#ঘায়েল
#পর্ব_২
#Saji_Afroz
.
.
.
-শুনছেন?
.
রানবী এর ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লো পুনম।
রানবী মুচকি হেসে বললো-
চিনতে পেরেছেন আমাকে?
.
রানবীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে পুনম বললো-
নাতো!
-সে কি! একটু আগেই আপনার কলেজ খুঁজতে সাহায্য করেছি আপনাকে।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে পুনম বললো-
ওহ আপনি! কিন্তু আমি তো আপনার কাছে সাহায্য চাইতে যাইনি কিংবা তেমন কোনো সাহায্যও আপনি আমাকে করেননি। তবুও ধন্যবাদ দিয়েছি আপনাকে। এখন কি চাই?
.
পুনম যে এমনভাবে কথা বলবে ভাবতে পারেনি রানবী।
এই প্রথম কোনো মেয়ে তার সাথে এমন কড়া ভাষায় কথা বলেছে। রানবীর উচিত তার থেকে দূরে থাকা কিন্তু মেয়েটির এই আচরণেই যেনো সে আরেকবার ঘায়েল হয়ে গেলো!
.
-কি হলো?
.
পুনমের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে পড়লো রানবী।
সে এসেছিলো তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। কিন্তু এটা সঠিক সময় নয় ভেবে রানবী বললো-
আসলে আপনাকে দেখে মনেহচ্ছে এখানে নতুন আপনি।
-কি করে বুঝলেন?
-নাহলে মহানগর কলেজ না চেনার কথা নয়।
-তো?
-এখানের সকলে আমাকে চিনে। কোনো প্রয়োজন হলে জানাতে পারেন। পাশের কলেজেই পড়ি আমি। অনার্স চতুর্থ বর্ষে।
.
মৃদু হেসে পুনম বললো-
পাশের কলেজের বড় ভাই হিসেবে আমাকে নিয়ে এতোটা ভাবার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
নতুন এসেই যে একটা বড় ভাই পেয়ে যাবো ভাবিনি।
.
বড় ভাই!
‘বড় ভাই’ ডাকটি শুনে রানবীর বন্ধুরা হাসিতে গড়াগড়ি খেতে থাকলেও তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
ফ্যাকাসে মুখ নিয়েই রানবী বললো-
বড় ভাই বানানোর প্রয়োজন কি। ফ্রেন্ডই বানাতে পারেন?
-এতো ফ্রেন্ড বানানোর ইচ্ছে থাকলে তো আর মহিলা কলেজে পড়তাম না, তাইনা?
-হু।
-আচ্ছ আসি।
.
পুনম এগিয়ে যাচ্ছে।
রানবী বলে উঠলো-
শুনেন?
-হু?
-আপনার নাম কি?
-পুনম।
-পুরোন? মানে পুরানো?
.
রানবীর কথা শুনে হেসে উঠলো পুনম।
রানবী খেয়াল করলো, হাসার সময় মেয়েটির গালে টোল পড়ছে।
হাসতে হাসতেই পুনম বললো-
পুরোন নয় পুনম!
.
কথাটি বলে এগিয়ে গেলো পুনম নিজের গতিতে।
এদিকে রানবীর বন্ধুরা তার পাশে আসতেই সে বলে উঠলো-
ইশ! আরো একবার ঘায়েল হলাম।
.
আকিব বললো-
প্রপোজ তো করিস নি? কেনো রে বড় ভাই বানিয়ে দিলো বলে?
-ধ্যাত! না। প্রপোজ করিনি। তবে করবো। সে আমার কাছে কতোটা স্পেশাল সেটা উপলব্ধি করতে না দিয়ে প্রপোজ করে বসা ঠিক হবেনা। তার দুটো কথা শুনে আমি বুঝেছি, অন্য মেয়েদের মতো পুনম নয়।
-সেটা তো আমরা দেখেই বুঝেছি। প্রেম পিরিত এই মেয়ে করবেনা।
-ভালো তো বাসবে।
-মানে?
-মানে বাদ দে। এখন আমি পুনম কে ফলো করবো।
.
রানবী ফলো করবে কোনো মেয়েকে!
আজ বোধহয় অবাক হতে হতেই তার বন্ধুরা স্ট্রোক করবে।
একদিনেই রানবীর এতো পরিবর্তন যেনো তারা মানতে পারছেই না।
.
.
.
রিকশা থেকে নেমে বাসায় প্রবেশ করলো পুনম।
পেছনের রিকশায় আছে রানবী।
পুনমের বাসা দেখে তার চোখে যেনো কপালে উঠে গেলো।
ওয়ারী তেই তার বাসা আর রানবী কিনা আজ দেখলো তাকে?
নাকি নতুন ভাড়াটিয়া সে?
নানারকমের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।
কিন্তু পরক্ষণেই রানবীর মনটা খুশিতে নেচে উঠলো।
ধোলাইখাল থেকে ওয়ারী অনেকটাই কাছে। রানবীর জন্য যেটা ভালোই হয়েছে।
রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে রানবী বললো-
ভাই চালাও রিকশা।
.
পকেট থেকে ফোন বের করে রানবী ডায়াল করলো আকিবের নাম্বারে।
আকিব রিসিভ করতেই রানবী বললো-
ও বন্ধু শুনছিস? পুনমের বাসা ওয়ারীতে।
-তো?
-তো মানে! ইচ্ছে হলে ওকে দেখতে পারবো, ওর উপর আমি নজরদারী করতে পারবো। আরো অনেক সুবিধে রয়েছে।
-ও যেনো তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে।
-আরে থাকবে অবশ্যই। কটা দিন পার হোক ঠিকই বুঝবি।
-কি মনেহয় পটবে এই মেয়ে?
-আমি তো ওকে পটাতে চাইনা। আমার প্রেমে ঘায়েল করতে চাই। যাতে কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা না ভাবে।
-মনেতো হচ্ছে এই মেয়ের পেছনে অনেক বছর ব্যয় করতে তোর, শুধু প্রেমে ফেলতেই।
-করলে করবো। ভালোবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা করার মতো মধুর কাজ আর দুটো নেই। এটা সাইকোলজিকাল ফ্যাক্ট এবাউট লাভ।
-তাই নাকি!
-হু, ঘায়েল হলেই বুঝবি কারো প্রেমে। এখন রাখলাম।
.
.
.
বাসায় এসে ভাবীর উদ্দেশ্যে রানবী চেঁচিয়ে বললো-
ভাবী ও ভাবী? এদিকে এসো।
.
রানবী এর বড় ভাবী খায়রুন।
এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে সে প্রায় ৫বছর হতে চললো।
রানবীকে বড় বোনের মতোই ভালোবাসে সে। তাই রানবী যেকোনো কিছুই বিনা সংকোচেই বলে খায়রুনকে।
আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা।
দেবরের ডাকে দ্রুতবেগে ছুটে আসলো খায়রুন।
তার হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে বললো-
কি হলো? আজ এতো হাসিখুশি দেখাচ্ছে?
-ঘায়েল হয়েছি আমি ভাবী।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে খায়রুন বললো-
ঘায়েল হয়েছিস মানে?
-মানে আমি প্রেমে পড়েছি।
-ওহ! সেতো তোর নিত্যদিনের স্বভাব।
.
খায়রুনের পাশে এসে রানবী বললো-
আমার নিত্যদিনের স্বভাব ছিলো প্রেমে পড়া। কিন্তু আমি প্রেমে পড়িনি।
-বুঝলাম না!
-ওহ হো ভাবী! যাক, এতোটুকু বুঝে রাখো রানবী তার জীবনসঙ্গিনীর দেখা পেয়ে গিয়েছে।
.
রানবীর কথা শুনে চোখ জোড়া বড়বড় করে খায়রুন বললো-
মানে তুই এবার ভালোবাসার জালে আটকে গিয়েছিস? আর মজা করার জন্য প্রেম করবিনা?
-ইয়েস মাই ডিয়ার ভাবী মা! আমার ওকে সারাজীবনের জন্য চাই।
.
মুখে হাসি নিয়ে খায়রুন অবাক হয়ে বললো-
কি এমন আছে মেয়েটার মাঝে? যাতে তুই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলি?
-শুনবে?
-হু।
.
রানবী সোফার উপরে বসে বলতে শুরু করলো-
সরল চাহনী, ঘন কালো লম্বা চুল, বড় বড় ডাগর চোখ, গোলাপি রঙের ঠোঁট, আর…
-আর?
-ঠোঁটের উপরের সেই তিল। ইশ! ভাবলেই ঘায়েল হয়ে যাই।
-তা বলেছিস তাকে তোর মনের কথা?
-উহু না!
-কেনো?
-কেননা সে অন্য দশটা মেয়ের মতো আমার সাথে প্রেম করতে রাজি হবেনা। আর আমি ওর সাথে প্রেম করতেও চাইনা। আমি চাই আমার জীবনে ওকে সারা জনমের জন্য।
.
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কথা শুনে খায়রুন বললো-
বর্ণনা শুনে তো আমিও ঘায়েল হয়ে যাচ্ছি। তা নাম কি ওই মেয়ের?
-পুনম।
-পুনম! নামটার মানে কি?
-জানিনা তো। কালই জেনে নিবো।
-কিভাবে?
.
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে রানবী বললো-
যার নাম তার থেকেই জানবো।
.
.
.
গোসল সেরে এসে দুপুরের খাবার খেতে বসলো পুনম।
তার একমাত্র ফুফু জাহারা। তার স্বামী দেশের বাইরে থাকে।
জাহারার মাত্র একটা ছেলে রয়েছে। বয়সে সে পুনমের ছোটই।
জাহারা আবার পুনমকে অনেক বেশিই ভালোবাসে। একমাত্র ভাই এর মেয়ে বলে কথা!
পুনমের চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
এদিকে তার সেই ধ্যান নেই। চেয়ারের উপর পা তুলে ভাত খেয়ে চলেছে সে।
জাহারা তোয়ালে এনে তার চুলগুলো মুছতে মুছতে বললো-
এতো বড় হয়েছো নিজের চুলগুলোও ঠিকমতো মুছতে পারোনা।
-ফুফুনি কি করবো বলো! মুছলেও পানি পড়তে থাকে। আর একবার চুল ভেজালে, শুকাতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। ইচ্ছে করে কেটে ফেলি।
-ইশ! কতো শখ! এই সময়ে কতোজন মেয়েরই বা ঘন কালো লম্বা চুল রয়েছে!
-তুমিও আম্মুর মতো বলছো। এই আম্মুর জন্যই তো আমাকে চুল বড় করতে হয়েছে। নাহলে কবেই কেটে ফেলতাম!
-হয়েছে হয়েছে। এখন থেকে তোমার চুল আঁচড়ে দেয়া আর মুছে দেয়ার দায়িত্ব আমার।
-সত্যি বলছো?
-হু। খেয়ে নাও এবার।
.
.
.
শার্টের কলার ঠিক করছে মাহিম।
ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠলো তার।
ফোনটা হাতে নিয়েই দেখলো ইপশিতার ফোন।
মাহিম…
পুনমের বড় ভাই সে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে আপাতত বেকার ঘুরছে।
.
ইপশিতা…
মাহিমের প্রেমিকা।
অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সে।
আজ প্রায় ২বছর হতে চললো মাহিম আর ইপশিতার সম্পর্ক।
.
ইপশিতার ফোন পেয়ে মাহিম রিসিভ করে বললো-
হু ইপু বলো?
-আব্বু আমার বিয়ে দিতে চায়ছেন মাহিম।
-তো করে ফেলো!
.
মাহিমের এমন ভাবলেশহীন আচরণ একেবারেই পছন্দ নয় ইপশিতার।
মাঝেমধ্যে তার মনেহয়, আসলেই মাহিম এই সম্পর্ক টা নিয়ে সিরিয়াস তো!
বিরক্তিভরা কণ্ঠ নিয়ে ইপশিতা বললো-
করে ফেললে তোর সাথে প্রেম করছি কেনো খাচ্চোর?
.
ইপশিতার কথা শুনে রাগ করা উচিত হলেও করলোনা মাহিম।
ইপশিতা যে একটু রগচটা স্বভাবের মেয়ে অজানা নয় তার।
মৃদু হেসে মাহিম বললো-
পিচ্চি একটা মেয়েকে নাকি বিয়ে দিতে চায়ছে! তো আর কি বলবো বলো? পুনম তোমার ছোট, তাও ওকে আমরা ঢাকা পাঠিয়েছি পড়াশোনার জন্য। যতোদিন ও না চায় ওর বিয়ে আমরা দিবোনা।
-সবার ফ্যামিলি এক নাকি মাহিম!
-আমি সবে মাত্র ভার্সিটি থেকে বের হলাম। একটা চাকরির জন্য তো সময় লাগবে তাইনা?
-হু।
-ততোদিন পারবেনা বিয়ে না করে থাকতে?
-কতোদিন?
-কয়েকমাস তো লাগবে ইপু!
-হু।
-আমি জানি তুমি পারবে। বেকার গেলে তোমার মা বাবা মেনে নিবেন না। তাই প্রতিষ্ঠিত হয়েই সামনে যাবো তাদের।
-হু।
.
.
ইপশিতার সাথে ফোনে কথা বলার পর, মাহিম ডায়েল করলো পুনমের নাম্বারে।
পুনম ফোন রিসিভ করতেই মাহিম বললো-
কেমন আছিস?
-ভালো আছি। তুমি নিশ্চয় আরো বেশি ভালো আছো।
-এভাবে কেনো বলছিস পুনম?
-কিভাবে বলবো ভাইয়া? আমাকে এতোদূরে পাঠানোর মানেটা কি বলতে পারো? চট্রগ্রামেও ভালো ভালো কলেজ আছে।
-তোর কি ওখানে কোনো অসুবিধে হচ্ছে?
-না তা হচ্ছেনা।
-তাহলে সমস্যা কি! বাবার ইচ্ছে তার মেয়ে ঢাকায় পড়াশোনা করবে। আর এজন্যই তো…
-তোমাদের এসব যুক্তি না আমার মাথায় ঢুকছেনা। প্রথমে আমাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছো আর এখন দূরে পাঠিয়ে…
-আমরা তোকে শুধু বিয়ে করবি কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম পুনম। জোর বা চেষ্টা করেছি এটা কিন্তু ভুল। এসব বাদ দে। নতুন কলেজ কেমন লাগলো বল। সব ঠিক আছে তো?
-হুম।
-কেউ বিরক্ত করলে আমাকে বলবি।
-চট্রগ্রাম থেকে এসে দাপট খাটাবে এখানে?
-দাপট খাটানোর লোকের অভাব নেই। নিজে যেতে না পারলেও আমার এক কথায় অনেকে পৌঁছে যাবে।
.
.
ভাই এর সাথে কথা বলার পরে ফোনের লাইন কেটে রুমের মাঝে পায়চারী করছে পুনম।
শুধু মাত্র পড়াশোনার জন্যই তাকে ঢাকা পাঠানো হয়েছে নাকি তার পরিবার তার কাছে লুকোচ্ছে কিছু!
.
(চলবে)