোধূলি হয়তো ঘৃণায় ওর দিক থেকে চোখ সড়িয়ে নিয়েছে।সেটাই তো স্বাভাবিক!এত কিছুর পর তোকে ঘৃণা করাটাই স্বাভাবিক দীপ্ত!কথাটা ভাবতেই তাচ্ছিল্যে হেসে দেয় দীপ্ত।আর এক মুহূর্তও দেরি না করে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায় দীপ্ত।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here