তুমি বললে আজ – পর্ব ২৭

0
601

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৭.

.
পিনপতন নীরবতায় হুটহাট গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে বাইরে থেকে। প্রায় মিনিট পাঁচেকর মতো সেভাবেই জড়িয়ে ধরে রেখেছেন তাসফি ভাইয়া। ওনাকে ওভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখেই আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। আর ই-মেইল দু’টো যে কিশের হতে পারে সেটাও বুঝতে পারছি কিছুটা।
সেভাবেই কিছু সময় থাকার পর আমি একটু নড়ে ওনাকে বললাম,

“ভার্সিটি থেকে ই-মেইল পাঠিয়েছে, তাই না?”

উনি সেভাবেই, কিছু সময় নিয়ে ‘হুম’ বললেন। চোখ কিছুটা ভিজে উঠেলেও ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো আমার। ওনার ইচ্ছে পূরণে যে এতটা ভালোলাগা কাজ করবে সেটা যেন ভাবতেই পারছি না। কাছের মানুষের সামান্য খুশিতেই তো নিজেরও খুশির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর আমি এখন জোর দিয়ে বলতে পারি, এই মানুষটা আমার অতি কাছের মানুষ। একান্ত ব্যাক্তিগত আমার মানুষ।
শব্দহীন ভাবে হেঁসে আস্তে করে বললাম,

“তো আমার নিউ স্যার, এমন গুরুগম্ভীর হয়ে না থেকে এবার তো একটু হাসেন।”

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না রুপু। আমি সত্যিই বিসিএস এ টিকে গেছি, সেই সাথে এত তাড়াতাড়ি জয়েনিং লেটার পাবো বিশ্বাস-ই হচ্ছে না।”

“বিশ্বাস হচ্ছে না কেন? আমি তো এটাই ভেবেছিলাম। আপনাকে যখন লেকচারার হিসেবে অফার করেছিলো তখন থেকেই হয়তো ওনারা আপনার জন্য অপেক্ষা করে ছিলো। আর আপনি তো আপনিই, নিজের জেদের কাছে কাউকে পরোয়া করেন না।”

“নিজের জেদ-টুকু ধরে না রাখলে তোকেও তো আমার করে পেতাম না।”

আমাকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন উনি। ওনার কথায় ভুরু কুঁচকে গেল আমার আপনা আপনি। সিরিয়াস মুহুর্তে এসব কথা এই বজ্জাত লোকটার দ্বারায় সম্ভব। কোথায় আমি ওনাকে শান্তনা দেবার চেষ্টা করছি আর উনি।
আমি কিছু বলতে নিলেই উনি বললেন,

“মাঝে মাঝে নিজের জেদ টাও সাফল্যের পথে নিয়ে যায়। তুইও কিন্তু আমার প্রতি নিজের জেদটা বজায় রেখে এই ভার্সিটিতে এডমিশন দিয়েছিস। একটু ভেবে দেখ, সেদিন আমার কথা তে প্রচন্ড রাগ হয়, জেদ হয় আর সেই জেদের রেশ ধরেই কিন্তু আর এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট তুই।”

একেবারে চুপ হয়ে গেলাম আমি। আসলেই তো, ওনার কথা পুরোটাই সত্যি। সেদিন ওনার বলা কথাগুলো আমাকে এমন ইফেক্ট করেছিলো যে ওনার এই নামকরা ভার্সিটিতে এডমিশন নেবার জন্য পাগল প্রায় হয়ে পরেছিলাম। দিন-রাত এক করে পড়েছিলাম। অন্য ভার্সিটি গুলোতে খারাপ পরীক্ষা দিয়ে এখানেই ভালো পরীক্ষা দেবার চেষ্টা করেছিলাম, শুধু মাত্র ওনার প্রতি নিজের ধরে রাখা জেদের কারণে। আর সেই ধরে রাখা জেদের কারণেই আজ আমি ওনার ভার্সিটিকে আমার ভার্সিটি বলতে পারি। আসলেই এ- দিকটা ভেবে দেখি নি আমি। উনি আবারও বলে উঠলেন,

“আমাদের ভার্সিটির লেকচারার হবার স্বপ্নটা যেমন ছিলো, বিসিএস ক্যাডার হবার ইচ্ছেটাও তেমনি ছিলো। ভেবেছিলাম ভার্সিটিতে জয়েন হবার পর সময় নিয়ে বিসিএস এর পিপারেশন নিবে কিন্তু ভাগ্য আর জেদের কাছে এই দু’বছর স্বপ্নটাকে ধামাচাপা দিতে হলো। জানিস এই জেদটা আমার কিভাবে তৈরি হলো? দেড় বছর আগে রিটায়ার্ড হওয়া প্রফেসর আফজাল স্যারের জন্য।”

ওনার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে শেষের কথায় অবাক হলাম কিছুটা। আমি তো জানতাম উনি ইচ্ছে করেই এমন জেদ ধরে রেখেছেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে উনি আবারও বলতে শুরু করলেন,

“প্রফেসর আফজাল স্যার নরম মনের মানুষ হলেও ভার্সিটির সবাই রাগী আর একঘেয়ে বলেই জানতো। পুরো ভার্সিটি একটা চালানোর মতো ক্ষমতা রাখতেন উনি, এতটাই ভয় পেত সবাই স্যার কে। সেই সবার সাথে আমিও ছিলাম। আমিও অনেক ভয় পেতাম, মনে হতো এই বুঝি একটু ভুলের জন্য বকা খেতে হবে। কিন্তু ক্লাসের সবাই বকা খেলেও আমি বাদ ছিলাম। পড়াশোনা রুলস মেইনটেইন করা সবকিছু পারফেক্ট ভাবে করার চেষ্টা করতাম। সেজন্যই হঠাৎ স্যারের নজরেও পরে গেলাম। স্যার মাঝে মাঝে আমাকে আলাদা ভাবে ট্রিট করতো সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু হঠাৎ তোকে নিয়ে দাদুর কথাগুলো আমার উপর ইফেক্ট করে, এলোমেলো হয়ে পড়ি একেবারে। সেই সাথে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হাড়িয়ে ফেলি কিছুটা। তাতে ফাস্ট সেমিস্টারের রেজাল্ট টা খারাপ হলো। স্যার হয়তো আমার রেজাল্ট খারাপ হওয়া’টা মেনে নিতে পারেন নি। আলাদা ভাবে ডেকে পাঠান আমায়, অনেক কথা শুনিয়ে দেয়। এটাও বলেন লেকচারার হিসেবে জয়েন করতে পারবো না। কিন্তু সেদিন স্যারের একটা কথা আমার মাথায় গেথে গিয়েছিল, আমি নাকি স্যারদের ভালোবাসা আর ভালো সম্পর্কের জোরেই টিচার হবে, নিজের যোগ্যতা দিয়ে নয়। সেদিনই নিজের জেদটা ধরে নিয়েছিলাম। ভার্সিটিতে পরীক্ষা তে টেকার পর ভাইভা তে ডাকা হয়। সেদিন ইচ্ছে করেই গেছিলাম ভাইভা দিতে, কারণ আমি জানতাম আফজাল স্যারও থাকবেন ওখানে। ভাইভার পর যখন আমাকে জয়েনিং লেটার দিতে চাইলো, তখন সেটা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলাম, নিজের যোগ্যতায় বিসিএস ক্যাডার হয়ে তবেই এই ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করবো তাছাড়া নয়। সেদিন আফজাল স্যারের চোখে প্রথমবার বিষ্ময় দেখেছিলাম, উনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আমার কথা। তারপর স্যার আমায় অনেক বার জয়েন হতে বলেছিলেন কিন্তু আমি জেদটা কে-ই প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি। স্যারের প্রতি আমার রাগ ছিলো না কখনো বরং ওনার সন্নিকটে গিয়ে গর্ভ হয়। আজকেও স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই ফিরতে দেরি হলো।”

হাজারো বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি যে নিজের মাঝে এতকিছু চেপে রেখেছিলেন সেটা আমি কেন বাসার কেউ-ই জানতো না। বাসা থেকে জবের কথা বললেও এটা সেটা বলে কাটিয়ে দিতেন, বলতেন বিসিএস -এর পর দেখা যাবে। ওনার কথাগুলো পিছনে যে এতকিছু লুকিয়ে ছিলো সেটা শুনেই আমি বিস্মিত হয়ে গেছি। আমার জন্য ওনাকে এতকিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে ভেবেই খারাপ লাগলো। মন খারাপ করে আস্তে করে বললাম,

“আমার জন্যই আপনাকে এতকিছু সহ্য করতে হয়েছে, তাই না? অযথা আমাকে নিয়ে উল্টা পাল্টা কেন ভাবতেন আপনি?”

“নিজের জিনিস নিয়ে নিজে ভাববো না? সেটাই বলতে চাচ্ছিস তো?”

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কথাটা বললেন উনি। আমি সাথে সাথেই বলে উঠলাম,

“মানে?”

“মানেটা হলো, তুমি আমার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। সেই ব্যাক্তিগত সম্পত্তি-টা নিয়ে শুধুমাত্র আমার-ই ভাবার অধিকার আছে।”

হুট করে কাছে এসে এভাবে কথাটা বলায় কেঁপে উঠলাম আমি। টিপটিপ শব্দ করে উঠলো বুকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

“ক্..কি বলছেন এ..এগুলো আ…”

“এমন কি বললাম? আমি তো শুধু তো….”

হঠাৎ করে তাসফির মোবাইল বেজে ওঠায় চুপ হয়ে গেলেন। বিছানা থেকে মোবাইল নিয়ে রিসিভ করে কথা বলতে লাগলেন। যতদূর বুঝতে পারলাম ভার্সিটি থেকে ফোন দিয়েছে, কালকে একবার যেতে বলেছে ওনাকে। কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললেন,

“তো কোথায় ছিলাম আমার?”

এবার কথা ঘোরানোর জন্য কিছুটা রেগে বললাম,

“কোথাও ছিলোন না, বাসায় যে ফোন দিতে হবে সেটাও কি ভুলে গেছেন? সব কথা আমাকেই কেন মনে করিয়ে দিতে হবে?”

উনি সাথে সাথে অস্পষ্ট সুরে ‘ও শিট’ বলে, বলে উঠলেন,

“আমি তো ভুলেই গেছিলাম। এই না হলে আমার বউ? এভাবেই আমাকে, আমার অভ্যাস গুলোকে মনে রাখবি সারাজীবন।”

কথাটা বলেই উনি আমার গালে গভীর ভাবে ওনার ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আমি আহাম্মকের মতো হা করে বসে রইলাম। কি হলো সেটা বুঝতেই আমার কিছু সময় লেগে গেল যেন। সিরিয়াস মোমেন্টে এগুলো ওনার দ্বারা কিভাবে সম্ভব হয়, হাউ?
আমার রিয়াকশন কে পাত্তা না দিয়ে এতক্ষণে বাসায় কল দিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। ফুপার সাথে কথা বলে জানালেন ওনার রেজাল্ট এবং ভার্সিটিতে জবের কথাটা। এরপর ফুপির সাথেও কিছুক্ষণ কথা বললেন। ফুপি বাসায় যাবার কথা বলতেই উনি জানালেন কিছুদিন পর যাবেন। সামনের মাস থেকে ওনার ভার্সিটিতে জয়েনিং সাথে আমার ক্লাস চলছে পুরো দমে। একমাস পর লম্বা ছুটি পড়বে তখনই বাসায় যাবে বলে জানালেন। ফুপির সাথে কথা বলা শেষ করে আমাদের বাসায় ফোন দিলেন। আব্বু আম্মু , বড়মা বড় চাচার সাথে কথা বললেন। বাসায় যাবার কথা বললে তাদেরও একই কথা বললেন। একে একে সবার সাথে কথা বলা শেষ করে রিফাপুর সাথে কথা বললেন। ওনার কথা শুনে যতটুকু বুঝতে পারলাম রিফাপু হয়তো ট্রিট চাইছে ওনার থেকে। উনি না না করে এক সময় বলে উঠলেন ‘আচ্ছা ঠিক আছে দিবো, আগে বাসায় যাই তারপর অনেক বড় করে ট্রিট দিবো তোদের।’ এরপর ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, আমিও রিফাপুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিলাম।

.
রাতের প্রায় এগারোটা বাজে। ঘুম কে ছুটি দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে কাজিন দলের গ্রুপ চ্যাটে মেতে উঠেছি। পাশেই মি. বজ্জাত তাসফি ল্যাপটপে কিছু একটা করে চলছে।
হঠাৎ করে ফোনে কলের শব্দে চমকে গেলাম। হাতে থাকা মোবাইলটা যেন ঘর কাঁপিয়ে তুলেছে। ভয়ের কারণে বুকে থু-থু করে, তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। কোলে ল্যাপটপ নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বিরক্তি চোখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এত রাতে হঠাৎ কে ফোন দিয়েছে এটাই ভাবছেন হয়তো উনি। আমি থতমত খেয়ে ওনার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে ওনাকে দেখিয়ে বললাম,

“গ্রুপে কল দিয়েছে পুরো শয়তানের দল, আপনাকে নিয়েই কথা হচ্ছিলো এতক্ষণ। আমি ধরতে পারবো না, আপনি-ই কথা বলেন।”

“আমাকে নিয়ে তোদের এত কথা কিশোর বলতো? সারাদিন এটা ওটা নিয়ে বিরক্ত করা শুরু করে থাকে, এখন নিশ্চিত সবাই ট্টিট চাই, ট্টিট চাই বলে মাথা খাবে।”

বলেই আমার মোবাইল নিতে চাইলে আমি সরিয়ে ফেললাম সাথে সাথে। বললাম,

“আমার টায় না। পরে ওরা কি না কি ভাববে তার ঠিক নাই। এমনিতেই তো সবাই আমাকে ছোট পেয়ে খোঁচাতে থাকে সারাক্ষণ। হু!”

“বিয়ে হয়েছে, দু’দিন পর বাচ্চা-কাচ্চা দিয়ে সংসার ভরিয়ে ফেলবি, আর বলিস কি না ছোট আছিস? ধরতে গেলে ওদের চেয়ে তুই-ই বড়।”

চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল আমার। সবসময় এমন কথাবার্তা না বললেই কি নয়? রেগে উঠে হালকা চিৎকার করে বললাম,

“সারাদিন এসব কথা না বললেই কি নয় আপনার? অসভ্য বজ্জাত ছেলে একটা।”

রাগে কটমট চোখে তাকালে উনি বেশ শব্দ করে হেঁসে উঠলেন। তারপর ল্যাপটপে আইডি ওপেন করে ভিডিও কলে যেতেই ওনাকে দেখে একপ্রকার চিৎকার করে উঠলো সবাই। এটা-সেটা বলেই ট্রিট দেবার কথা বলে হামলে পরলো সবাই। কিছুদিন পর সিজনের ছুটি পড়লে গ্রামের বাড়ি গিয়ে বড় করে ট্টিট দিবেন বলে জানালেন সবাইকে। সবাই এবারও হো হো করে উঠলো ওনার কথায়। তারপর শুরু হয়ে গেল আমার কাজিন দলের আড্ডাটা।

.
.
(চলবে….)

তাসফির বিসিএস পরীক্ষার সাথে ভার্সিটির টিচার হবার কি সম্পর্ক, এটা অনেকই বলেছিলো। আশা করি এই পর্বে ক্লিয়ার হয়েছে সবার কাছে। গল্পটা এভাবেই ভেবে রেখেছিলাম। একটা নির্ভেজাল প্রেম কাহিনি। আর যেভাবে ভেবেছি সেভাবেই শেষ করবো ইনশাআল্লাহ। শেষটায় হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে😐 শেষের পথেই চলে এসেছে গল্পটা। আজকের পর্বটার শেষ যেখানে করতে চেয়েছিলাম সেখানে শেষ করতে পারি নি সময়ের অভাবে। যাই হোক, কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু সবাই। আমার গ্রুপে আপনাদের অনুভূতি গুলো জানানোর চেষ্টা করবেন, এতে আমার লেখার আগ্রহটা আরও বেড়ে যাবে🙂 গ্রুপ লিংক কমেন্টে দেওয়া হলো, যারা জয়েন নেই তারও হয়ে যাবেন। আপনাদের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করবেন। ভালোবাসা সবাইকে।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here