#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে-স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব-১২
– গোধূলি লগ্নে সূর্যের ছন্দপতন হয়ে যায়!এই সময়টা একান্তই গোধূলির।
আনমনেই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলে গোধূলি।পর মুহূর্তেই অচেনা পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো। চটজলদি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে দীপ্ত এসেছে।ঠিক ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলির ধারণাতেও ছিল না এই সময় দীপ্ত ছাদে আসবে।এই সময়টা যে একান্তই ওর নিজের মতো করে কাটাতে ভালোবাসে।সূর্য ডুবার এই সময়টা যে ওর বড্ড প্রিয়।
এলোমেলো চুলে সূর্যটা আড়াল করে কাউকে এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে মুখ ফসকেই কথাটা বলে ফেলেছে দীপ্ত।কিন্তু গোধূলি যখন ওর দিকে ফিরে তাকায় তখন চোখ গিয়ে আটকে যায় গোধূলির বাম গালের ঠিক মাঝখানে থাকা কুচকুচে কালো তিলটার উপর।কিছুতেই নজর ফেরাতে পারছিল না।চোখের দৃষ্টি ঘুরেফিরে বারবার ওইখানেই চলে যাচ্ছে।গোধূলি নেহাতি একটা বাচ্চা মেয়ে।দীপ্তের চাহনির মানে বা গভীরতা কোনোটাই বুঝার মতো ওর বয়স হয় নি।দীপ্তকে ওইভাবে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে গোধূলির কপাল কুঁচকে আসে।অবাক স্বরে বললো,
– এইভাবে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছো কেন?ভূত দেখলে নাকি?
– মাশাল্লাহ।
– মানে?
……
– কি হলো কথা বলছো না কেন?
…….
দীপ্ত নির্বিকারভাবে গোধূলির দিকেই তাকিয়ে আছে।বিকালের কথা মনে পড়তেই গোধূলি ভেতর থেকে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে।মুখ ভার করে থমথমে স্বরে বললো,
– এতক্ষণে বুঝি তোমার আমার কথা মনে পড়লো?বাড়িতে এসেছো তো সেই কখন!
……
– ও হ্যালো! আমি কিছু বলছি তোমায়।শুনতে পাচ্ছো না?
দীপ্তের চোখের সামনে হাত নেড়ে বললো গোধূলি।দীপ্ত তখনও চুপ।ওর যেন কোনো কথা কানেই যাচ্ছে না।নেশালো চোখে গোধূলির দিকে তাকিয়েই আছে!
– সাজিবু মেজো মা তোমায় ডাকে।
আলিফ খবর নিয়ে এসেছে।সিঁড়ির কাছ থেকে খবর খানা বলেই আলিফ চলে গেলো।আলিফের দিকে এক পলক তাকিয়ে গোধূলি ফের মাথা উচু করে দীপ্তের দিকে তাকায়।দীপ্তের ভাবমূর্তি কিছুই ও বুঝতে পারছে না।এই ছেলে এমন তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
গোধূলি নিচে নামছে না বলে আলিফ আবার আসে।গোধূলির কাছে এসে চিৎকার দিয়েই বলে,
– সাজিবু সেই কখন তোমায় বললাম যে মেজো মা ডাকছে, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাও নি?
আলিফের চিৎকারে দীপ্ত আর গোধূলি দুজনেই কেঁপে উঠে।
– হুম চল।
গোধূলি চলে যেতেই দীপ্তও ওর ধ্যান থেকে বেড়িয়ে আসে।পরমুহূর্তেই মনে পড়ে আলিফের সাজিবু বলে সম্মোধনের কথা।অস্ফুটস্বরে বললো,
– সাজিবু!মানে সাজি?ওহ শীট!তারমানে ওই হচ্ছে গোধূলি।ধ্যাৎ হাতের কাছে পেয়েও ওকে কিছু বলতে পারলাম না?
দীপ্ত ফের রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
– আমাকে লজ্জায় ফেলা না? এইবার তো চিনে নিয়েছি।তোমায় তো আমি পরে দেখে নিবো গোধূলি রানী!
_________________
ডাইনিং টেবিলের টুকটাক শব্দ ছাড়া পুরো বাড়ি জুড়ে আর কোথাও বিন্দুমাত্র টু শব্দটাও কেউ করছে না।সবাই নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সাড়ে এগারো বাজে। দীপ্ত আর আহান ছাড়া সবার খাওয়া হয়ে গেছে। জাকিয়া বেগম ওদের জন্যই টেবিলে খাবার দিচ্ছেন।নিজের কাজের ফাঁকে এক পলক তাকালেন ছোট ছেলের দিকে।সে সোফায় শুয়ে ফোন নিয়ে গেইমস খেলছে।জাকিয়া বেগম গলায় স্বর উঁচু করে বললো,
– ইহান তোর ভাইয়া আর দীপ্তকে ডেকে নিয়ে আয়। অনেক রাত হয়েছে তো ডিনার কখন করবে?সেই কখন থেকে দুটোতে মিলে কি এমন করছে যে খাওয়ার সময়টুকুও পাচ্ছে না?
– আমি কি জানি!তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাস করো গিয়ে।
ফোনের মধ্যের দৃষ্টি স্থির রেখে ইহান কথাটা বললো।ইহানের এমন চ্যাৎচ্যাৎ করে কথা বলাটা জাকিয়া বেগমের পছন্দ হলো না।জাকিয়া বেগম চোখ রাঙিয়ে শক্ত গলায় বললো,
– ইহান,আর কখনো যাতে এইভাবে মুখে মুখে কথা বলতে না শুনি।মনে থাকে যেনো!এখন যা গিয়ে ওদের ডেকে নিয়ে আয়।
ইহান আবার একটু বেশিই ইমোশনাল।মায়ের এইটুকু কড়া কথাতেই চোখে পানি এসে টলমল করছে।মুখ টিপে কাঁন্না সংবরণ করে গোমড়া মুখ করে আহান আর দীপ্তকে ডাকতে চলে গেল।
•
– দীপ্ত ভাইয়া!এই দীপ্ত ভাইয়া উঠো!আর কত ঘুমাবা?কখন থেকে ডাকছি।এই দীপ্ত ভাইয়া।
ইহান বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর দীপ্তের শরীর ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে ডাকছে।কিন্তু দীপ্তের কোনো হেলদোল নেই।ও নির্লিপ্তভাবে শুয়েই আছে।ইহান দীপ্তের শরীর ঝাকিয়ে আরো বার কয়েক ডাকার পর দীপ্ত একটু নড়েচড়ে উঠলো।আধখোলা চোখে ইহানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো,
– আহ!ইহান যা তো!বিরক্ত করিস না।এত সকালে কেউ ঘুম থেকে উঠে?আমাকে আরেকটু ঘুমাতে দে।
দীপ্তের কথায় ইহান আশ্চর্য হয়ে বললো,
– এত সকাল কোথায়?সকাল নয়টা বাজে!ততক্ষণে হয়তো দাদাজানও মর্নিং ওয়াক করে বাসায় চলে এসেছে।দাদাজান যদি জানতে পারে আজকে আমি এখনো মর্নিং ওয়াক করতে যাই নি তাহলে আজ আর আমার নিস্তার নেই!দাদাজান তো আমাকে মেরেই ফেলবে!
এবার দীপ্ত বিরক্ত হয়ে উঠে বসে বললো,
– কি বিড়বিড় করছিস তুই?
– সকালে বাড়ির সবাইকে মর্নিং ওয়াক করতে হয়!এটা দাদাজানের আদেশ!কাল রাতে তুমি আর ভাইয়া যখন ডিনার করছিলে তখন দাদাজান তোমার খুঁজ করতে এসে জানতে পারে তুমি ডিনার করতে নিচে গেছো।তখন দাদাজান তোমায় না পেয়ে আমাকে বলে গিয়েছিল সকালে যাতে তোমাকে ডেকে দেই মর্নিং ওয়াক এ যাওয়ার জন্য।এখন বাজে সকাল নয়টা। দাদাজান যদি এসে দেখে তুমি এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো তাহলে বুঝতে পারছো কি হবে?
মিনমিনে স্বরে কথাগুলো বললো ইহান।দীপ্ত চাপা স্বরে কর্কশভাবে বললো,
– কি হবে?
– লঙ্কা কান্ড!
ইহানের দিকে কপাল কুঁচকে তাকায় দীপ্ত।বিস্মিত হয়ে বললো,
– তাই?
ইহান শীতল কণ্ঠে বলে,
– হুম!তুমি জানো না একদিন ওয়াক করতে না গেলে দাদাজান ঠিক কি কি শাস্তি দিয়ে থাকে!
দীপ্ত এবার একটু চিন্তায় পড়ে যায়।যদি তাই হয় তাহলে তো শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য কিছু একটা করতেই হয়।কাল এসে যদি আজ সকালেই নানাজানের শাস্তির মুখে পড়তে হয় তাহলে মান ইজ্জতের আর কিছু বাকি থাকবে না।দীপ্ত ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো,
– আচ্ছা ইহান,এই রুমের একটা ব্যালকনি আছে রাইট?
– হুম আছে তো।কিন্তু তুমি ব্যালকনি দিয়ে কি করবে দীপ্ত ভাইয়া?
– আমার সাথে আয় তাহলেই বুঝতে পারবি!
– মানে?
– আরে আগে আয় তো তুই,পরে বলছি!
•
– কি ব্যাপার আহসান?তুমি আজকে মর্নিং ওয়াক এ যাও নি কেন?
– আ্ আসলে বা্ বা্ বাবা আমি আসলে………
আহসান সাহেব আমতা-আমতা করছে।কাচুমাচু মুখ করে নজর এদিক সেদিক ঘুরাচ্ছেন।আনোয়ার সাহেব ছেলের এইরূপ ব্যবহার দেখে বাজখাঁই গলায় বললেন,
– কি বলছো স্পষ্ট করে বলো!
– আসলে বাবা আজকে আমার পেট খারাপ ছিল!কালকে রাতে বাড়িতে ভালো মন্দ খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল।তাছাড়া বিয়ে বাড়িতেও….!
আহসান সাহেব কথা শেষ করার আগেই আনোয়ার সাহেব কপাল কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বললো,
– থাক হয়েছে আর বলতে হবে না।যা বুঝার আমি বুঝে গেছি।
এইটুকু বলেই থামেন আনোয়ার সাহেব।পরমুহূর্তেই ফের শক্ত গলায় বললো,
– আমি তা বলি কি, এই বার খাওয়া দাওয়াটা একটু কমাও!খাবার যখন হজম হয় না তাহলে এত খাওয়ার কি দরকার?আজকে মর্নিং ওয়াক এ না যাওয়ার জন্য তোমার শাস্তি হলো,তোমার সকালের নাস্তা খাওয়া বন্ধ!
– বাবা!
করুন স্বরে বললো আহসান সাহেব।আনোয়ার সাহেব সুর টেনে বলেন,
– কি?মর্নিং ওয়াক এ না যাওয়ার সময় শাস্তির কথা বুঝি মনে ছিল না?
আহসান সাহেব আর কোনো কথা বলতে পারলেন না।মুখটা একদম চুপসে গেছে।বাবার অবস্থা দেখে আহান ঠোঁট টিপে হাসছে।বাবা শাস্তি পাচ্ছে আর ছেলে দাঁড়িয়ে থেকে হাসছে!কি জামানা এলো রে!আহানের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন আহসান সাহেব।বাবার চোখ রাঙানো দেখে কোনোমতে নিজের হাসি আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে আহান।আনোয়ার সাহেব আহানকে কড়া গলায় আদেশ জারি করলেন,
– আহান তোর বাবার দিকে খেয়াল রাখবি ও যাতে কোনো খাবারে হাত না দেয়!ঠিক আছে?
– জ্বি দাদাজান!
– নানাজান!
বাসার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আনোয়ার সাহেবকে ডাক দিলো দীপ্ত।আনোয়ার সাহেব গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– এই তো দীপ্ত চলে এসেছে।
আনোয়ার সাহেব আহসান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– দেখো!দীপ্তকে দেখে কিছু শিখো!ছেলেটা সবে কালই এলো।তারউপর এতটা পথ জার্নি করে আসার পরেও সকালে ঠিকই মর্নিং ওয়াক করে চলে এসেছে!আর তুমি? এত বড় একটা দামড়া ছেলে হয়েও রুটিন মাফিক চলতে পারো না।
আনোয়ার সাহেবের শেষের কথাটা শুনে ফিক করে হেসে দেয় দীপ্ত আর আহান ইহান।বাবার এমন দুর্দিনে এই ছেলেগুলো এমন ভাবে হাসছে যেন আহসান সাহেবের শাস্তি আর দাদার বলা কড়া কথাগুলো ওদের শুনতে ভালোই লাগছে।আহসান সাহেব এবার বেশ রেগে গেছেন।ছেলেদের উদ্দেশ্যে বেশ জোরে সোড়েই গলা খাঁকারি দেন।চকিত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায় আহান আর ইহান।বাবার রক্তিম চোখ দিকে দুই ভাইয়ের মুখের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে যায়।দীপ্তও ব্যাপারটা লক্ষ্য নিজের হাসিটাও বন্ধ করে দেয়।দীপ্ত আর ইহান গিয়ে সোফায় বসলো,সাথে আনোয়ার সাহেবও।
– দাদাজান……
গোধূলি আর কিছু বলতে পারলো না।তার আগেই আহান ওর মুখ চেপে ধরেছে।গোধূলির কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– প্লিজ বনু চুপ কর!কিছু বলিস না।তোকে অনেক আইসক্রিম আর চকলেট কিনে দিবো পাক্কা!
– উম্মম উম্মম!
– ওহ্ সরি!
গোধূলির মুখ ছেড়ে দিয়ে আহান উৎকন্ঠিত স্বরে বললো।গোধূলি বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে আহানকে কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বললো,
– উফ বাবা এই ভাবে কেউ কারো মুখ চেপে ধরে?
আরেকটু হলে তো আমার প্রানটাই বেরিয়ে যাচ্ছিল বড়দাভাই!
সত্যিই আহান গোধূলির মুখটা একটু বেশি জোরেই চেপে ধরেছিল।আহারে মুখ গোমড়া করে মিনমিনে স্বরে বললো,
– সরি বনু!তুই যে ভাবে চিল্লাতে যাচ্ছিলি এ ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল?
চলবে…