দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ১০

0
720

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে-স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব-১০

গোধূলি চলে যেতেই দীপ্ত রাগে ক্ষোভে অনুশোচনায় অপরাধীর ন্যায় অনবরত দেওয়ালে ঘুষি মারছে।ও তো ইচ্ছে করে গোধূলিকে আঘাত করতে চায় নি।অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও আঘাতটা তো ওই করেছে।দীপ্ত দেওয়ালে নন-স্টপ ঘুষি মেরেই যাচ্ছে।এক পর্যায়ে দীপ্তের হাত থেকে প্রচুর ব্লিডিং হতে শুরু করে।ক্লান্ত হয়ে শেষে দেয়াল ঘেষে ধপ করে নিচে বসে পড়ে।এক ধ্যানে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসে দীপ্ত।ওর এই হাতে দুটি মানুষের রক্ত তো একি!তাতে কোনো ফারাক নেই।তাহলে ওর কেন গোধূলির রক্ত দেখে মনটা এতো অস্তির হয়ে গেছে?দীপ্তের নিজের হাত থেকেও তো রক্ত ঝড়ছে কই ওর তো ব্যাথা লাগে না।তাহলে গোধূলি রক্ত দেখে কেন ওর হাত কাঁপছিল?

দীপ্তের মনে হাজারো রকমের ভাবনার উতালপাতাল।নিজের করা ঘৃণ্যতম অপরাধের আগুনে ঝলসে উঠছে ওর হৃদয়।নিজের প্রাণ ভ্রমরার গায়ে আজ ও হাত তুলছে।শারীরিক আঘাতের চেয়ে ওর মনের আঘাততাই দিয়েছে গভীরভাবে।সুস্থ, চঞ্চল, হাসোজ্জল মেয়েটাকে নিমিষেই রূপান্তরিত করেছে ঘন কালো মেঘের ন্যায়!হাটুর ভাঁজে মাথা রেখে অতীতে ডুব দিলো দীপ্ত!

ফ্ল্যাশব্যাক _______

– আব্বু ট্রাফিক-জ্যাম কখন ছাড়বে?সেই কখন থেকে বসে আছি।ধ্যাৎ!

বিরক্ত হয়ে কথাটা বলে দীপ্ত।দীপ্ত গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে দেখলো জ্যাম ছাড়ছে কিনা।দেখা শেষ হলে যখন গাড়ির কাঁচটা তুলতে যাবে ঠিক তখনই কারো খিলখিল করে হাসার আওয়াজ ওর কর্ণকুহরে তীরের বেগে এসে প্রবেশ করতেই চমকে উঠে দীপ্ত।

– দীপ্ত বাহিরে প্রচুর ধূলাবালি জানালার কাচঁটা তুলে দাও।

ধীর কন্ঠে জামাল চৌধুরী বললেন।দীপ্ত বাবার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়।জামাল সাহেব আবার ইশারায় বললেন।দীপ্ত ক্ষানিকটা মন খারাপ নিয়েই জালানার কাঁচটা আবার তুলে দেয়।কিন্তু কিছুতেই ওর মন মানছিল না।খিলখিল করে হাসা সেই হাসির আওয়াজ বার বার ওর মনকে অশান্ত করে তুলছিল।সেই সুহাসিনীকে এক পলক দেখার জন্য প্রবল ইচ্ছা জাগে দীপ্তের মনগহীনে।গাড়ির ভেতর দিকে বন্ধ জানালা দিয়ে বার বার উঁকি ঝুকি বাইছে।মনটা বড্ড ছটফট করছে ওর।মায়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিষ্পাপ কণ্ঠে বললো,

– আম্মু জানালাটা একটু খুলি?প্লিজ!

– না দীপ্ত!তোমার আব্বু দেখলে বকা দিবে।

– আব্বু তো সামনে বসে আছে দেখতে পাবে না!

– দীপ্ত কেন কথা শুনছো না বলো তো?শুনতে পাও নি তোমার আব্বু কি বলল?বাহিরে অনেক ধূলাবালি আছে।তোমার না ডাস্ট অ্যালার্জি আছে?

– প্লিজ আম্মু!বেশি না এক মিনিট!
প্লিজ প্লিজ প্লিজজজ!

– ঠিক আছে।তবে কিন্তু এক মিনিট এই।

– ওকে!

দীপ্ত বেশ উৎফুল্ল হয়ে আবার জানালার কাঁচটা নামিয়ে সেই সুহাসিনীকে খুঁজতে জন্য গাড়ির ভেতর থেকে মাথা বের করলো।কিন্তু যতক্ষণে দীপ্ত তাকে খুঁজতে গেল ততক্ষণে ট্রাফিক জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে।মনে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে দীপ্ত আবার জানালার কাঁচটা বন্ধ করে মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে পড়ে।মনে মনে আওড়াচ্ছে,তাহলে কি তাঁকে হারিয়ে ফেললাম?তবে আমার কেন এতোটা অস্বস্তি হচ্ছে?আচ্ছা, তার সাথে আমার কি কখনো আবার দেখা হবে?

– দীপ্ত কি এতো ভাবছিস বল তো?

দীপ্ত চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে দীপ্তি বেগম বললেন।দীপ্ত ওর মায়ের দিকে না তাকিয়েই ধীর কন্ঠে বলল,

– কিছু না আম্মু।

– তাহলে তোকে এমন অন্যমনষ্ক দেখাচ্ছে কেন?

– এমনি ভালো লাগছে না! আচ্ছা আম্মু…

দীপ্ত কিছু বলতে গিয়েও না বলেই থেমে যায়।দীপ্তি বেগম নরম গলায় বললো,

– হুম,কিছু বলবি?

– না থাক!

– কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস!

– আচ্ছা আম্মু,আমরা যদি মন থেকে কাউকে চাই তাহলে কি পাবো?

দীপ্ত বেশ উৎকন্ঠিত স্বরে বলে ফেললো কথাটা।দীপ্তি বেগম ছেলের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,

– কাউকে মানে?

হকচকিয়ে যায় দীপ্ত।কথাটা এইভাবে ও বলতে চায় নি।কৌতূহলবশত বলে ফেলেছে।দীপ্ত পর পরেই গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– না মানে ধরো, আমি যদি মন থেকে কিছু চাই তাহলে কি আমার আমি সেটা পাবো?

– হুম হতেও পারে।যদি তুমি মন থেকে সত্যি সত্যি চাও।তবে তার জন্য তোমাকে অবশ্যই অধ্যাবসায়, সাধনা, ধৈর্য্য,চেষ্টা আর পরিশ্রম করতে হবে।কেননা,কষ্ট ছাড়া জীবনে কোনো কিছুই অর্জিত হয় না।

দীপ্তি বেগম ফের বললো,

– হঠাৎ এইসব প্রশ্ন করছিস কেন?

– না এমনি।

– আচ্ছা,তুই বলতে না চাইলে আমি তোকে জোর করবো না।

দীপ্ত কথাটা বলে মুখ ভার করে বসে আছে।দীপ্ত ওর ভালো লাগা খারাপ লাগা সব কিছুই ওর মায়ের সাথে শেয়ার করে।একমুহূর্তে উনি একটু দীপ্তকে পরিক্ষা করে নিচ্ছেন।আসলেই কি দীপ্ত এমনি এমনি এই প্রশ্নটা করেছে নাকি ও কোনো কিছু নিয়ে সত্যি সত্যি চিন্তিত?দীপ্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,

– আরে আম্মু তেমন কিছু না।আসলে আমরা যখন জ্যাম এ আটকে ছিলাম তখন আমি একটা মেয়ের হাসির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম।জানো আম্মু মেয়েটার হাসিটা না খুব সুন্দর।কিন্তু মেয়েটাকে আমি দেখতে তাকে দেখার আগেই জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে।

– তা আমার ছেলে কি সেই সুহাসিনীর প্রেমে পড়ে গেলো নাকি?

দীপ্তের গাল টিপে আহ্লাদী গলায় বললো দীপ্তি বেগম।মায়ের কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় দীপ্ত।গলার স্বর উঁচু করে বললো,

– আরে না আম্মু।তুমি এই সব কি বলছো!

– হুম বুঝি বুঝি সব বুঝি!

– আম্মু, চুপ করো তো আব্বু শুনতে পাবে।

– আমি অলরেডি শুনে নিয়েছি মাই সান!

কথাটা বলে জামাল সাহেব মিটিমিটি হাসছে।দীপ্ত চমকে উঠে বাবার কথায়।লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো,

– আব্বু!

– সত্যি করে বল,প্রেমে পড়ে গেলি না তো আবার?

– আব্বু তুমিও!

দীপ্তি বেগম ছেলের লজ্জার অবসান ঘটিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে বললেন,

– আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে।এখন ওই সব বাদ দিয়ে বল তো, অনেক দিন পর তো নানুর বাড়ি যাচ্ছিস কেমন লাগছে?

– খুব ভালো লাগছে আম্মু!আই এম সো এক্সাইটেড!

– তাই?

– হুম!

– এই আদিবা দেখ তো তোর ফুপি মনে হয় চলে এসেছে।

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে রাবিয়া বেগম গলার স্বর উঁচু করে বললেন।রাবিয়া বেগম সোফায় বসে পানের বাটা থেকে পান খাচ্ছেন।আদিবা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।সত্যিই দীপ্তি আর জামাল সাহেব এসে গেছেন।আদিবা ওর ফুপা আর ফুপিকে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে।জামাল সাহেব আর দীপ্তি বেগমও এসে রাবিয়া বেগমকে জিজ্ঞাসা করেন।রাবিয়া বেগম শুধু উনাদের দেখতে পায়ে আশ্চর্য হয়ে বললেন,

– দীপ্ত কোথায়?ও আসে নি?ওর না আসার কথা?

দীপ্তি বেগম স্মিত হেসে বললো,

– এসেছে মা।

রাবিয়া বেগম ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,

– কোথায় তাহলে?

দীপ্তি বেগম মায়ের পাশে এসে বসেন।বললো,

– দীপ্ত গাড়িতে বসে আছে।তাকে নাকি এই বাড়ির কাউকে গিয়ে রিসিভ করে নিয়ে আসতে হবে।সে এতো বছর পর তার নানুর বাড়িতে আসছে একটু স্পেশাল খাতিরযত্ন তো করতেই হবে।

– কেন?তোমার ছেলে কি এই বাড়ির জামাই নাকি?

কথাটা কানে যেতেই চমকে উঠে দীপ্তি বেগম।চোখ পাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন,

– এই কে রে?

– আমি,গোধূলি!

দীপ্তি বেগম মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখেন উপরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে গোধূলি।দীপ্তি বেগম স্মিত হেসে বললো,

– আচ্ছা পাকনা বুড়ি!তা আপনি ওইখানে কি করছেন?এইদিকে আসেন।

গোধূলি দৌড়ে এসে ওর ফুপির পাশে বসে।দীপ্তি বেগম ফের বললো,

– জানো মা, দীপ্তের এমন কথায় আমিও বেশ অবাকেই হয়েছিলাম।অথচ আসার সময় বলছিল সে নাকি খুব এক্সাইটেড!আর এখানে এসে উল্টো সুর টেনে কথা বলছে।আমিও বলে এসেছি, তুই থাক তোর মুড নিয়ে আমি চললাম বাপের বাড়ি।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here