তুমি আমার -পর্ব ৯

0
400

#তুমি_আমার
#পর্ব_০৯
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

রং বেরঙের বাতি আর কালারিং কাপড় দিয়ে সেজেছে খান বাড়ির পুরো ছাদ।আবিদ পরেছে মেরুন রঙের পাঞ্জাবী।আরু রিয়া আর আয়েশা পরেছে কচু পাতা রঙের শাড়ি।সবাইকে বেশ লাগছে আজ।সিরাত গাপটি মেরে এক কোণে বসে আছে।সকলে আবিদ কে রঙ মাখাচ্ছে এগুলো দেখছে।সিরাতের পাশ ঘেঁষে এসে বসলো আয়ান।চোখ নাচিয়ে বলল,

-‘কি মনু মন খারাপ’?সিরাত মাথা ঝাকিয়ে না জানালো।মৃদু হেসে বলল,’তাহলে শরীর খারাপ।লাগছে’?এবারও না জানালো সে।’তাহলে বফ ছ্যাঁকা দিছে নাকি তোরও বিয়ের শখ জেগেছে’?কথাটা শোনে চোখ গরম করে তাকালো সিরাত।আয়ান বএিশ পাটি দাঁত বের করে বললো,

-‘রাগ করছিস কেন মজা করছিলাম।তুই সবকিছুতে না বলছিস তাই’।ওর কথার পিঠে কোনোকথা বলতে ইচ্ছে করলো না তার।আজ চুপ থাকতে বড্ড ভালো লাগছে।আবেশ ক্যামেরা হাতে সকলের ছবি তুলতে ব্যস্ত।সিরাত মাঝেমধ্যে ওকে আড়চোখে দেখছে।আরু আর আয়েশা সেল্ফি তুলছে মনের সুখে।কিছুক্ষণ পর পর এসে সিরাতের খবর নিচ্ছে।সকলে হলুদ নিয়ে মাতামাতি করছে।একে অপরকে রাঙিয়ে দিচ্ছে।আবেশ সেগুলো দেখছে আর সুন্দর মূহুর্ত গুলোর ক্যামেরা বন্দি করছে।সিরাতের এখন খুব বিচ্ছিরি একটা ইচ্ছে জেগেছে মনে।এই মুহূর্তে আবেশকে হলুদের মধ্যে চুবিয়ে মারতে।তাহলে হয়তো মনের রাগ কিছুটা কমতো তার।

একগাদা হলুদ নিয়ে সিরাতের সামনে দাঁড়ালো রিয়া।সেগুলো দেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো সিরাত।ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বলল,

-‘দোস্ত ল্যাংড়া হয়ে বসে আছিস বলে কি ভেবেছিস তোকে কেউ হলুদ দেবে না।তোর তো আফসোস হয় নাকি।একদম ভাবিস না দোস্ত আমি থাকতে তোর কোনো আফসোস থাকতে দিবো না’।সকলে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে রিয়ার দিকে আর হাসছে।তখনই কোথা থেকে ঝড়ের বেগে এসে রিয়ার হাত চেপে ধরলো সিয়াম।সিয়ামকে দেখে রেগে গেলো রিয়া।রেগে কর্কশ কন্ঠে বলে,

-‘আপনার সাহস তো কম নয় আপনি কোন সাহসে আমার হাত ধরেছেন?ছ্যাঁচড়া কোথাকার এখানেও আমাকে ফলো করতে করতে চলে এসেছেন’?হাত মোচড়াতে মোচড়াতে সিয়াম বলল,

-‘সাহসটা বরাবরই আমারর বেশি।তোমার মত ঝগড়ুটে কে ফলো করবো আমি।এ্যাহ আমার এখনও এত খারাপ দিন আসে নি।তুমি ওকে হলুদ দিতে পারবে না’।

-‘ফালতু কথা না বকে আমার হাত ছাড়ুন।আমার বন্ধুকে আমি হলুদ লাগাব তাতে বাধা দেওয়ার আপনি কে’?পাশ থেকে সিরাত বলল,

-‘রিয়া তুই ভুল বুঝছিস আমার কথাটা শোন।ঝগড়া করিস না।উনি হ….সিরাতকে থামিয়ে বলল ‘তুই থাম আমাকে কথা বলতে দে’!

-‘অনেককিছু।কিছুতেই ওর গায়ে হলুদ দিতে পারবে না তুমি’!একটু চেঁচিয়ে রিয়া বলল, ‘কিহ্!কেন’?

-‘কারণ আমি চাই না ওর তাড়াতাড়ি বিয়ে হোক।আমি শুনেছি বিয়ের হলুদ আবিয়াওা মেয়ের উপর লাগলে তার তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায়’।

-‘ওর বিয়ে হলে আপনার কি’?মৃদু হেসে ওর হাত ছেড়ে সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলল,’অনেক কিছু।কারণ ওটা আমার কলিজার টুকরো আর আমার কলিজা আমাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাক আমি চাই না’।

ওদের কথা শুনে সকলে হতভম্ব।আবেশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে।বন্ধুর সাথে তাঁর ছাএী ঝগড়া করছে বেশ দারুন।কিন্তু রিয়া কি ওকে চেনে না নাকি?সিরাত কি বলবে কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।আবার রিয়া বলার সুযোগও দিচ্ছে না।আবেশ একটু কাছে গিয়ে বলল,

-‘কি হয়েছে রিয়া’?রিয়া অভিযোগের সুরে বলল,

-‘দেখুন না স্যার এই লোকটা সেদিন রাস্তায় আমার সাথে অসভ্যতামি করেছে তারপর জুয়েলারি শপে ইচ্ছে করে আমার জিনিস নিয়ে নিয়েছে আর এখন তো দেখলেনই’।

-‘সিয়াম এটা কিন্তু তুই ঠিক করছিস না।তুই আমার ছাএীকে ইভটিজিং করছিস।রাস্তায় শপিংমল আবার এখানেও ছি ছি’।বলে মুখ চেপে হাসছে আবেশ।সিয়াম ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,

-‘তুইও মজা নিচ্ছিস শালা।বোনটা ত খাঁটি হারামি এখন দেখছি তুই তার থেকেও বড় হারামি’।বলে ওখান থেকে চলে গেলো।এখানে থাকলে ওর মান সম্মান আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।তাছাড়া আজ বোনের উপরও খুব রাগ লাগছে তাঁর।ভাইয়া ভাইয়া কয়েকবার পেছন ডেকেও কোনো লাভ হলো না সিরাতের।এখন নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।কেন সেদিন এরকম করেছিল কে জানে।সকলেই বিষয়টা জানার জন্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তারপর সিরাত রিয়াকে পুরোটা খুলে বলায় সকলের কাছে বিষয়টা ক্লিয়ার।রিয়া নিজের কাছে নিজেই এখন লজ্জিত।সিরাতের সবকয়টা বান্ধবী কত সম্মান করে তাকে আর সে কিনা না জেনে কত কি উপাধি দিয়ে বসে আছে।আবেশ টিটকারির সুরে বলল,

-‘কারও বোনও এমন দুশমন হয় জানা ছিল না তো!এই তোমাকে দেখে নতুন নতুন অনেক কিছু জানতে পারছি’।

ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে সিরাত।আকাশের উজ্জ্বল তারার মাঝখানে ওই তালার মত চাঁদটাকে দেখছে।কি আকর্ষণীয় আর মায়াবী লাগছে।এই দৃশ্য দেখাতেই মগ্ন সে।এখন বরের হাতে মেহেদী দেওয়া হচ্ছে।সকলে বিজি ও মেহেদী দেবে না বলে এক রকম পণ করে বসে আছে।কেউ জোর করেও ওর সাথে পারে নি।তবে আরু বলে গেছে ঘুমের মধ্যে হলেও ওকে মেহেদী পরিয়ে ছাড়বে ও।আবেশ ওকে এক পাশে দাঁড়াতে দেখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? পায়ে ব্যাথা করছে না’?আবেশের দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সিরাত মনে মনে বলল,

-‘মনের ব্যাথায় দিন রাত কাতরাতে থাকি সেটা চোখে পরে না আর এখন এসেছেন পায়ের ব্যাথার খবর নিতে’।

-‘কি হলো কিছু বললে না ত’?মৃদু হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ মনে বলল,

-‘গতকাল আমাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ।আমার জন্য আপনার এই অবস্থায় পরতে হলো।অহেতুক ঝামেলায় পরে শুধু শুধু নিজের ক্ষতি করলেন এতটা রিস্ক না নিলেও পারতেন।পুলিশ ছিল তারা খুঁজে পেলে পেত নাহলে…. চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্ত মনে হতেই সাড়া শরীর কেঁপে উঠলো ওর।শুকনো গলা ভিজিয়ে আবার বলল,’তখন ভয়ে আমি কি করেছি নিজেই জানি না।হয়তো এমন অনেককিছুই ঘটেছে যেগুলো করা উচিৎ হয় নি।কি করবো বলুন তখন আমার কাছে ভাল মন্দের হিতাহিত জ্ঞান ছিলো না।আমি হেল্পলেস ছিলাম।সরি!সবকিছুর জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন’।আবেশ গম্ভীর মুখে পুরো কথা মনযোগ দিয়ে শুনলো।ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

-‘ওসবের জন্য তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে না।সেটা আমিও জানি তোমার ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল না।জেনে বুঝে করো নি।পরিস্থিতি টাই ভয়াবহ ছিল।আর কি বললে পুলিশ!নইলে যা হওয়ার হতো।কথাটা দারুন এটাই তোমার কাছ থেকে আশা করা যায়।এজন্যই তোমাকে সবাই ছোট বলে।তবে যাই বলো তুমি আমাদের বাসায় ছিলে সে অনুযায়ী তোমাকে সেইফ রাখা আমাদের দায়িত্ব ছিল কিন্তু পারিনি।যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো তাহলে সিয়ামের কাছে ছোট হয়ে যেতাম নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারতাম না’।

আবারও দায়িত্বের বেড়াজাল।চোখ দুটো পানিতে ভিজে যাচ্ছে কিন্তু সেগুলো কে গড়িয়ে পরতে দিলো না সিরাত অতি সন্তর্পনে আড়াল করে নিলো।আবেশ কিছুক্ষণেই উধাও হয়ে গেলো।পেছনে আর তাঁকে দেখা গেলো না।কেন আজ মনটা এত বিষণ্ণ নিজেরই জানা নেই সিরাতের।ও তো জানে আবেশ ওকে নিয়ে তেমন কিছু ফিল করে না তাহলে কেন এত অভিমান।

শরীরটা আর ভালো লাগছে না।ছাদে বসে থাকতে আরো বোরিং লাগছে।একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন।তাই উঠে যেতে নিলেই একটা বড়সড় ধমক শুনতে পায় সিরাত…

-‘এই মেয়ে আর এক পাও ফেলবে না।এখানে স্থির হয়ে বসে থাকো’।আবেশের কথা শোনে থমকে গেলো।লোকটা হঠাৎ এভাবে সবার সামনে ধমকাধমকি করছে কেন?উনি কাছে এসে কিছু ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘এগুলো খেয়ে নাও।ভালো লাগবে।আগামীকাল বর যাএী যেতে হবে ত নাকি’।মাঝেমাঝে উনার ব্যবহারে সিরাত অবাক না হয়ে পারে না।একটু আগেও লোকটা কেমন করে কথা বললো আর এখন মুখে কি অমায়িক হাসি।না করতে যেয়েও করতে পারলো না। হাতে নিয়ে খেয়ে নিলো হয়তো পায়ের ব্যাথাটা কিছু কমবে তাঁর।

রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে সিরাত।পায়ের ব্যাথাটা ক্রমশ আরো বাড়ছে।হয়তো হাঁটাচলা করার ফল এটা।উপরে এখনও সবাই আছে।ও টায়ার্ড ফিল করছে বলে তাকে রেখে গেছে।হঠাৎ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে কেঁপে উঠলো সে।হয়তো ওর মা এসেছেন।কিন্তু না ওকে অবাক করে দিয়ে আবেশ রুমে ঢুকেছে।কিন্তু দরজা বন্ধ করলেন কেন উনি।ভেবেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর।বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠতে যেয়ে আহ্ বলে আবারও বসে পরলো সে।ওর আর্তনাদ শুনে দৌড়ে ওর কাছে এলো আবেশ।পায়ের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

-‘কেয়ারলেস মেয়ে একটা। এভাবে লাফ দেওয়ার মত কি হয়েছিল।এক জায়গায় স্থির থাকতে পারো না তাই না’।

-‘আপনি এখানে কেন?আর দরজাই বা বন্ধ করলেন কেন’?উনি কোনোকথা না বলে ধুমধাম পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন।সিরাত ক্যাবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে রইলো।পুরো রুম জুড়ে পাইচারী করতে শুরু করে দিল।ওর মাথায় এটা ঢুকছে না বাসায় এতগুলো ওয়াশরুম থাকতে ওর রুমে হঠাৎ ঢুকলো কেন?ও রুম থেকে বেরিয়ে বেলকোনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।হঠাৎ গালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো।পেছন ঘুরে তাকাতেই আবেশকে দেখে আরেকদফা চমকালো।এক গাল হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।নিজের গালে স্পর্শ করে হাতে নিয়ে দেখলো হলুদ।অবাক চোখে তাকালো আবেশের দিকে।আবেশ একটু এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘আমি চাই খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে হোক।যদিও আমি এসবে বিশ্বাস করিনা তবুও তোমাকে রাঙিয়ে দিলাম।এবার দ্রুত বিয়েটা হয়ে যাক’।

বলে চট করে দরজা খুলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন তিনি।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিরাত।এতক্ষণ ওর সাথে কি হলো যেন কিছুই বোধগম্য নয় তার কাছে।এই লোকটার মতিগতি বোঝার ক্ষমতা নেই ওর।কেমন রহস্যেঘেরা মানব।গালে স্পর্শ করে আনমনে হেসে উঠলো সিরাত।মাঝে মাঝে উনার ব্যবহারে কেমন সুখ সুখ অনুভূত হয়।এই সুখের চাদরে সারাজীবন নিজেকে জড়িয়ে রাখতে মন চায়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here