#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#part_38_39_40
নিবিড় মিতুর পাশে বসলো। সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না,,কি করবে এখন। মায়ের কথা শুনা উচিত ছিলো। আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো,, যদি কিছু দেখা যায়,, কিন্তু রাত সাড়ে এগারো টা – বারোটার সময় কিছুই পাবে না এটা সে ভালোই জানে,,
নিবিড় বসে বসে গেইম খেলছে, মিতু একবার নিবিড়কে দেখে অন্য দিকে তাকাতেই চোখে ফুচকাওয়ালা আসছে। এতো রাতে ফুচকাওয়ালা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মিতু খুশিতে একপ্রকার লাফিয়ে উঠে গেলো। তারপর বললো,,
— ফুচকা খাবো!!!
নিবিড় মাথা না তুলেই বললো,,
— এতো রাতে ফুচকা পাবো কই? তারচেয়ে এখন বাসায় চলো। কাল ফুচকা খাওয়াবো, প্রমিজ।
— আগে ফুচকা খাবো, তারপর যাবো।
নিবিড় বিরক্ত হয়েই মাথা তুললো। সামনের দিকে চোখ যেতেই দেখলো একটা ফুচকাওয়ালা। ততক্ষণে মিতু দৌড়ে তার কাছে চলে গেছে। কে বলবে এই মেয়ে প্রেগন্যান্ট! লাফালাফি দৌড়াদৌড়ি এখনো বন্ধ হয় নি।
নিবিড় মিতুর পাশে গিয়ে দাড়ালো। মিতুকে একবার দেখলো। মিতুর পুরো নজর এখন ফুচকার দিকে। মেয়েরা কেমন লুলোপ দৃষ্টিতে ফুচকা দেখে। কেনো যে এরা এভাবে দেখে সেটা নিবিড় কিছুতেই বুঝতে পারে না। কি আছে এমন ফুচকার মধ্যে!!
মিতু ফুচকাওয়ালা কে বললো,
— মামা, বেশি ঝাল দিয়ে দিবা কিন্তু?
ফুচকাওয়ালা হাসলো।
নিবিড় মাথা নেড়ে বললো,
— না,, একদম ঝাল দিবেন না।
মিতু নিবিড়ের দিকে তাকালো। মিতুর তো মনেই ছিলো না, তার সাথে আরোও একজন আছে। ঝাল খেলে যদি তার কিছু হয়! হাসলো একটু। এক প্লেট ফুচকা খেয়েই মিতু হাপিয়ে গেলো।
নিবিড় কিছুক্ষণ মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
— এবার যাওয়া যাক??
মিতু মাথা নেড়ে না বললো, তারপর আবার ফুটপাতে বসে পড়লো।
নিবিড় কিছুটা এগিয়ে বললো,
— মানে কি?? এখন কেনো যাবে না?চলো তো,,
মিতুর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে ফেললো। কিছুক্ষন হাঁটার পর নিবিড় লক্ষ করলো, মিতুর হাটতে কষ্টই হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে গাড়ি নিয়ে আসলেই ভালো হতো। মিতুকে এক ঝটকায় কোলে তোলে নিবিড়। সে চায় না মিতুর কোনো কষ্ট হোক।
মিতু অবাক হয়ে নিবিড় দেখলো, এই মূহুর্তে তার কোনো কিছু বলার ভাষা নেই। শুধু নিবিড়ের কাঁধ দু হাতে জড়িয়ে রাখলো। মিতুর ভয় হচ্ছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি তাকে ধপ করে ফেলে দিবে।
নিবিড় এতক্ষন সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটলেও এবার মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
— কি হয়েছে??
— আমাকে ফেলে দিবেন না তো??
নিবিড় হাসলো। বাসার সামনে মিতুকে নামিয়ে হাত সংকোচন প্রসারন করলো। হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। মিতুকে যতোটুকু হালকা ভেবেছিলো ততোটুকু হালকা নয় সে।
রূপন্ত মোবাইল টা সাইলেন্ট করে দিলো। তিশা কল দিচ্ছে। তিশার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা তার নেই। তিশার উপর অনেক রেগে আছে সে। বিকেলে একবার ফোন করে বললেই পারতো যে সে আজকে আসতে পারবে না, তাহলে তাকে আর অপেক্ষা করতে হতো না। একে তো আসে নি, তার উপর ফোন ও বন্ধ করে দিয়েছিলো। এখন মাঝরাতে তার কথা মনে পড়েছে। এখন সে কিছুতেই কল ধরবে না। মোবাইল টা বালিশের নিচে রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবার বের করলো,, অনেকগুলো কল দিয়েছে, আবার মেসেজও করেছে। রূপন্ত মেসেজটা পড়তে লাগলো,
” আমার মা মারা গেছে,রূপন্ত ”
মেসেজটা পরার পর, কিছুক্ষণ থ মেরে বসে রইলো। রূপন্তর এখন তিশার পাশে থাকা দরকার। আর সে কিনা তিশার উপর রাগ করে বসে আছে। তখন তো সে জানতো না যে তিশার মা মারা গেছে। রূপন্ত তিশাকে কল দিলো।
তিশা সাথে সাথেই রিসিভ করে নিলো,, মনে হলো রূপন্ত কলের অপেক্ষায় ছিলো সে,,
রূপন্ত কি বলবে বুঝতে পারছে না। তিশার কান্নার শব্দে ওর চারপাশ ভারী হয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,
— তিশা
— রূপন্ত,, আমার আম্মু মারা গেছে, আমাকে একা রেখেই চলে গেলো,,
বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পরলো। রূপন্ত তিশাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষায় খুঁজে পাচ্ছে না।
— তিশা বাচ্চাদের মতো কান্না করে না। আন্টি কি অসুস্থ ছিলো?
— নাহ্,, স্ট্রোক করেছিলো। আমরা প্রথমে বুঝতে পারি নি। যখন বুঝতে পারলাম, তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিন্তু রাস্তায়!!
আর বলতে পারলো না তিশা কেঁদে দিলো আবার।কাঁদতে কাঁদতে গলার স্বর পাল্টে গেছে। রূপন্তর সাথে এখন কথা বলতে পারবে না। লাইনটা কেটে দিলো। দু হাতে মুখ চেঁপে ধরলো। যদি সে আরো আগে বুঝতে পারতো আম্মুর কি হয়েছে তাহলে নিশ্চয় আম্মুকে বাঁচানো যেতো। তার কারনেই আজ তার আম্মু তাকে ছেড়ে চলে গেছে, যদি একটু আগে সে বুঝতে পারতো,,
পূন্য আর শিউলি বেগম হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রিকশায় বসে পূন্য নিজেই মনে মনে দোয়া করছে, যেনো রিপোর্ট পজিটিভ না আসে। ও কোনোভাবেই চায় না তিয়ানের কাছে ফিরে যেতে। রিপোর্ট টা হাতে পাওয়ার পর পূন্যর খুশিই হলো, নেগেটিভ আসছে। যাই হোক এখন আর ফিরে যাওয়ার কোনো চান্স নেই। আর পজিটিভ হলেও সে ফিরে যেতো না, কারন যে অনন্যার সন্তানের সম্মান দিতে পারে নি, সে কিনা দিবে তার সন্তানের সম্মান।
পুলক এসে চেয়ারটা টেনে বসতেই তৃপ্তি তার দিকে কালো রংয়ের একটা ডায়েরি এগিয়ে দিলো। তারপর বললো,
— বুবুন জানতো আপনি অনন্যার মৃত্যুর কারন জানতে চাইবেন। তাই সে অনন্যা আপুর মোবাইল আর ওর ডায়েরি টা সাথে নিয়ে এসেছিলো। ও জানতো আপনি একদিন না একদিন কল দিবেনেই,অনন্যার আত্মহত্যার কারণ জানতে। ও আজকে আসতে পারবে না, তাই আমাকে পাঠালো। এই ডায়েরি টা পরলেই আপনি সব জানতে পারবেন।
পুলক কিছুক্ষন তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে রইলো। কাল ওর সাথে ঐ মেয়েটাকে দেখে মনে হলো ঐ মেয়েটা অনন্যার রহস্য টা জানে। পুলকের মনে বারবার প্রশ্ন জাগছিল কেনো অনন্যা আত্মহত্যা করেছিলো! কিন্তু তৃপ্তি বা পূন্য কারো নাম্বারেই ছিলো না তার কাছে। তার জন্যই জন্যই ফোন দিয়েছিলো অনন্যার নাম্বারে,, ভেবেছিলো হয়তো বন্ধ থাকবে, কিন্তু সেই মেয়েটা কল রিসিভ করলো। পূন্য আপু। তার কাছে অনন্যার মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলেই সে এই কফি শপের নাম বলে এইখানে আসতে বললো। কিন্তু এসে দেখলো তৃপ্তি বসে আছে। হাত বাড়িয়ে ডায়েরি টা টেনে নিলো নিজের কাছে। দুইটা কফি অর্ডার করে ডায়েরি খুলে পড়তে লাগলো।
কফি সেই কখন দিয়ে গেছে। তৃপ্তি বসে আছে, পুলক খাচ্ছে না দেখে সেও খেতে পারছে না, ভদ্রতা বলে একটা আছে তো।
পুলক ডায়েরি টা বন্ধ করে তৃপ্তির দিকে তাকালো, গাল বেয়ে দু’ফোটা পানি পড়লো ওর কফির মগটায়, কফির কয়েকটা ছোট বিন্দু মগের উপরে ছিটকে পড়লো। কান্না জড়িত কন্ঠে বললো,
— ” আমাকে একবার বলতো যে ও প্রেগন্যান্ট, আমি মেনে নিতাম। ঐ লোকটা মেনে নেয় নি তো কি হয়েছে, আমি তোমার সন্তান কে মেনে নিতাম। আমি ভালোবাসতাম তোমাকে, কেনো বলো নি। ”
এই পুলকের মুখে এই কথাটা শুনার পর তৃপ্তি পুলককে ভালোবেসে ফেলেছে,সেটা সে হারে হারে বুঝতে পারছে। একজন মানুষ কিভাবে এতো ভালোবাসতে পারে সেটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে। অনন্যার জন্য আগে তার জন্য যতোটুকু ভালোবাসা ছিলো, এখনও ঠিক ততোটুকুই ভালোবাসা আছে। ভালোবাসাকে সম্মান করতে জানে সে। সত্যিই তার ভালোবাসাতে কোনো খাদ ছিলো না। এমন একটা মানুষের প্রেমে পড়া অন্যায় নয়। সে ঠিক করেই নিয়েছে,সে পুলকের পাশে থাকবে ওর সুখে দুঃখের ভাগীদার হবে। পুলকের মুখের দিকে তাকালো ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বসে আছে পুলক, কাঁদছে না, তবে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে সেটা তৃপ্তি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।
পুলক তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো,
— সেকি,, আপনি খাচ্ছেন না কেনো? ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!!
একটু হেসে কফির মগটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিলো। ঠান্ডায় হয়ে গেছে প্রায়, হালকা গরম আছে। মগটা টেবিলের উপর রেখে বললো,
— আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
পুলক মগটা তে চুমুক দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তৃপ্তির কথা শুনে নামিয়ে টেবিলের উপর রাখলো।
বেশ সহজ, স্বাভাবিক ভাবে এই কথাটা বললো মেয়েটা,, আচ্ছা মেয়েটা কি বিদেশী!! নাহ্, মেয়েটা বাঙালি। আচ্ছা বাঙালি মেয়েরা এভাবে নিজেদের বিয়ের কথা নিজের মুখে বলে, এতো বিনা দ্বিধায়, লজ্জা ছাড়া!!এই প্রথম সে দেখলো।
পুলক ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
— আমাকে বিয়ে করতে চান কেনো?
— অনন্যার প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে। একজন মানুষ কিভাবে এতো ভালোবাসতে পারে আরেকজন কে!! কে না চায় তার জীবনসঙ্গী তাকে এভাবে ভালোবাসুক। তাই আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
–কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না, আমি তো অনন্যাকে ভালোবাসি।
তৃপ্তি চোখমুখ উল্টে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“গুলি মারি তোর ভালোবাসারে, তোর ভালোবাসার দরকার নাই আমার। আমি তো শুধু তোর কষ্ট দেইখা বললাম।”
পুলক বললো,
— কিছু বললেন?
— নাহ্,, আপনার ভালোবাসতে হবে না। আর আমি কখনো আপনার ভালোবাসা চাইবোও না। আমি শুধু আপনাকে বিয়ে করতে চায়,, আপনার সুখে দুঃখে পাশে থাকার জন্য।
— আপনি কি বলছেন আপনি জানেন??
— হুম জানি। দেখি ডায়েরি টা দেন।
পুলক ডায়েরি টা এগিয়ে দিলো। তৃপ্তি ডায়েরি টা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। পুলক বিলটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু তৃপ্তি কে আর পেলো না। মেয়েটা বেশ স্পষ্টবাদী। অনন্যার কথা ভাবতেই ভাবতেই রিকশায় উঠে বসলো।
তিয়ান অফিসে বসে ডিভোর্স পেপার টাতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সে বুঝতেই পারছে না তার কি ভুল ছিলো! যখন অনন্যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো তখন অনন্যা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। অনন্যা তখন তাকে পুরো অবহেলা করেছিলো। সে বাধ্য হয়েছিলো পূন্যকে বিয়ে করতে, অনন্যা যখন তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো তাই সে আর কিছুই পূন্য কে বলে নি। আর যখন সে পূন্যকে নিয়ে সুখী,, তখন অনন্যা আবার ফিরে এলো! সে নাকি প্রেগন্যান্ট! তখন সে করে পূন্যকে ছেড়ে অনন্যার দিকে যেতো। তাহলে পূন্যকে কষ্ট দেওয়া হতো। তাকে ঠকানো হতো না। যে অতীত সে ধুয়ে মুছে নতুন জীবন নিয়ে বাঁচতে চাইলো তখন আবার তার অতীত ফিরে এলো,,সেই অতীত যে তাকে অবহেলায় ভরিয়ে দিয়েছিলো। তখন রাগের মাথায় তাকে ফিরিয়ে দিলেও পরে অবশ্য তার সন্তানের জন্য অনন্যার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলো। তাদের একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তার আগেই অনন্যা!!! কি করলো এটা!! আমি কোথায় চারজনের জীবন টা সুন্দর করে সাজাতে চাইলাম,, আর অনন্যা ছোট্ট একটা ভূল করে নিজে তো শেষ হলোই আর আমার সন্তান কেও। ডিভোর্স পেপার টা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। তারপর ছুড়ে ফেলে দিলো। সব সময় তার সাথেই কেনো এমন হয়!! সে চায় নি পূন্যর সাথে অন্যায় হোক, এটাই তার ভুল। যদি পূন্যকে ছেড়ে তখন অনন্যাকে মেনে তাহলেই মনে হয় ঠিক ছিলো। পূন্যর কথাতে এটাই বুঝেছে সে। টেবিলে একটা ঘুষি মারলো, টেবিলের উপরের গ্লাসটা ফেটে গেলো। তিয়ানের হাতও হালকা কেটে গেলো। সেদিকে কোনো খেয়াল তার নেই। অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো।
তিশা বাবার সামনে সোফায় বসে আছে।
তিশার বাবা নজরুল চৌধুরী, ব্যবসায়িক মানুষ। এই জায়গা সেই জায়গা ব্যবসার কাজে ঘুরতে থাকেন। বাসায় খুব কম সময়েই থাকেন। কাল তার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে বাসায় আসেন। সকালে কবর দিয়ে এলেন, তার স্ত্রীকে। কিন্তু এখন ঝামেলায় হয়ে গেছে,, মেয়েকে কোথায় রেখে যাবেন তিনি, কার ভরসায় রেখে যাবেন,, তাই ঠিক করলো,পনেরো -বিশ দিনের মধ্যে বিয়ে দিয়ে হাত পা ঝেড়ে ফেলবেন। নাহলে মেয়ে নিয়ে চিন্তায় থাকতে হবে।
তিনি তিশার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
— দেখো মা,, তোমার মা মারা গেছে,,ও এই সংসার টা এতো বছর চালিয়েছে। আমি তো সারা মাসে দুয়েকদিন বাদ দিয়ে তোমাদের সময়ই দিতে পারতাম না। আর এখনও দিতে পারবো না, এইদিক সেইদিক যেতেই হবে। তাই আমি চাইছিলাম তোমার বিয়ে দিয়ে দিতে। হাতে দুয়েকটা পাত্র ছিলো। তুমি যদি বলো তাহলে,,
তিশা সারারাত কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে রেখেছে। বাবার কথা শুনে চুপচাপ বসে রইলো।
অনেকক্ষণ পর বললো,
–বাবা,, আমাকে সপ্তাহ খানেক সময় দিবে!!
নজরুল সাহেব কিছু একটা ভেবে বললেন,,
— হ্যা, নাও সময় নাও।
তিশা উঠে রুমে চলে এলো। বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে। কাল তার মা মারা গেলো, আর আজ তার বিয়ের কথা! সে কি করবে? রুপন্ত তো এখনও চাকরি বাকরি কিছুই পায় নি!
আচ্ছা রাতে রূপন্তকে ফোন দিয়ে বলবে এই কথা!তাকে বলেই বা কি হবে?
চলবে,,,,,
#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#part_39
,
,
,
,
তিশা উঠে রুমে চলে এলো। বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে। কাল তার মা মারা গেলো, আর আজ তার বিয়ের কথা! সে কি করবে? রুপন্ত তো এখনও চাকরি বাকরি কিছুই পায় নি!
আচ্ছা রাতে রূপন্তকে ফোন দিয়ে বলবে এই কথা!তাকে বলেই বা কি হবে?
চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো তিশা। বাবার ডাকে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো। ঘুমের রেশটা একেবারে কেটে গেলো, হালকা একটু আতংক নিয়ে বললো,
— কিছু বলবে??
— হুম। একটা পাত্রর সংবাদ পেয়েছি। আমার চিনা পরিচিতই, ছেলে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছে। সপ্তাহ খানেক পর আসবে পান চিনি করে যাবে। তাদের যদি ইচ্ছা হয় তাহলে ঐ দিনেই নিয়ে যাবে।
আকাশ থেকে গুনে গুনে একশো টা বাজ তিশার মাথায় পড়লো। একটু আগেই তো তাকে এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। আর এখন এসে বলছে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে!
তিশা বললো,
— কিন্তু বাবা আমাকে তো এক সপ্তাহ সময় দিয়েছো।
— হুম,, দিয়েছি তো। বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে নাও। এক সপ্তাহ অনেকটা সময় বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।
নজরুল সাহেব বেরিয়ে গেলেন।তিশা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। কি করবে সে বুঝতে পারছে না। এক সপ্তাহ পর তার বিয়ে! এক সপ্তাহ পর,, কাল তার মা মারা গেছে। আর আজ তার বিয়ের কথা হয়ে গেলো। কিন্তু সে তো অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। রূপন্তকে ভালোবাসে আর তাকেই বিয়ে করবে। কিন্তু সেটা কি আর হবে!
পুলক তৃপ্তির কথাগুলো গভীরভাবে ভাবতে লাগলো, তার এমন শর্তেও মেয়েটা রাজি হয়ে গেলো।কিন্তু তার শর্তে রাজি হয়ে পুলক সুবিধা পেলেও তো তৃপ্তি কোনো সুবিধা পাবে না। তাহলে সে কেনো রাজি হলো? যাই হোক বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য বলা হচ্ছে, ভেবেছিলো অনন্যাকে রাজি করিয়ে তারপর বাড়িতে বিয়ের কথা বলবে, কিন্তু অনন্যা তো!! হুহ্,,
পুলক তৃপ্তির ঠিকানা, ফোন নাম্বার জোগাড় ফেলেছে। এই কাজে সে পটু হয়ে গেছে। অনন্যার সময় করেছিলো তো।যদি সে তৃপ্তিকে বিয়ে করে তাহলে শুধু একটাই কারণে করবে, আর সেটা হলো তৃপ্তি কোনোদিন তার কাছে অধিকার চাইবে না। কিন্তু এখুনি সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে যে তৃপ্তিকে বিয়ে করবে, না করবে না।
পূন্য ধীর গলায় তিয়ানকে বললো,
— কেনো এসেছো তুমি??
তিয়ান পূন্যর দুহাত ওর দুহাতের মুঠোয় নিলো। কতোদিন পর ও পূন্যকে স্পর্শ করছে, পূন্যর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। ধীর গলায় বললো,,
— শেষবারের জন্য এসেছি!! তুমি আমার সাথে যাবে নাকি জিজ্ঞেস করতে,, তুমি কি যাবে?
–না,,
— সব সময় কি এই উত্তর টাই থাকবে?আচ্ছা সত্যি করে একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে তুমি?
— কি প্রশ্ন??
— তুমি আমাকে কখনো ভালোবেসে ছিলে??
পূন্য তিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে, কেনো এসেছে তিয়ান? আগে কখনো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বললে খুব তাড়াতাড়ি তার উত্তর দিতে পারতো সে। কিন্তু আজ দিতে পারবে না। নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর বললো,
— অনেক রাত হয়ে গেছে, তোমার বাসায় যাও।
কথটা বলার সাথে সাথেই তিয়ান পূন্যকে টেনে ওর কাছে নিয়ে এলো,, তারপর দাঁতে দাঁত চেঁপে বললো,
— অবশ্যই যাবো। তোমার সাথে রাত কাটাতে আসি নি আমি। অবশ্য কাটালেই বা কি, তুমি তো এতোদিন শুধু তোমার শরীরের চাহিদা মিটিয়ে নিয়েছো। তাহলে আর একদিনও নাহয় মিটিয়েই নিলে,, আর বৈধ ভাবেই মিটাতে পারবে। কারন আমি তো এখনও তোমার স্বামী।
পূন্য এতক্ষন নিরবে সব শুনে নিলো। তিয়ান এইভাবে কথা বলছে তার সাথে! অবশ্য আর কিভাবেই বা কথা বলবে ও। ওর ভাষায় এরকম।
পূন্য চোখের পানিটা মুছে বললো,
— আমি শরীরের চাহিদা মিটিয়ে নিয়েছি,, নাহ্!!! আর তুমি!! আমি তোমার কাছে গিয়েছিলাম!! না তুমি আমার কাছে এসেছিলে? আমি সব সময় তোমার শিকার হয়েছি, তুমি আমাকে ভোগ করেছো,অনন্যাকে ভোগ করেছো, না জানি আরো কতোজনকে ভোগ করছে। ক্যারেক্টারলেস, একটা!!আ,,,,
কথাটা শেষ করার আগেই পূন্যর ঠোঁট লুফে নিলো। ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিতেই, পূন্য নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা,, তিয়ানের পিঠে নখ বসিয়ে দিলো, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিয়ানের কাছে ধরা দিলো। তিয়ানের মাথার ঘনচুলে হাত রাখলো।
পূন্য কোমরের উপর রাখা হাতটা দিয়ে পূন্য আরো একটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ভালোবাসায় পূর্ণ হলো কিছুটা সময়। রাগ অভিমান ভূলে কিছুক্ষণ বিভোর হয়ে রইলো তারা। তিয়ান পূন্যকে ছেড়ে দিলো,পূন্য হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় বসে পড়লো, চোখ থেকে একফোঁটা জল গাল হালকা স্পর্শ করে মেঝেতে পড়লো।
তিয়ান ঠান্ডা গলায় বললো,
— দেখলে তো,, এইভাবেই তুমি একদিন আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। এতক্ষণ তো ক্যারেক্টারলেস বলছিলে,, তাহলে কেনো ক্যারেক্টারলেসের কাছে এলে এখন?? আমি অপেক্ষায় থাকলাম।
তিয়ান বেরিয়ে গেলো। পূন্য ঘাড় ঘুরালো,,কিন্তু তিয়ানকে দেখতে পেলো না।সত্যিই সে এতক্ষণ তিয়ানের মধ্যে ডুবে ছিলো।
“রূপন্ত বাবা আমার বিয়ে ঠিক ফেলেছে।কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
রূপন্ত মেসেজটা পরার পর ঠান্ডা মাথায় ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লো। বালিশের পাশে মোবাইল টা রেখে মোবাইল টার দিকে তাকিয়ে রইলো। তিশার বিয়ে করে ফেলেছে, তিশার বাবা!! ওনি বড্ড বেরসিক। তার স্ত্রী মারা গেছে, কোথায় তার বিয়ে করা উচিত। কিন্তু তিনি কি করছে! তার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। লোকটা মনে হয় স্ত্রীর মৃত্যুতে পাগল হয়ে গেছে। যাক রাত কম হয় নি, কয়েকটা বড় বড় হাই তুলে চোখ বন্ধ করলো রূপন্ত। সাথে সাথেই মোবাইলটা বেজে উঠলো,, রূপন্ত চোখ বন্ধ রেখেই বুঝতে পারলো তিশা ফোন করেছে। কারন সারাদিন অপেক্ষা করে মরে গেলো মহা রানী কল দিবেন না। কিন্তু যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে ওমনি তিনি কল দিবেন। আজ আর তার ব্যাতিক্রম হয় কি করে? বন্ধ রেখেই মোবাইল টা কানে তুললো রূপন্ত,, ওপাশ থেকে তিশার গলা ভেসে আসলো। যাক তাকে আর জিজ্ঞেস করতে হলো না যে, ” কে বলছেন”
তিশা বললো,,
— রূপন্ত তুমি মেসেজটা দেখেছো?
— হুম, দেখেছি তো।
— তাহলে তুমি যে আমাকে কল দিলে না!! তোমার তো কল দেওয়া উচিত ছিলো। কেনো কল দিলে না?
— কি এমন বিষয় যার জন্য এখন কল দিতে হবে!! আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ন বিষয় মনে হয় নি এটা। তাই কল দেয় নি।
— রূপন্ত, এটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ন বিষয় মনে হয় নি??
— নাহ,,
— তুমি বোধহয় মেসেজ টা ভালো করে পরো নি,,ঠিক আছে আমি আবার বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনো, আমার বিয়ে…
রূপন্ত তিশাকে পুরো কথাটা বলতে দিলো না, সে বললো,
— আমি লেখাটা মনোযোগ দিয়েই পড়েছি, একটা ছোট্ট মেসেজ লিখেছো, একটা অক্ষর ও আমার চোখ এড়ায়নি। তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এটাই তো!!!
তিশা মোবাইলটা কানে ধরে বসে রইলো, রূপন্ত এতো ঠান্ডা গলায় কথা বলছে কেনো! তার মনে রূপন্তকে হারানোর যে ভয় ঢুকেছে, রূপন্তর মনে কি সে ভয়টা ঢুকে নি। আচ্ছা রূপন্ত এতোদিন তার সাথে মজা করে নি তো!!!
সে ভয় ভয় গলায় বললো,
— রূপন্ত, তুমি এভাবে কেনো কথা বলছো?
— কিভাবে কথা বললাম! দেখো তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এটা তো একটা স্বাভাবিক বিষয়, একটা মেয়ের বিয়ে সব সময় আগেই ঠিক হয়। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মেয়েদেরকে বাবা মা বেশি দিন পড়ালেখা করাতে চায় না, তাই তাদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়। তোমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আর ছেলেরা সব সময় দেরিতেই বিয়ে করে, কারণ তাদের চাকরি করে নিজের লাইফটা কে সাজাতেই অনেকটা সময় কেটে যায়।
— আচ্ছা তুমি কি একটু সিরিয়াস হতে পারো না!! সব বিষয়ে হেয়ালী করো কেনো?
— আমি তো সিরিয়াস ভাবেই কথা বলছিলাম কিন্তু তোমার কাছে মনে হলো..। আচ্ছা এখন সিরিয়াস ভাবেই কথা বলছি,, রাতে খাইছো??
— আমার এখন খাওয়ার সময় পড়ছে বলে মনে হয় তোমার!! দেখো তুমি সহজ ভাষায় বলো তুমি কি চাও??একদম হেয়ালী করবা না,,
— রাগ করলা নাকি!! আমরা কালকে দেখা করি কেমন! এখন কথা না বলি,, এখন তুমি রেগে আছো, তাই কথা না বলি কেমন,কাল আগের জায়গাটাতে চলে এসো। এখন খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট,,
— তোমার গুড নাইটের গুষ্ঠি…
বাকিটা বলার আগেই রূপন্ত ফোন কেটে দিলো। মোবাইল টা বিছানায় আছাড় মারলো। কেমন মানুষের প্রেমে পড়লো সে, তার বিয়ের খবর শুনে এমন একটা রিয়েক্ট করলো, যেনো তার পাড়াপ্রতিবেশি কোনো মেয়ের বিয়ে। রাগ হচ্ছে নিজের উপর,, এতো ঠান্ডা মেজাজে কেউ কথা বলতে পারে সে জানতো না।
সারাটা রাত তিশা ঘুমায় নি। কিন্তু ওদিকে রূপন্ত নিশ্চয়ই পরে পরে ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা কখন দেখা করবে তা তো বলে নি। তিশা রূপন্তর নাম্বার টা ডায়াল করলো।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো,
ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,,
— কে??
রূপন্তর ঘুম জড়ানো কন্ঠ স্বর শুনে তিশার রাগ উঠে গেলো, সত্যি সত্যিই সে ঘুমিয়েছিলো, এদিকে সে টেনশনে মরছে, আর ওনি ঘুমাচ্ছেন।
বেশ রাগি গলায় বললো,
— কখন ঘুমিয়েছিলে?
কন্ঠস্বর শুনে মোবাইলের নাম্বার টা দেখলো, তিশা কল দিয়েছে নাম্বার টা দেখে বুঝলো রূপন্ত। মৃদু হাসলো, হয়তো সারারাত ঘুমায় নি। সত্যি পাগলী একটা। মৃদু হেসে রূপন্ত বললো,
— রাতে,,সবাই তো রাতেই ঘুমায়। এতো সকালে তুমি কেনো কল দিলে??
— কারন আমার ঘুম আসছে না।
— আসবেই বা কি করে, বিয়ের আগে কোনো মেয়ের ঘুম আসে না।
— এই তুমি কি দিয়ে তৈরি??
— মাটি দিয়ে।
তিশা নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে নিলো। তারপর বললো,
— কখন দেখা করবে?
— বিকালে।
এবার তিশা লাইন কেটে দিলো। ওর সাথে কথা বলে মেজাজ চড়াতে চায় না সে।
সাড়ে তিনটা থেকে তিশা রূপন্তর অপেক্ষায় বসে আছে। নদীর ধারে,ঘাসের উপর বসে আছে। অনেকবার কলও দিয়েছে। কিন্তু রূপন্ত ফোন কেটে দিয়েছে।
কাঁটায় কাঁটায় চারটা বাজে রূপন্ত দুইটা আইসক্রিম নিয়ে তিশার সামনে ধরলো,, কারন তিশা এখন রেগে আছে। তাকে ঠান্ডা করার জন্যই আইসক্রিম নিয়ে আসা। তিশার পাশে বসে তিশার কাধ জড়িয়ে ধরলো।
তিশা রূপন্তর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
— তো কি ভাবলে??
— দুজনে বসে আইসক্রিম খাবো। কিছুক্ষন প্রেম করবো, তারপর তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিবো। তারপর বাসায় গিয়ে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো।
রূপন্ত তিশার হাতে একটা আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— খাও।এরকম দূরে বসে আছো কেনো? কাছে আসো!!
তিশা আইসক্রিম টা ছুড়ে ফেলে দিলো নদীতে।তারপর বললো,
— আচ্ছা তুমি কিছুতো বলো?? আমি এখন কি করবো ??
— দেখো তিশা,, সব সময় এতো রাগ করো কেনো?বিয়ে হওয়ার কথা চলছে, এখনো বিয়ে হয় নি। আর হাতে এক সপ্তাহ সময় আছে। এতো টেনশন করছো কেনো,যখন বিয়ে হবে তখন টেনশন করো। রিলাক্স মুডে থাকো না একটু,
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আইসক্রিমের প্যাকেটটা খুলে আইসক্রিমে একটা কামড় দিয়ে বললো,
— তোমার আইসক্রিম টা রাগ দেখিয়ে ফেলে দিলে??এখন!
তিশা এতক্ষণে একটু টেনশন মুক্ত হলো। রূপন্তর উপর কেনো যেনো একটু ভরসা এলো। পরক্ষনেই আবার কি ভেবে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। রূপন্ত তিশার হাতের উপর হাত রাখতেই তিশা রূপন্তর কাঁধে মাথা রাখলো।
রূপন্ত তিশার সামনে আইসক্রিম টা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— আচ্ছা,, আইসক্রিমের জন্য আর কান্না করতে হবে না। আমাকে বললেই আমি আমার আইসক্রিম টা দিয়ে দিতাম।
তিশা মাথা তুলে রূপন্ত কে কয়েকটা কিল মারলো, তারপর হাসলো। রূপন্ত অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তিশার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
— এতদিন কান্নাকাটির মধ্যে পার্লার যেতে একদম ভূলে গিয়েছিলে মনে হয়! আর মেকআপ বোধহয় করো নি, আসার সময়। কেমন কালো হয়ে গেছে চেহারা,, চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। তবে এই রূপেও তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
তিশা হাসলো। রূপন্তর হাত থেকে আইসক্রিম টা নিয়ে একটা কামড় দিলো।
চলবে,,,,
#গোধূলি_লগ্ন
,
,
#Writer_Tabassum_Tajnim
,
,
#Part_40
,
,
,
তিশা হাসলো। রূপন্তর হাত থেকে আইসক্রিম টা নিয়ে একটা কামড় দিলো।
একটা সপ্তাহ পর,,
রূপন্ত চুপচাপ নিবিড়ের সামনে বসে আছে। নিবিড় কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলো। তারপর বললো,
— কিভাবে করলি এটা তুই?? আমাদের মান সম্মান ডুবিয়ে দিলি। মেয়েটার বাড়ির লোকজন এসে কতো কথা শুনিয়ে গেছে,, বাড়িতে একটা চিৎকার চেচাঁমেচি,,,
রূপন্ত কিছুক্ষণ নিবিড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললো,
— আমার হাতে এতো সময় ছিলো না, আর যা করেছি তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। যাকে ভালোবাসতাম তাকে বিয়ে করে ফেলেছি। ভুলের কিছু তো দেখছি না। ও যদি পালিয়ে না আসতো, তাহলে ওর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যেতো।
— আব্বু আর মা তোকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না!
— আমিও যাবো না,, তিশাকে নিয়ে চলে যাবো।
— কোথায় যাবি! কার কাছে যাবি!!
— আছে একজন। আচ্ছা আমি উঠি তাহলে,, তিশা বাইরে অপেক্ষা করছে।
রূপন্ত হনহন করে বেরিয়ে গেলো নিবিড়ের কেবিন থেকে। বাইরে এসে তিশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তিশার হাত ধরে হাটতে লাগলো,, বাসায় উঠতে হবে।
নিবিড় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো,, রূপন্ত তিশাকে নিয়ে পালিয়েছে। বাড়ির সবাই অবাক হয়েছিলো, মা তো নাওয়া খাওয়া ছেড়ে আঁচলে মুখ চেঁপে কাঁদে, আর আব্বুর মুখ তো দেখায় যায় না, পাঁচ জনের পাঁচ কথা শুনে তার উঁচু মাথা নিচু হয়ে গেছে। তিনি তো দৃঢ় গলায় বলেই দিলেন, তিনি বেঁচে থাকতে রূপন্ত আর বাড়ি আসতে পারবে না। দুইদিন পর রূপন্ত তার কাছে এসে বললো সে তিশা নামে একজন কে বিয়ে করেছে, আর সিলেট চলে যাবে,, বেশ অবাক করা একটা বিষয়,, নিবিড় বিশ্বাসেই করতে পারছে। তার বার বার মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন ছিলো।
মোবাইল টা নিয়ে মিতুর নাম্বারের কল দিলো নিবিড়। মেয়েটা ইদানীং খাবার নিয়ে বড্ড বেশি অবহেলা করছে। আর তারই বা দোষ কি, ভাত মুখে তুলার আগেই বমি চলে আসে, মাঝে মাঝেই তলপেট ব্যাথা করে। যত দিন গড়াচ্ছে মেয়েটা ততই কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। আবার ডাক্তার দেখাতে হবে।
— হুম বলেন,,
মিতুর গলায় আওয়াজ শুনে নিবিড় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো। বললো,
— খেয়েছো??
— না,,খাবো মাকে সাথে নিয়ে।
— এখনো খাও নি,, অনেক বেলা হয়ে গেছে তো। প্রায় দুইটা বাজে,, তাড়াতাড়ি খাও।
— আচ্ছা
–আচ্ছা না,, এখুনি খেয়ে নাও।
— হুম।
মিতু লাইনটা কেটে দিয়ে মোবাইল টা বালিশের উপর রেখে শাশুড়ির রুমের দিকে ছুটলো। দুই দিন হলো পানি ছাড়া তিনি কিছুই দাতে কাটছেন না। পাড়া প্রতিবেশীরা এসেই রূপন্তর কথা জুড়ে দেয়, মজা নেয়। আর তারা চলে গেলেই মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদবে। মিতু কিছুতেই বুঝতে পারে না, রূপন্ত ভূল কি করেছে। সে যাকে ভালোবাসতো তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে, বিয়ে করেছে । এবার মেনে নিলেই তো হয়। মেয়ের বাবা বাড়িতে এসে চিল্লাচিল্লি করে গেলো। বাবা নির্দেশ দিয়ে দিলো রূপন্ত বাড়িতে আসতে পারবে না।
দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো মিতু। দিনের বেলাতে রুমটা অন্ধকার হয়ে আছে। জানালা গুলো বন্ধ করে রেখেছে। মিতু জানালা টা খুলে দিয়ে আয়েশা আক্তারের পাশে বসলো। তার চোখের পানি চোখের কোনায় জমে আছে।
আয়েশা আক্তার মিতুকে দেখে উঠে বসলো। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললো,
— কি হয়েছে?
— খেতে চলুন মা।
— আমার এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
— চলুন না,, আমিও খায় নি এখনো। আপনার জন্য বসে আছি।
— তুমি এখনো না খেয়ে আছো কেনো? যাও যাও খেয়ে নাও।
— আপনিও চলুন।
আয়েশা আক্তার বিছানা থেকে পা নামালেন। এই মেয়ের জন্য এখন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও খেতে যেতে হবে।
— আমি জানি না।
কথাটা বলে তৃপ্তি গাড়ির দরজা খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না।এই লোকটা তো মহা ঝামেলার ড্রপ দেওয়ার কথা বলে এখন বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতে দিচ্ছে না, আগে জানলে এর গাড়িতে উঠতো না।
তিয়ান ধীর গলায় বললো,
— পূন্য কোথায় বলে দিলেই তো হয়। তৃপ্তি তোমার বোন নাম্বার টাও পাল্টে ফেলেছে, এখন আবার কোথায় চলে গেছে?? প্লিজ আমাকে বলো ও কোথায় আছে।
তৃপ্তি তিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আপনাকে বলতে না করেছে যে,,আমি ওকে প্রমিজ করেছি বলবো না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তৃপ্তি আবার বললো,,
— আমি আপনাকে ওর নাম্বার টা দিয়ে যাচ্ছি।আর ও কোথায় গেছে তা না জানলেও হবে। কয়েকদিন পর ও আবার এখানে চলে আসবে। আবেদন করবে এইখানে আসার জন্য।
তিয়ান তৃপ্তির দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
— আবেদন করেছে মানে!! পূন্য কি জব করছে?
তৃপ্তি মাথা চুলকাতে লাগলো। বিড় বিড় করে বললো,”যখন বকবক করতে থাকিস, তখন সব বলে দিস।” তারপর বললো,
— ঐ হ্যা,, বুবুন, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলো। তো হয়ে গেছে,, কোনো টাকা ছাড়াই। সিলেটের কোনো একটা স্কুলে জয়েন করেছে। এবার তো লকটা খুলে দিন!!
–বাহ্ বা,, বিয়ে তো করেছি একটা ব্রিলিয়ান্ট মেয়েকে। সব কিছুই বুঝতে পারে, কিন্তু আমাকেই বুঝতে পারে না।
তিয়ান লক টা খুলে দিতেই তৃপ্তি গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।তারপর হেসে বললো,
— ওর নাম্বার নিয়ে লাভ হবে না। কারন ও আপনার কল ধরবে না।
কথাটা বলেই একটা দৌড় দিলো। তিয়ান পিছু ডাকলো,, কিন্তু শুনলো না। স্কুলের নাম বলে যায় নি,, আর নাম্বার টাও দিয়ে যায় নি। তাহলে খুজবে কিভাবে!! সিলেট তো ছোট খাটো একটা গলি নয় যে খুঁজে বের করে নিবে।
কিছুক্ষণ পর তৃপ্তি আবার আসলো। হাতে একটা কাগজ নিয়ে,,এতে পূন্যর নাম্বার আর ঠিকানাটা বেশ সুন্দর করেই লিখা। তিয়ানের হাতে ধরিয়ে বললো,
— ভাইয়া, নাম্বার আর ঠিকানাটা দিলাম। ভুল বুঝাবুঝি টা মিটিয়ে নিন। অনন্যার ডায়েরি টা আমিও পড়েছি। আপনার কিছু দোষ আছে, কিন্তু… জানি না আমার বোনকে আপনি ফিরিয়ে আনতে পারবেন কি না। তবে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে সে ফিরে আসবে আপনার কাছে। আসছি,,
তিয়ান হাসলো,একটা তৃপ্তির হাসি হাসলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো।
স্কুলে একটা ক্লাস নিয়ে পূন্য মোবাইল টা হাতে নিতেই দেখলো,, what’s app ভিডিও পাঠিয়েছে। মিতু ভিডিও পাঠিয়েছে!! পাগলি টা আবার কি পাঠালো!!
ভিডিও টা ওপেন করলো। ভিডিওটা দেখার পর কিছুক্ষন হাসলো। বাহ্,,এই বাচ্চা মেয়েটার বাচ্চা হবে ভেবেই হাসি পাচ্ছে। ও তো নিজেকেই সামলাতে পারে না। আবার বাচ্চাকে কি সামলাবে!! তবে লাস্ট কথাটা শুনে পূন্যর মনটা কেমন করে উঠলো,,
“জানো তো,, আমি না অনেক অসুস্থ হয়ে গেছি।”
পূন্য মিতুকে একটা কল দিলো।
— পূন্য আপু কেমন আছো??
মিতুর ফোন ধরার পর খুশি, হাসি মিশ্রিত এই কন্ঠ টা পূন্যর খুব ভালো লাগে। বাচ্চা টাইপের কন্ঠ আসে তখন। পূন্য হেসে বললো,
— ভালো। তুই?
— হুহ,, ভালো না। একবার ও তো খোঁজ নাও না তুমি!!
— ঝামেলার মধ্যে থাকি তো, তাই আর কি!!
— বুঝছি বুঝছি,, তিয়ান ভাইয়া কেমন আছে?
— ভালো।
— আচ্ছা আপু একটা ডিল করবে!!!
— ডিল!!! কি নিয়ে আর কেনো?
— আগে বলো তুমি রাজি কি না?? না হলে বলবো না,,
— আচ্ছা ঠিক আছে, রাজি। এখন বল!
— নাহ পড়ে বলবো। একটা কথা জানো আপু,, রূপন্ত তিশাকে বিয়ে করেছে। তিশার মা মারা যাওয়ার পর ওর বাবা ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই রূপন্ত নিয়ে পালিয়েছে।
পূন্য মিতুর কথাটা শুনার পর ফোনটা কেটে দিলো। কিছুক্ষণ চেয়ারটায় চুপ করে বসে রইলো। তিশার মা মারা গেছে। হুম মারা গেছে তাতে তার কি!! সে কেনো কল কেটে দিলো! একটু খারাপ লাগছে মহিলাটার জন্য! কিন্তু কেনো খারাপ লাগছে!! পূন্য ভাবতে লাগলো,, কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো ওহ,,সে তার জন্মদাত্রী মা। এই টুকু খারাপ লাগা প্রাপ্য, এর বেশি মানে এক ফোটা চোখের জলও তার প্রাপ্য নয়। সে তো তাকে জন্ম দিয়েই চলে গেছে,,তার কথা একবারও ভাবে নি। শুধু জন্ম দিয়েই মা হওয়া যায় না। আবার অনেক সময় জন্ম না দিয়েই মা হওয়া যায়। পূন্য উঠে দাড়ালো, তাকে ক্লাসে যেতে হবে তো। প্রথমে এখান থেকে যাওয়ার জন্য আবেদন করলেও এখন মনে হচ্ছে এই জায়গাটায় ওর জন্য ভালো হবে। এখানেই থেকে যাবে সে। ক্লাসে ঢুকার আগেই আবার ফোন টা বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে ভেসে থাকা নাম্বার টা দেখে একরাশ বিরক্তি চোখে মুখে ফুটে উঠলো। কালকে রাত থেকে তিয়ান কল দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না নাম্বার টা পেলো কোথায়! মোবাইল টা সাইলেন্ট করে ক্লাসে ঢুকে গেলো।
তিয়ান রাগের মাথায় মোবাইল টা ফ্লোরে ছোড়ে মারলো। পর মূহুর্তেই আবার তুলে নিলো,, কিন্তু মোবাইলের টাচ টা ফেটে গেছে,, ডিসপ্লে ও চলে গেছে। পুরো অকেজো হয়ে গেছে,, এটা দিয়ে আর কোনো কাজ হবে না। আবার ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। পূন্যর উপর মারাত্মক রাগ হচ্ছে, ইচ্ছে করছে ওর গালে দুটো চড় মারতে। কিন্তু কোনোদিন ও পূন্যর গায়ে হাত তুলতে পারবে না সে,,তার চেয়ে বরং এই রাগটা মোবাইলের উপর দিয়েই চলে যাক। ঢকঢক করে পুরো এক বোতল পানি খেয়ে নিলো। শার্টের বোতাম গুলো খুলে শার্ট টা সোফার উপরে ছুড়ে ফেলে দিলো। ফ্যান টা ফুল স্পিডে মাথার উপরে ঘুরছে, তারপরেও এসি টা চালিয়ে দিলো। বিছানায় বসে পড়লো,, তিয়ান আর পূন্যকে ফিরিয়ে আনতে যাবে না, তাকে ফিরে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করবে না, বারবার তার অবহেলায় অবহেলিত হতে চায় না সে, এই কথা গুলো তিয়ান পূন্য চলে যাওয়ার পর অনেকবার বলেছে। কিন্তু কখনোই সে এই কথাগুলোর ভিতরে বন্দী থাকতে পারে না। কিন্তু পূন্য ঠিকি “না” শব্দটার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে।
ঘন্টা খানেক বসে থাকার তিয়ান উঠে দাড়ালো। রাগটা একেবারে কমে গেছে। একটু আগে পূন্যর উপর যে রাগ গুলো জমা হয়েছিলো এখন তা ভালোবাসায় বদলে গেছে। ড্রয়ারটা থেকে আরেকটা মোবাইল সেট বের করলো। ফ্লোরে পরে থাকা মোবাইল টা হাতে নিলো,, সিম কার্ডটা খুলে নতুন টা তে লাগিয়ে নিলো। শার্টটা তুলে আবার গায়ে দিলো, বেরুতে হবে তাকে। অফিসে যেতে হবে, ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া ডিভোর্স পেপার টা আনতে হবে। কিন্তু না পেলে!!
দু পা বাড়ানোর সাথে সাথেই মোবাইলটা বেজে উঠলো,,
স্ক্রিনটার দিকে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো বুঝতে পারলো না, তাকে পূন্য কল দিয়েছে!! ১৬২ বার কল দেওয়ার পর সে কল দিলো!!! বুঝে উঠার আগেই কল টা কেটে গেলো!
চলবে,,,,