#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#Part_12_13
পুলক দৌড়ে এসে অনন্যার সামনে দাড়ালো। কিছুক্ষণ দম নিয়ে পড়ে বললো,
–এই সরি সরি,, আজ একটু দেরি হয়ে গেলো।
— আপনার কি কাজ কর্ম নেই,, সারাদিন আমার বাড়ির সামনে, আমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করেন।
— দেখেছো, তোমার অভিমান হয়েছে!! কালকে কিন্তু তুমি বলেছিলে আর আজকে আপনি বলছো। আমি দেরি করে আসাতে এই অভিমান টা হয়েছে তাই না!!!
— না,, কিসের অভিমান,, তুমি কে,যে তোমার উপর অভিমান করবো!!
অনন্যা পা চালালো,, সত্যিই কি পুলকের উপর তার অভিমান হয়েছে। সত্যিই কি সে পুলক কে ভালোবেসে ফেলেছে!!
শিউলি বেগম তৃপ্তির প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন,
–হ্যা রে,, পূন্য ফোন দেয় না কেনো? ও কেমন আছে? কি করছে? শাশুড়ি কেমন,, কিছুই তো বললো না। আমার না বড্ড চিন্তা হয় মেয়েটা কে নিয়ে।
তৃপ্তি মুখের খাবার টা শেষ করে বললো,
— বুবুনের মন মেজাজ ভালো থাকে না, তাই ফোন টোন করে না। দেখবে যদিন মন ভালো থাকবে সেইদিন নিশ্চয়ই কল দিবে।
শিউলি বেগম চেয়ারে বসে কাঁদতে লাগলেন। তৃপ্তি অবাক হয়ে বললো
— কাঁদো কেন??
— তুই বুঝবি না!! আমার মেয়েটা রে কতদিন হলো দেখি না। এক মাস!! কোনোদিন চোখের আড়াল হইতে দেই নাই। আর আজ ২০-২৫ দিন হইলো দেখি না।
— নিবিড় ভাইয়ার বিয়েতে তো আসছিলো, তুমি যাও নাই তাই দেখতে পারো নাই।
— একটু কল দে না,, কথা বলি ওর সাথে,,
তৃপ্তি খেয়ে উঠে মোবাইল টা নিয়ে ওর মায়ের সামনে বসলো। পূন্য কে কল দিলো, প্রথম বার কেটে গেলো,, দ্বিতীয় বার কল দিতেই রিসিভ করলো।
তৃপ্তি বললো,,
— এই দেখো,, কল দিতে না দিতেই তোমার মেয়ে রিসিভ করে ফেলছে,,
হ্যালো বুবুন,,
— হুম, কেমন আছিস??
— আমি ভালো আছি,, কিন্তু আম্মু ভালো না,, এই নে আম্মুর সাথে কথা বল।
শিউলি বেগম মোবাইলটা কানে লাগিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে দিলো, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
— কেমন মেয়ে রে তুই,, একবার খবর নিলি না তো আমার?
— কাঁদতেছো কেন?? কি হয়ছে??
— কিছু হয় নাই। কেমন আছিস?
— ভালোই,,, তুমি??
— তোরে ছাড়া ভালো লাগে না,, বাসা কেমন জানি খালি খালি লাগে।
— খাইছো??আর আব্বু কি অফিসে চলে গেছে??
— না,, খায় নাই এখনো। হ, তোর আব্বু অফিসে।
— এখনো খাও নাই!! তাড়াতাড়ি খাও।
— ও পূন্য,, কয়েকদিনের জন্য আয় না। দেখ না করিস না মা,,, আইসা পড়।
— আমার শাশুড়ি না বললে আসবো কিভাবে,?
— আমি কথা বলবো ওনার সাথে।
— ঠিক আছে বলো,, তবে কয়েকদিন পর। এখন কান্নাকাটি বন্ধ করে খেতে বসো। নাহলে শরীর খারাপ করবে।
— আচ্ছা,,
— আচ্ছা,, এখন রাখি তাহলে??
— তুই কি সুখে আছিস??
পূন্য ফোনটা রাখতে গিয়েও থেমে গেলো। এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও জানে না।
— আম্মু,, এখন রাখছি। ভালো থেকো। আর আমি সুখেই আছি।
পূন্য ফোনটা কেটে দিলো। হ্যা, সে সুখে আছে। তিয়ান তো ওকে সুখেই রেখেছে।
মোর্শেদা বেগম বসে বসে পান চিবুচ্ছে,, তিনি যা ভেবেছিলেন তাই হয়েছে।মেয়েটা এতো ঘরোয়া,, সংসারের কাজ গুলো যেভাবে সামলে নেই মনে হয় দশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। সবার দিকেই সমান ভাবে খেয়াল রাখছে। মোর্শেদা বেগমের র দুঃখ একটাতেই, তার ছোট ছেলেটার জন্য,, বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো।
বিকালের দিকে পূন্য বিছানায় শুয়ে আছে,, তার খুব ঘুম পাচ্ছে, চোখটা লেগে গেছে, কিন্তু পুরোপুরি ঘুমায় নি এখনো। হঠাৎ কিছুর শব্দ পেয়ে পূন্য উঠে বসলো৷ তিয়ান এসে পড়েছে।
তিয়ান পূন্যকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— তুমি শুয়ে থাকো। সরি শব্দ করার জন্য।
তারপর অনন্যাকে ডেকে কফির কথা বললো। পূন্য নিজেই উঠে বসলো, তিয়ান ততক্ষণে ওয়াশরুমে চলে গেছে। পূন্য গিয়ে কফি আর চা দুটোই বানায়,, শাশুড়ি কে চা দিয়ে তিয়ানের জন্য কফি নিয়ে আসে।
তিয়ান পূন্যর হাত থেকে কফি নিয়ে বললো,,
— আমি তো অনন্যাকে বলেছিলাম,, তুমি না গেলেও পারতে।
— কেনো?? আমার হাতের কফি বুঝি ভালো লাগে না??
তিয়ান হাসলো। পূন্য হেসে বেলকুনির দিকে পা বাড়ালো। পূন্য স্বাভাবিক ভাবেই তিয়ানের সাথে কথা বলছে!! পূন্য ভাবতেই অবাক লাগছে। ভাগ্য করে এমন স্বামী পেয়েছে। সত্যিই তিয়ান কতো সহজে সব কিছু মেনে নিলো। সম্পর্কটাকে কতো সহজ করে দিলো। হঠাৎ চোখটা সেই গাছটার নিচে বসে থাকা ছেলেটির উপর পড়লো।
তিয়ান এসে পূন্যর গ্রিলে উপর রাখা হাত দুটো ধরলো। পূন্য তিয়ানের দিকে তাকাতেই তিয়ান বললো,
— একটু বেরুচ্ছি,, আসতে অনেক রাত হবে।
— ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
তিয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেলো। ও বললো আসতে রাত হবে, আর পূন্য বললো তাড়াতাড়ি চলে আসতে, হাসলো তিয়ান।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো,,পূন্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো গাড়িটার দিকে,, এই ২০-২৫ দিনের মধ্যে এই একটা দিন যেখানে আমি মনে হয় তিয়ানের কথা বেশিই ভাবছি, সেটাই নিশ্চয় ভালো।
অনন্যা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো পুলক বসে আছে নাকি, হুম বসে আছে। অনন্যার মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি খেলে গেলো। আজকে সন্ধ্যার সময় লাইট টা জ্বালালো না। যাতে পুলক তাড়াতাড়ি চলে যায়।
গাড়িটা থামতেই আলভী তিয়ানের দিকে এগিয়ে এলো। তিয়ান গাড়ি থেকে নামতেই ওকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পর দেখা হলো কিনা।
–এই ছাড়, মনে হচ্ছে আমাকে বছর দুই বছর পর দেখেছিস।
তিয়ানের কথা শুনে আলভী তিয়ানকে ছেড়ে দিলো,, তারপর হেসে বললো,,
— হুম,, দুই বছর না হলেও ২২ দিন পর।
আলভী তিয়ান বসে আছে। আলভী নিজে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তিয়ানের দিকে সিগারেটের প্যাকেট টা এগিয়ে দিলো। তিয়ান আলভীর দিকে তাকিয়ে আছে,, সিগারেটের প্যাকেট টা দেখে,। আলভী ভ্রু নাচিয়ে বললো,,
–কিরে শালা,, এমন ভাবে দেখছিস যেনো জীবনের প্রথম দেখলি,, আগে কখনো খাস নি!! নাকি ভাবি না করছে?
তিয়ান মাথা নাড়িয়ে হেসে হাত দিয়ে প্যাকেট টা নিলো। তারপর বললো,
— ভাবি তো জানেই না যে আমার এই অভ্যাস টা আছে।
তিয়ান সিগারেট টা মুখে নিয়ে ধোঁয়া টা উড়িয়ে দিলো। আলভী হেসে বললো,
–এই সাধারণ বিষয়টা এখনো বলতে পারিস নাই,, তাহলে বাকি বদ অভ্যাস গুলোর কথা কিভাবে বলবি??
— আমাকে কেনো বলতে হবে, ও যথেষ্ট বুদ্ধিমান আস্তে আস্তে বুঝে যাবে।
— তুই অনেক চালাক,, সবাই কে পটিয়ে নিতে পারিস৷ আচ্ছা তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
— সারপ্রাইজ!!! কি??
–সীমা!!!
তিয়ান হালকা কেশে উঠলো। আলাভী হা হা হা করে হেসে দিলো।তিয়ান ভ্রু কুচকে আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
–সিরিয়াসলি??
–yeah,,আসছে ওর হাজবেন্ডের সাথে।
— Husband!!! বেচারার মনে হয় ব্যান্ড বাজিয়ে দিচ্ছে সীমা।
— তা যা বলেছিস। বিয়ে আগে যতগুলোর সাথে রিলেশন ছিলো বিয়ের পর তার ডাবল হয়ে গেছে। ওর অভ্যাস টা আর গেলো না।
গাড়ির আওয়াজ শুনে দুজনেই উঠে দাড়ালো। আলভী আর তিয়ান এগিয়ে গেলো। সীমা গাড়ি থেকে নেমেই তিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— তিয়ান,, কতো মিস করছিলাম তোমায়,,
— Excuse me!!
কথাটা বলে তিয়ান নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।তারপর বললো,,
— চলো,, গিয়ে বসি।
আলভী সীমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখলো,, ওয়েস্টার্ন ড্রেসে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে সীমা। শরীরের সাথে মিশে আছে,, এতো টাইট যে শরীরের প্রত্যেকটা ভাজ বুঝা যাচ্ছে,,
আলভী ওদেরকে রুমে নিয়ে এলো।
অনেকক্ষন আড্ডা দেওয়ার পর তিয়ানের পাশে এসে সীমা বসলো, তারপর হেসে বললো,
–শুনলাম বিয়ে করে নিয়েছো??
— হুম,, লুকিয়ে কিংবা পালিয়ে বিয়ে করি নি। তাই শুনাটাই স্বাভাবিক।
— তা তোমার বউ কেমন দেখতে ??
— অনেক সুন্দর,,, একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না।
— বাহ্,, বউয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা করছো কতো সহজেই,, অথচ এই কথাটা তোমার মুখ থেকে শুনার জন্য কতো কিছুই না করেছি। তোমার বউয়ের মধ্যে এমন কি আছে যা আমার মধ্যে নেই??? বলো,
তিয়ান আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে একটা টান দিলো। তারপর বললো,,
— ওর মধ্যে যা আছে, তার এক কোনাও তোমার মধ্যে নেই। ওর সাথে তুমি তোমার তুলনা করো না।
— ওহ,, তো তোমার Past সম্পর্কে কিছু জানাও নি তাকে!!!
তিয়ান কিছুক্ষণ সীমার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর হাতের ঘড়িটা দেখলো। সাড়ে দশটা বাজে,,,। উঠে দাড়ালো আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— আমাকে এখন যেতে হবে।
আলভী উঠে দাড়িয়ে অবাক হয়ে বললো,,
— তুই তো বলেছিস,, কমপক্ষে ১২টা পর্যন্ত থাকবি।
— নারে,,, তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
সীমা বলে উঠলো,,
— ছেড়ে দে আলভী,, ওর বউ মনে হয় তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।
সীমা উঠে তিয়ানের কাছে এলো,,
— বউকে এতো ভালোবাসো!!! এই ভালোবাসা থাকবে তো কয়েকদিন পর???
তিয়ান সীমার দিকে না তাকিয়েই বললো,,
— আমার ভালোবাসাটাকে তোমার ভালোবাসার সাথে গুলিয়ে ফেলো না অন্তত,,,
চলবে,,,,
#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#Part_13
রুমে ঢুকে পূন্যকে পেলো না তিয়ান। ওয়াশরুমে ও নেই,, মনে হলো বেলকুনিতে আছে তাই সেখানেই গেলো। হুম পূন্য বেলকুনিতেই বসে আছে৷ তিয়ান পূন্যর পাশে গিয়ে বসলো,, তারপর বললো,,
— এখনো ঘুমাও নি!.
পূন্য চমকে উঠলো,, কিছুক্ষণ তিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
— নাহ্, ঘুম আসছে না।
তিয়ান চেয়ার থেকে উঠে পূন্য সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,
— দেখো তো মুখে কিছুর গন্ধ আছে কিনা?
— কিসের গন্ধ?
— আগে দেখো তো।
পূন্য তিয়ানের মুখের কাছে মুখ আনলো,,, নাহ্ ও চকলেটের গন্ধ পেলো, তাই বললো,
— চকলেটের গন্ধ!!
তিয়ান উঠে দাড়ালো। পূন্যও উঠে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তিয়ান পিছন থেকে বলে উঠলো,,
— আসলে সিগারেট খেয়েছিলাম কি না,, তাই আর গন্ধ শুকতে বললাম। তোমার যদি আবার সিগারেটের গন্ধ সহ্য না হয়!!
পূন্য কিছু না বলে রুমে এসে শুয়ে পড়লো। তিয়ানও পিছু রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো।
তিয়ান আস্তে করে পূন্য কোমর জড়িয়ে ওর কাছে টেনে নিলো, পূন্য পিঠে নিজের মুখটা চেপে ধরে বললো,,
— এই পূন্য,, তুমি রাগ করেছো? সরি,, তুমি যদি চাও তাহলে আর খাবো না।
পূন্য তিয়ানের দিকে ঘুরলো। তারপর হাসলো, বললো,
— রাগ করার কি আছে? আজকাল ছোট বড় কম বেশি সবাই সিগারেট খায়। এটাকে এখন ফ্যাশন বললেই হয়। তো রাগ করবো কেনো?
তিয়ান হাসলো, সে জানতো পূন্য কোনোরকম রাগ করবে না। তিয়ান পূন্যর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো। পূন্য কিছুক্ষণ ঠোঁট শক্ত করে রাখলেও আস্তে আস্তে তিয়ানের মাথার চুল হাত দিয়ে আকড়ে ধরলো।
মাথা ব্যাথার যন্ত্রণায় অনন্যা আর শুয়ে থাকতে পারলো না। উঠে বসলো,, রুমে একটাও ঔষুধ নেই।
মলম ও নেই। তাই উঠে পূন্যর রুমের দিকে যেতে লাগলো। এখনো তিয়ান আসে নি, গাড়ির শব্দ তো পায় নি,, তাই ঔষুধ নিয়ে চলে আসলেই হবে।
পূন্যর রুমের দরজাটা খুলায় ছিলো,, তাই অনন্যা ধাক্কা দিয়ে রুমের ভিতর ঢুকে গেলো,, অন্ধকার রুম,, বাইরে থেকে হালকা আলো এসে দেয়ালের উপর পড়েছে,, অনন্যা ঐ দিকে তাকাতেই মনে হলো দুটো ছায়া মূর্তি যেনো ছিটকে আলাদা হয়ে গেলো।
পূন্য উঠে বসলো,, কথার ভিতর ভালো করে শাড়ির আঁচল টা ঠিক করে নিলো,, তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,,
–কিছু বলবে অনন্যা।
–হ্যা,,না মানে বড্ড মাথা ব্যাথা করছে গো। তোমার কাছে ঔষুধ আছে??
পূন্য উঠে লাইট জ্বালানো। অনন্যা বিছানার দিকে তাকাতেই চোখ পড়লো তিয়ানের উপর। তিয়ান কখন চলে এসেছে!!! কই গাড়ির শব্দ তো পাওয়া যায় নি। এতো কিছু ভাবার সময় নেই,, অনন্যা কোনো মতে ঔষুধ টা নিয়ে চলে গেলো। পূন্য কিছু টা দম নিয়ে দরজাটা লক করে দিলো।
পূন্য শুয়ে পড়তেই, তিয়ান ওর দিকে ঘুরলো, পূন্য হেসে বললো,
— ঘুমিয়ে পড় । Good Night…
— Good Night
তিয়ান একটা হাত পূন্যর উপরে রাখলো।
মিতু চুপচাপ নিবিড়ের পাশে শুয়ে আছে। হঠাৎ করে বললো,,
— আচ্ছা, আমাকে একটু পূন্য আপুর কাছে নিয়ে যাবেন??
নিবিড়ের এখন কোনো কথায় শুনতে ভালো লাগছে না। তাই মিতুকে চুপ থাকতে বললো,,
— মিতু চুপচাপ শুয়ে থাকো। একদম কথা বলবে না। না হলে রুম থেকে বেরিয়ে যাবো।
মিতু কিছু বললো না,, চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো,, কিন্তু পারলো না,, মিতু বুঝতে পারছে তার এই আচরণে কেউ তার উপর খুশি নন। উঠে বসলো,,, তাতে কি হয়েছে!! সেও তো অনেকের আচরণে খুশি নয়। কিন্তু সবাই এত্ত বকাবকি করে কেন!! সবচেয়ে বেশি বকে এই লম্বু টা। উফফ,, জন্মের সময় মুখে মনে হয় মধু দেয় নি। সবচেয়ে ভালো হলো, শশুড় আর রুপন্ত।
মিতু ঘুরে দেখলো নিবিড় ঘুমিয়ে গেছে,, তাই জোরে একটা চিৎকার দিতেই নিবিড় উঠে বসলো,,তারপর বললো,,
— কি হয়েছে??
— কিছু না,, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তো,, তাই জাগিয়ে দিলাম।
নিবিড় আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না,, ঠাস করে মিতুর গালে চড় বসিয়ে দিলো। তারপর উঠে চলে গেলো। মিতু কতোক্ষন গালে হাত দিয়ে বসে থাকলো,, চোখ থেকে পানির ফোটা অনর্গল শাড়িতে পড়ছে, শাড়ির আঁচল দিয়ে একটু পরপর চোখ মুছছে। কি এমন করেছিলো যার জন্য এমন করে মারলো। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো নিবিড়।
ছাদে বসে পরপর দুইটা সিগারেট জ্বালালো নিবিড়। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল,, মিতুকে আরো দুয়েক চড় দিলে ঠিক হতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে না মারলেই পারতো। কিন্তু কি করবে সে!! একদিকে পূন্যকে হারিয়ে ফেলা,,অন্যদিকে এই মেয়ের পাগলামি। নিবিড়ের আর কিছুই সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে নিবিড়েরই একদিন পাগল হয়ে যাবে,, নাহ্ অন্য সবার রাগ মিতুর না মিটালেও পারতো। মিতুর কাছে মাফ চাওয়া দরকার। কিন্তু মিতু কি মাফ করবে,, পূন্য হলে চোখ বন্ধ করে মাফ দিতো। নিবিড় উঠে ধীর পায়ে ছাদ থেকে নামলো। হেঁটে ওর রুমের দিকে যাচ্ছে,, কিছু শব্দ শুনে থেমে যায়,, অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে বুঝতে পারে যে অন্তু ( রুপন্ত) পড়ছে। রাত ১ বাজে এখনো পড়ছে!! নিবিড় অন্তুর দরজায় দাক্কা দিয়ে বলে,,
— আর পড়তে হবে না। এবার শুয়ে পড় অনকে রাত হয়ে গেছে।
নিবিড়ের গলা শুনে রুপন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।অবাক হয়ে বলে,,
— তুমি এখনো ঘুমাও নি!!
— ঘুমালে কি আর তোর সামনে দাড়িয়ে থাকতাম।
নিবিড় হেসে রুপন্তর ঘরে ঢুকলো,, এই ঘরটায় আগে নিবিড়ের ছিলো। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঘরে। নিবিড় চেয়ারটাতে বসে পড়লো।
রুপন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,,
— ভাইয়া, আমার কাছে অনেকগুলো পুরোনো জিনিস আছে,,
নিবিড় ভ্রু কুচকে তাকালো,,রুপন্ত ওকে তেমন পাত্তা না দিয়ে একটা ডায়েরি বের করলো। তারপর সেটা নিবিড়ের হাতে দিলো। নিবিড় কিছু বুঝতে পারলো না, কারো পারসোনাল ডায়েরি এভাবে অন্যকারো তুলে দেয় নাকি।
রুপন্ত হেসে বললো,,
— আমি আপনাকে আমার পারসোনাল ডায়েরি দেই নাই। খুলতে পারেন,, আর পারসোনাল ডায়েরি দিলে বা,, আগে তো আমার ডায়েরি পড়ার জন্য তুই আর পূন্য আপু লুকিয়ে লুকিয়ে আমার রুমে আসতি, তোদের জন্য আমাকে ডায়েরি লুকিয়ে রাখতে হতো।
রুপন্ত হাসলো, সাথে নিবিড় ও হাসতে হাসতে ডায়েরি টা খুললো। নিবিড়ের হাতের লেখা আছে,, প্রথম দুইটা পাতায়,, তারপর রুপন্তর হাতের লেখা
বাকি চারটা পাতায়। তারপরের পাতাগুলোতে ছোট ছোট কাগজের টুকরো গুলো আটা দিয়ে লাগানো হয়েছে ডায়েরির পাতায়। টুকরো গুলোতে নিবিড় আর পূন্যর হাতে লেখা। নিবিড় রুপন্তর দিকে তাকালো, রুপন্ত হাসলো আর ইশারা দিয়ে দেখতে বললো।
নিবিড় আরো কয়েকটা পাতা উল্টে ফেললো। পুরো ডায়েরিতেই কাগজের টুকরো গুলো আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে।
রুপন্ত এগিয়ে এসে টেবিলের উপরে বসলো। তারপর বললো,,
— তোর আর পূন্য আপুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিঠি গুলো। যখন পূন্য আপু আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো,, আর যখন আমরা পূন্য আপুদের বাসায় বেড়াতে যেতাম, তখন তোরা আমাকে আর তৃপ্তি কে তোদের ডাকপিয়ন বানাতি। এর চিঠি ওর কাছে দাও, আবার ওর চিঠি এনে এর কাছে দাও। বিনিময়ে চকলেট পেতাম, পূন্য আপু আদর করতো, আর তোদের কাছ থেকে এই চিঠি গুলো পেতাম। অবশ্য পূন্য আপুর আদরের জন্য আর এই কাগজের টুকরো গুলোর জন্যই আমি এই পিয়নের কাজ টা করতাম। আর চকলেট টা তো বাহানা ছিলো
রুপন্তর কথাটা শুনে নিবিড় ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো,, রুপন্ত হেসে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,,
–একদিন তুই কাগজের টুকরোর মধ্যে লিখে দিয়ছিলি,, 1 4 3.. তো আমি লুকিয়ে লুকিয় কাগজটা দেখে পূন্য আপুর কাছে নিয়ে দিলাম। পূন্য আপু কাগজে লিখে দিলো, ” মানে”
তুই লিখে দিলি মানে, ” I love you” আমি আবার কাগজ নিয়ে পূন্য আপুর কাছে গেলাম। পূন্য আপু লিখে দিলো,, “1 4 3″
তুই ও এর মানে জানতে চাইলি,, তার উত্তরে পূন্য আপু লিখে দিলো, ” I Hate you”
তখন Love- Hate এর মানে বুঝতাম না মনে হতো দুইটার অর্থ এক, শুধু পড়ে মজা পেতাম। কিন্তু এখন বুঝি,,
নিবিড় হেসে বললো,,
— তুই তো দেখি,,,
— হুম,,, মাঝে মাঝে পড়তাম। সব সময় না। পড়ে তৃপ্তিকে গিয়ে বলতাম। তোর এই I love you শুনে তৃপ্তিকেও বলছিলাম,, তৃপ্তি আই লাভ ইউ। ক্লাস সিক্সে পরি তখন, জানতাম না আই লাভ ইউ মানে কি। তাই বলে ফেললাম। তৃপ্তি ঠাস করে একটা চড় মেরে বললো,, হারামি, বান্দর, জানোস আই লাভ ইউ এর মানে কি??
এর পর আর জীবনেও কেউরে এই কথা বলি নাই।
রুপন্তর এই কথা শুনে নিবিড়ের হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গেলো। রুপন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নিবিড়ের হাসি দেখলো,, হঠাৎ নিবিড় হাসি থামিয়ে উঠে দাড়ালো,, একটু আগেই সে মিতু কে চড় মেরেছে। সরি বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু এখানে এসে রুপন্তর সাথে আড্ডায় বসে পড়লো,,
রুপন্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
— শুয়ে পড়,, অনেক রাত হয়ে গেছে।
— ভাইয়া,, প্রথম ভালোবাসা ভূলা যায় না,, তাই না
রুপন্ত প্রতিউত্তরে শুধু একটা মলিন হাসি পেলো। কিছুক্ষণ নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,,
— কতো ভালোই না হতো পূন্য আপু তোর বউ হলে। তুই সুখে থাকতি, মিতু কি আদৌও তোর যোগ্য!!! তোর পাশে শুধু পূন্য আপুকেই মানায়। তুই পূন্য আপুকেই ডিজার্ভ করিস।
নিবিড় কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝতে পারলো, মিতু তার যোগ্য না, আর তার বাবা সেটা বুঝতে পারলো না!!
ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো,,মিতু ঘুমাচ্ছে দেখে আর ডাক দিলো না। আলতো করে মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে নিতেই দেখলো বাম গালটায় পাঁচটা আঙ্গুল ভেসে গেছে। নিবিড়ের একটু কষ্টই হলো,, এমন ভাবে না মারলেও পারতো।
অনন্যা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে,, প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় এখন চোখ দিয়ে পানি পড়ছে,, ঔষুধ খেয়েছে কিন্তু কমছে না কেনো। চোখে আবার ভেসে উঠলো দুটো ছায়ামূর্তির ছিটকে আলাদা হয়ে যাওয়ার দৃশ্য,, অনন্যা না গেলেও পারতো ঐ সময়,,, এমনিতেও তো মাথা ব্যাথা কমছেই না। আর সহ্য করতে পারছে না,, এই মনে হচ্ছে মৃত্যু চলে এলো।
ছটফট করতে করতে শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে আসলো।
সকাল দশটা বেজে গেলো,, পুলক অপেক্ষা করছে,, কখন অনন্যা বেরুবে,, আজ যে তাকে চলে যেতে হবে। একমাস পর আবার দেখা হবে অনন্যার সাথে,, শেষ দেখা টা একবার দেখুক অনন্যাকে। মনটা কেমন জানি করছে, ইচ্ছা করছে না যেতে, কিন্তু ব্যবসার কাজে এতোদিন না গেলেও এখন যেতেই হবে। অনন্যার কি আজ ক্লাস নেই!! আচ্ছা ওর কিছু হয় নি তো,, যদি ক্লাস না থাকে তাহলেও তো একবার বাইরে আসবে। এখনো কেনো আসছে না??
এগারো টার দিকে অনন্যার ঘুম ভাঙলো,,তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় আসলো,কারন অনন্যার মনে হচ্ছে আজ পুলককে দেখতে পাবে না। কিন্তু বারান্দায় এসে একটা সস্তির নিশ্বাস ফেললো। পুলক দাড়িয়ে আছে। অনন্যার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো,, অন্যদিকে পুলকের অভিমান হলো।
অনন্যাকে দু চোখ ভরে দেখে নিয়ে পুলক হাটা ধরলো। অনন্যা ভ্রু কুচকে দেখলো,, সে বুঝতে পারছে না আজ পুলক চলে যাচ্ছে কেনো? কেন জানি ওর মনে হচ্ছে আর পুলকের সাথে দেখা হবে না।
চলবে,,,,