তুমি বললে আজ – পর্ব ৬

0
668

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৬

.
বুকের টিপটিপ শব্দটা সমান তালে ছুটাছুটি করতে লাগলো আমার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে গলা শুকিয়ে গেল একদম। এই মানুষটা এখানে কি করে? এখানে তো ফুপির আসার কথা। ফুপির জায়গায় উনি কিভাবে আসলেন? তাহলে কি উনি আসবেন জন্যই কি ফুপিকে দিয়ে দরজা খুলতে বললেন? আর আমি ফুপি ভেবে উনার কথা উনাকেই বলছিলাম? এখন আমার কি হবে? কে বাঁচাবে আমাকে?
তাসফি ভাইয়া আমার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু সেই চোখে রাগ জমিয়ে আছে কি না? তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,

“আআপনি?? এএ..এখানে?”

আমার কথা শুনে চোখ সড়িয়ে নিলো উনি। এদিক-ওদিক বার কয়েক তাকিয়ে ছুটে আসলেন আমার দিকে, ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে আঁটকে গেলাম। তাসফি ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন, কিন্তু চেষ্টা করেও পিছিয়ে যেতে পারলাম না আমি। খাটের সাথে আঁটকে গেল আমার পা দু’টো। সাথে বুকের ধুকধুক শব্দটাও ক্রমশ্য বাড়তে লাগলো।
অতি নিকটে এসে আমার দিকে গভীরভাবে তাকালেন তাসফি ভাই। উনার গম্ভীর চাহনি বুঝতে পারলোও রাগের মাত্রাটা ঠিক কতখানি ধরতে পারলাম না। উনার এই চাহনিতে স্থির ভাবে তাকাতে পারলাম না উনার দিকে। অস্থির চোখে ছুড়ে ছুড়ে দেখতে থাকলাম শুধু। তাসফি ভাইয়া জোরে দু’বার শ্বাস নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,

“শরীর দেখিয়ে বেড়ানোর খুব রং লেগেছে মনে, তাই না? বেয়াদব! খুব বড় হয়েছিস সেটাই বুঝতে চাচ্ছিস সবাইকে দেখিয়ে?”

অবাক হলাম আমি। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনার কথার মানে বোঝার জন্য নিজের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলাম। ধপ করে বিছানায় বসে পরলাম, হাতের কাছের তোয়ালেটা পেতেই সেটা নিয়ে জড়িয়ে নিলাম নিজেকে। কাঁপুনি থামলো না বরং তার মাত্রা কিছুটা বেড়ে গেল। উনার সামনে এতক্ষণ এভাবে ছিলাম? ভেবেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার। কি করবো আমি এখন? বারবার কেন এই মানুষটার সামনেই কেন আমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়? নিচে লেহেঙ্গা পার্টটা পড়ে থাকলেও হাত কাটা সেমিস পরে ওড়না বিহিন উনার সামনে ছিলাম, মনে হতেই ভীষণ রকমের কান্না পাচ্ছে আমার। ওড়না জড়িয়ে এই কয়েকবার দরজা খুলে দিলেও এবার ফুপির গলা শুনে ওড়না নেবার প্রয়োজন মনে করি নি। কিন্তু ফুপির জায়গায় যে তাসফি ভাই চলে আসবে সেটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত।
লজ্জায় হোক বা ভয়ে তাকাতে পারলাম না উনার দিকে। সাহসটা কিছুতেই জোগাতে পারলাম না। দু-হাত দিয়ে তোয়ালেটা জড়িয়ে বসে রইলাম বিছানায়। নিচ দিকে তাকিয়ে শুধু উনার হাঁটু থেকে নিচ পর্যন্তই দেখতে পাচ্ছি। আমাকে চুপ করে এভাবে বসে থাকতে দেখে, একই ভঙ্গিতে বললেন,

“বিয়ে বাড়িতে এভাবে দরজা খোলার সাহস কি ভাবে আসে? বেয়াদব! আমার জায়গায় যদি ওরা আসতো? ফাজলামির জায়গা পাস না?”

“আআমি ভ..ভাবছিলাম ফুফ..ফুপি….”

কাঁপা কাঁপা গলায় আটকে আটকে বললাম কথাগুলো। কিন্তু তাকানোর সাহস হলো না উনার দিকে। ভয় আর লজ্জায় যেন জড়িয়ে যাচ্ছি বারংবার। এবার উনার গম্ভীর গলার বলে উঠলেন,

“দরজা খুলে সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে সেটা অন্তত দেখা উচিত। খেয়ে খেয়ে মামার টাকা পয়শা শুধু ধ্বংস করেই যাচ্ছিস, এক বিন্দু বুদ্ধিও মাথায় ঢুকাতে পারিস নি আজ পর্যন্ত।”

আস্তে করে চোখ দুটো তুলে তাকালাম উনার দিকে। উনি শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমাকে তাকাতে দেখে উনার গম্ভীর গলাটা শান্ত করে আবারও বললেন,

“চুলগুলো ভালোভাবে মুছে রেডি হয়ে নে। কেউ ডাকলেও আর দরজাটা খুলবি না। তোর অতি প্রিয় ফুপি ডাকলেও না। একদম ফুল ফিল রেডি হয়েই দরজা খুলবি, মনে থাকে যেন। আমি যাচ্ছি দরজাটা আঁটকে দে।”

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই আর দাঁড়ালেন না উনি। পিছন ফিরে বেড়িয়ে যেতে লাগলেন। উনার শেষ ধাপটা দরজার বাহির পড়তেই দৌড়ে গিয়ে বেশ শব্দ করেই দরজাটা আটকে দিলাম। দরজার সাথেই হেলান দিয়ে বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। এতক্ষণ মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো আমার। এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। উনার কথা অনুযায়ী দরজা খুলে একটাবার অন্তত দেখা উচিত ছিলো বাহিরে কে। সত্যিই যদি তাসফি ভাইয়ের জায়গায় বাহিরের কেউ থাকতে, তাহলে কি অবস্থা হতো আমার? কিন্তু উনার সামনেই এভাবে ছিলাম, কথাটা মনে পরতেই বুকটা আরও জোরে ধুকধুক শব্দ করে উঠছে। এবার আর কিছুতেই দরজা খুলবো না আমি। একদমই না।
বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ তাসফি ভাইয়া গলা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। দরজার বাহিরে কারো সাথে কথা বলছেন।

“তোমরা বরং রিমির রুমেই বসো। ওর রুমটা মনে হয় এখন ফাঁকা আছে। রিমিরা এখনি চলে আসবে, ততক্ষণ ওর রুমেই বসো।”

“আমাদের নিয়ে এতে উত্তেজিত হতে হবে না ভাইয়া। বিয়ে বাড়িতে কি রুমে বসে থাকা যায়? তার মধ্যে বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা। আন্টি শুধু শুধুই এত চিন্তা করছে।”

“তা বললে কি হয়? তোমরা তো প্রথম বার আসলে বাসায়। মামী তো সময় দিতে পারছে না তাই আম্মু এদিকটা সামলাচ্ছে। ওই রুমটাই রিমির, তোমরা চলো আমি আসছি।”

এরপরই শুনতে পেলাম কিছু ছেলেমেয়ের গলা। আর তাসফি ভাইয়ার কথায় যতটুকু বুঝলাম উনারা রিমি আপুর বন্ধু মহল। কালকে গায়ে হলুদে আপুর কাছের কয়েকটা বান্ধবী এসেছে, বাকীগুলো আজকে। তাদের মাঝে ছেলেমেয়ে সবাই আছে। তাসফি ভাইয়া আবারও বললেন,

“তুমি কি ভুলে গেছো আম্মু, তোমার এই ভাস্তি আস্ত একটা মাথামোটা। মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই তার, ওর রুমেই কেন ওদের নিয়ে আসতে হবে তোমার?”

“ভাবলাম ওর রুমটা ফাঁকা আছে তাই।”

“তোমার আর এতকিছু ভাবতে হবে না। ফুপি ভাস্তি দুজনেই এক তোমরা। এতটুকু বুদ্ধি সুদ্ধি মাথায় নেই তোমাদের। সব জ্বালা তো এখন আব্বু আর আমাকেই সামলাতে হবে। চলো এখন! মামা যে তোমাদের কিভাবে সহ্য করেছে? এখন তো…..”

আর শুনতে পেলাম না উনার কথা। ফুপিকে নিয়ে হয়তো চলে গেছেন। যতটুকু বুঝতে পারলাম, আমাকে দরজা খুলতে বলে রিমি আপুর বন্ধু মহলের সবাইকে নিয়ে ফুপি আমার রুমেই আসছিলেন। সবকিছু ঠিক আছে কি না, সেটা দেখার জন্যই তাসফি ভাইয়া ফুপির আগেই রুমে চলে এসেছিলেন। আর এসেই আমাকে এ অবস্থায় দেখেন। ভাগ্যিস তাসফি ভাই এসেছিলেন, উনার আগেই যদি রিমি আপুর ছেলে বন্ধুরা চলে আসতো? উফ্! ভয়ংকর একটা পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।
নিজের এহেন বোকামির জন্য এখন হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিলাম উনাকে, কিন্তু ফুপিকে এভাবে বলায় আমার অনেক খারাপ লাগছে। ফুপিকে সহ আমাকেও অপমান করলেন। আসলেই উনি আস্ত একটা বজ্জাত লোক। একদম ভালো হবে না উনার। অসহ্যকর বজ্জাত একটা মানুষ। মনে মনে উনাকে বকতে বকতে রেডি হতে শুরু করলাম।

.
রিফাপু ওড়নার এক কোণা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি রিফাপুর পাশে, সাথে পুরো কাজিন দলের সাথে। আর মাঝে মাঝে সবার সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছি। আমি কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির হলেও সেটা কেবল পরিচিত মানুষের কাছেই প্রকাশ পায়। কেন জানি অপরিচিত মানুষের সামনে একদম চুপচাপ শান্ত মেয়ে হয়ে যাই। কিন্তু পরিচিত হবার পর আমার বকবকানিটা যেন আর থেমে থাকে না। এখন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবগুলোই অপরিচিত মুখ, তাই রিফাপু ওড়নার কোণা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে লাল ফিতা দিয়ে লম্বা ভাবে আঁটকে দেওয়া। তার নিচে একটা ছোট টেবিলে কয়েক প্রকার মিষ্টি সহ বিভিন্ন রকমের শরবত রাখা। একটা গ্লাসে ট্যাং দিয়ে শরবত করা থাকলেও বাকিগুলো তে বিভিন্ন কিছু মেশানো আছে।

গেইট আঁটকে টাকা নিয়েই কথা কাটাকাটি হচ্ছে দুই পক্ষের মাঝে। আমাদের দাবি বিশ হাজারের নিচে কিছুতেই গেট ছাড়বো না, আর ছেলে পক্ষ কিছুতেই দিতে রাজী হয়। কেউ কারোর চেয়ে কম না, দুই পক্ষই সমান তালে কথা কাটাকাটি করে চলছে। এর মাঝে তাসফি ভাইয়া উদয় হলেন আমাদের মাঝে। এতে আরও হৈহৈ করে উঠলো আমার পুরো কাজিন দল। সোজা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে একবার চোখ বুলিয়ে সামনে তাকালেন। তাসফি ভাই আসার পর ছেলে পক্ষের কয়েকটা মেয়ে যেন গিলে খাচ্ছে উনাকে। বারবার উনার দিকে তাকাচ্ছে আর ফিস ফিস করে কিছু বলে যাচ্ছে নিজেদের মাঝে। কথাগুলো শুনতে না পারলেও ঠিকই বুঝতে পারলাম আপু গুলো বড়সড় রকমের ক্রাশ খেয়েছে উনার উপর। মেয়েগুলোর আর দোষটা কোথায়? কালো পাঞ্জাবি পরে এমন এমন লুকে আসলে তো যেকোনো মেয়েরই প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার কথা। কিন্তু উনার সেই বিখ্যাত একটা ধমক খাওয়ার পর যে এই আপু গুলোর আর কিছু খাওয়ার জোঁ থাকবে না সেটা নিশ্চিত আমি। কথাটা ভেবেই যেন প্রচন্ড মায়া হলো আপু গুলোর প্রতি।

প্রায় বিশ মিনিট পর কথা কাটাকাটি থেমে গেল। দুই পক্ষের মার্জিতে বারো হাজার টাকায় রাজী হয়ে গেল সবাই। আমরা ভেবে নিলাম বাকী টাকা বরের জুতো চুড়ি করে উসুল করে নিবো। রিফাপু নতুন জামাইকে মিষ্টি খাওয়াতে লাগলো। হঠাৎ তাসফি ভাই আমার হাত ধরে মাথাটা নিচু করে বললেন,

“এগুলো হয়ে গেলে বেশি ঘোরাঘুরি করবি না, চুপচাপ রিফার সাথে সাথে থাকবি। একদম যেন এই ছেলেগুলোর সামনে তোকে না দেখি। মনে থাকে যেন কথাগুলো।”

কিছু না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম উনার কথার। আগে বা পরে কিছু বলে লাভ হবে না আমার। তাই চুপচাপ উনার কথা মেনে নেওয়ায় বরং ভালো। এমনিতেই দুপুরের সেই ঘটনার পর একদম চুপ হয়ে আছি। অদ্ভুত এক পরিস্থিতির সম্মুখীনে পরেছিলাম, ভাগ্যিস রিমি আপুর বন্ধুদের সামনে ওমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় নি। কিন্তু তাসফি ভাইয়ের সামনে ওভাবে ছিলাম ভেবেই কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে। সামনে তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়েগুলো আমার দিকে কেমন করে যানি তাকিয়ে আছে। তেমন একটা পাত্তা দিলাম না। রিফাপুর হাত ধরে বোনরা মিলে চলে আসলাম। আর তাসফি ভাইয়া সহ ভাইরা নতুন দুলাভাইকে নিয়ে চলে গেল আপ্যায়ন করতে।

বিয়ে পড়ানো শেষে সবাইকে খাবার দেওয়া হয়েছে। রিফাপু সহ বাকীরা গেছে নতুন দুলাভাইয়ের হাত ধোয়াতে। ভাইয়ার এতগুলো ছেলে বন্ধু থাকার কারণে আপুদের সাথে না গিয়ে চুপচাপ বসে আছি টেজের একপাশে। হাতে থাকা মোবাইল ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগলাম। হঠাৎ করে কেউ আমার হাতটা ধরতেই চমকে উঠলাম।

.
.
(চলবে…..)

কয়েক দিনের গ্যাপ দিয়ে আজকে লেখায় কেমন যেন খাপছাড়া মনে হচ্ছে। আজকের পর্বটা ভালোভাবে তুলে ধরতে পারি নি হয়তো। আগামী পর্ব থেকে পুষিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ। 🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here