#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব-৯
আচমকায় হাত ধরে কেউ টান দেওয়ায় গোধূলির অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। ভয় পেয়ে গিয়ে যেইনা চিল্লাতে যাবে ওমনি কেউ ওর মুখটা সজোড়ে চেপে ধরলো।পরমুহূর্তেই তার সুঠাম দেহের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে গোধূলির মুখটা বাঁধতে লাগলো।মুখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতেই গোধূলির হাত দুটো শক্ত করে পেছন দিকে মুঁচড়ে চেপে ধরেছে।অন্ধকারের মধ্যে গোধূলি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।তবে এটা ঠিকই বুঝতে পাচ্ছে ওর পিছনে থাকা বলিষ্ঠ হাতের অধিকারী আগন্তুক কোনো পুরুষ মানুষ!গোধূলি কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্ধকারেই ওকে যেনো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই ওই মানবের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না।
ছাদে এসে এক হাতে গোধূলির হাত মুষ্টি বদ্ধ করে অন্য হাত দিয়ে সিঁড়ির সামনের দরজাটা লাগিয়ে তবেই গোধূলির হাত ছাড়লো।হাত ছাড়া পেয়ে গোধূলি যেই না ওর মুখের বাঁধন খুলতে যাবে সেই মানবটি তড়িৎ গতিতে এসে গোধূলির হাতগুলো ঘুরিয়ে আবার পিছনে মুচড়ে ধরলো।পাশের দেওয়ালটায় ঠেসে ধরলো গোধূলিকে।আজ পূর্ণিমা!পূর্ণিমার আলোয় দীপ্তের মুখটা গোধূলির চোখে ঝলঝল করে উঠতেই আঁতকে উঠে ও।এই মুহুর্তে ছাদে কোনো লাইট না থাকলেও দীপ্তকে চেনার জন্য চাঁদের আলোটুকুই যতেষ্ট ছিল গোধূলির জন্য।গোধূলি দীপ্তের এই রকম কান্ডে রীতিমতো মতো অবাক।
একটু আগে……
ছোটরা সবাই ডিনার করার পর আদিবার ঘরে গিয়ে আড্ডা জমায়।আলোচনার শুরুতেই গোধূলির ভার্সিটির প্রথম দিন প্লাস নবীন-বরন কেমন কাটলো সেটা সবাই শুনতে চায়।গোধূলিও সকাল থেকে শুরু করে বিকাল পর্যন্ত ওর সাথে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি মুহূর্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলো।গোধূলির কথা শুনে সবাই যতটা না অবাক হলো তার থেকে সবাই হাসছেই বেশি।সবার হাসাহাসি দেখে গোধূলি হতাশার সুর টেনে বললো,
– কোথায় ভাবলাম তোমরা হয়তো আমার দুঃখের কথা শুনে হয়তো আমাকে একটু হলেও সান্ত্বনা দিবে!তা না করে সবাই এমন ভাবে হাসছো যেন আমি কোনো জোকস বলছি।ধ্যাৎ,আমি তোমাদের সাথে থাকবোই না।তোমাদের যা খুশি তাই করো গিয়ে।এমনিতেও তো ছোট বলে আমাকে কেউ পাত্তাই দেয় না!
গোধূলি বিরক্ত হয়ে আদিবার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।সবাই কত ডাকলো কিন্তু কারোর ডাকে সাড়া না দিয়ে গোধূলি চলেই এলো।রুমে যাওয়ার সময় মনে পড়লো ওর ফোনটা আদিবার ঘরে রয়ে গেছে।তাই ফোনটা আনার জন্য ঘুরে আবার যখন আদিবার ঘরের দিকে যাবে ঠিক তখনই কারেন্টটা চলে যায়।গোধূলি অন্ধকারের মধ্যেই পা টিপেটিপে এগোয় আদিবার রুমের দিকে। যখনই রুমে ঢুলতে যাবে ঠিক তখনই দীপ্ত ওকে আটকে দেয়
বর্তমান……
– তোর সাহস কি করে হলো তখন বউ সেজে সবার সামনে যাওয়ার?
গোধূলির মুখ বাঁধা অবস্থাতেই দীপ্ত ওর গাল চেপে ধরে রুদ্ধ গলায় কথাটা বলে।
দীপ্তের এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি গোধূলি বুঝতে পারছে না।একে তো ওর মুখটা বেঁধে রেখেছে তার উপর মুখটা চেপেও ধরেছে?অন্য হাতে তো ওর হাত গুলো গুড়িয়েই দিচ্ছে।দীপ্তের প্রশ্নটা গোধূলির বোধগম্য হলো না বউ সেজে সবার সামনে গিয়েছে বলে কি হয়েছে?আর এতে ওরই বা এত রিয়েক্ট করার কি আছে?দীপ্তের সজোরে চেপে রাখা গোধূলির গালের ব্যাথাটা তীব্র হতেই গোধূলি দীপ্তের হাত সড়ানোর জন্য মুখে উম উম শব্দ করছে।দীপ্তকে ওর মুখের বাঁধনটা খুলতে বলছে।এক টানে মুখের রুমালটা খুলে গোধূলিকে ছেড়ে দিয়ে একটু সড়ে দাঁড়ায় দীপ্ত।গোধূলি বুকে হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে।সকালে দীপ্তের ব্যবহারে এমনিতেই গোধূলির মন মেজাজ খারাপ তারউপর এখন দীপ্তের এমন উদ্ভট আচারণ।গোধূলির কাছে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে দীপ্তকে।দেখে মনে হচ্ছে ওকে যেনো এই মুহুর্তেই আস্তো গিলে ফেলবে।গোধূলিকে এইসব পরিস্থিতিতে পড়তে হয় নি।ওর কেমন যেনো অস্বস্তি হচ্ছে।তবে মনের কোণে কয়েকটি প্রশ্ন বার বার উঁকি দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এই মুহূর্তে দীপ্তকে দেখে মনে হচ্ছে না ও কোনো স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে।তাই গোধূলি কোনো রকম বাক্য ছাড়াই ছাদ থেকে চলে আসতে নিলেই দীপ্ত ওকে এক হেচকা টানে দেয়ালের সাথে দুই হাত দিয়ে আটকে ধরে।চোয়াল শক্ত করে কড়া গলায় বললো,
– আমার কথার উত্তর না দিয়ে তুই চলে যাচ্ছিস?তোর সাহস তো দেখছি বেশি বেড়ে গেছে।
গোধূলি দীপ্তের এইরূপ ব্যবহারে বার বার অবাকই হচ্ছে।সাধারণ একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীপ্তের এই রকম আচার-আচরণের মানেই গোধূলি বুঝতে পারছে না।দীপ্তের ব্যবহারে মনে হচ্ছে ও কোনো বড় ধরনের অন্যায় করে ফেলেছে।গোধূলির নিস্তব্ধতা দীপ্তের রাগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যতেষ্ট ছিল।দীপ্ত ফের ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
– কি হলো আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
ঘোর কাটে গোধূলির।দেওয়ালের সাথে শক্ত করে হাত ধরে রাখায় গোধূলি ওর হাতে খুব ব্যাথা পাচ্ছে।ফলে ধীর কন্ঠে বললো,
– আমার হাতে লাগছে!হাতটা ছাড়ুন!
দীপ্ত কঠোর গলায় বললো,
– লাগুক!আমার যখন লাগে!তখন তো আমি কাউকে বলতে পারি না!
গোধূলি দীপ্তের কথায় বিস্মিত হয়ে বললো,
– মানে?
দীপ্ত চোখ রাঙিয়ে বলে,
– আমাকে প্রশ্ন করার জন্য তোকে এখানে নিয়ে আসি নি!আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পেলাম না!
গোধূলি আশ্চর্য হয়ে বললো,
– কি বলবো?
– বাহ বাহ বাহ!
গোধূলিকে ছেড়ে দিয়ে হাতে তালি দিয়ে বললো দীপ্ত।পরমুহূর্তেই আবার গোধূলির বাহুদ্বয় খুব শক্ত করে চেপে বেশ রাগী কন্ঠে বলল,
– তারমানে তুই শুনতেই পাস নি আমি কি বললাম?
দীপ্ত গোধূলিকে পুনরায় ছেড়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
– আচ্ছা যা আবার বলছি।আদিবা আপুর জায়গায় তুই কেন বউ গিয়েছিলি?
কয়েক সেকেন্ড কেটে গেছে গোধূলির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দীপ্ত এবার ধমকে বলল,
– কি হলো এখনো শুনতে পাস নি আমি কি বললাম?
আঁতকে উঠে গোধূলি।নিজেকে সামলে মুচকি হেসে নরম গলায় বললো,
– তখন তো আমি একটু মজা করেছিলাম।
– ওহ্ আচ্ছা!তাহলে তোর যদি মন চায় মানুষের জীবন নিয়েও মজা করবি?
দাঁতে দাঁত চেপে বললো দীপ্ত।দীপ্তের কথা শুনে কপাল কুঁচকে আসে গোধূলির।সামান্য একটু মজা করার সাথে মানুষের জীবনের কি সম্পর্ক?গোধূলি মাথায় কিছু ধরছে না।দীপ্ত এই সব কি বলছে?গোধূলি অবাক হয়ে বললো,
– আরে এতে এত ওভার রিয়েক্ট করার কি আছে?আমি তো জাস্ট একটু দুষ্টুমিই করেছি।আফটার অল, রায়ান ভাইয়া আমার দুলাভাই হয়।রায়া…….
গোধূলি ওর কথাটা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই দীপ্ত আবার ওর মুখ চেপে ধরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
– একটু দুষ্টুমি করেছিস?
এইবার গোধূলির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।দীপ্ত ওকে রীতিমতো টর্চার করছে।যখন তখন হাত মুচড়ে ধরছে,মুখ চেপে ধরছে।এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?আজব।অসহ্য লাগছে গোধূলির।ওর কি ব্যাথা লাগে না।সিম্পল একটা বিষয়কে এতবড় করে দেখার কি আছে গোধূলি তো এটাই বুঝতে পারছে না।তবে এখন দীপ্তের ব্যবহারে গোধূলির রাগ উঠে গেছে।দীপ্তের হাতটা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে শক্ত গলায় বললো,
– দরকার হলে আরো করবো!
কথাটা শেষ করতেই সজোরে চড় পরে গোধূলির গালে।তাল সামলাতে না পেরে পাশের দেওয়ালে গিয়ে বারি খায় গোধূলি।মরিচা ধরা পেরেকের একাংশ হয়তো কপালে আঘাত করে গভীর ভাবে। অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো গোধূলি।সাথে সাথে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।কপালটা থেকে গাল বেঁয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে।কিন্তু গোধূলি দীপ্তকে বুঝতে দেয় নি।তবে এইবার গোধূলির আর সহ্য হলো না।নিজের জখমের কোনো পাত্তা না দিয়ে বেশ জোরে সজোরেই চিল্লিয়ে বলল,
– কি সমস্যা কি আপনার?আমি না হয় একটু দুষ্টুমিই করেছি।তার জন্য এইভাবে আমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসে কৈফয়ত চাওয়ার মতো তো বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেলি নি আমি।যেখানে বাড়ির বড়রা আমাকে কিছুই বলে নি।সেখানে আমি আপনাকে কৈফত দিতে বাধ্য নৈই মিস্টার দীপ্ত চৌধুরী!
কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই ফের গোধূলির অন্য গালেও চড় পড়ে।চড় গুলো খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল গোধূলির কাছে।কেননা আজ পর্যন্ত একটা ফুলের টুকাও কেউ দেয় নি ওকে।সেই জায়গায় আজ দীপ্ত নিরদ্বিধায় সাধারণ একটা তুচ্ছ বিষয়ে ওর গায়ে হাত তুলছে?গালে হাত দিয়ে নিচের দিকে প্রচন্ড রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে গোধূলি।রাগে ওর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।গোধূলির চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে।
গোধূলিকে চড় দেওয়ার পরমুহূর্তেই হাতে আঠালো কোনো কিছুর উপস্থিতির টের পেয়ে দীপ্ত ওর হাতের দিকে তাকায়।যদিও অন্ধকার তবু্ও চাঁদের আলোয় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এটা রক্ত!দীপ্তের হাত কাঁপছে।অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,
– রক্ত!
দীপ্ত চকিত দৃষ্টিতে গোধূলির দিকে তাকায়।গোধূলিকে গালে হাত নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বললো,
– গোধূলি তোর কি হয়েছে?দেখি কোথায় কেঁটেছে……
দীপ্ত কথাটা বলতে বলতে গোধূলির দিকে হাত বাড়াতে গেলেই গোধূলি দীপ্তের সামনে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয়।অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় দীপ্তের দিকে।গোধূলির শক্ত গলায় বলল,
– নো!ডোন্ট টাচ মি!আমাকে টাচ করার অধিকার আমি আপনাকে দেই নি মিঃ দীপ্ত চৌধুরী!আর কখনো এই ভুল করবেন না।
গোধূলির রক্তিম নেত্রযুগল দেখে দীপ্তের বুকের ভেতরতায় ধুক করে উঠে।চাঁদের আলোয় ওই নেত্রযুগলে এসে জমা হওয়া নোনাপানি চিকচিক করে উঠতেই আঁতকে উঠে দীপ্ত।অপরাধীর ন্যায় কাচুমাচু মুখ করে কিছু বলতে নিলেই হুট করে কারেন্ট চলে আসে।কারেন্ট চলে আসায় গোধূলি আর একমুহূর্তও ছাদে রইলো না।এক দৌড়ে ছাদ থেকে বেড়িয়ে চলে যায়।
চলবে…….